welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ভারতের বৈচিত্যের মধ্যে ঐক্যের প্রাসজ্ঞিাকতা(The relevance of unity in India's diversity)

ভারতের বৈচিত্যের মধ্যে ঐক্যের প্রাসজ্ঞিাকতা (The relevance of unity in India's diversity)


"বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐকা” শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হল দেশে ভৌগোলিক উপাদানের বিপুল সমারোহে বিভিন্নতা থাকা সত্বেও একতা বা ঐক্যের অবস্থা প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বিদ্যমান। প্রসঙ্গক্রমে বলা হয়ে থাকে, এদেশে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বিভিন্ন দিক থেকে বৈচিত্র্য থাকলেও, সার্বিকভাবে ভৌগোলিক উপাদানগুলির মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্বের তুলনায় আন্তঃনির্ভরশীল প্রাসঙ্গিকতাই সবচেয়ে বেশি। রিসলে (Risley) বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধর্মগত, প্রথাগত বৈচিত্র্যের অভ্যন্তরে উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত ভারতবর্ষের সর্বত্রই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য বিরাজ করছে.


বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কয়েকটি নিদর্শন (A few patterns of unity in Diversity):

ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সম্পর্কটির একাধিক দৃষ্টান্ত রয়েছে। ভারতের যে সমস্ত ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতি বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনকে বাঁচিয়ে রেখেছে, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল-

(১) ভারতের স্বতন্ত্র অবস্থান, বিন্যাস, আয়তন এবং প্রকৃতিগত দিক থেকে নানা বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও এদেশের সমগ্র ভৌগোলিক অংশটি সকলের কাছে ভারতবর্ষ নামেই পরিচিত, যে নামটিকে অতি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবেই আমাদের পবিত্র বেদ ও পুরাণেও ব্যবহার করা রয়েছে। তাছাড়া ভারত মাতৃভূমির ধারণা অথবা বন্দেমাতরম্ গানে এদেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা বা ঐক্য আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

(ii) ভারতের অন্তর্গত নদীগুলিও ঐক্যের বোধ জাগ্রত করার জন্যে বিশেষভাবে দায়ী। যেমন, অতীত কাল থেকেই গঙ্গা, কাবেরী, সরস্বতী নদীগুলি দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর কাছে পবিত্রতার নিরিখে এখনো সমানভাবে পূজিত হয়।

(iii) ভারতের প্রতিটি মানুষ, সে যে ধরনের জাতিই হোক না কেন, তারা সকলেই এককভাবে ভারতীয় বা হিন্দুস্তানি রূপে পরিচিতি পায়। বস্তুত, এটি হল দেশের প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত জাতিগত ঐক্যের একটি স্পষ্ট প্রমাণ।

(iv) ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বহু ধর্মাবলম্বী, বহু বর্ণের জনগোষ্ঠী থাকা সত্ত্বেও, প্রত্যেকেই প্রায় সমজাতীয় ভাবধারায় ঐক্যের অনুভূতি বজায় রেখে শান্তিপূর্ণভাবে একে অপরের মধ্যে শুভেচ্ছা ও ভাব বিনিময় করে থাকে।

(v) ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত জুড়ে বহুমুখী সাংস্কৃতিক ভাবধারার সমন্বয়ে (যেমন- দর্শন, সাহিত্য বা অন্যান্য শিল্পকলার প্রতিটি ক্ষেত্রে) বৈচিত্র্যের ঐক্য সুস্পষ্টভাবে বিদ্যমান। এদেশে সাংস্কৃতিক একতা রয়েছে বলেই শক, হুন, পাঠান, মোঘল, গ্রিক, পারসিক, কুষান, পল্লব প্রভৃতি স্বতন্ত্র জাতিগুলি একাত্ম হয়ে মিলেমিশে গেছে।

(vi) ভারতে কোনও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলে দেশের প্রতিটি মানুষ একত্রিত হয়ে সেগুলিকে উপভোগ বা উদ্যাপনে আন্তরিকভাবে শামিল হয়।

ভারতে দ্বিভাষী মানুষের সংখ্যা উত্তরোত্তর যথেষ্টভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশে এই বিভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় 64.2 শতাংশ। সমীক্ষকদের মতে, ভারতবর্ষে প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে মিশ্রণ ঘটছে বলেই এই ধরনের মিশ্র সাংস্কৃতিক ঐক্যের পথ সুগম হয়েছে।

(২) ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বেশভূষা বা খাদ্যাভাসগুলি এখন কিন্তু আর কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এগুলি সকলের মধ্যেই কমবেশি ছড়িয়ে পড়েছে।

(3)Anthropological Survey of India-এর সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের সম আবেগ, সাংস্কৃতিক সমন্বয় আরও দৃঢ় হয়ে ওঠায় সার্বিকভাবে দেশের সমস্ত জনসম্প্রদায়ের মধ্যে আর্থসামাজিক আদান-প্রদানমূলক সম্পর্ক পূর্বের চেয়ে যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে।


■ সাংবিধানিক স্বীকৃতি (Constitutional Recognition):

