আঞ্চলিক পরিকল্পনা(Regional Planning)
কোনও একটি দেশের উন্নয়নমূলক সমস্ত ধরনের কর্মকান্ডের সাথেই পরিকল্পনার স্থানিক পরিসরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। বিশেষ করে, পরিবেশ-সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদ্ভূত যাবতীয় পরিস্থিতিকে যথাযথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে গতিশীল ও সুসংহত করে তুলতে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকেই উন্নয়নের অন্যতম সোপান বলে মনে করা হয়। এখানে আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারণাটিকে আরও স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা হল।
ধারণা (Concept): আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল কোনও একটি রাষ্ট্রের বিধিসম্মত, নৈতিক এবং সমস্যা সমাধানমূলক এক বিশেষ উন্নয়নমুখী প্রচেষ্টা। গ্রাম-শহর, কৃষিক্ষেত্র-শিল্পক্ষেত্র, সমাজ-অর্থনীতির কাঙ্খিত লক্ষ্য পূরণ, এমনকি সমস্ত ধরনের পরিবেশ-পরিস্থিতিকে সুষমভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাবগুলি আঞ্চলিক পরিকল্পনার মাধ্যমেই বু পায়িত হয়। তাই, আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল ভবিষ্যতে যে কোনো লক্ষ্য পূরণের অন্যতম হাতিয়ার।
সাধারণত, এক বা একাধিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিভিন্ন উন্নয়নমূলক চিন্তাধারার কার্যকরী কৌশল বা নীতির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে সমন্বয়কারী একটি নিরবচ্ছিন্ন দক্ষ প্রক্রিয়া মানা হয়। তাই এখানে পরিকল্পনার কাঠামোয় থাকা সমস্ত প্রকল্প কর্মসূচি দৃঢ় আন্তঃসম্পর্কযুক্ত।
সংজ্ঞা (Definition):
বিশেষজ্ঞ মহলে উন্নয়নমূলক কর্মপদ্মা রূপায়ণ এবং গবেষণার সঙ্গে জড়িত আঞ্চলিক পরিকল্পনার বেশ কয়েকটি সংজ্ঞা প্রচলিত রয়েছে। যেমন-
• সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা (Definition of narrow vision)
Mumford বলেছেন- Regamal Planning asks not how wide an area can be brought under the aege of the Metropolis, but has the population and crie facilities can be distributed so as to promote and stimulate a vivid and creative the throughout a wiele region, অর্থাৎ,
আবুলিক পরিকল্পনা জিজ্ঞাসা করে না মহানগরীর তত্ত্বাবধানে কোন্ এলাকা কতটা বিস্তৃত হতে পারে, কিন্তু সমগ্র অঞ্চলে জনসংখ্যা এবং নাগরিক সুযোগ-সুবিধাগুলির বণ্টন কীভাবে একটি সৃজনশীল এবং সমৃদ্ধ জীবনধারায় প্রাণবন্ত হয়েছে তাকে উদ্দীপিত করে।
• বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান অঞ্চল বিশারদ John Friesdman (1926-2017 খ্রিঃ) বলেছেন- Regional planning as the process of formulating and social objectives in the wedering of activities on
Supra-Urban Space অর্থাৎ, আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল অতি-নগরীয় পরিসরে ক্রমান্বয়ী কার্যাবলি প্রণয়ন এবং সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের প্রক্রিয়া।।
ব্রিটিশ পরিকল্পনা বিশারদ John Glasson-এর মতে, "Regional planning is the procese of formulating and classifying social objectives in the ordering of activities in Supra-Urban
Spaz অর্থাৎ, আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল অতি নগরীয় পরিসরে বিভিন্ন নির্দেশক কার্যাবলির সমন্বয়ের মাধ্যমে সামাজিক উদ্দেশ্যগুলির গঠন প্রক্রিয়া।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখানে Mumford, Friedman এবং Glasson-প্রদত্ত আঞ্চলিক পরিকল্পনার এই ধারণাগুলি কিছুটা সংকীর্ণতার দোষে দুষ্ট। কারণ, উল্লিখিত সংজ্ঞার সবকটিতেই শুধুমাত্র নগরকেন্দ্রিক পরিসরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
• প্রশস্ত দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞা (Definition of wide vision)
D. G Tungare আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারণা দিতে গিয়ে বলেছেন- Regional planning is planning for development of a region which is demarcated on geographical or economic considerations and is designed for the development of the resources of that region অর্থাৎ, আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল উন্নয়নের জন্য এমন একটি পরিকল্পনা যেটি ভৌগোলিক বা অর্থনৈতিক বিবেচনায় সীমাবদ্ধ এবং অঞ্চলের সম্পদের উন্নয়নের জন্য সংকল্পিত।
বিখ্যাত আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ Mackaye উল্লেখ করেন- Regional Planning is an attempt at disoseering the plans of the nature for the attainment of Man's ends upon the Earth, অর্থাৎ
পৃথিবীতে আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল মানুষের অন্তিম অভিষ্ঠপূরণে প্রকৃতির আবিষ্কারমূলক পদক্ষেপ।
• Lewis Mumford-এর মতে, "Regional Planning is the conscious direction and collectivecongration of all those of this which rest upon the use of the rise অর্থাৎ গুলির পরিকল্পনা হল সেই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের সচেতন দিক নির্দেশনা এবং সম্মিলিত কার্যাবলির একত্রীকরণ ও পৃথিবীকে একটি স্থান রূপে ব্যবহার করার ওপর নির্ভর করে।
আঞ্চলিক পরিকল্পনার সংজ্ঞাটিকে R. P. Mishra, K. V. Sundaram, V. S. Prakash Ra প্রমুখ তাঁদের সমন্বয়ী ভাবাদর্শের ভিত্তিতে উল্লেখ করেছেন- "Regional Planning is concerned w mkring of human activities in supra local space. It aims simultaneously at ecomme development, secul pentice and environmental quality
পরিকল্পনা ও আঞ্চলিক পরিকল্পনার সম্পর্ক(Relation between Planning and Regional Planning)
আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিষয় আলোচনার প্রসঙ্গে পাঠক মহলে যে প্রশ্নটি প্রায় সকলকেই ভাবায়, তা হল পরিকল্পন এবং আঞ্চলিক পরিকল্পনার সম্পর্ক ঠিক কোথায়। অতীতে কোনো একটি রাষ্ট্র তার একাধিক কল্যাণকামী চিন্তাধারাকে বাস্তবায়িত করতে বেশ কিছু পরিকল্পনার সাহায্য নিতে হত। তৎকালীন, এই ধরনের পদক্ষেপগুলির অধিকাংশই ছিল কোনও না কোনও একটি বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতির সমস্যাভিত্তিক প্রেক্ষাপটে রচিত। যেমন, খ্রিস্টপূর্ব 5000- 40080 অব্দে প্রাচীন মিশরে গড়ে তোলা নগর রাষ্ট্র 'নোম' এবং নীলনদকেন্দ্রিক বাঁধ নির্মাণ প্রচেষ্টা অথবা, স্থানীয় সেচ ব্যবস্থার প্রচলন প্রভৃতি ছিল পরিকল্পনামূলক কার্যাবলির সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী পদক্ষেপ। আবার, বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মাটিমার হইলার সিশু প্রদেশীয় অঞ্চলে গড়ে ওঠা হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারোর নগর কাঠামো নির্মাণ কৌশলকেও ওই একই ধরনের পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ঊনবিংশ শতকের প্রাক্কালে রাষ্ট্র পরিচালনা, শিল্প তথা ব্যাবসাবাণিজ্যের নীতি নির্ধারণ, এবং সামরিক ক্ষেত্রে গৃহীত একাধিক সুচিন্তিত পদক্ষেপগুলির কোনওটিই আঞ্চলিক পরিকল্পনার স্বীকৃতি পায়নি। বিশেষত্ব তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রে গৃহীত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (Economic planning), সম্প্রদায়গত পরিকল্পনা (Community planning), ভূদৃশ্য নির্মাণ কৌশল (Landscape architecture), বিশেষ পরিকল্পনা (Special planning), নির্মাণমূলক পরিকল্পনা (Architecture planning) প্রভৃতি শব্দগুলি সাধারণ পরিকল্পনার মতোই প্রায় সমার্থক অর্থ বহন করত।
কিন্তু উনবিংশ শতকের শেষের দশক থেকে ইউরোপের দেশগুলিতে আঞ্চলিকতাবাদ (Regionalism)-এর ভাবধারা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রথাগত পরিকল্পনার ধারণাটিতেও আঞ্চলিক শব্দটির সংমিশ্রণ ঘটতে থাকে। এর ফলে, সাধারণ পরিকল্পনার মূল ধারণাটিও ক্রমশ বদলাতে শুরু করে। বিংশ শতকের দোরগোড়ায় আঞ্চলিকতাবাদের আদর্শ ভাবধারা উন্নত বিশ্বের অধিকাংশ দেশগুলিকে কীভাবে আচ্ছন্ন করেছিল এবং সেই সঙ্গেঙ্গ নিজস্ব আঞ্চলিক সমুন্দি প্রকাশ করার জন্য অধিকাংশ দেশ কীভাবে উঠে পড়ে লেগেছিল, তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে বিখ্যাত ঐতিহাসিক Erick Storm-4"Regionalism History 1890-1945 The Cultural Approach শিরোণামে European History Quaterly (Vol. 33 No. 2) নামক গ্রন্থে। বিশেষ করে, 1920-30-এর দশকে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে গ্রেট ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া তাদের উন্নততর স্থাপত্য এবং সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবেশনের জন্য যেভাবে আঞ্চলিকতাবাদী ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল, সেটিকে Erick Storm তাঁর গ্রন্থের আলোচনায় স্পষ্টত দেখিয়েছেন। যদিও, 1950-60-এর দশকে নব্য অতিমাত্রিক অঞ্চলিকতাবাদী ভাবধারা পরবর্তীকালে আধুনিক পরিকল্পনায় বেশ কিছু সমস্যার জন্ম দেয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞই একথা স্বীকার করে নিয়েছেন, সাধারণ পরিকল্পনা থেকে আঞ্চলিক পরিকল্পনার পরিবর্তিত ধারণা সৃষ্টি ও আঞ্চলিকতাবাদের কিছুটা প্রভাব থেকেই যায়। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পৃথিবীর একাধিক সংগঠিত রাষ্ট্র বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার মোকাবিলা বা উন্নয়নের স্বার্থে আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন যুথবদ্ধ কৌশল গ্রহণে সহমত প্রকাশ করে। বিশেষত, আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন নীতি বা কার্যকরী পদক্ষেপগুলিকে বাস্তবায়িত করতে এই সকল দেশ নিজস্ব এবং স্থানীয় সহায়-সম্পদগগুলিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছিল। আরও পরে, উন্নত এবং উন্নয়নশীল একাধিক রাষ্ট্র যখন গ্রাম থেকে শহর এবং সমাজ থেকে অর্থনীতির সার্বিক কল্যাণের ব্রতকে সামনে রেখে যুগোপযোগী বিভিন্ন নিত্যনতুন কৃৎ-কৌশল গ্রহণ করতে শুরু করে, ঠিক তখন থেকেই আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিষয়টি আরও বিজ্ঞানসম্মতরূপে উপনীত হয়।
