অনুন্নয়ন সংক্রান্ত তন্তু(The underdevelopment related theory)
অনুন্নয়নের বিষয়াটি দীর্ঘকাল ধরেই বিভিন্ন দেশের বৃদ্ধিজীবি মহলে প্রায় উপেক্ষিতই ছিল। তবে, অনুন্নয়ন প্রসঙ্গে যে কয়েকটি তত্ত্ব লক্ষ্য করা যায় তার সব কটিই প্রায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীন্নাজ গড়ে ওঠে। প্রথম দিকে, এই ধরনের তত্ত্বগুলি লাতিন আমেরিকার বৃদ্ধিজীবী মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে আফ্রিকা ও এশিয়ার বুদ্ধিজীবী মহলেও অনুন্নয়নের তত্ত্বগুলি খুবই প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রেমন্ড ডুমাল (Raymond Duvall) অনুন্নয়ন সম্পর্কে তিনটি বিশেষ ধারার কথা উল্লেখ করেছিলেন। যেমন-
• প্রথম ধারাটিকে তিনি সমগ্রবাদী (holistic) দৃষ্টিভঙ্গী হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যেখানে তৃতীয় বিশ্বের ধনতান্ত্রিক কাঠামোর সমাজব্যবস্থায় বিকাশের সাথে সাথে কিভাবে কেন্দ্রীভূত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিগমবন্ধ (incorporated) হয়েছে এবং পরিণতিস্বরূপBe-8.4: রেমন্ড ভূভাল সংশ্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সমাজব্যবস্থার বিকৃত (distorted) রূপ অনুন্নয়ন প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উঠে এসেছে। তাঁর মতে, তৃতীয় বিশ্বে উন্নয়নের ধারায়, সেখানকার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধার বেশিরভাগটাই বন্টিত হয়েছে গুটিকয়েক বাছাই করা জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে। ফলে, এখানে একদিকে যেমন উন্নয়নের পরিসরটি সীমিতভাবে করায়ত্ত হয়েছে কিছু সংখ্যক ধনীদের হাতে; আর বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সর্বদা বঞ্চনার দ্বারপ্রান্তে রয়ে গেছে।
• ভুভালের দ্বিতীয় ধারাটি প্রত্যক্ষবাদী (empiricist) দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেটি সত্তরের দশকে উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পরিসংখ্যানগত তথ্যগুলিকে নির্দিষ্ট পরিমিতিভিত্তিক গবেষণা করে পিছিয়ে পড়া দেশগুলির অনুন্নয়নের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষিত হয়েছে।
• সবশেষে ডুভালের তৃতীয় ধারাটিকে সক্ষমতার (power) দৃষ্টিভঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত যেখানে উন্নত দেশগুলির উপর অনুন্নত কিছু দেশের পরনির্ভরশীলতার বিষয়টি স্পষ্টত উঠে এসেছে।
এখানে অনুন্নয়ন প্রসঙ্গেঙ্গ নির্ভরশীলতার তত্ত্বটিকে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।।
■ অনুন্নয়নের নির্ভরশীলতা তত্ত্ব (Dependency theory on Under Development):
অনুন্নয়ন কেন, কীভাবে এবং কোন পরিস্থিতিতে শুরু হয়। অনুন্নয়ন দ্বারা কিভাবেই বা উন্নয়ন অর্জিত হতে পারে। সেই বিষয়ক কয়েকটি চিরন্তন প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের ফলশ্রুতিতে যে তত্ত্বটির জন্ম হয়েছে সেটি হল নির্ভরশীল তত্ত্ব (Dependency theory)। এটি আসলে এমন একটি তত্ত্ব, যা পিছিয়ে পড়া দেশগুলির অনুন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু উন্নত দেশগুলির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আরোপিত কৌশলগত সত্ত্বাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়কালে বিভিন্ন কাঠামোবাদী ও নব্য মার্কসবাদী ল্যাটিন চিন্তাবিদ প্রচলিত আধুনিকীকরণ তত্ত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নির্ভরশীল তত্ত্বের বিকাশ ঘটিয়েছিলেন। বিশেষ করে, 1950-এর দশকের শেষের দিকে আর্জেন্টিনার অর্থনীতিবিদ এবং রাষ্ট্রনায়ক রাউল প্রিবিশের দ্বারা এই ধারণাটি প্রথম প্রস্তাবিত হলেও, 1970-1980- এর দশকে ফার্নান্দো তারদোসা ও এনজো ফেলেটোর প্রমুখ অনুন্নয়ন প্রসঙ্গে তাঁদের নিজস্ব মতামতকে নির্ভরশীল হয়ে।
