আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের গাঠনিক রূপ (Regional diversity)
সাধারণত কোনও একটি ভৌগোলিক এলাকায় থাকা বিভিন্ন প্রাকৃতিক, আর্থসামাজিক এবং মানব-সাংস্কৃতিক উপাদানগুলির সুদুরপ্রসারী এবং স্বতন্ত্রতার মিশ্রণ হল আঞ্চলিক বৈচিত্রা (Regional diversity is the combinations of the far-reaching and uniqueness of the various natural, socio-economic and human-cultund elements that are usually present in a geographical area)
• উদাহরণস্বরূপ, ভারতের মহান আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের সমারোহে এখানকার পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র উপকূল, মরুভূমি, সমতল এলাকা, মাটি, অরণ্য, সম্প্রদায়, জাতি, লিঙ্গ, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি সমস্ত বিষয়গুলিকে সমানভাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
■ আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের বিশেষত্ব (Speciality of Regional Diversity):
আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের উল্লিখিত ধারণাটিকে সামনে রাখলে এর বেশ কয়েকটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যাবে, যেমন -
(i) কোনো দেশের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য ভৌগোলিক বাস্তবতার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিচ্ছবির।
(ii) আঞ্চলিক বৈচিত্র্য সর্বদা বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং অপ্রাকৃতিক উপাদানের রকমভেদ (Variety)-কে উপস্থাপন করে থাকে।
(iii) আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রটি সর্বদা বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী।
(iv) আঞ্চলিক বৈচিত্র্য দ্বারা দৃশ্যমান প্রতিটি ভৌগোলিক উপাদান এবং তার মিথস্ক্রিয়া ইঙ্গিত করে থাকে।
(v) আঞ্চলিক বৈচিত্রার প্রকাশ স্থানীয়, প্রাদেশিক এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্নভাবেই প্রকাশ করা যেতে পারে।
■ আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের বিভিন্ন রূপ(Different forms of Regional Diversity):
সাধারণত আঞ্চলিক বৈচিত্র্যকে অন্তর্ভুক্তিকরণের জন্য, এর যে সমস্ত রূপ লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে কয়েকটি অন্যতম হল-
• প্রাকৃতিক বৈচিত্রা (Natural diversity): প্রকৃতিকে সর্বদা বৈচিত্র্যের আধাররূপে বিবেচনা করা হয়। কোনও একটি দেশের ভূসংস্থান বা ভূমিরূপ, জলবায়ু, মৃত্তিকা, জলাশয়, অরণ্য, এমনকি জীবসম্প্রদায়ের ভৌগোলিক প্রাচুর্যতার সমাহারকেই সাধারণত প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য বলা হয়। যেমন-ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক কিংবা জলবায়ুগত বৈচিত্র।
যেমন-আঞ্চলিক উন্নয়নের নিরিখে ভারতের সম্পদ অঞ্চলগুলির মধ্যে অন্যতম হল পূর্ব হিমালয় অঞ্চল, নিম্ন গাচ্ছোয় সমতল অঞ্চল, মধ্য, গাঙ্গোয় সমতল অঞ্চল, উচ্চ গাঙ্গোয় সমভূমি অঞ্চল, ট্রান্স গায়ে সমতল অ পূর্ব মালভূমি এবং পার্বত্য অঞ্চল, পশ্চিম মালভূমি এবং পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতি।
• জীব বৈচিত্র্য (Biodiversity): পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন ধরনের প্রাণী এবং উদ্ভিদ প্রজাতির সামগ্রিক সমাহারকেই জীববৈচিত্র্য বলা হয়। 1986 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে "বায়োডাইভার্সিটির ওপর জাতীয় ফোরাম"-এ জীববৈচিত্রোর আঞ্চলিক বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। জীববৈচিত্র্যের এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লুপ্তপ্রায় জীং প্রজাতিকে রক্ষা, জীবজগতের ভারসাম্য এবং সুস্থতার দিকগুলিকে সুরক্ষিত করালেও, পৃথিবীর এমনকিছু অঞ্চল রয়েছে যেগুলি সেখানে উপলব্ধ বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবপ্রজাতি দ্বারা বিশেষ পরিচিতি পায়।
যেমন-প্রায় 3 মিলিয়নেরও অধিক জীবপ্রজাতি নিয়ে গঠিত আমাজনের চিরসবুজ অরণ্য অঞ্চল হল Biological Hotspot'-এর সর্বাধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আধার।