উপরিলিখিত আলোচনার মধ্য দিয়ে একটা কথা খুবই স্পষ্ট, অভীতের যে কোনও স্যানিক পরিকল্পনার একটি সম্প্রসারিত এবং সার্বজনীন পদক্ষেপ হল আঞ্চলিক পরিকল্পনা। কারণ, প্রথাগত পরিকল্পনা এবং আঞ্চলিক পরিকল্পনার সমস্ত নীতি ও পটভূমিগুলি যেন কোথাও গিয়ে একত্রীভূত হয়ে যায়।
আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রকৃতি এবং পরিধি (Nature and Scope of Regional planning):
আঞ্চলিক পরিকল্পনা মাত্রই তার বিশেষ কিছু নীতি বা দার্শনিক ভিত্তি থাকে, যেগুলি সমগ্র কার্যকৌশলের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে সেটিকে ভবিষ্যৎ অভিমুখী করে তোলে। কাজেই, আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে বুঝতে গেলে শুরুতেই এর প্রকৃতি এবং পরিধির অভিমুখ সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত বাঞ্ছনীয়। এখানে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রকৃতি এবং পরিধি সংক্রান্ত বিষয় দুটিকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করা হল।
• প্রকৃতি (Nature):
• সংকল্প (Determination): স্থানীয়, আঞ্চলিক, রাষ্ট্রীয় অথবা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে স্বল্প অথবা দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের সংকল্পে একটি যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আঞ্চলিক পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
• কায়নো (Structure): এটি এমন একটি উন্নয়নমুখী, বিধিসম্মত, প্রয়োগমূলক এবং কর্মকৌশলী প্রচেস্টা, যা অনিবার্যভাবে কোনো প্রশাসনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত থাকে।
• সর্বস্তরীয় (All levels): প্রতিটি অঞ্চল এবং উপ-অঞ্চলের সর্ব স্তরে অর্থাৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত একাধিক সমস্যা এবং পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে এই ধরনের পরিকল্পনা রূপায়িত হয়।
• একক পরিসর (Unit extent): আঞ্চলিক পরিকল্পনার জন্য একটি রাষ্ট্রের ক্ষুদ্র, মধ্যম বা বৃহৎ পরিসরের যে-কোনও একটি আঞ্চলিক একক (Regional unit)-কে সামনে রেখে প্রণয়ন করা হয়ে থাকে।
• ভাবধারা (Ideology): পৃথক পৃথক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পনার সুচিন্তিত কার্যাবলীকে বিজ্ঞানসম্মত এবং মনস্তাত্ত্বিক বহুমুখী ভাবধারায় আঞ্চলিক পরিকল্পনায় প্রযোজ্য হয়।
• পরিচালনা (Management): কোনও একটি অঞ্চলকে দ্রুত সমৃদ্ধির পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিকল্পনাই হল একমাত্র এবং প্রধান একটি কৌশলগত হাতিয়ার। সেজন্য, সমগ্র প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দক্ষার সাথে নিরবচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত হয়।
• যুক্তিসঙ্গাত (Reasonable): সমস্ত ধরনের আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন কর্মকৌশলকে বাস্তব অভিজ্ঞতায় যুক্তিসঙ্গঙ্গতভাবে বিবেচনা করে তবেই গ্রহণ করা হয়।
• নমনীয়তা (Flexibility): আঞ্চলিক পরিকল্পনার কাঠামোগত কৌশলগুলি যথেষ্ট বিধিবন্ধ হলেও, প্রয়োজন এবং পরিস্থিতি অনুসারে এখানে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এই দিক থেকে বিবেচনা করলে, আঞ্চলিক পরিকল্পনা যথেষ্ট নমনীয় প্রকৃতির।
• সময়ানুগতা (Punctuality): আঞ্চলিক পরিকল্পনা মানেই সেটি সর্বদ্য নির্দিষ্ট বাধাধরা সময়ের গণ্ডিতে পরিচালিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। এখানে পরিকল্পনার ব্যাপ্তি এবং প্রয়োজন অনুসারে স্বল্পকালীন বা দীর্ঘকালীন উভয় সময়কাঠামোকে স্থির করে দেওয়া হয়।
• পরিধি (Scope): ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অথবা সরকারি থেকে বেসরকারি বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে যে-কোনও ইতিবাচক কর্মকাণ্ডকে সুষ্ঠু এবং পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করতে আঞ্চলিক পরিকল্পনার পরিধি বর্তমানে যথেষ্ট সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, পৃথিবীতে মানুষের ক্রিয়ামূলক এমন কোনও স্থান নেই যেটি আঞ্চলিক পরিকল্পনার আওতার বাইরে। বিগত একশো বছরে মানুষের সমাজ-অর্থনীতি-পরিবেশকেন্দ্রিক নানাবিধ সমস্যা সমাধানের স্থায়ী কল্যাণকামী প্রচেস্টায় আঞ্চলিক পরিকল্পনার কর্মসূচিগুলি একটি সুসংবন্ধ কাঠামোর রূপায়িত হয়েছে। যেমন-
• প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবস্থাপনা (Natural resources management):
মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণে এমনকি মূল্যবান
প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার বিষয়টিকে
পরিচালিত করতে আঞ্চলিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত
প্রতিটি কার্যকর নীতির আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রটি
বর্তমানে যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে। যদিও এই ধরনের
আন্তঃসম্পর্ক বিবেচনায় অর্থনৈতিক পরিসরে
সম্পদকেন্দ্রিক অনুশীলন, দক্ষতাপূর্ণভাবে প্রাকৃতিক
উন অল (Resource development ression) কোন একটি অঞ্চলের উন্নয়ন সম্ভাবনা বিচার করতে পরিকল্পিতভাবে যে কার্যকরী ক্ষেত্রটি সবচেয়ে বহুমুদী। হয়ে উঠেছে, সেটি হল সম্পদ উন্নয়ন অঞ্চল। সাধারণত, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার পরিধি সম্প্রসারণের এই ক্ষেত্রত্রীকে স্তর (Micro level) এ উপলক্ষ সম্পদ, সংস্থান ও সম্পদ বন্টনের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তুলতে অন্যতম একটি গতিশীল কৌশল রূপে বিবেচিত হয়। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের আঞ্চলিক নীতিতেও এই বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
উপকরণ সংগ্রহ ও সেগুলির রক্ষণাবেক্ষণের পরিবেশকে আরও মজবুত করেছে। এর ফলে, অঞ্চলভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অত্যন্ত যুগোপযোগী হয়ে উঠেছে।
• ভূমি ব্যবস্থাপনা (Land management): মানুষের সমস্ত ধরনের কার্যাবলির অন্যতম কেন্দ্রস্থল হল এই ভূমিভাগ। একদিকে, ভূমিভাগ যেমন নিজেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, অন্যদিকে ভূমিভাগকে কেন্দ্র করেই সম্পদের উৎপাদন, বণ্টন এমনকি ব্যাবহারিক সমস্ত ধরনের উদ্যোগ নিয়ন্ত্রিত হয়। সেই কারণে, বিগত কয়েক শতক থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় সঠিক ভূমি ব্যবস্থা প্রণালী গড়ে তুলে সেটিকে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। বিশেষ করে, গ্রামাঞ্চল, শহরাঞ্চল, পার্বত্য অঞ্চল, মরু অন্যল এমনকি সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলির ভূমিভাগকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা সমস্ত উন্নয়নমূলক কার্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রূপায়িত হয়ে থাকে।
• মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা (Human resources management):
পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে সম্পদ ও পরিসেবা সরবরাহ অক্ষুন্ন রাখতে, এমনকি সমাজ তথা অর্থনীতিকে সচল রাখতে মানবসম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আঞ্চলিক পরিকল্পনার একটি অন্যতম অভিমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাটিকে শুধুমাত্র উৎপাদনের স্বার্থে বিবেচনা করা হত। কিন্তু, বর্তমানে জনশক্তির বিকাশ, সর্বোত্তম সামাজিক সংগঠন সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ, উপযুক্ত কর্মী নিয়োগ, উন্নয়ন কার্য সম্পাদনা বা মূল্যায়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে মানবসম্পদের পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা আঞ্চলিক পরিকল্পনার একটি সম্ভাবনাময় অধ্যায় রচনা করেছে।
• অর্থনৈতিক উন্নয়নমুখী ব্যবস্থাপনা (Economic development oriented management): এক সময় বিশ্বের প্রতিটি দেশ উন্নয়নের প্রচলিত ক্ষেত্রগুলির সঙ্গে তাল মেলাতে, পরিকল্পনার পথ ধরেই উৎপাদনমুখী কাঠামোর সংস্কারে মনোনিবেশ করেছিল। এর ফলে অর্থনৈতিক পরিসরে মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, উৎপাদন কাঠামোয় প্রযুক্তিগত সম্প্রসারণ, শ্রম বা শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি, ভোগ ও সঞ্চয়শীলতা, দেশের ভারসাম্যযুক্ত সমৃদ্ধিসহ একাধিক ক্ষেত্র উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ মডেল রূপে আঞ্চলিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