fames Caporaso-র মতে, নির্ভরতার প্রসঙ্গটিকে তিনটি ধারণায় ব্যস্ত করা যায়, (1) নির্ভরশীলতা এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা যার ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র পাওয়া যায় ধনতন্ত্রের উদ্ভব এবং তৎসঙ্গো সৃষ্ট আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাজনের মধ্যে। (ii) স্থানীয় ও বিদেশী মূলধনের বন্টনকে ঘিরে গড়ে ওঠা অতিরাষ্ট্রিক সম্পর্ক, সেইসাথে উন্নয়নের ধারাকে পছন্দমতো নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা নির্ভরশীলতা বাড়ায়, (iii) পশ্চাদগামী দেশগুলির আর্থসামাজিক প্রতিবন্ধকতা অনেকক্ষেত্রে জাতীয় অর্থনীতির বিকৃতি ঘটিয়ে নির্ভরশীলতার পথকে আরো সুগম করে।
মূল বক্তব্য (The main point)
নির্ভরশীলতা তত্ত্ব হল সমাজবিজ্ঞানের এমন একটি ধারণা যেখানে, সাম্রাজ্যবাদ কাঠামোয় কেন্দ্রীয় উন্নত দেশগুলির সপেক্ষে প্রান্তবর্তী অনুন্নত দেশগুলির বিভিন্ন প্রতিকূল পরিস্থিতিকে ইঙ্গিতপূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে। আসাদে নির্ভরশীলতা হচ্ছে দুটি ভিন্ন দেশের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি অসম অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এখানে, সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কাঠামোর দেশগুলি হল উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র, যাদের পুঁজিবাদের ধারক ও বাহক বলা হয়। অন্যদিকে, প্রান্তিক দেশগুলি অনেক সময় বিপুল সম্পদের মূল আধার হয়েও অনগ্রসর বা অনুন্নত অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। এই তত্ত্বের সমর্থকরা মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুন্নয়নের কারণ অভ্যন্তরীণ নয় বরং বাহ্যিক। কারণ, উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক শোষণ, শ্রম পাচার, পুঁজিবাদী কাঠামোয় অনগ্রসর দেশগুলো চিরকালই নির্ভরশীল থেকে অনুন্নয়নের প্রেক্ষাপট গড়ে ভোলে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক চাহিদা ও রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য এই রামিত অবস্থাকে কখনোই অতিক্রম করতে পারে না। এই দেশগুলিকে যদি উন্নতি করতেই হয়, তাহলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর উপর বাহ্যিক নির্ভরশীলতা যথেষ্ট কমাতে হবে।
1790 খ্রিস্টাব্দে Amarionn Economic Revueu-তে ব্রাজিলের বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী Thentomo Dos Santos-এর লেখা The Structure of Dependence নামক প্রবন্ধে নির্ভরশীলতার ধারণা সম্পর্কে বলেছেন,
"a situation in which the economy of certain countries is conditioned by the development and expansion of another economy to which the former is subjected. The relation of inter dependence between two or more economics, and between these and world trade, assumes the form of depndence when some countries (the dominant ones) can do this only as a reflection of the expansion, which can have either a positive or a negative effect on their mediate development তবে, নির্ভরশীলতার তত্ত্বটি যে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদেরই চরম আরেকটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, একথা প্রায় সমস্ত তাত্ত্বিকেরাই বর্তমানে স্বীকার করে নিয়েছেন।
■নির্ভরশীলতা তত্ত্বের বিশেষত্ব (Speciality of Dependency Theory)
নির্ভরশীলতা তত্ত্বে বিশ্বাসী চিন্তাবিদেরা বেশ কয়েকটি মৌলিক বিষয়কে স্বীকৃতি দিয়েছেন, যেগুলি হল-
