বিশ্বব্যাংক কর্তৃক মানব উন্নয়ন সূচকের প্রস্তাবসমূহ(Proposals for the Human Development Index by the World Bank)
মানব উন্নয়নের আধুনিক মানদণ্ড প্রকাশের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকাও অত্যন্ত প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সম্প্রাতি মানব উন্নয়নের সূচক উপস্থাপনায় আরও কয়েকটি ক্ষেত্রকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেগুলি হল-
মাথাপিছু ব্যক্তিগত ভোগের স্তর (Level of personal consumption per capita): যে সমস্ত দেশের মানুষজন মাথাপিছু ব্যক্তিগত ভোগ প্রবণতায় ইচ্ছামতো সর্বাধিক সুযোগ পায়, জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে তারাই মূলত এগিয়ে থাকে। সেই কারণে, বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবনায় মাথাপিছু ভোগ বৃদ্ধি মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সাধারণত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশের অধিকাংশ মানুষ যারা দারিদ্র্যসীমার নীচে থাকার ক্রয়কেন্দ্রিক অক্ষমতার কারণে তাদের ভোগ প্রবণতায় যথেষ্ট কম। এরফলে, তারা জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুফলগুলিকে সার্বিকভাবে উপভোগ করতে পারে না।
শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির প্রবণতা (The tendency of malnutrition in children): সুষম আতার না পাওয়ার কারণে ঘটে থাকা অপুষ্টি হল এমন একটি স্বাস্থ্যগত ত্রুটি যা শিশুদের দৈহিক এবং মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভিত পুরোপুরি নষ্ট করে দেয়। বর্তমানে, নবজাতক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুরাই যে শুধু অপুষ্টির শিকার, ঠিক তা নয়, জন্মের পর থেকে 17 বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মধ্যেও এই ধরনের অপুষ্টির প্রবণতা যথেষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। যে সমস্ত দেশের শিশুদের অপুষ্টিগত মাত্রার প্রভাব যত বেশি, মানব উন্নয়নেও তারা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই বিশ্বব্যাংক শিশুদের অপুষ্টিকে মানব উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারকরূপে গণ্য করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রভৃতি দেশে অপুষ্টিজনিত কারণে ভূক্তভোগী শিশুদের সংখ্যার হার প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। ভারতে, পাঁচ বছরের কম বয়সের প্রায় 40 শতাংশ শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও বিকাশ সঠিকভাবে হচ্ছে না এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় 21 শতাংশ শিশু কোনো না কোনোভাবে মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। ভারতের যে রাজ্যগুলিতে অপুষ্টিজনিত সমস্যা বেশি সেগুলি হল উত্তর প্রদেশ, তামিলনাড়ু, মধ্য প্রদেশ, ঝাড়খন্ড এবং বিহার। অন্যদিকে, Global Hunger Index অনুসারে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। বিশ্বজুড়ে প্রায় 795 মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন কারণে অপুষ্ট, যার বেশিরভাগই আফ্রিকা ও এশিয়ায় বসবাস করে।
শিশুদের মৃত্যু প্রবণতার হার (Infant mortality rate): সদ্যোজাত শিশু অথবা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে শিশুদের পাঁচ বছর বয়সকালের আগেই শিশু মৃত্যুর প্রবণতা বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশে স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যায়। মূলত দারিদ্রা, নারী অবহেলা, উপযুক্ত সুষম পুষ্টির অভাব, চিকিৎসার ঘাটতি, বিভিন্ন রোগভোগ (যেমন-ডায়রিয়া, পক্স, মাম্পস, রিকেট, জন্ডিস, কনজাঙ্কটিভাইটিস প্রভৃতি)-এর কারণে বর্তমানে শিশুমৃত্যুর হার অত্যন্ত বাড়িয়ে তুলে জীবনের গুণমানকে ভীষণভাবে বিনষ্ট করেছে। বিশেষ করে, উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলিতেই শিশুমৃত্যু হারের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। এই অবস্থা থেকে যাতে দ্রুত বেরিয়ে আসা যায়, সেই জন্য বিশ্বব্যাঙ্কের মানব উন্নয়নের প্রস্তাবনায় শিশুমৃত্যু হারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জন্মের সময় শিশুদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল (Life expectancy of children at birth) : প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল কোনও একটি দেশের প্রাকৃতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। জন্মের সময় শিশুদের প্রত্যাশিত বা সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল যত বেশি, তা পরোক্ষভাবে পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যগত পরিকাঠামোর সর্বোত্তম মান প্রকাশে সহায়ক হয়। সেই কারণে, বিশ্বব্যাংক মানব-উন্নয়নের আধুনিক মাত্রাগত পরিমাপকরূপে শিশুদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের কথা উল্লেখ করেছে।
বয়সকেন্দ্রিক সাক্ষরতা (Age oriented Literacy): প্রগতিশীল প্রতিটি সমাজে শিক্ষাই হল মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের অন্যতম মানদণ্ড। সাধারণত, নির্দিষ্ট বয়সকাল পর্যন্ত উপযুক্ত শিক্ষার হার বজায় থাকলে, কোনও একটি দেশের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার, উপযুক্ত পরিচালনা, কর্মসংস্থান, পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটার পাশাপাশি কুসংস্কারমুক্ত উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিক উন্নয়নের পথকে যথেষ্ট সম্প্রসারিত রাখে। সেই কারণে, বিশ্বব্যাংক পনেরো বছর বয়সকাল পর্যন্ত প্রতিটি জনগোষ্ঠীর (শিশু থেকে কিশোর) শিক্ষার অন্তর্ভুক্তিকে মানব উন্নয়নের অন্যতম একটি স্তম্ভ রূপে বিবেচনা করেছে।
পৌর জনগোষ্ঠীর সংখ্যা (Number of urban Populations): বেশিরভাগ পৌরাঞ্চলে প্রতিটি মানুষের বেঁচে থাকার নাগরিক সুযোগসুবিধা (যেমন- কর্মসংস্থান, উচ্চমানের জন পরিসেবা, পয়ঃপ্রণালী ও শৌচাগারের সুবিধা, উচ্চ ভোগের সুযোগ প্রভৃতি)-গুলি যথেষ্ট পরিমাণে বেশি। তাছাড়া, যে সমস্ত দেশে নগরীয় জনসংখ্যার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, তারা স্বাভাবিকভাবেই মানব উন্নয়নের শিখরে থাকে। সেই কারণে বিশ্বব্যাংক মানব উন্নয়নের মানদান্ডে পৌর জনগোষ্ঠী কেউ প্রাধান্য দিয়েছে।