ভারতীয় প্রেক্ষাপটে আঞ্চলিকীকরণ(Regionalization in Indian context)
বৈচিত্র্যময় সুবিশাল ভারতবর্ষের দৈশিক পরিমণ্ডলকে আধ্যলিকীকরণের প্রচেষ্টায় বিন্যস্ত করা কোনও নতুন ভৌগোলিক পদ্মা নয়। এদেশের প্রাকৃতিক পরিসরের ভৌত বা বাহ্যিক রূপগত বিভিন্নতা এবং ক্রিয়াশীল ক্ষেত্রগুলিকে সামনে রেখে পরিকল্পনাভিত্তিক আঞ্চলিকীকরণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের অখন্ডতা রক্ষার প্রচেষ্টাকে সর্বাত্মকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিম্নলিখিত আলোচনায় এই বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হল।
ভারতে আগ্যলিকীকরণের উদ্দেশ্য (Purpose of Indian Regionalization):
ভারতের আঞ্চলিকীকরণের ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল-
(i) প্রশাসনিক তথা রাষ্ট্র পরিচালনের স্বার্থে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সীমানা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা।
(ii) ভৌগোলিক দিক থেকে দেশের বিভিন্ন বাহ্যিক এবং ক্রিয়ামূলক অঞ্চলগুলির সমধর্মিতা ও বিষমধর্মীতার কাঠামো অনুসন্ধান।
(iii) ভারতের প্রতিটি আঞ্চলিক উপাদানকে তাদের স্বতন্ত্র প্রকৃতি বা পৃথক গুণাবলীর ভিত্তিতে চিহ্নিতকরণ।
(iv) ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল বিশেষে ভাষা, ধর্ম, পোশাক, জাতিগত আচরণ প্রভৃতি বিষয়গুলিকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের নিরিখে অভীক্ষা ও সংরক্ষণ করা প্রভৃতি।
পটভূমি:ভারতীয় ভূখণ্ডে অতীতের বিভিন্ন সময়ে আঞ্চলিকীকরণের যে-সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল, তার বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হলো।
ভারতের আঞ্চলিকীকরণ বা অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণের প্রাথমিক প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল মৌর্যদের (321-10 খ্রিস্ট পূর্বাব্দ) আমলে। সেই সময়, শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে দেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল সি করা হয়েছিল, যথা-
• উত্তরে -তক্ষশীলা অঞ্চল,
• পূর্বে -তোসালি অঞ্চল,
• দক্ষিণে -সুবর্ণগিরি অঞ্চল,
• পশ্চিমে-উজ্জয়িনী অঞ্চল।
ii) বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র, দলিল, দস্তাবেজ থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে বলা যায়, মুঘল সাম্রাজ্যে (1526-1889 )মুঘল সাম্রাজ্যে বিভাজিত আঞ্চলিক পরিসর খ্রিস্টাব্দ) শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে, রাজস্ব সংগ্রহ বা কৃষি অঞ্চলগুলিকে প্রাধান্য দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল আঞ্চলিকীকরণেরই অন্যতম একটি পদক্ষেপ। মুঘল আমলের সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক পরিসরগুলিকে পাশে তালিকা রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।
(iii) মুঘল আমলে প্রশাসনিক দিক থেকে যে সকল আঞ্চলিক পরিসরগুলিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ব্রিটিশ শাসনাধীন (1858-1946 খ্রিঃ) ভারতবর্ষে সেগুলিকেই আবার ইংরেজি ভাষায় কিছুটা পরিবর্তন ঘটিয়ে নবরূপে প্রকাশ করা হয়।
(iv) স্বাধীনোত্তর ভারতে প্রথাগতভাবে মূলত দু-ধরনের আঞ্চলিকীকরণ প্রাধান্য পেয়েছিল। এর মধ্যে প্রথমটি ছিল ভাষার ভিত্তিতে রাজ্যগুলির সীমানা চিহ্নিতকরণ (যেমন- তেলেঙ্গানা) এবং দ্বিতীয়টি ছিল বিভিন্ন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলির উন্নয়নের স্বার্থে পরিকল্পনা অঞ্চল গঠন। প্রথমটিকে অবশ্য কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ আঞ্চলিকীকরণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি ফেলতে নারাজ। কারণ, State Recognisation Act-1956 অনুযায়ী ভাষার ভিত্তিতে তৎকালীন প্রাদেশিক অঞ্চল স্থিরকরণ ছিল রাজ্য পুনর্গঠনের অন্যতম ভিত্তি বা রাষ্ট্রের প্রশাসনিক দায়বন্ধতা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি, তথা আর্থসামাজিক পরিস্থিতিকে প্রাধান্য দিয়েও বেশ কয়েকটি প্রাদেশিক অঞ্চল থেকে প্রধান রাজ্যগুলি থেকে পৃথকভাবে তাদেরকে সীমায়িত করা হয়েছে, যেমন- 2000 খ্রিস্টাব্দে উত্তর প্রদেশের কিছু অংশ নিয়ে উত্তরাখন্ড রাজ্য গঠন, বিহারের কিছু অংশ নিয়ে ঝাড়খন্ড রাজ্য গঠন প্রকৃতির উল্লেখযোগ্য।
ভৌগোলিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতে আঞ্চলিকীকরণ(Regionalization in India in Geographer's Point of View)
ভারতকে একটি বৃহদায়তন পূর্ণ ভৌগোলিক একক বিবেচনা করে আঞ্চলিকীকরণের প্রচেষ্টায় যে কয়েকজন। ভূবিশেষজ্ঞ এগিয়ে এসেছেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাহ্যিক অঞ্চলগুলিকে সমধর্মী (Homogeinious) এবং ক্রিয়ামূলক অঞ্চলকে বৈচিত্র্যপূর্ণ বা বিষমধর্মী (Heterogeinious) এককরূপে গণ্য করেছেন। এখানে, ভারতের বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক নির্ধারকের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত আঞ্চলিকীকরণ প্রক্রিয়াটিকে খ্যাতনাম কয়েকজন ভৌগোলিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করা যায়।