• সাধারণ প্রক্রিয়া (Normal Process) নির্ভরশীলতাকে একটি সাধারণ প্রক্রিয়ারূপে মানা হয়,
• পুঁজিবাদী চিন্তাধারা (Capitalist thought) এই তত্ত্বে ষোড়শ শতক থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত পুঁজিবাদের ইতিহাস ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি পুঁজিবাদভিত্তিক নির্ভরশীলতার ধরনগুলিকেও অনুসন্ধান করা হয়েছে।
• বাহিকে বিষায় (External matter) নির্ভরশীলতা এমন একটি বাহ্যিক আরোপিত বিষয়, যেটিকে বাইরে থেকে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
• অসম প্রকৃতি(Uneven nature)
পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে অনুন্নয়ন কোনও অভ্যন্তরীণ সীমাবদ্ধতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসম অর্থনৈতিক সম্পর্কের বহিঃপ্রকাশ।
আঞ্চলিক মেরুকরণ (Regional Polarization) নির্ভরশীলতাকে বিশ্ব অর্থনীতির আঞ্চলিক
• মেরুকরণ হিসেবেও দেখা হয়ে থাকে, যেখানে পুঁজিবাদী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বৃত্তকে ক্রমাগত শোষণ বা পাচার করে থাকে। এর প্রভাবেই, মূলত কেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী দেশগুলোতে উন্নয়ন এবং প্রান্তের দেশগুলোতে অনুন্নয়ন ঘটতে দেখা যায়।
• উন্নয়নের অসংগতি (Developmental inconsistency) নির্ভরশীলতা তত্ত্বে উন্নয়নকে প্রায়শই অসংগতিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। কারণ, এই ধারণা মতে অনগ্রসর প্রান্তের দেশগুলি সর্বদা উন্নয়নমুখী প্রদীপের তলাতে অন্ধকারেই রয়ে যায়। কোথাও কোথাও এই সমস্ত প্রান্তিক দেশগুলিতে বিচ্ছিন্নভাবে উন্নয়ন সাধিত হলেও, সেটিকে অসঙ্গত উন্নয়নরূপে গণ্য করাই শ্রেয় ।
বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভশ্রীতে নির্ভরশীলতা তত্ত্ব (Dependency theory in experts perspectiv
• অনুমান সম্পর্কে রাউল প্রিবিশের ধারণা (Raul Pribisch's idea about underdevelopment)
ভালেন্টিনার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ রাউল প্রিবিশ (1901-1986 খ্রিঃ) কাঠামোগত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে প্রবন দিয়ে অনুন্নয়ন সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যস্ত করেছিলেন। বস্তুত, ECLA বা CEPAL-এর কার্যনির্বাতী পরিচালকবৃসে প্রিবেশ 1950 খ্রিস্টাব্দে লাতিন আমেরিকার অর্থনৈতিক অনুন্নয়নের প্রধান সমস্যাগুলি সম্পর্কে তাঁর তত্ত্বটিকে গারোজনার আকারে প্রকাশ করেছিলেন।
রাউল প্রিবিশ নির্ভরশীলতা তত্ত্বে এমন একটি প্রসঙ্গা উপস্থাপন করেছেন, যার একদিকে রয়েছে একটি প্রভাবশা পুঁজিবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা (প্রথম শ্রেণির ধনী দেশগুলি দ্বারা পরিচালিত) এবং অনাদ্যিকে প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে হয়েছে কায়িক শ্রমের উপর নির্ভরশীল বিশ্বের অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলি। তিনি মনে করেন, এই ধরনের কিছু প্রান্তিক দেশে যেখানে মানুষের মাথাপিছু আয় যথেষ্ট নিম্নগামী, তাদের ওপর প্রভাবশালী উন্নত দেশগুলি সর্বব আধিপত্য বজায় রেখে চলে। এইভাবে, পিছিয়ে পড়া সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে তীব্র বর্ণনার বৈষম্যের পথ ধরে তাদের নির্ভরশীলতার বিষয়টি যথেষ্ট প্রকট হয়ে ওঠে।