নগর ব্যবস্থাপনা (City management): বহুকাল ধরেই পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা শহর তথা নগরায়িত এলাকাগুলি আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রধান একটি অভিমুখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নগরায়ণ তথা নগর বিকাশের সার্বিক মাত্রা বিভিন্ন পরিকল্পিত ক্ষেত্রের মধ্যে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্থান পেয়েছে। বর্তমানে, আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারাবাহিক প্রেক্ষাপট শুধু যে শহর বা নগরের সুন্দর নকশা বা অবকাঠামোয় থেমে রয়েছে ঠিক তা নয়, বরং শহর বা নগরে উপযুক্তভাবে ভূমি ব্যবহার, নগরে পরিশুদ্ধ জলের পরিসেবা প্রদান, বাসস্থান সমস্যা দূরীকরণ, দুষণ বাধ, স্বাস্থ্যসমস্যার সমাধান, উন্নত পরিবহণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ সৃষ্টির মতো একাধিক বিষয়গুলি আঞ্চলিক পরিকল্পনার অঙ্গীভূত হয়েছে। বিশেষকরে, আধুনিক বিশ্বে বৃহত্তর লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক, টোকিয়ো প্রভৃতি নগরগুলির উজ্জ্বল উপস্থিতি সেখানকার উন্নত আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারাবাহিকতাকেই নির্দেশ করে।
• গ্রামীণ উন্নয়ন (Rural development) শহর বা নগরাঞ্চলগুলির মতোই গ্রামীণ অন্যল তথ্য গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নের প্রাসঙ্গিকতা সাম্প্রতিককালে আঞ্চলিক পরিকল্পনায় যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যেহেতু গ্রামাঞ্চলেই বসবাস করেন। সেই কারণে, এই সমস্ত দেশে গ্রামীণ এলাকার সমষ্টিগত উন্নয়ন, নির্দিষ্ট ভূমি ব্যবহার, স্থানীয় রাস্তাঘাট ও পরিকাঠামোর উন্নয়ন, স্বনিযুক্তি, দারিদ্র দূরীকরণ প্রভৃতি বহুমুখী নানান কার্য ক্রমেই আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রধান অংশ হয়ে উঠেছে।
• পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা (Environmental management):
কোনও একটি দেশে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পরিকল্পনাকে সামনে রেখে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্পদের শোষণ যখন উচ্চতর মাত্রায় পৌঁছায়, তখন পরিবেশকেন্দ্রিক বিভিন্ন সমস্যা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সেই কারণে, বর্তমানে আঞ্চলিক পরিকল্পনায় পরিবেশগত সমস্যা সমাধান ও তার বিশ্লেষণ সংক্রান্ত বিষয়টি যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিশ্বের অধিকাংশ পশ্চিমি দেশে যে সমস্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, তার প্রায় সবকটিতেই পরিবেশগত দিকটি ভীষণভাবে উপেক্ষিত ছিল। উন্নয়ন তথা পরিকল্পনামূলক ক্ষেত্রে এই ধরনের পরিবেশবিমুখিতা মানুষকে এক চরম বাস্তবতার সম্মুখীন করেছে। বিশেষ করে, নগরায়নকে ঘিরে প্রবল যানজট, বর্জ্য সমস্যা, বাসস্থানমূলক সমস্যা, নদীবীধকে ঘিরে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ, ভূমিক্ষয়, বন্যার সমস্যা প্রভৃতি বিষয়গুলি যেভাবে মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেগুলির থেকে নিষ্কৃতি পেতে আঞ্চলিক পরিকল্পনায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণভাবে সংযুক্ত হয়েছে।
যেমন-1980 খ্রিস্টাব্দে তিওয়ারি কমিটির প্রতিবেদন ভারতের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় পরিবেশ ব্যবস্থাপনার উল্লবনা বিষয়টির একটি বিশেষ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এইভাবে আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিস্তৃত পরিধি বিশ্বের পিছিয়ে পড়া দেশগুলিকেও উন্নয়ন সম্পর্কে নতুন করে ভাবাতে শুরু করেছে। এর ফলে অদুর ভবিষ্যতে উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত দেশগুলিতে বিকাশের সুযোগ যে মাত্রাধিকভাবে বাড়বে একথা সহজেই স্বীকার করে নেওয়া যায়।
আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারণাসংক্রান্ত ভিত্তি(The Basis of the Concept of Regional Planning):
মানবসভ্যতা পরিচালনা তথা সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে একটি উল্লেখযোগ্য স্তম্ভ মানা হয়। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় এই ধরনের তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিত্তি উন্নয়নের মূল স্তম্ভস্বরূপ প্রোথিত রয়েছে। আঞ্চলিক পরিকল্পনায় পটভূমি ঠিক কবে এবং কোথায় প্রথম গড়ে উঠেছিল সে নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে 1955 খ্রিস্টাব্দে Artur Glickson বলেছেন-"It is obvious that Regional Planning is not an intervention of our days, but a practice of old times"
তবে, এ বিষয়ে একটি কথা প্রায় সকলেই স্বীকার করে নিয়েছেন রাষ্ট্রের উন্নয়নমুখী জনহিতকর বিভিন্ন কার্যের লক্ষ্যে প্রথাগত আঞ্চলিক পরিকল্পনামূলক কার্যক্রম আজ থেকে প্রায় কয়েক হাজার বছর পূর্বে শুরু হলেও শিল্পায়ন এবং নগরকাঠামো উন্নয়নকে সামনে রেখে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একাধিক সুশৃঙ্খল এবং বিজ্ঞানসম্মত আশঞ্চলিক পরিকল্পনার অধিকাংশই বিগত শতকের বিভিন্ন সময়কাল জুড়ে বিকশিত হয়েছে ।
যদিও, আধুনিক নগর পরিকল্পনায় Patrick Geddes-এর অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে আঞ্চলিক পরিকল্পনার (Father of Regional Planning) রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তা সত্ত্বেও অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ আন্তলির পরিকল্পনা উপলব্ধিতে 1928 খ্রিস্টাব্দে Benton Mackaye প্রণীত 'New Exploration-A Philosphy of Regional Planning গ্রন্থটিকে একটি উল্লেখযোগ্য অনুপ্রেরণামূলক ভিত্তি মনে করেন। কারণ Benton তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিকল্পনার একটি সুনিদিও বিধিবন্ধ পথনির্দেশিকা দিয়েছিলেন, যেটি পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশেই প্রযোজ্য হয়।
আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যে গতি এসেছিল, তার ধারাবাহিকতাকে 1969 খ্রিস্টাব্দে Maynard M. Hufschmidt পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বে উপস্থাপন করেছেন, যথা-
1930 থেকে 1940-এর দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সম্পদ সম্পর্কে দক্ষতাপূর্ণ জ্ঞানের প্রতিফলনস্বরূপ যে "Tennessi Valley Authroity (TVA)" গড়ে উঠেছিল, তাদের প্রদর্শিত প্রযুক্তি এবং পরিকল্পিত নির্দেশিকাগুলিই পরবর্তীকালে নেদারল্যান্ডের পুনরুদ্ধারকৃত পোল্ডার তুমি প্রকল্প, ইস্রায়েলের জাজরিল উপত্যকা পরিকল্পনা রূপায়ণে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এইভাবে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনা পুনরুজ্জীবনে, তথা আঞ্চলিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে TVA অনুকরণীয় আধুনিক পরিকল্পনার একটি উল্লেখযোগ্য সোপান হয়ে ওঠে।
• 1930 এবং 1950-এর দশকে আমেরিকায় দক্ষিণি চিন্তাধারায় প্রতিষ্ঠিত Odum এবং Vance-এর সমাজ-সংস্কৃতিমূলক গবেষণা আঞ্চলিকতাবাদের যে পটভূমি তৈরি করেছিল, সেটিও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
• 1960-এর দশকে Walter Isard কর্তৃক পরিকল্পনার বিভিন্ন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি, পরিকল্পনার নকশা, এবং পরিকল্পনার মৌলিক বিবিগুলি বিজ্ঞানসম্মতভাবে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রতিটি পদক্ষেপকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভৌগোলিক মাত্রা প্রদান করে। বিশেষত, মনুষ্যকেন্দ্রিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিসরগুলিতে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বণ্টনগত নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের যাবতীয় দায়বদ্ধতাক Isard আঞ্চলিক পরিকল্পনার অন্যতম নীতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে বিশ্বের অধিকাংশ স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার কারণে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যকে ভিত্তি করে সেখানে আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারণাগুলি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এইভাবে, স্বল্পোন্নত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলিতে আঞ্চলিক উন্নয়নের পথ যথেষ্ট সম্প্রসারিত হয়।
1960-এর দশক থেকে পরবর্তী সময়কালগুলিতে পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশ (বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ) দ্রুত নগরায়ণ এবং মহানগরীয় উত্থানের কারণে নতুন করে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হতে থাকে। তৎকালীন, বিভিন্ন পৌর সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে John Friedman প্রবর্তিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা কৌশলের হাত ধরেই নগরগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার একাধিক ব্রত সংশ্লিস্ট দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করতে দেখা যায়। এইভাবে, আঞ্চলিক পরিকল্পনা ক্রমেই তার বর্তমান রূপে উপনীত হয়।
একবিংশ শতকে সমগ্র পৃথিবীব্যাপী আঞ্চলিক পরিকল্পনার মিশ্র কৌশলগত প্রকৃতিতে তিনটি বিশেষ ধারা চোখে পড়ে, যেমন-
(1) পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিকল্পনার দৃষ্টিভঙ্গিকে নমনীয় এবং সহযোগিতামূলক করে গড়ে তোলা।
( 1) পরিকল্পনার প্রয়োগ ক্ষেত্রগুলিতে সার্বিক সত্যতার নিরিখে বিভিন্ন অনুক্রমিক কৌশলগত ব্যবস্থায় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা।
(iii) এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনার স্বার্থে স্থানীয় ভূমি, বাহ্যিক ভুদশ্য এবং পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া।
উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট(Different context of Regional planning in Developed and Developing Countries)