• সাংস্কৃতিক বৈচিত্রা (Cultural diversity): কোনও একটি অঞ্চলে এক বা একাধিক জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি এবং সামাজিক আচরণগুলি সাংস্কৃতিক বৈচিত্র। আকারে প্রতিফলিত হয়। এই ধরনের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রোর ধারা সাধারণত এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে ক্রমান্বয়ে স্থানান্তরণ ঘটে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্রা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতাগুলির একাধিক নিদর্শনকে সযত্নে সংরক্ষণ করে থাকে। বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে সাথে নিয়ে প্রতিটি জনসম্প্রদায় তাদের নিজস্ব ভাবধারাগুলিকে আরও সক্রিয় এবং সুন্দর করে তোলে।
কোনো একটি সমাজে জাতি, ধর্ম, ভাষা, 1994 খ্রিস্টাব্দ থেকে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিবেচনায় বিভিন্ন সংস্কৃতির বিভিন্ন সমন্বয়ী অবস্থার তাৎপর্যপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ হল সামাজিক বৈচিত্র্য।
আন্তর্জাতিক স্তরে, 1945 খ্রিস্টাব্দে জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক চেতনা ও সাংস্কৃতিক ভাবধারাগুলিকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে রক্ষা করার একাধিক প্রয়াস শুরু হয়েছিল। পরবর্তীকালে, সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করার জন্য একটি আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য, 2001 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে আন্তর্জাতিক স্তরে সংস্কৃতির বিস্তার এবং সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়ে তুলতে UNESCO প্রতিবছর 21 মে দিনটিকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক বৈচিত্রা দিবসরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যেমন- ভারতীয় সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এখানকার পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, স্থাপত্য, চারুকলা, ভাষা, শিল্প, সংগীত, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক কাঠামো, কৃষিকাজ, ভূমি পরিচালনার অনুশীলন, এমনকি শস্য নির্বাচন প্রণালীতেও লক্ষ্য করা যায়। প্রায়শই দেখা গেছে, ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যগুলি মানবতার সাধারণ "heritage"-এর একটি অংশরূপে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্মানজনক স্থান অর্জন করতে সাহায্য করেছে।
• ভাষাগত বৈচিত্রা (Linguistic diversity): ভাষার মধ্যে একটি ভৌগোলিক স্থানের অতীত এবং ঐতিহ্যের বহুগুণের অস্তিত্বকে উপলব্ধি করা যায়। বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলেই বেশ কতকগুলি স্বতন্ত্র ভাষাগোষ্ঠীর মানুষজন রয়েছে। বস্তুত, কথ্য ভাষাগুলি একদিকে যেমন মানুষের ভাবের আদানপ্রদান করে, অন্যদিকে একে অপরের মধ্যে সাহচর্যতার বাতাবরণ গড়ে তোলে, একইভাবে ভাষার ভিত্তিতে সমগ্র বিশ্বের এক একটি পৃথক বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলকেও চিহ্নিত করা যায়।
যেমন-সিনে তিব্বতীয় ভাষা বৈচিত্র্য অঞ্চল, ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা বৈচিত্রা অঞ্চলগুলি বিশ্বের নির্দিষ্ট কয়েকটি ভৌগোলিক পরিসরে সীমায়িত।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব (Importance of Regional
ধারণাটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন-
(i)আঞ্চলিক উচিসংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের পারস্পরিক নির্ভরতার বিষয়টিকে বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই উপস্থি করা যায়।
(ii) বৈচিত্র্য শুধুমাত্র কতকগুলি বিশেষ সত্ত্বার সমাহার নয়, বরং জানার উপায়গুলিকেও বৈচিত্র্য অন্তর্ভুক্ত করে থাকে।
(iii) বৈচিত্রা দৃষ্টিভঙ্গি, মানুষের চিরাচরিত বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞতার সমৃদ্ধি ঘটিয়ে উন্নয়নের আঞ্চলিক লক্ষ্যকে আরও ভালো তথ্য সংগ্রহ, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে পরিচালিত করে।
(iv) বৈচিত্র্যের পরিমন্ডল মানুষের জন্য ব্যক্তিগত, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষাধিকার বজায় রাখে।
(V) বৈচিত্র্যের সমন্বয়ী ভাবনা জনজীবনে সমস্ত ধরানের আর্থসামাজিক বৈষম্য দূর করতে বিশেষ অনুপ্রেরণা জোগায়।
(vi) বৈচিত্র্যের ধারণা আঞ্চলিক উন্নয়নের বিভিন্ন নৈতিক কার্যাবলীর গ্রহণযোগ্যতাকে অন্তর্ভুক্ত করে।
(vii) বৈচিত্র্যের সমন্বয়ী ভাবধারা ইতিবাচকভাবে পরম্পরা রক্ষা, সহযোগিতা, শ্রদ্ধা, উৎসাহ প্রভৃতির মাধ্যমে বাড়ি হয়।