প্রিবিশ তাঁর নির্ভরতা তত্ত্বে একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকেন্দ্রিক পরিসরে দিনিয়োগ নির্ভরতার বিষয়টি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মূল শিল্পের জাতীয়করণের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রের ভূমিকাকেও অত্যন্ত যুপ্তি সহকারে তুলে ধরেছেন। এখানে তিনি বাণিজ্যের প্রকৃত অনুশীলন, বাণিজ্য সংগঠন এবং বাণিজ্যিক চুপ্তি কাঠামো থেকে অর্থনীতির তাত্ত্বিক দিকগুলিকে সম্পূর্ণ আসাদ করে দেখিয়েছেন। নির্ভরশীলতা তত্ত্ব অনুসারে, অনুন্নয়ন প্রসঙ্গটি প্রধানত বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির প্রান্তিক অবস্থানের কারণে ঘটে থাকে। সাধারণত, অনুন্নত দেশগুলি বিশ্ব বাজারে সস্তা শ্রম এবং কাঁচামাল সরবরাহ করতে গিয়ে, তাদের অর্থনীতির যাবতীয় সত্তা উন্নত দেশগুলির ওপর অর্পণ করে দেয়। এই ধরনের কৌশলী বাণিজ্যের ঘেরাটোপে অনুন্নত দেশগুলি উচ্চমূল্যে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে পণ্য ক্রয় করতে গিয়ে নিজেদের সঞ্চিত পুঁজির পরিমাণকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে ফেলে। এর অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ অনুন্নয়নের একটি দুষ্টচক্র বিশ্বের কেন্দ্র-পরিধিস্থ দেশগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক বিভাজনকে ক্রমেই স্থায়ী করে তোলে। প্রিবিশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ধীর এবং অসম প্রসারণকে দেশগুলির মধ্যে উন্নয়নের মাত্রার পার্থক্য ঘটানোর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, প্রযুক্তির অসম আন্দোলন দুটি মেরু অর্থাৎ কেন্দ্র এবং পরিধির জন্ম দেয়, যা সময়ের সাথে সাথে পারস্পরিক অন্তঃসত্ত্বা বজায় রেখে চলে।
প্রসঙ্গাত উল্লেখ্য, প্রিবিশ তাঁর তত্ত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো শিল্পোন্নত দেশগুলিকে কেন্দ্র এবং আর্জেন্টিনার মতো। দেশগুলিকে প্রান্তিক অঞ্চলরূপে উপস্থাপিত করেছেন।
• অনুন্নয়ন সম্পর্কে পল ব্যারেনের ধারণা (Paul Baran's idea about underdevelopment)
1950-এর দশকে বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক পল ব্যারেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে হাতিয়ার করে এবং পুঁজিবাদী উন্নয়নের ভাবনার বিরুদ্ধে প্রথম চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নির্ভরশীল দেশগুলোর অনুন্নয়নের কারণ অনুসন্ধানে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
তাঁর মতে, বর্তমানের উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি কোনও একসময় তাদের উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে যথেষ্ট শোষণ করেছে। ফলস্বরূপ, সংশ্লিষ্ট সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোতে বিপুল পরিমাণ পুঁজির কেন্দ্রীকরণ ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশীল দেশগুলি নিজেদের আর্থিক অভিলিঙ্গাকে নিশ্চিত করতে পুরাতন ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভেঙ্গে দিয়ে অনুন্নত দেশগুলিতে এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, যেগুলো পরোক্ষভাবে আবার সাম্রাজ্যবাদী শোষণকে অনিবার্যভাবেই শাসকযন্ত্রে উপনীত করেছে।
বিষয়টিকে আরও স্পষ্টভাবে বোঝাতে ব্যারেন ভারতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, ভারতকে যদি প্রটিশরা শোষণ না করাত এবং দেশটিকে যদি স্বাধীনভাবে নিজস্ব ভাগ্য নির্ধারণ করার সুযোগ দেওয়া হত, তাহলে আজকের ভারত আরও অনেক উন্নত হতে পারত। অন্যদিকে উপনিবেশিক শোষণের অনুপস্থিতি কীভাবে উন্নয়ন সম্ভাবনাকে বিকাশিত করে, সেটি বোঝাতে তিনি আবার জাপানের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বলেন, জাপানের অর্থনৈতিক প্রাঙ্গদ্যের মূল কারণ হল সেখানকার উপনিবেশিক শাসনমুক্ত অবাধ রাজনৈতিক স্বাধীনতাক ঠিক সেই কারণেই, ব্যারেন পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকে অনুন্নয়ন থেকে উত্তরণের জন্য সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের তাৎপর্যকে যথেষ্ট মান্যতা দিয়েছেন।