সাধারণত পরিকল্পনার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্বের সমস্ত দেশেই প্রায় এক হলেও, সময়কাল এবং প্রেক্ষাপটগত দিক দিয়ে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আঞ্চলিক পরিকল্পনা পৃথক পৃথক ভাবে গৃহীত হয়েছে। যেমন-
• উন্নত দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Regional Planning in the Developed World):
আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিজ্ঞানসম্মত কৌশলী পদক্ষেপ প্রথম নেওয়া হয়েছিল বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে। বিশেষ করে, শিল্পবিপ্লবের হাত ধরে ইউরোপের অধিকাংশ দেশে প্রগতিশীল অর্থনীতির যে দৃঢ় কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাকেই পরিপূর্ণ রূপ দিতে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য পদক্ষেপ রূপে বিবেচনা করা হয়। তৎকালীন, শিল্পবিপ্লবের সূত্রপাতকে ঘিরে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আঞ্চলিক অর্থনীতি এবং নগর কাঠামোয় পরিকল্পনার বিষয়টি অস্পষ্টভাবেই ক্রমশ জনপ্রিয় হতে থাকে। 1902 খ্রিস্টাব্দে Howard তাঁর বিখ্যাত 'Garden Cities of Tomorrow" -তে উল্লেখ করেন, শিল্পবিপ্লবের সময় ব্রিটিশ সরকারের আঞ্চলিক পরিকল্পনামূলক একাধিক পদক্ষেপ (যেমন-শিল্পকেন্দ্র স্থাপন, নগর কাঠামো সৃষ্টি প্রভৃতি) উন্নয়নের একটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয় হয়ে উঠেছিল। এরপর, আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন পদক্ষেপ নেদারল্যান্ড, রাশিয়া, কানাডা, জার্মানি সহ বিশ্বের একাধিক উন্নত দেশে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আঞ্চলিক পরিকল্পনার অধিকাংশ বিধিসম্মত এবং বৃহদায়তন পদক্ষেপ গ্রহণ সার্বিকভাবে জনপ্রিয়তা পায় দ্বিতীয় বিশ্বযুষের পরবর্তী সময়কালগুলিতে। যে সমস্ত প্রেক্ষাপট পৃথিবীর প্রায় অধিকাংশ উন্নত দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়নে সহায়ক হয়েছে, সেগুলি
• আধুনিক শিল্প-পরিকাঠামোর সম্প্রসারণ,
• উন্নততর নগরতন্ত্রের বিকাশ,
• আধুনিক ভূমি ব্যবহার প্রণালীর সুযোগসুবিধা,
• পরিবহণ ব্যবস্থাকে আরও দ্রুততর করে তোলার প্রচেষ্টা,
পরিবেশগত স্থিতিশীল উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রভৃতি।
• এখানে, বিশ্বের কয়েকটি উন্নত দেশে গৃহীত আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিভিন্ন পদক্ষেপ দৃষ্টান্ত সহকারে উপস্থাপন করা হল।
ইংল্যান্ড (England)
শিল্পবিপ্লবের পরিণতিস্বরূপ ইংল্যান্ডে অর্থনৈতিক পরিকল্পনার যে প্রাথমিক ভিত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তা পরবর্তী করেই বিশ শতকে আন্তঃআশ্বলিক পরিকল্পনার একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করে। যেমন- 1922 খ্রিস্টাব্দে এসোন Doncaster Regional Planning Scheme-এর মধ্যে দিয়ে উন্নত নগর কাঠামো সৃষ্টি এবং আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার সূত্রপাত ঘটায়। এরপর, 1932 খ্রিস্টাব্দে "Town and Country Planning Act" গ্রহণের মাধ্যমে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে দেশের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু হয়। অবশ্য, এই আইনেও বেশ কিছু ত্রুটি থাকায় ইংল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সরকার (The British Central Government) আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে 1934 খ্রিস্টাব্দে "Development and Improvement Act" পাস আগের চেয়ে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এরপর, 'Micro- regional Planning দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে 1944 উউ Greater London Plan'-এর মাধ্যমে সমগ্র দেশকে চারটি উপ অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়েছিল, যথা- "Municipal Borough', 'Urban District', 'Rural District' এবং 'Parish' যেগুলি ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের অধিকাংশ আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে দ্রুত বাস্তবায়িত করার প্রধান ক্ষেত্র। 1947 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে 'Town and Country Planning Act'-কে পুনরায় পরিমার্জিত করা হয়। বর্তমানে ইংল্যান্ডের আঞ্চলিক পরিকল্পনার জন দুটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যথা জাতীয় স্তর এবং নগরকেন্দ্রিক স্তর।
এই আইনের ফলে ইংল্যান্ডের পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রগুলি the 4/11 কাল্যান্ডের Dottcoaster পরিকল্পনর একটি ছবি
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইংল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে গৃহীত এই ধরনের কর্মসূচিই পরবর্তীকালে ফ্রান্স, ইটালি, জার্মানি বেলজিয়াম এমনকি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো বেশ কয়েকটি দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনার অন্যতম কৌশলগত পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়ায়।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিকে সামনে রেখেই নগর পরিসেবাভিত্তিক বিভিন্ন কাজের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রাথমিক কর্মসূচি গৃহীত হয়। বিশেষ করে 1850 খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্ক শহরকে ঘিরে রূপায়িত আঞ্চলিক পরিকল্পনায় সেখানকার পরিকল্পনাবিদ Frederick Law Olmsted-এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। তাঁরই প্রেরণায় এদেশে 1899 খ্রিস্টাব্দে গঠিত American Society of Landscape Architecture গঠন করা হয়েছিল। এরপর, 1923 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের আর্থ সামাজিক সমস্যা বিশ্লেষণের জন্য "Regional Planning Association" নামক একটি বেসরকারি সংস্থা গড়ে তোলা হয়, যারা দীর্ঘকাল যাবৎ নগরাঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা বিশ্লেষণে অত্যন্ত পারদর্শিতার সঙ্গে কাজ করে গেছে।
1925-1935 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে Lewis Mumford এবং Benton Mackaye-এর ভাবাদর্শকে অবলম্বন করে "Regional Planning Association of America" এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উন্নয়নমূলক একাধিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান এবং আঞ্চলিক তথা স্থানীয় পরিবেশগত সমস্যাগুলিকে অনুধাবন করেই তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান Franklin D. Roosevelt-এর পৃষ্ঠপোষকতায় 1933 খ্রিস্টাব্দে Tennessee Valley Authority (TVA) স্থাপিত হয়, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন,জল নিষ্কাশন, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রভৃতি। চল্লিশের দশকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত একাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে (যেমন-উত্তর ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয় টেকনোলজি কলেজ, মিশিগান ও শিকাগো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি) আঞ্চলিক পরিকল্পনা পাঠের বিশেষ বিভাগ খোলা হয়। 1974 খ্রিস্টাব্দের 5 জুন প্রায় 13 বিলিয়ন মার্কিন ডলার আর্থিকমূল্যের বাজেট ভিত্তিক চার বছর মেয়াদি একটি বিশেষ পরিকল্পনা কর্মসূচী "Marshal Plan-European Recovery" গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীকালে, এই পরিকল্পনা মোতাবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিসরে ভূমি ব্যবহার, বসতি বিন্যাস, জলসরবরাহ, পরিবহণ ব্যবস্থা, উৎপাদন প্রণালী সহ একাধিক ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে, Smart Growth-কে সামনে রেখে এখানকার বিভিন্ন প্রান্তে যাবতীয় আঞ্চলিক পরিকল্পনা রূপায়িত হয়ে থাকে।
জার্মানি (Germany)
জার্মানিতে প্রাথমিক ভাবে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল বিগত শতকের দ্বিতীয় দশকে। বিশেষ করে, 1920 খ্রিস্টাব্দে জার্মানির বুচ শিল্পাঞ্চল এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা অন্যান্য শিল্পাঞ্চলগুলির উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে SVR (Siedlungsverband Ruhrkohlenbezirk) নামক একটি রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা রূপায়ক সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থাটি Expert Council of German Federation on Integration and Migration'-এর তত্ত্বাবধানে জার্মানিসহ বিশ্বের একাধিক দেশের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় দীর্ঘকাল যাবৎ তাদের বিশেষ অবদান রেখেছে। SVR-এর প্রচেষ্টায় 1960-এর দশকে জার্মানিতে নগরকেন্দ্রিক পরিকল্পনাকে দ্রুত বাস্তবায়িত করতে 'Federal Construction Law' গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীকালে, জার্মানিতে কৃষিভিত্তিক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে 'Green Structure Plan' এবং পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য 'Federal Transit Plan'-গুলিকে আঞ্চলিক পরিকল্পনায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল
