welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

মৌসুমি জলবায়ু (Monsoon Climate)

মৌসুমি জলবায়ু (Monsoon Climate)


মৌসুমি শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ মৌসিম (mousim) বা মালয়ালাম শব্দ মনসিন (monsin) থেকে, যার অর্থ ঋতু। মৌসুমি শব্দটি এক বিশেষ ধরনের ঋতুকালীন নিয়মিত ও ধারাবাহিক বায়ুপ্রবাহকে নির্দেশ করে, যে বায়ু গ্রীষ্ম ঋতুতে যেদিক থেকে প্রবাহিত হয়, শীত ঋতুতে ঠিক তার বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত হয়।

সুতরাং, শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুভেদে বিপরীত দিক পরিবর্তনকারী প্রবাহিত বায়ুকে মৌসুমি বায়ু বলে.

বস্তুত, এভাবে প্রবাহিত ব্যয়ই আদশ মৌসমি বায়। পৃথিবীর মধ্যে ভারতবর্ষ এমন একটি দেশ, যেখানে আদন মৌসমি বায় লক্ষ করা যায়। বছরের অধিকাংশ সময় এই বায়ু প্রবল ও ব্যাপকভাবে প্রবাহিত হয়। তাই, ভারতৎে মৌসুমি বায়ুর ক্রীড়াক্ষেত্র বলে মনে করা হয়। তবে কোনো কোনো অঞ্চলে বা দেশে এই বায়ু বছরের একটি শুরুতে ধারাবাহিক ও নিয়মিতভাবে প্রবাহিত হওয়ার পর অবশিস্ট দিনগুলিতে অনুপস্থিত থাকতে পারে কিংবা বিপরীত দিক থেকে প্রবাহিত না হয়ে অন্য যে-কোনো দিক থেকে প্রবাহিত হাতে পারে। এই ধরনের মৌসুমি বায়ুকে ছয় মৌসুমি (Pseudo-monsoon) বা মৌসুমিভাবাপন্ন (monsoon tendencies) বায়ু বলা হয়। স্বভাবতই মৌসুমি বস্তু প্রভাবাধীন দেশগুলি মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলের অন্তর্গত।

• মৌসুমি জলবায়ুর ভৌগোলিক অবস্থান (Geographical Location of Monsoon Cirmate)

• অক্ষাংশগত অবস্থান মৌসুমি জলবায়ু আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলের জলবায়ু হলেও এটি উপক্রান্তীয় অঞ্চলের কোনো কোনো স্থানে লক্ষ করা যায়। সাধারণত নিরক্ষরেখার উভয়দিকে 10°-24° অক্ষরেখার মধ্যে এই জলবায় অবস্থান করে। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই জলবায়ু 30° উত্তর অক্ষরেখা পর্যন্ত বিস্তৃত।

• দেশীয় অবস্থান আদর্শ মৌসুমি জলবায়ুর অবস্থান পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপক্রান্তীয় অঞ্চলে। এই অঞ্চলের দেশগুলি হল-ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার (ব্রহ্মদেশ), মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিন চিন ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জ। এ ছাড়া আংশিকভাবে তাইওয়ান, কোরিয়া, জাপান, কামপুচিয়ায় (কম্বোডিয়া) এই জলবায়ু লক্ষ করা যায়। 

ছন্দ মৌসুমি বা মৌসুমি-ভাবাপন্ন জলবায়ুর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি হল-পশ্চিম আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের গিনি, সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া ও আইভরি কোস্ট (কিয়দংশ) এবং পূর্ব আফ্রিকার মালাগাসির পশ্চিমাংশ। লাতিন আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলের ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম, ফরাসি গায়ানা ও ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব অংশ পুয়ের্তোরিকোর উত্তর-পূর্ব উপকূল ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের ডোমিনিকান রিপাবলিক। এ ছাড়া উত্তর অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অংশে মৌসুমিভাবাপন্ন জলবায়ু লক্ষ করা যায়।

• মৌসুমি জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Monsoon Climates)

i. উন্নতা-সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য।

ii. ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অন্তর্গত উপকূলবর্তী অঞ্চল বেশ গরম এবং উদ্বুতার পরিমাণ প্রায় একই রকম থাকে।

iii. গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ বর্ষী আসার আগে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়।

iv. এই ঋতুতে গড় তাপমাত্রা 27°-32° সেঃ-এর মধ্যে থাকে। ভারতে উত্তরের সমভূমিতে এই তাপমাত্রা ২৪° 49° সেঃ পর্যন্ত হয়।

v. গ্রীষ্মকাল প্রচন্ড উল্ল ও আর্দ্র, বাতাসে প্রচুর পরিমাণে জলীয় বাষ্প থাকে।

vi. দেশের অভ্যন্তরভাগে দিনের বেলায় তাপপ্রবাহ চলে। মে ও জুন মাসের প্রথম ভাগে তাপমাত্রা আরও বেশি হতে থাকে। সমগ্র উত্তর ভারত প্রখর গ্রীষ্মে লু' (Loo)-এর কবলে পড়ে।