• অনুন্নয়ন সম্পর্কে এ. জি. ফ্রাঙ্ক-এর ধারণা (A. G. Frank's idea about underdevelopment):
স্নাঙ্গকে বলা হয় নির্ভরশীলতা তত্ত্বের অন্যতম আরেকজন পথিকৃৎ। ফ্রাঙ্ক কিছুটা দল ব্যারনের চিন্তাধারার অনুসারী হলেও, তাঁর "Fundamental of Marxism and" গ্রন্থে আমেরিকার পটভূমিতে নির্ভরশীলতার তত্ত্বটিকে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে নব্য মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর বিশেষ সাহায্য নিয়েছেন।
তত্ত্বের প্রথমেই ফ্রাঙ্ক বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা পুঁজিবাদের তীব্র সমালোচনা করে তিনটি প্রধান স্ববিরোধিতার কথা। স্কুলে ধরেন, যেমন-
(a) কিছু কিছু দেশের কাছ থেকে কতিপয় রাষ্ট্রের উদ্বৃত্ত শোষণ ও অর্থ আত্মসাৎ করার প্রচেষ্টা।
(B) মেট্রোপলিটন কেন্দ্র ও প্রান্তিক উপ-অন্যলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মেরুকরণ প্রথা।
(c) মৌলিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কাঠামোগত ধারাবাহিকতা।
ফ্রাঙ্ক মনে করেন, এই বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি ইন্টারলকিং চেইন হিসাবে গড়ে উঠেছে, যার এক প্রান্তে রয়েছে ধনী 'মেট্রোপলিস' কেন্দ্রীয় এলাকা (Cores)-ভিত্তিক 'উন্নত জাতি' (যেমন-ইউরোপীয় জাতি) এবং অন্য প্রান্তে 'পরিবলয় (Periphery)' গুলিতে রয়েছে অনুন্নত জাতি (যেমন-লাতিন আমেরিকার জনগোষ্ঠী)। এখানে উন্নত কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রগুলি তাদের উচ্চতর অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তির কারণে প্রান্তিক অঞ্চলের জাতিগুলিকে সর্বদা শোষণ করতে সক্ষম।
ফ্রাঙ্কের নির্ভরশীলতার দৃষ্টিকোণ থেকে 1500 থেকে 1960 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিশ্ব ইতিহাসিক প্রেক্ষাপটের পুঁজিবাদী চেহারাটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। এই সময়কালে বিশ্বের ধনী ইউরোপীয় দেশগুলি উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের মাধ্যমে যে পরিমান মুনাফা সঞ্চয় করেছিল, সেগুলি তাদের শিল্পায়ন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের মসৃণ পথ তৈরি করে দেয়। এর ফলেই তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো ক্রমশ আর্থসামাজিক সমস্ত দিক থেকে প্রায় একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
প্রসঙ্গে ফ্রাঙ্ক আরো একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছিলেন। তার মতে, উন্নত দেশগুলি আসলে দরিদ্র দেশগুলির উন্নয়নকে ভয় পায়, কারণ প্রান্তিক তথা অনুন্নত দেশগুলির উন্নয়ন পশ্চিমের উন্নত দেশগুলির আধিপত্য ও সমৃদ্ধির জন্য হুমকিস্বরূপ।
■নির্ভরশীলতার তত্ত্বের সমালোচনা (Criticism of the theory Dependence)
নির্ভরশীলতার তত্ত্বটি আবার বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-
• কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণা নিয়ে বিতর্ক (Debate over center and edge concepts): নির্ভরশীলতার তত্ত্বে উন্নত কেন্দ্র এবং প্রান্তবর্তী উন্নয়নশীল অঞ্চলের মধ্যে যে পার্থক্য করা হয়, তাদের মধ্যে স্বাধীনতা ও নির্ভরশীলতার পরিমাণগত মানদণ্ড নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছের বেতির অব সারিক সম্পর্কের নিধিদে পৃথিবীর প্রায় সকল উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশই পরস্পরের উপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল।
• পরিলিক কেন্দ্রীভূত ভর (Regional centralized theory) কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন। আঞ্চলিকতার উত্তটি কেবলমাত্র ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলির ক্ষেত্রে যতটা প্রয়োগযোগ্য, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর ক্ষেত্রে সেভাবে প্রযোজ্য নয়।