অবশ্য, 1979 খ্রিস্টাব্দে SVR নামক পরিকল্পনা সংস্থাটি KVR (Kommunalverband Ruhrgebiet) -এ উপনীত হয়। পরবর্তীকালে অর্থাৎ, 1998 খ্রিস্টাব্দে জার্মানিতে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে Federal Regional Planning Act' প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে, জার্মানির আঞ্চলিক পরিকল্পনামূলক প্রক্রিয়ায় স্থিতিশীল উন্নয়নের 'Agenda 21' সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, জার্মানির মোট 402-টি প্রশাসনিক এলাকায় বিশেষ ভূমি ব্যবস্থাপনামূলক পরিকল্পনাসমূহ অত্যন্ত দ্রুততার সাথে রূপায়িত হয়েছে।
ফ্রান্স (France)
ফ্রান্সে আঞ্চলিক পরিকল্পনার ধারাটি যথার্থভাবে বিকাশ লাভ করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালীন সময়ে। প্রথমদিকে, এদেশের নগরকেন্দ্রিক কয়েকটি সাধারণ সমস্যাকে সামনে রেখে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রচেষ্টা শুরু হয়। 1947 খ্রিস্টাব্দে M.J.F. Gravier-এর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ 'Paris and the French Desert'-এ উল্লেখ করেছিলেন, পরিকল্পনার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্যারিস শহরকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়ন প্রায় থেমে গিয়েছিল। বিশেষ করে, 1836-1936 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্যারিস শহরের কর্মসংস্থান প্রায় 45 শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ায়, ফ্রান্সের অন্যান্য অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়ন আশানুরূপভাবেই কমে যায়। পরবর্তীকালে, Gravier এর সুষম কৌশলের যক্তিই ফ্রান্সের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। 1950-এর দশকে ফ্রান্সের নগর উন্নয়ন এবং পরিকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রী M. Claudius Petit-এর তত্ত্বাবধানে জাতীয় এবং আঞ্চলিক স্তরে উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গ্রহণের একাধিক নি ভাত থাকে। 1950 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সামগ্রিক উন্নয়নের নিরিখে মোট 21-টি পরিকল্পিত প্রদেশ গঠন কর হয়েছে লাউরে পর, 1963 খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের আঞ্চলিক পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্ব দেওয়া হয় 'DATAR (da territonie et a attractive regionale) নামক অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে। এরা, ফ্রান্সের আঞ্চলিক পরিকল্পন রূপায়ণে নির্দিষ্ট একটি আর্থিক বাজেটের প্রস্তাব করার পাশাপাশি, দেশের অন্যান্য আঞ্চলিক পরিকল্পনা রূপায়ণকার প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে যৌথ সমন্বয় বজায় রেখে একাধিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে। বর্তমানে, ফ্রান্সের আঞ্চলিক পরিকল্পনা তথা উন্নয়নের প্রায় সমস্ত কার্যাবলি সেখানকার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিকল্পন (National Economic Plan)-র মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়ে থাকে।
নেদারল্যান্ড (Netherlands)
পশ্চিম ইউরোপের উন্নত ক্ষুদ্র দেশ নেদারল্যান্ডে আঞ্চলিক পরিকল্পনার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এই দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে আজ থেকে প্রায় 400 বছর আগেও সমুদ্র থেকে পুনবৃন্ধারকৃত জমি 'পোল্ডারল্যান্ড' গঠনের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যেত। সেই সময়, নেদারল্যান্ডের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় কৃষিক্ষেত্রগুলিই সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছিল। পরবর্তীকালে, বিশেষ করে 1937 খ্রিস্টাব্দ থেকে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, স্থানীয় সম্পদের সুষম বণ্টন, শিল্প ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিসর বৃদ্ধি, এমনকি পোল্ডারভূমিকে কেন্দ্র করে বসতি অঞ্চল প্রতিস্থাপনের লক্ষ্যে এদেশে বৃহৎ আঞ্চলিক পরিকল্পনাগুলিকে বাস্তবায়িত করার একাধিক কর্মসূচি রূপায়িত হয়। 1941 খ্রিস্টাব্দে জাতীয় পরিকল্পনা কর্মসূচিতে নেদারল্যান্ডের প্রান্তিক অঞ্চলগুলিকেও উন্নয়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়। এই প্রচেষ্টা নেদারল্যান্ডে পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে প্রায় সমানভাবে অব্যাহত ছিল। এ দেশের আঞ্চলিক অর্থনীতিকে আরও সুগঠিত করতে 2016 খ্রিস্টাব্ে Regional Economic Development Strategy (REOS) গ্রহণ করা হয়েছে। এই কৌশল নেদারল্যান্ডের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে সুষম উন্নয়নের আওতায় এনেছে।
বর্তমানে, নেদারল্যান্ডের আঞ্চলিক পরিকল্পনায় পরিবেশের সুরক্ষাগত ক্ষেত্রটিও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই বিষয়ে 2019 খ্রিস্টাব্দে নেদারল্যান্ডে গৃহীত The National Environmental Planning Strategy (NOVI)-টি ছিল উল্লেখযোগ্য একটি পদক্ষেপ। বর্তমানে, নেদারল্যান্ডের আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে সর্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে 2018 থেকে 2022 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রায় 950 মিলিয়ন ইউরো মূল্যের আর্থিক বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে।
উন্নয়শীল বা স্বল্পোন্নত দেশে আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Regional Planning in the Developing or Less Developed World):
বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ উন্নয়নশীল তথা স্বল্পোন্নত দেশে আঞ্চলিক পরিকল্পনার আদর্শগত ভিত্তি এবং আর্থিক সক্ষমতা একসময় কোনোটিই সেভাবে ছিল না। তবে, অতীতে এই সমস্ত দেশগুলিতে আঞ্চলিক পরিকল্পনার যতটুকু বাস্তবায়ন ঘটেছিল, সেগুলিকে অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদী বা ঔপনিবেশিক গোষ্ঠীর বিশেষ উদ্যোগের প্রতিফলন কলা যেতে পারে। কারণ, ব্যাবসাবাণিজ্যের স্বার্থে পোর্তুগিজ, ডাচ, ইংরেজসহ সমস্ত জনজাতি উন্নয়নশীল বেশির ভাগ দেশগুলিতেই তাদের বাণিজ্যিক কলোনিগুলিকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করেছিল।
পরবর্তীকালে, সংশ্লিষ্ট উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঔপনিবেশিক স্বার্থে অর্থনৈতিকভাবে আগ্রাসন করার বিবিধ লক্ষ্যে নতুন করে বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, আঞ্চলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন ঘটতে থাকে। বিশেষ করে, ভারতে চা, পাট, নীল চাষের জন্য প্রতিষ্ঠিত রেলপথ স্থাপনের পরিকল্পনা, বাংলায় কৃষিভিত্তিক ভূমি ব্যবহার প্রণালীর পরিবর্তন ঘটিয়ে কলকাতা মহানগরী গঠনের পরিকল্পনা, কিউবা এবং ফিজিতে বাগিচা ফসল বুপে আষ চাষের ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি পদক্ষেপ ছিল সংশ্লিষ্ট দেশগুলির আঞ্চলিক পরিকল্পনার উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
অবশ্য, অনুন্নত তথা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও, এখানকার নগরায়ণকে ঘিরে অতি ধীর গতিতে হলেও বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিকল্পনার যুগোপযোগী নীতির বাস্তবায়ন ঘটেছে। এখানকার অধিকাংশ নগর কাঠামোমূলক পরিকল্পনায় বেন ওয়াটারসনের প্রস্তাবিত 'Urban Model'-কেই সর্বাধিক অনুসরণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলিতে বেশ কিছু প্রচলিত সমস্যা সমাধানের কৌশলী পথ ধরেই বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটেছে। এই ধরনের সমস্যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল-
(1) দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, (ii) সম্পদকেন্দ্রিক সংকট অথবা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব, (iii) দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো (iv) সামাজিক অনগ্রসরতা, (v) প্রযুক্তিগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার অভাব, (vi) রাজনৈতিক অস্থিরতা, (vii) আঞ্চলিক পরিকল্পনা রূপায়ণে সুষ্ঠু পরিকাঠামো এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, (viii) প্রাথমিক চাহিদা (খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান) মেটানোর অক্ষমতা এবং (EN) দুর্ভিক্ষ-মহামারী-প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রভৃতি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, উল্লিখিত সমস্যাগুলিকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করতেই ব্রাজিল, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ঘানা প্রভৃতি দেশের জাতীয় তথা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খলভাবে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষ করে-
(a) ব্রাজিলে 'O Estatuto da Cidade (The city Stature) নামক বিশেষ পৌর পরিকল্পনা আইন মোতাবেক দেশের বিভিন্ন প্রান্তে উন্নত নগর কাঠামো গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
(b) ভেনেজুয়েলার গায়ানা অঞ্চলে CVG (Corporation Venezolana de Guyana)-এর তত্ত্বাবধানে ইস্পাত কারখানা এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রণয়ন।
৫) নাইজেরিয়ায় লাগোস, ইবাভান, কানে, পোর্ট হারকোর্ট-এর মতো উন্নত নগর কাঠামো রূপায়ণ এবং 'Niger Delta Development Board (NDDB), Oil Minerals Producing Area Development Commission (OMPADEC) প্রতিষ্ঠা।
৫) কলোম্বিয়ায় 'Territorial Development Law-1997', 'Land Use Master Plan'-এর প্রতিষ্ঠা।
আধগুলিক পরিকল্পনার প্রয়োজীয়তা বা উদ্দেশ্য(Need or Objectives of Regional Planning):
