অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা (Participatory Planning)
বর্তমান, ভারতের বিকেন্দ্রীভূত বা বহুস্তরীয় পরিকল্পনার ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে, পরিকল্পনা প্রণয়ন বা বাস্তবায়নের কাজটি শুধুমাত্র প্রশাসনিক স্তরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং পরিকল্পনায় সার্বিক অংশগ্রহণের বিষয়টি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এই ধরনের পরিকল্পনায় সমন্বয়, সহমত, দায়বদ্ধতা, প্রতিশ্রুতি এমনকি নৈতিক কর্তব্যের সুস্পষ্ট প্রতিফলন বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাই, বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার একটি উন্নত এবং ফলনে পদক্ষেপকূপে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনাকে দেখা হয়ে থাকে।
ধারণা (Concept)
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা হল এমন একটি পন্থা যেখানে সমাজে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীকে কেমও অঙ্কিত লক্ষ্য অর্জনে সমানভাবে বিবেচনা করা হয়। এখানে, সমাজের সকল স্তরের মানুষের সুচিন্তিত মতামত ব আশিকে সম্মান করে গৃহীত পরিকল্পনাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। এই ধরনের পরিকল্পনার সুফল ভোগ কর থাকেন উপভোক্তা, দাতা, নীতি নির্ধারক, প্রযুক্তিবিদ প্রমুখ সমাজের সর্বস্তরের মানুষজন।
"CIVICPLAN" নামক ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে- "Participatory planning is a way of doing planning that puts residents at the centre of decision-making in their community." অর্ধাং অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা এমন একটি পদ্মা যেখানে প্রতিটি সম্প্রদায়গত বাসিন্দাকে নিজস্ব সিশান্ত গ্রহণের কেন্দ্রে রায় হয়।
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার উদ্ভব (Origin of Participatory Planning)
বিংশ শতকের তৃতীয় দশকের পর থেকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ একাধিক দেশে শহুরে মডেল উপস্থাপনায় পরিকল্পনায় স্থানীয় সম্প্রদায়ের পছন্দ, উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গী, সার্বিক জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার একত্রীকরণের একটি সমন্বয়ী পদ্মারূপে অংশগ্রহণকে যুক্তিসঙ্গতভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। সেই সময়, প্রশিক্ষিত পেশাদার বিভিন্ন মানুষকে কাজে লাগিয়ে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনায় ওপর-নীচ (Top-bottom) পদ্ধতির দৃষ্টিভঙ্গীগুলিকে কেন্দ্রীভূত আকারে পরিচালিত হত। পরবর্তীকালে, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সমষ্টিগত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে এই ধরনের পরিকল্পনায় গ্রাম স্তরের স্থানীয় উন্নয়নমূলক প্রতিটি কার্যক্রমকেও গণমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, 1990 খ্রিস্টাব্দে ব্রাজিলের পোর্ত আলেগ্রে শহরে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা ও তার জন্য নির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দকরণ সার্বিকভাবে প্রথম সাফল্য পায়। এরপর অবশ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই ধরনের পরিকল্পনা ছড়িয়ে পড়ে। একবিংশ শতকের প্রথম দশক থেকে ভারত, বাংলাদেশের একাধিক গ্রাম ও শহরাঞ্চলগুলিতেও ওই পরিকল্পনা যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। বর্তমানে, বিভিন্ন দেশের কিছু কিছু আঞ্চলিক অথবা স্থানীয় পর্যায়ের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে অংশগ্রহণ পরিকল্পনায় যথেষ্ট মনোনিবেশ করে
ভারতে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা (Participatory Planning in India)
1986 খ্রিস্টাব্দে UNICEF-এর প্রচেষ্টায় ভারতের বেশ কিছু শহরে জল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, রাস্তার মেরামতি বা নতুন পাকা রাস্তা তৈরি, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে টিকাদান এবং স্থানীয় আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার নিযুক্ত সম্প্রদায়কেন্দ্রিক আয়োজকদের সহায়তায় "Urban Basic Service Programme"-এর মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা প্রথম রূপায়িত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, ভারতীয় সংবিধানের 73-তম সংশোধন আইনের 243 (B) অনুচ্ছেদে বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনায় গ্রামসভাকে গুরুত্ব দিয়ে সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতের অধীনে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার গঠনমূলক পদক্ষেপটি আরও সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর, পঞ্চায়েত আইনের 16(a) ধারায় অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনাকে আরও নিম্নস্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিতে, প্রতিটি নির্বাচনী ক্ষেত্রে গ্রাম সংসদ প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