পুঁজিবাদ ও উদ্বৃত্তের বিপক্ষে ধারণা (Ideas against capitalism and surplus) অমিয়ো পুঁজিবাদী দেশগুলি প্রান্তবর্তী অনুন্নত দেশগুলি থেকে যে পরিমাণে উদ্বৃত্ত নিজেদের দেশে পাচার করেছে, তার পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকেও কোনও না কোনওভাবে সহায়তা করেছে।। প্রসতো Goldthrop (1975 খ্রিঃ) বলেছেন, শুধুমাত্র নির্ভরশীলতার জনাই উপনিবেশ প্রভাবির দেশগুলিতে ভালো পরিবহণ এবং যোগাযোগ।
তত্ত্বের প্রসলিকা (Relevance of the theory):
নির্ভরশীলতা তত্ত্বের একাধিক সমালোচনা থাকলেও, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির অনুন্নয়ন বা পিছিয়ে পড়ার প্রসঙ্গটিকে এখান থেকে খুব ভালোভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। ব্রাজিলের বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী থিওটোনিও ১০ সান্তোসের বলেছেন-নির্ভরতা হল এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে অনুন্নত দেশগুলি বেশ কিছু পূর্বশর্তের ভিত্তিতে অন্যান্য বিকশিত দেশগুলির অধীনস্থ হয়ে পড়ে। অনেকক্ষেত্রে, দীর্ঘকালীন নির্ভরশীলতার পরিসরে ধনী জাতিগুলির সম্পদ বৃদ্ধি পরোক্ষভাবে অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়। এর ফলে সংশ্লিষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলির আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে দেখা যায়।
নির্ভরশীলতা তত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, অনুন্নয়ন কেবল বিকাশের ব্যর্থতা নয়; এটি ঔপনিবেশিকদের ছারা শুরু করা এমন একটি প্রক্রিয়া, যা অনাদিকাল ধরেই বিশ্বের একাধিক দেশগুলির দারিদ্র্যকে সক্রিয়ভাবে টিকিয়ে রেখেছে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, তৃতীয় বিশ্বের গ্রীষ্মণ্ডলীয় অঞ্চলগুলি থেকে খাদ্য ও পণ্য আমদানির (বিশেষত-চিনি কোকো, তামাক, গম, তুলা, মাংস, মাছ, পাট, কফি, নারকেল, রাবার, উল, পাম তেল, চাল, কলা, চীনাবাদাম, নীল টিন, সোনা, রৌপ্য প্রভৃতি) যে অভিমুখ সাম্রাজ্যবাদী শিল্পোন্নত দেশগুলির দিকে ছিল, তারই নিদারুণ প্রভাবে ব্রাজিল আর্জেন্টিনা, চিলি, ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলিকে আজও ভুগতে হয়। কারণ, এই সমস্ত দেশগুলির বহু মানুষ এখনো প্রথাগতভাবে দারিদ্রের ভার পুরুষানুক্রমে বহন করে আসছে। আজকের দিনেও, আমেরিকা, চিন, জাপান প্রভৃতির মতো বেশকিছু ধনী দেশ সমৃদ্ধির উচ্চ পর্যায়ে থেকে তৃতীয় সাদের দেশগুলিতে আন্তর্জাতিক পুঁজি বিকাশের পথে বিভিন্নভাবে বাধাপ্রদান করে, তাদের মাথা তুলে দাঁড়ানোর ধমতাকেই কেড়ে নিচ্ছে। এই কারণে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Monthly Review Group-এর আহলে পাঁড়ানোর ব্যারন বলেছেন, ধনতন্ত্রের উত্তরণ সফলভাবে ঘটলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সামন্তবাদ ও ধনতন্ত্রে আজও প্রায় একইভাবে বিরাজ করছে।
অবশ্য কোনও কোনও বিশেষজ্ঞের মতে, নির্ভরশীল ব্যবস্থার মধ্যে থেকেও কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। বিশেষ করে, আজে গুন্ডার ফাদক এ প্রসঙ্গে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন, নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র উপায় বিশেষ এ-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক অবস্থার সৃষ্টি করা।
আসলে, উন্নয়ন ও অনুন্নয়নের মধ্যে চিরকালীন একটি দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক রয়েছে। বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট উপলব্ধির জন্য তুলনামূলকভাবে আলোচনা করা হলো।