আঞ্চলিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্যগুলি বহুমুখী হয়ে থাকে, যথা-
• আঞ্চলিক বৈষম্য কমানো (Reduce regional disparities): পৃথিবীর সমস্ত অঞ্চলে সম্পদ এবং পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রগুলি সমানভাবে বণ্টিত না থাকার কারণে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে বিশেষ করে, গ্রাম এবং শহরাঞ্চলগুলিতে এই ধরনের বৈষম্যতা সবচেয়ে বেশি। সেই কারণে, আঞ্চলিক পরিকল্পনার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল স্থানীয় এবং আঞ্চলিক স্তরের সমস্ত ধরনের বৈষম্য দ্রুত হ্রাস কর।
• সামগ্রিক উন্নয়ন সুনিশ্চিতকরণ (To ensure the integrated development): একটি দেশ ব রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সার্বিক উন্নয়নের একমাত্র কার্যকরী পদক্ষেপ হল আঞ্চলিক পরিকল্পনা। বর্তমানে, সামগ্রিক উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে অধিকাংশ দেশ তাদের পরিকল্পনার লক্ষ্যগুলিকে আঞ্চলিক বিভিন্ন অনুক্রমে পরিচালিত করে থাকে।
• সম্পদের অপচয় রোধ (Prevent wastage of resource): কোনও একটি দেশের বিভিন্ন সহায়ক সম্পদের অপচয় রোধ করার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক পরিকল্পনা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধিবদ্ধ পদক্ষেপ। যে দেশে সম্পদের অপচয় যত বেশী, উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তারা ততোধিক পিছিয়ে থাকে। সেই কারণে আঞ্চলিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
• আঞ্চলিক বাস্তবতা অনুধাবন (To recognize the regional realities): ভবিষ্যতে কোনো একটি স্থানে যাতে উন্নয়নের কৌশলগত ধারাবাহিকতা বজায় থাকে, সেজন্য আঞ্চলিক সমস্যা-সম্ভাবনার বাস্তবতাগুলিকে আগে থেকে উপলব্ধি করতে বিভিন্ন পরিকল্পনামূলক নীতির সাহায্য নেওয়া হয়।
• সম্প্রদায়কে শক্তিশালীকরণ (Strengthening communities): দেশের পিছিয়ে পড়া বিভিন্ন জনসম্প্রদায়কে আর্থ-সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের স্রোতে এগিয়ে দিয়ে, তাদের সার্বিক সক্ষমত বৃদ্ধির জন্য আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
• প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান (Provides effective services): পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষেরই সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে। সেই কারণে, দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সেবামূলক যেমন-খাদ্য, পানীয়, অর্থ, চিকিৎসা, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রভৃতি) কার্যক্রমকে সঠিকভাবে পরিচালিত করার উপযুক্ত কৌশল হল আঞ্চলিক পরিকল্পনা।
• আবুলিক গতিশীলতা বজায় রাখা (Maintaining regional mobility): কোনোও একটি দেশে গ্রাম থেকে ব্লক, ব্লক থেকে জেলা এবং জেলা থেকে প্রাদেশিক ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধকরণ এবং জাতীয় তথা আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রাখতে আঞ্চলিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়ে থাকে।
শিল্পায়ন (Industrialization) : আঞ্চলিক পরিকল্পনার নীতিগুলি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে যেকোনও দেশের শিল্প-পরিকাঠামোকে বৃদ্ধি করতে যেমন প্রযোজ্য হয়, একইভাবে নতুন শিল্পকেন্দ্রের বিকাশ এবং রুগ্ন শিল্পগুলির পুনর্বিন্যাসেও যথেষ্ট কার্যকরী প্রেরণা জুগিয়ে থাকে।
• সমস্যা সমাধান (Problem Solving): আঞ্চলিক পরিকল্পনায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, অপুষ্টি, আয়বৈষম্য, লিঙ্গভঙ্গবৈষম্য, নিরক্ষরতা-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যাকে প্রতিহত করার বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
• নগর কাঠামোর উন্নয়ন (Development of Urban Structure): কোনও একটি অঞ্চলে শহর বা নগর কাঠামোর সম্প্রসারণ, নগরের সুষম বৃদ্ধি এমনকি নগরকেন্দ্রিক যাবতীয় পরিসেবা বজায় রাখতে আঞ্চলিক পরিকল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়।
• অন্যান্য (Others): এ ছাড়াও, কোনও একটি দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, জাতীয় আয় ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, শিক্ষার উন্নয়ন, মানবসম্পদের উন্নতি এমনকি জীবনযাত্রার সার্বিক মানোন্নয়নে আঞ্চলিক পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
■ আঞ্চলিক পরিকল্পনার নীতি (Principles of Regional Planning):
অঞ্চলিক পরিকল্পনা বেশ কিছু নির্দিষ্ট নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে "Utopian World: A paradisalJourney নামক একটি আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে আঞ্চলিক পরিকল্পনার যে সাতটি উল্লেখযোগ্য নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলি হল-
1. ঘটনার উল্লম্ব একতার নীতি (The Principle of Vertical Unity of Phenomena):
প্রাকৃতিকভাবে অথবা প্রণোদিতভাবে সৃষ্ট। কর্মকান্ডের বিশেষ এক আধার। যার ফলে, এখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং মানবীয় উপাদান তথা ঘটনাবলী পরস্পর একে অপরকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে থাকে। এই ধরনের মিথস্ক্রিয়াকে সামনে রেখেই আঞ্চলিক পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ নীতিগুলি স্থিরিকৃত হয়। বিশেষ করে, সামগ্রিক পরিসরে ক্রিয়াশীল যেকোনও জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত প্রতিটি ঘটনাকে একটি সুসংহত কাঠামোয় ফেলে, সেগুলিকে উল্লম্ব একতার নীতি অনুযায়ী যথাযথ বিশ্লেষণ করা হয়। এইভাবে, পার্থিব শিলামন্ডল, বারিমণ্ডল, বায়ুমণ্ডল প্রভৃতি আধারগুলিতে আর্থ-সামাজিক ও মানবীয় পরিমন্ডলকে ঘিরে উন্নয়নের পরিমাণগত এবং গুণগত দিকগুলিকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। এইভাবে প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক ঘটনাবলীর আমমারী ও অবিকল্পনার উত্তম একতার নীতিটিকে R. C. Chandra প্রদত্ত ধারণাচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন ক হল (Pc-4.16)।
2. আনুভূমিক স্থানিক ঐক্যের নীতি (Principle of Horizontal Spaital Unity):
সাধারণত আঞ্চলিক পরিকল্পনার আনুভূমিক সম্মানিক ঐক্যের নীতিটি পাশাপাশি বিভিন্ন অনন্তলের পরিকল্পনাকেন্দ্রিক আন্তঃসম্পর্ককে বিশেষভাবে প্রতিফলিত
এককভাবে কোনও অঞ্চলই যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তেমনই পৃথিবীতে গঠনগত এবং কার্যকরী দিক থেকে গড়ে ওঠা কোনও একটি অঞ্চলের মধ্যে আবার একাধিক উপ-অঞ্চল তার নিজস্ব সত্তা অনুযায়ী উপস্থাপিত হয়। বিশেষ করে, কোনও একটি দেশের জাতীয় তথা আঞ্চলিক পরিসরটি যেমন প্রাদেশিক উপ-আঞ্চলিক পরিসর ছাড়া অসম্পূর্ণ, তেমনই জাতীয় পরিসরকে বাদ দিয়ে আঞ্চলিক পরিকল্পনা গঠনের কথা চিন্তাই করা যায় না। সেই কারণে, সফলভাবে কোনও আঞ্চলিক পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানোর লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি উপ-একক অঞ্চল বা ক্ষুদ্র পরিসরগুলির মধ্যে অনুভূমিক ঐক্যের সম্পর্কটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আঞ্চলিক পরিকল্পনায় এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি স্থানিক ঐক্য অনুধাবনের কার্যকরী এক নীতিরূপে উন্নয়নকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। সংশ্লিষ্ট ধারণাচিত্রে (Pic-4.17) বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিসরের অনুভূমিক সম্পর্কের ঐক্যের বিষয়টিকে দেখানো হয়েছে।
আর্থিক পরিকল্পনার অনুভূমিক সম্পর্ক নীতি
3. স্থান ও কালের ধারাবাহিক নীতি (The Principle of Space time continuum):
সস্থানিক পরিকল্পনার কাঠামোর সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের একটি বিশেষ সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। কারণ, বিশ্বের বেশির ভাগ অঞ্চলেই যে সমস্ত পরিকল্পনা প্রচলিত রয়েছে, সেগুলির জন্য স্বল্পকালীন অথবা দীর্ঘকালীন একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ধার্য করা হয়। বহুমাত্রিক স্থানিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের ধার্যকাল সমগ্র পরিকল্পনাটিকেই একটি সুসংহত কাঠামোয় বেঁধে রাখে। এর ফলে, আঞ্চলিক পরিকল্পনার সিদ্ধান্তগুলি দ্রুত বাস্তবায়িত করে, ভবিষ্যতের মূল লক্ষ্যকে অটুট রাখা যায়। সুতরাং, আঞ্চলিক পরিকল্পনায় স্থান ও সময়ের ধারাবাহিক নীতিটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নির্দেশনার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
4. সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের নীতি (The Principle of Comprehensive Development):
কোনও একটি দেশ বিকাশের সর্বোচ্চ স্তরে তখনই পৌঁছায়, যখন সেখানকার অঞ্চলভিত্তিক একাধিক বৈষম্যের নিরসন ঘটিয়ে সার্বিক কল্যাণসাধন সংক্রান্ত বিষয়টি অটুট থাকে। তাই, আঞ্চলিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু এবং দীর্ঘমেয়াদি কৌশলে সর্বাঙ্গীন উন্নয়নের নীতিকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বর্তমানে, ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়ন তথা পরিকল্পনায় "সকলের সাথে সকলের বিকাশ" নীতিটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
5. সম্প্রদায়ের উন্নয়নের নীতি (The Principle of Community Development):
