ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্যের সাথে আঞ্চলিকতার সম্পর্ক(The Relationship of Regionalism to Regional Disparity in India)
প্রাথমিকভাবে আঞ্চলিকতার ধারণাটি দেশের প্রতি চরম আনুগত্যতা প্রকাশের একটি স্বতন্ত্র বহিঃপ্রকাশ। তবে, কোনও একটি অঞ্চলের স্বার্থ যখন অন্য একটি অঞ্চল অথবা রাষ্ট্রের উন্নয়নমূলক স্বার্থের সাথে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ে, অন্যথায় একটি দেশের বিরুদ্ধে অন্য একটি দেশ যখন প্রতিকূলভাবে নিজেদের চাহিদাগুলিকে জাহির করে, তখনই স্থানীয় স্বার্থ সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিগুলির আঞ্চলিকতায় উন্নীত হয়। ভারতে আঞ্চলিকতা ভাবধারার শিকড় এদেশের ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিগতসত্ত্বা, সম্প্রদায়, ধর্ম ইত্যাদি বহুবিধ বৈচিত্র্যের মধ্যে যেভাবে বিদ্যমান, একইভাবে সেই অনুভূতি বহনকারীদের আঞ্চলিক বঞ্চনার বোধগুলি জাগ্রতকরণের ক্ষেত্রেও পৃথক আঞ্চলিক ভাবধারা বিশেষ ইন্ধন রূপে কাজ করে থাকে। অতীতে একাধিকবার দেখা গিয়েছে, দেশের বিশেষ কোনও আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে সংঘাতপূর্ণ ভাবধারাগুলি বিভিন্ন রাজনৈতিক গণআন্দোলনকে তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। এইভাবে, ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের সাথে আঞ্চলিকতার একটি গভীর এবং চিরকালীন সম্পর্ক রয়ে গেছে।
ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্যের সাথে আঞ্চলিকতার ধারণাটি মিশে গিয়েছে মূলত চারটি কারণে-
1. বঞ্চনা (Deprivation): ভারতের বেশ কিছু রাজ্যের অর্থনৈতিক বঞ্চনার দীর্ঘকালীন পরিস্থিতি।
2. অধিক প্রত্যাশা (High expectation): কিছু কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির অধিক সুযোগসুবিধা পাওয়ার প্রতি আগ্রহ।
3. পৃথক রাষ্ট্রের দাবি (Demands for Separate States): কোনও রাজ্যের বেশকিছু অংশকে নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গড়ে তোলার দাবি।
বিরোধ (Conflict): অন্তঃরাষ্ট্রীয় বিরোধ এবং রাজনৈতিক অভিলিন্দা।তবে, অধিকাংশ ভৌগোলিক মনে করেন ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের সাথে আঞ্চলিকতা যুক্ত থাকার মূলে বিভিন্ন রাজ্যের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য-ব্যর্থতা, উত্থান-পতন প্রভৃতি এই সবকিছুই যেন মিলেমিশে রয়েছে।
যুক্তি (Logic): ভারতের বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক ক্ষেত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি বহুযুগ ধরেই ঐতিহ্যের একটি মিলন মঞ্চ গড়ে তুললেও, স্বাধীনতা-পূর্ব এবং স্বাধীনতা-পরবর্তীকালীন আঞ্চলিকতা ভাবধারায় যে পরিবর্তনগুলি এসেছে তার মূলে রয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আঞ্চলিক বৈষম্যের পরিস্থিতি। বিশেষ করে, ভারতের প্রতিটি রাজ্য একই ভুখন্ডের অন্তর্গত হলেও উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম, মধ্য এবং উত্তর-পূর্ব-সহ ভারতের প্রতিটি অন্নদলের ঐতিহাসিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট একে অপরের থেকে চিরকালই আলাদা। এমনকি, ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি রাজাগুলির মধ্যেও এই ধরনের প্রেক্ষাপটে বিশেষ স্বাতন্ত্র্যতা রয়েছে। ফলে, সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে মাঝে মধ্যেই একাধিক বৈষম্যের পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এখানকার বিক্ষুদ্ধ মানুষজন বিভিন্ন গণআন্দোলনে শামিল হয়, যাকে চরম আঞ্চলিকতাও বলা হয়ে থাকে। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল-
(1) 1950 থেকে 1960-এর দশকে, বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক উন্নয়নের প্যাকেজ নিয়ে গড়ে ওঠা তীব্র বৈষম্য দেশে একাধিক জাতিগত এবং সহিংস গণ আন্দোলনকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
(ii) 1980-এর দশকে, রাজ্য পুনর্গঠনের প্রধান কেন্দ্র ছিল উত্তর- পূর্ব ভারত। অথচ, এখানকার মণিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল প্রদেশসহ কয়েকটি রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী একাধিক আন্দোলন গড়ে ওঠে।
(iii) আঞ্চলিকতার দীর্ঘ আন্দোলন এবং টানাপড়েনের পর 2000 খ্রিস্টাব্দ থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নতুন করে একাধিক রাজ্য পুনর্গঠিত হতে শুরু করেছে।