1946 খ্রিস্টানে কেরলে, "Peoples Plan Campaign আরা বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনায় মানুষের সৌদির কামরায়ানকে চহ্নিত বা মূল্যায়ন করে উন্নয়ন সমস্যা নিরসনে নাগরিকদের সুসংহত বা সক্রিয় অংশগ্রহণ পম্পতির বিষয়ে প্রবির ইতিবাচক প্রস্তাব গৃহীত হয়। যার মধ্যে রয়েছে, দেশের বৃহত্তম নারীকেন্দ্রিক দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি, কুরুষত EALS. Housing Scheme এবং কেরালা খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচি, প্রভৃতি। জনগণকে পরিকল্পনা অভিযানের সরিয় অংশ হিসেবে গণ্য করে তৎকালীন কেরলে প্রায় 31 মিলিয়ন মানুষ এই প্রচেষ্টায় বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছিল।
"পশ্চিমবঙ্গে 1999 খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে উন্নয়নমূলক কাজে স্থানীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের লক্ষ্যে "Convergent Community Action Plan" বা জনগোষ্ঠী অভিসারী কার্যকরী পরিকল্পনা গ্রহণ করার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করেছিল।
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার শর্ত (Condition of Participatory Planning)
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার জন্য বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণ অতি আবশ্যক। যেমন-
(i) অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনায় জনসমষ্টির প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করা।
(ii) এখানে স্থানীয় সমস্যাকেন্দ্রিক প্রতিটি মানুষের ভাবের আদান-প্রদান নিশ্চিত করে তোলা।
(iii) জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, বর্ণ নির্বিশেষে আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসা সঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে পরিকল্পনার পথ প্রশস্ত করা।
(iv) অন্য কারোর বক্তব্যে প্রভাবিত না হয়ে, অথবা অন্য কাউকে প্রভাবিত না করে উন্নয়নমূলক আলোচনাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
(v) নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিটি আলোচনাকে শেষ করে সম্প্রদায়গতভাবে উন্নয়নের সিদ্ধান্তগুলির বাস্তবায়ন ঘটানো, প্রভৃতি।।
কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ(A few notable steps)
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধাপ হল-
(i) পরিকল্পনার নির্দিষ্ট অভীষ্টকে সামনে রেখে গ্রাম বা শহরাঞ্চলের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য তথ্য আহরণ।
(ii) পরিকল্পনার যথাযথ সুযোগ সৃষ্টি বা লক্ষ্য নিরূপণ করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে একত্রীকরণ।
(iii) স্থানীয় জনগোষ্ঠী এবং সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগকারীদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ।
(iv) পারস্পরিক মত বিনিয়োগের মাধ্যমে অতীত ও বর্তমানের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মূল সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ।
(v) সামগ্রিক আলোচনার মাধ্যমে চিহ্নিত সমস্যাগুলির সমাধানে অগ্রাধিকারভিত্তিক উপযুক্ত উন্নয়ন পন্থা নির্ধারণ।
(vi) বিভিন্ন সহায়সম্পদ বা অর্থের জোগান নিশ্চিতকরণ বা উপযুক্ত বাজেট খতিয়ে দেখে পরিকল্পনার বিকল্প পথা স্থানীয় করন।
সামগ্রিক পরিকল্পনাটির জন্য নির্দিষ্ট সময় ধার্য করে সেগুলিকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
(vii) গৃহীত পরিকল্পনামূলক কার্যক্রমে সহজলভ্য প্রাতিষ্ঠানিক কৌশলগুলিকে সর্বাধিক ব্যবহৃত করা।
(ix) সংশ্লিষ্ট সহায়ক জনগোষ্ঠীর দক্ষতা অনুযায়ী পারস্পরিক কর্ম বণ্টন।
(x) পরিকল্পনার ফলাফলগুলিকে স্থানীয় জন- সমষ্টিগত স্তরে বিশ্লেষণ।
(xi) ধৈর্য সহকারে সমগ্র পরিকল্পনাটির মূল্যায়ন, প্রভৃতি।
অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনার প্রধান স্তম্ভ (The main pillar of Participatory Planning)
অংশগ্রহণ পরিকল্পনার প্রধান স্তম্ভ হল- যাদের জন্য উন্নয়ন, তারাই পরিকল্পনা করবে, আর সেই উন্নয়নমূলক পরিকল্পনা ব্যবস্থাটিতে সঞ্চালকদের প্রধান ভূমিকা হবে সহায়করূপে। এই ধারণাটিকে সামনে রেখে একটি দেশের অংশ- গ্রহণমূলক পরিকল্পনায় যে বিষয়গুলি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে, সেগুলি হল-
স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন তথ্য প্রদান বা তথ্য সংগ্রহ।
উপযুক্ত পরামর্শ প্রদান- যার বেশ কয়েকটিকে পরিকল্পনার বিকল্প পন্থা রূপে বিবেচনা করা হয়।
বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে সমষ্টিগত যোগদান।
সম্প্রদায়গত প্রতিটি মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্তিকরণ।
উন্নয়নের স্বার্থে একসভো সিন্ধান্ত নেওয়া।
পরিকল্পনার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সম-অংশীদারিত্ব গ্রহণ।
সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমদৃষ্টিভঙ্গি বা সমভাবাপন্নতার নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া।