সমাজে সকল সম্প্রদায়ের জন্য সমতার দৃষ্টিকে সামনে রেখে সমষ্টিগত উন্নয়নের লক্ষ্যই হল সুপরিকল্পিত আঞ্চলিক পরিকল্পনার আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক নীতি।
6. সামাজিক কাম্যতা এবং পরিবর্তনশীল অর্থনীতির ভারসাম্যের নীতি (The Principle of Equilibrium between Social Desirability and Economic Viability)
অধিকাংশ আঞ্চলিক পরিকল্পনাবিদ মনে করেন, জনসমষ্টির সার্বিক কল্যাণমূলক আঞ্চলিক পরিকল্পনার বিষয়টি সামাজিক আকাঙ্ক্ষা এবং অর্থনীতির যাবতীয় উপাদানের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্কের ওপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। সেই কারণে, আঞ্চলিক পরিকল্পনার নীতিতে কাম্য সমাজ গঠন এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যাবস্থার অনুমোদনকে বিবেচনা করা হয়।
7. বাক্তৃতান্ত্রিক ভারসাম্যের নীতি (The Principle of Ecological Equilibrium):
আঞ্চলিক পরিকল্পনার নীতিতে বর্তমানে যে বিষয়টি নতুনভাবে সংযোজিত হয়েছে সেটি হল বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই পরিবেশের গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখেই উন্নয়নমূলক যাবতীয় আঞ্চলিক পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রচেষ্টা করে থাকে।
8. বিভিন্ন প্রকার আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Different types of regional planning):
কোনও একটি রাষ্ট্রের পরিমণ্ডলে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন-
(A) প্রকৃতি অনুসারে (According to the purpose of planning):
প্রকৃতি অনুসারে আঞ্চলিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রগুলি মোটামুটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত, যথা-
1. ভূমি ব্যবহারগত পরিকল্পনা (Land use Planning):
যে পরিকল্পনায় কোনও একটি অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বিভিন্ন সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাকে নিরসন করতে ভূমির ব্যাবহারিক রূপান্তর ঘটিয়ে স্থানীয় জনসম্প্রদায়ের কল্যাণ করা হয়, তাকেই ভূমি ব্যবহারগত পরিকল্পনা বলা হয়।
• লক্ষ্য (Vision): (1) বিভিন্ন প্রতিবন্ধক বা অবহেলিত ভৌগোলিক পরিসরকে পরিকল্পনাভুক্ত করা। (৪) ভূমিভাগের যাবতীয় সম্পদগত সমস্যা অনুধাবন ও তার মোকাবিলা। (iii) বিভিন্ন ভূ-প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়
সমীক্ষা এবং তার প্রতিরোধমূলক সক্ষমতা বৃদ্ধি। (iv) প্রকৃতির মধ্যে সুশৃঙ্খল নান্দনিক ভূ-সংস্থানিক কাঠামোর সম্প্রসারণ প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality) (1) ভূমিব্যবহারগত পরিকল্পনাগুলি অথবা ক্ষুদ্র বৃহদাঞ্চলভিত্তিক হয়ে থাকে। (ii) এই ধরনের পরিকল্পনায় ভূমিভাগের বাহ্যিক কাঠামোর সঙ্গে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রের সামঞ্জস্যবিধান করা হয়। (i) বেশির ভাগ ভূ-প্রাকৃতিক পরিকল্পনাগুলি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত Civil এবং Military Engineer-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে।
• দৃষ্টান্ত: পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিধস ঠেকানোর পরিকল্পনা, মরুভূমি সম্প্রসারণ রোধের পরিকল্পনা প্রভৃতি।
2. অর্থনৈতিক পরিকল্পনা (Economic Planning):
পরিকল্পিতভাবে কোনও একটি দেশে প্রাপ্ত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, সামগ্রিক উৎপাদন, বিনিয়োগ এবং বন্টনের যাবতীয় কার্যক্রমকে সামনে রেখে মানবকল্যাণের লক্ষ্যে কৌশলগত বিভিন্ন প্রচেষ্টাকেই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বল। হয়। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ধারণাটিকে নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, যেমন-
* Herman Levy-এর মতে, Economie platining means swearing a better balance between demand and suply by conscious and thoughtfed contrat either of production or distribution' অর্থাৎ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মানে সচেতন এবং চিন্তাপূর্ণভাবে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যকে সুরক্ষিত করা, অন্যথায় উৎপাদন বা বণ্টনকে নিয়ন্ত্রণ করা।
H. D Dickirson বলেছেন- Econome planning is the making of major economic decisions te and how much to to be produced, how, when and where it is to be produced, and to when it to be allocated by the comprehensive survey of the economic system as whole অর্থাৎ, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা হল অর্থনীতির প্রধান সিদ্ধান্তসমূহ কী ধরনের এবং কীভাবে নেওয়া যেতে পারে তা প্রতিপন্ন করে কীভাবে, কখন এবং কোথায় এটিকে সমগ্র অর্থনৈতিক কাঠামোয় বরাদ্দ করা যেতে পারে সেটিকে সার্বিক নিরীক্ষণের মাধ্যমে স্থির করা। • লক্ষ্য (Vision): (1) উৎপাদনের সঙ্গেঙ্গ ক্রমবর্ধমান চাহিদা তথা ভোগ ব্যবস্থার সঠিক ভারসাম্য বজায় রাখা।
ii) আঞ্চলিক এবং উপ-আঞ্চলিক স্তরে দারিদ্রদ্র্য নিরসনে অর্থনৈতিক মর্যাদায় সাম্যতা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা।
(iii) শিল্প, পরিবহণ, বাণিজ্য, পরিকাঠামোসহ দেশীয় অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়ন।
(iv) দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে বেকারত্বের হার কমানো।
(v ) ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আর্থ-সামাজিক ব্যবধান কমিয়ে এনে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন বৃদ্ধি ঘটানো প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality): (1) অর্থনৈতিক পরিকল্পনা একটি পুনরাবৃত্তিমূলক প্রক্রিয়া, যেখানে পুঁজি বা পণ্য সঞ্চালনের বিশেষ ভূমিকা থাকে। (৪) আংশিক বা সামগ্রিক এই পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা স্বল্পমেয়াদি (1-2 বছর) এবং দীর্ঘমেয়াদি (5-10 বছর) উভয়ই হতে পারে। (iii) এই ধরনের সুচিন্তিত পরিকল্পনায় রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক অভীষ্টকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়।
• দষ্টান্ত 1930-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনুসরণ করে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল। ভারতের প্রথম অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ছিল 1944 খ্রিস্টাব্দের 'বোম্বে পরিকল্পনা। অবশ্য প্রথমদিকে ভারতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও ছিল এই প্রকৃতির।
3. সামাজিক পরিকল্পনা (Social Planning):
পরিকল্পনা, যার মধ্য দিয়ে কোনও অঞ্চলে সামাজিক সামাজিক সম্ভাব
সামাজিক পরিকল্পনা হল এমন একটি বসবাসকারী প্রতিটি ব্যক্তিকে উপযুক্ত নিরাপত্তা ও বিভিন্ন সহায়তা প্রদান করে সামাজিক ভারসাম্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার পাশাপাশি সামাজিক জীবনযাত্রাকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তোলা হয়। সামাজিক পরিকল্পনার বিষয়টিকে "Social Policy" রূপেও দেখা হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ জন মার্শাল বলেছেন- "Social Policy refers to the Policy of Governments with regard to action having a direct impact on the welfare of citizens, by providing them with service or income ।
শহরাঞ্চলগুলিতে সামাজিক পরিকল্পনাগুলির কীভাবে বাস্তবায়ন ঘটানো যায়, এ বিষয়ে 1995 খ্রিস্টাব্দে Checkoway বিশেষভাবে গবেষণা করেছিলেন।
• লক্ষ্য (Vision): Rothman (1979 খ্রিঃ)-এর মতে, সামাজিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হল-
সম্প্রদায়গত বিভিন্ন সমস্যার দূরীকরণ।
সম্প্রদায় ভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহকরণ।
সমাজ ও সম্প্রদায়কে সঠিকভাবে অনুশীলন।
ধারাবাহিকভাবে সমাজকে সচল ও উন্নততর করে তোলা প্রভৃতি।
•বিশেষত্ব (Speciality): (1) এটি সামাজিক সেবাপ্রদানমূলক একটি নির্ধারিত কর্মসূচি। (ii) এই পরিকল্পনার অধিকাংশ কর্মসূচিই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা সরকারি কর্মসূচির মাধ্যমে স্থির করা হয়। (iii) সামাজিক পরিকল্পনা রূপায়ণের পথ মানুষকে পরোক্ষভাবে আর্থিক সচ্ছলতা এনে দেয়। সেই কারণেই Lederer (1933 খ্রিঃ) বলেছেন-
frection of modern society would seem to be toward a planned econuniy
• দৃষ্টান্ত: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে গ্রেট ব্রিটেন, রাশিয়া, জার্মানি সহ ও একাধিক দেশে সামাজিক পরিকল্পনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। 1960-এর দশক থেকে community development'-এর মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলিও সামাজিক পরিকল্পনায় মনোনিবেশ ঘটাতে শুরু করে।
4. পরিবেশগত পরিকল্পনা (Environmental Planning):
যে সমস্ত পরিকল্পনায় স্থানীয় তথা আঞ্চলিক পরিবেশ-পরিস্থিতির গুণগত মান অক্ষুন্ন রেখে মানুষের কল্যাণে স্থিতিশীল এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার পথকে আরও সম্প্রসারিত করে তোলা হয়, তাকেই পরিবেশগত পরিকল্পনা বলা হয়। ফিলিপাইন্সের 'The Republic Act-1987' অনুসারে পরিবেশগত পরিকল্পনা হল- 'a multi-disciplinary art and science of analyzing, specifying, clarifying, harmonizing, managing and regulating the use and development of land and water resources, in relation to their environs, for the development of sustainable communities and ecosystems."