ভারতে বৈচিত্রোর মধ্যে ঐক্যের বিষয়টিকে আইনি দক্ষতার সাথে সঙ্গতি বজায় রাখতে গিয়ে এটিকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টিকে অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে 1934 খ্রিস্টাব্দে প্রথম সমর্থন জানিয়েছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায়। 1938 খ্রিস্টাব্দে জওহরলাল নেগো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস (INC)-এর অধিবেশনে জাতীয় ঐকোর ভাবধারাগুলি নিয়ে সাংবিধানিক পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরবর্তীকালে সংবিধান রচনার পর, প্রথম ধরাতেই ভারতকে একটি "Union territory"-রূপে গণ্য করা হয়েছে। 1976-এর সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবনায়। সার্বিকভাবে "সমাজতান্ত্রিক" ভারতের ঐক্যের বিষয়টি আরও গ্রহণযোগ্যতা পায়। রাষ্ট্রের বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐক্যের প্রাসঙ্গিকতায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাংবিধানিক বিবি হল-

(i) ভৌগোলিক ঐক্যের বিধান অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক সমস্ত ধরনের চাপ থেকে ভারতীয় ভূখণ্ড ও অন্তর্ভুক্ত সীমানা যাতে সবসময় অটুট থাকে, সেজন্য সংবিধানের। অনুচ্ছেদে ভৌগোলিক ঐক্যের বিধান রাখা হয়েছে।

ধর্মীয় ঐক্যের বিধান ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবযারা অক্ষুন্ন রাখতে সংবিধানের 25 অনুচ্ছেদে জনগণকে যে কোনও ধর্ম গ্রহণ, ধর্ম প্রচার এবং সকল ধর্মের প্রতি সমান আনুগত্য নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ভাষাগত ঐক্যের বিধান সংবিধান দেশের কোনো একক ভাষাকে গুরুত্ব না দিয়ে ৪ নম্বর তফসিলে মোট 22টি অর্থনৈতিক একীকরণের বিধান সংবিধানের 19 অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, জাতি, ধর্ম বা সংস্কৃতি নির্বিশেষে পণ্য ও পরিষেবা কর (GST) বিষয়ক সংস্কারে "এক দেশ এক কর" নীতিকেও কার্যকর করা হয়েছে।

তবে, আলোচনার প্রসঙ্গো এখানে একটা কথা বলা বিশেষভাবে জরুরি যে, বৈচিত্র্য এবং ঐক্য এই দুটি ধারণা এক নয়। কারণ এদের মধ্যে বেশ কয়েকটি সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে, যেমন-

ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে সামগ্রিক ঐক্যের ক্ষেত্রগুলি বর্তমানে বেশ কতকগুলি হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, যার অন্যতম কয়েকটি হল-

(i)আঞ্চলিক স্বার্থকে সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতাবাদের বাধা।

(ii) জাতি, বর্ণ, ধর্মকে সামনে রেখে বিভাজনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশ।

( iii) জনসম্প্রদায়ের মধ্যে আঞ্চলিক অসহিহ্বতাকেন্দ্রিক বিভিন্ন অবিশ্বাস ও সন্দেহের ফলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় স্বন্দ্ব।

(iv) দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের অসম বিন্যাস।

(v) অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সম্পদের ঘাটতির পরিবেশ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

তা সত্ত্বেও, ভারতের ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপটে ঐক্যের ধারণাটি বিভিন্ন দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য শব্দটি আসলে জাতীয় অখণ্ডতামূলক ভাবধারার সাথে সম্পর্কিত, যা সামগ্রিকভাবে সমাজ ও জাতিকে আরো উন্নত বা পরিশীলিত করে।


তাৎপর্য (Significance):

ভারতীয় আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য শব্দটি বিভিন্ন কারণে অতান্ত তাৎপর্যপূর্ণ, যেমন-

> বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর ধারণাটি দেশের বিভিন্ন নাগরিকদের মধ্যে শান্তি, সমৃদ্ধি এবং সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

> বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মেলবন্ধন কর্মক্ষেত্র, সংগঠন এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মনোবল বাড়িয়ে দেশের উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ঘটায়।

> সুস্থ মানবিক সম্পর্কের প্রচার এবং সকল মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের মধ্যে একতার বিষয়টি জীবনযাত্রাকে যথেষ্ট সমৃদ্ধ করে তোলে।

> বৈচিত্র্যের মধ্যে একতা ভারতকে পর্যটনের অন্যতম একটি উৎস ক্ষেত্রে উপনীত করেছে।

> ভারতীয় জীবন, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং পোশাক ইত্যাদিতে বৈচিত্র্য রয়েছে বলেই সারা বিশ্ব থেকে অনেক দর্শনার্থী এবং পর্যটকদের আকৃষ্টের কারণ হয়ে উঠেছে।

> দেশের বৈচিত্র্যপূর্ণ সমন্বয়মূলক ঐক্যের পরিবেশ পেশাদারী ক্ষেত্রগুলিকে উদ্বুদ্ধ করে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য সংক্রান্ত যাবতীয় অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণে সহায়ক হয়।

> আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের সার্বিক ঐক্যের ভাবধারা নাগরিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতার আদর্শকে তুলে ধরে একটি সম্মানজনক অবস্থান পেতেও সাহায্য করে থাকে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01