• লক্ষা (Vision): (1) পরিবেশীয় কাঠামো বিনষ্টকারী বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং অ-প্রাকৃতিক অবাঞ্ছিত উপাদনগুলিকে চিহ্নিতকরণ।
(ii) বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে পরিবেশের বিভিন্ন উপাদানের গুণমানভিত্তিক স্বাভাবিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা।
(1) প্রাকৃতিক সম্পদ (জল, মাটি, বাতাস, অরণ্য), বাস্তুতন্ত্র এবং বিভিন্ন লুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ ও প্রাণী-প্রজাতির সুরক্ষা প্রদান।
বিভিন্ন দূষণ এবং দুর্যোগগুলির প্রশমন প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality): (1) পরিবেশগত পরিকল্পনাটি বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সংযোগী একটি সুস্থ বা স্থিতিশীল প্রক্রিয়া।
পশ্চিম আফ্রিকার উপকুলীয় পরিবেশ পরিকল্পনা
(ii) এই ধরনের পরিকল্পনাগুলি জাতীয় তথা আন্তর্জাতিক স্তরে গৃহীত হয়।
iii) সমস্ত পরিবেশগত পরিকল্পনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়কালে প্রণয়ন করা হয়।
iv) পরিবেশকেন্দ্রিক পরিকল্পনাগুলিতে সকল রাষ্ট্রের সহমত বা সমন্বয়ী ভাবনার বিশেষ প্রতিফলন ঘটে থাকে।
• দৃষ্টান্ত: The Association of Environmental Professionals (AEP) এবং U. S. Green
Building Council (USGBC) নামক সংস্থা দুটি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পরিবেশগত সুরক্ষা ব্যবস্থাপনায় একাধিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে পরিবেশগত পরিকল্পনায় যে সমস্ত ক্ষেত্রে প্রধান ব্যবস্থাপনা রূপে
সর্বাধিক গরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল- (a) কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনামূলক পরিকল্পনা।
আপৎকালীন ব্যবস্থাপনা, (৫) পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও শক্তি ব্যবস্থাপনা (৫) জলসম্পদ ব্যবস্থাপনা
5. উন্নয়ন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা (The Development Specific Planning):
কোনো একটি দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিসেবাগত ক্ষেত্রের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সুচিন্তিতভাবে উপযুক্ত সময়কাল ধার্য করে যে সার্বিক পরিকল্পনামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, তাকেই উন্নয়ন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা
• লক্ষ্য (Vision):
(1) উৎপাদন এবং পরিসেবা প্রদানমূলক কোনো একটি ক্ষেত্রের সামগ্রিক সমৃদ্ধিকরণ।
(ii) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।
(iii) আঞ্চলিক তথা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে অধিকতর স্বনির্ভরতা অর্জন।
(iv) জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম চাহিদাগুলিকে সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া।
(V) সমাজ-সংস্কৃতি অর্থনৈতিক প্রতিটি ক্ষেত্রের মধ্যে সার্বিক সমন্বয়সাধন।
(vi) সার্বজনীন শিক্ষা ও মানবসম্পদের বিকাশসাধন প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality): (1) উন্নয়ন-নির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রতিটি রাষ্ট্রেরই ধারাবাহিক এবং সুস্পষ্ট নীতিভিত্তিক একটি দায়বদ্ধতাপূর্ণ পদক্ষেপ।
(ii) এই ধরনের পরিকল্পনা মানুষের জীবনযাত্রার সর্বাঙ্গীন মানোন্নয়নের সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
( iii) কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, বাণিজ্য সংক্রান্ত সমস্ত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
(iv) বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্য দিয়েই যে-কোনও রাষ্ট্রের জনকল্যাণকামী আদর্শ সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত করে
• দৃষ্টান্ত: বর্তমানে ভারতে NITI আয়োগ কয়েকটি ক্ষেত্রকে বেছে নিয়ে যে ধরনের সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে আসছে, সেটি একটি উন্নয়ন নির্দিষ্ট আঞ্চলিক পরিকল্পনা। আবার, দেশের পরিবহণ সংক্রান্ত পরিকল্পনাগুলি এই প্রকৃতির।
(B) পরিকল্পনা সম্পাদনের ভিত্তিতে (Based on the execution of planning):
1. কেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Centralised Regional Planning):
দেশের যে সমস্ত পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী কোনও জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মুখ্য পরিচালনাধীনে গৃহীত হয়, তাকেই কেন্দ্রীয় আঞ্চলিক পরিকল্পনা বলা হয়।
• লক্ষ্য (Vision): (i) আঞ্চলিক তথা প্রাদেশিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উন্নয়নকে বিশেষভাবে অগ্রাধিকার প্রদান।
(ii) অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় এবং মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রচেষ্টা।
(iii) আঞ্চলিক স্তরে যাবতীয় বৈষম্যের অবসান ঘটানো।
(iv) জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে রাষ্ট্রের জনকল্যাণকামী ভাবমূর্তি প্রদর্শন প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality): (1) এই ধরনের পরিকল্পনা রূপায়ণে কোনও একটি দেশের রাষ্ট্র ধানের প্রতিনিধিত্বে থাকা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা কমিটির বিশেষজ্ঞদের মুখ্য ভূমিকা থাকে।
(ii) সমগ্র পরিকল্পনাটিকে জাতীয় সরকারের নির্বাচিত নির্দিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা মানাতা পায়।
নির্দিষ্ট সময়কালভিত্তিক কেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক পরিকল্পনার অধিকাংশ লক্ষ্যমাত্রা ও নীতিগুলিকে সমষ্টিগত কৌশল আকারে বিবেচনা করা হয়।
• দৃষ্টান্ত: ভারতে 1952 খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য National Development Council-কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
2. বিকেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Decentralised Regional Planning):
যে সমস্ত পরিকল্পনা সমগ্র দেশের প্রান্তিক অঞ্চল পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে উন্নয়নের উপযুক্ত লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করে প্রশাসনিক নিম্নতম স্তর থেকে রূপায়িত হয়, তাকেই বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা বলে।
• লক্ষ্য (Vision): (i) কোনও বৃহৎ অঞ্চলের মধ্যে থাকা একাধিক উপ-অঞ্চলগুলিকে নির্দিষ্ট পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা।
ii) স্থানীয় এবং সম্প্রদায় ভিত্তিক উন্নয়নের পরিসর বৃদ্ধি করা।
(1) আঞ্চলিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সমষ্টিগত প্রত্যাশা বা মনোভাবগুলিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া।
(iv) আঞ্চলিক বিভিন্ন স্তরে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, পরিসেবাগুলির সমবন্টনের ব্যবস্থা করা প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality) (1) বিকেন্দ্রীভূত আঞ্চলিক পরিকল্পনায় গ্রাম স্তর, ব্লক স্তর, জেলাস্তর প্রভৃতিক্রমান্বয়ে গুরুত্ব পায়। (1) বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনায় রাজ্য প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। (iii) এই ধরনের পরিকল্পনায় ভবিষ্যৎ পন্থা নির্ধারণ, নীতি অনুমোদন বা রূপায়ণ এবং বাস্তবায়নে আঞ্চলিক কাঠামোর নিম্নস্তরে থাকা বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ সহমত বিশেষ গুরুত্ব পায়।
• দৃষ্টান্ত: ভারতের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে সফলভাবে দেশের সর্বস্তরে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা রূপায়ণের নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল।
পরিকল্পনা নীতির প্রয়োগমূলক ক্ষেত্রের ভিত্তিতে (Based on the applied field of planning policy):
অন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Intra Regional Planning):
যখন কোনও একটি নির্দিষ্ট একক আঞ্চলিক সীমানার মধ্যেকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়, তাকে অন্তঃ আঞ্চলিক বা আন্তঃ স্থানীয় পরিকল্পনা বলে।
লক্ষ্য (Vision): (i) একক আঞ্চলিক বা স্থানীয় স্তরে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন, স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবহণ সংক্রান্ত সমস্যা এবং জনঘনত্বজনিত সমস্যার নিরসন।
(ii) শিল্পায়ন, পরিকাঠামো বৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সমষ্টিগত সুযোগ সৃষ্টি।
(ii) পৌরায়ণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা।।
স্থানীয় পরিবেশ পরিস্থিতি রক্ষণাবেক্ষণ
দৃষ্টান্ত: 1960 থেকে 1970-এর দশকে যুক্তরাজ্যের সর্বাধিক জনবহুল শহরাঞ্চলগুলিতে 'Garden city তৈরির কৌশলটি আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে রূপায়িত হয়।
আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনা (Inter Regional Planning):
যে সমস্ত পরিকল্পনায় পার্শ্বস্থ কোনো দুই বা ততোধিক অঞ্চলের বিভিন্ন সমস্যা নিরসন করতে অধ্য আর্থ-সামাজিক সমতা রক্ষা করার জন্য গৃহীত হয়, তাকেই আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনা বলে।
• লক্ষ্য (Vision): (১) বিভিন্ন অঞ্চলের
আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিকে নির্ধারিত পরিকল্পনার আওতাভুক্ত করা।
(ii) বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সম্পদ ও পরিসেবার সর্বোত্তম ব্যবহার ও সেগুলির সামঞ্জস্যপূর্ণ বণ্টন।
(iii) বিভিন্ন আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ তথা আঞ্চলিক ভারসাম্য বৃদ্ধি (Balanced Growth) ঘটানো।
(iv) নগরায়ণের প্রসার প্রভৃতি।
• বিশেষত্ব (Speciality): (1) এটি প্রাদেশিক অঞ্চলগুলির উন্নয়নে গৃহীত একটি সমন্বয়মূলক পরিকল্পনা। (৪) মূলত বহু উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গৃহীত এই পরিকল্পনাগুলি দীর্ঘমেয়াদি প্রকৃতির।
(a) অন্তা আঞ্চলিক পরিকল্পনা, (b), আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনা (c) অন্তঃ এবং আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনার সমন্বয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে বা জাতীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে অধিকাংশ আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনাগুলি রূপায়িত হয়।
• দৃষ্টান্ত: নরওয়ে, ইটালি প্রভৃতি দেশে আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনা সর্বাধিক জনপ্রিয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে আঞ্চলিক পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে এই দুটি প্রক্রিয়ায় পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলির যৌথ সমন্বয় ঘটানো হয়। কারণ, এই ধরনের পরিকল্পনাগুলির মধ্যে একটিকে সহায়ক এবং অপরটিকে পরিপুরক পরিকল্পনারূপে আখ্যায়িত করা হয়। সংশ্লিষ্ট 4.21 নং ধারণাচিত্রে অন্ত আঞ্চলিক এবং আন্তঃ আঞ্চলিক পরিকল্পনাটির সমন্বয়ী কাঠামোটিকে উপস্থাপন করা।