vii. বৃষ্টির শুরুতে গরম কমে যায়।

viii. শীতকালের গড় তাপমাত্রা 10°-15° সেঃ-এর মধ্যে থাকে। উচ্চ অক্ষাংশে উন্নতা ভীষণভাবে কমে যায় কোনো কোনো স্থানে এই তাপমাত্রা হিমাঙ্ক বা প্রায় হিমাঙ্কের কাছাকাছি চলে আসে। এই সময় কোনে কোনো স্থানে শৈত্যপ্রবাহ হয়।

ix. এই জলবায়ু অঞ্চলে উয়তার বার্ষিক প্রসর অনেক বেশি। এই প্রসরের পরিমাণ ২° থেকে 11° সেঃ পর্যন্ত হয়। উন্নতার বার্ষিক প্রসরের তারতম্যের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় মহাদেশের অবস্থান, বাষ্পচাপ, মেঘাচ্ছন্নতা এবা অক্ষাংশ ও উচ্চতা দ্বারা। ইয়াংগুনে উন্নতার প্রসর মাত্র 53° সেঃ, কিন্তু কলকাতায় তা 11° সেঃ।।

x. দিনের বেলায় উন্নতার প্রসর অনেক বেশি হয়। উপকূলবর্তী অঞ্চলে উন্নতার প্রসর মহাদেশীয় অবস্থান অপেক্ষা অনেক কম।

2. বায়ুচাপ ও বায়ুপ্রবাহ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট:

(i) পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় মৌসুমি বায়ুর প্রবাহ ITCZ-এর স্থান পরিবর্তনের দ্বারা পরিচালিত হয়। মহাদেশ ও তৎসংলগ্ন সমুদ্রে অসম উত্তাপনের (heating) জন্য সালভাগ ও জলভাগের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত চাপঢাল অবস্থান করে

(ii) শীত ও শ্রীষ্মে বায়ু প্রায় 180° (কমপক্ষে 120°) দিক পরিবর্তন করে প্রবাহিত হয়

(iii) বায়ুর আগমন কাল ও প্রত্যাগমন কাল সুনির্দিষ্ট নয়: এটির নির্দিষ্ট সময়ের আগে বা পরে আগমন ও প্রত্যাগমন ঘটে। এই বায়ু সম্পূর্ণ খামখেয়ালি চরিত্রের।

(iv) গ্রীষ্মকালে এশিয়ার স্থলভাগ প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়, ফলে এক গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের সৃষ্টি হয়, যা স্থলভাগের ওপর দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে। ITCZ নিরক্ষরেখার উত্তরে সরে আসে এবং বায়ুমন্ডলীয় নিম্নচাপ ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। এই অবস্থায় ক্রান্তীয় সমুদ্রের উচ্চচাপ কেন্দ্র থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্পপূর্ণ সামুদ্রিক বায়ু পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত হয়। এই বায়ু প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটায়। ভারতবর্ষে এটি দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত.

v) গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে বায়ুমন্ডলে অস্থিরতা শুরু হয়। বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকায় অপরাহ্নে ক্ষণস্থায়ী বায়ুমণ্ডলীয় গোলযোগ ঘটে। বজ্র-বিদ্যুৎসহ বড়, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি হয়। স্থানীয়ভাবে এগুলি ঘাট থাকে। এগুলি পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ওড়িশায় কালবৈশাখী, দক্ষিন ভারতে আম্রবৃদ্ধি এবং রাজস্থানে আঁধি (ধূলিঝড়) নামে পরিচিত।

(vi) শীত যত এগিয়ে আসে, ততই স্থলভাগের তাপমাত্রা কমতে থাকে ও নিম্নচাপ দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চ চাপ বাড়তে থাকে। অবশেষে উচ্চচাপ নিম্নচাপের স্থান দখল করে ও দৃঢ়ভাবে অবস্থান করে।

(vii) শীতকাল শীতল ও শুদ্ধ। মহাদেশের ওপর দিয়ে বায়ু প্রবাহিত হয় বলে এটি শুদ্ধ থাকে। স্থানবিশেষে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে।

(viii) শীত ঋতুতে স্থলভাগ উচ্চচাপের অন্তর্গত হয় বলে বায়ুমণ্ডল সুস্থির থাকে। মেঘমুক্ত আকাশ, রোদ ঝলমল। দিন এবং রাতে তাপমাত্রার দ্রুত বিকিরণের জন্য বৈপরীত্য উত্তাপ ঘটে থাকে। কুয়াশা, ধোঁয়াশা, শিশির, তুহিন ইত্যাদি লক্ষ করা যায়।

(ix) শীতকালে স্থলভাগের ওপর অবস্থিত উচ্চচাপের কেন্দ্র থেকে বাতাস সমুদ্রের নিম্নচাপ কেন্দ্রের দিকে বইতে থাকে। এই বায়ু শীতকালীন মৌসুমি বা শুষ্ক মৌসুমি বায়ু নামে পরিচিত। ভারতে এটি উত্তর-পূর্ব দিক থেকে আসে। এই বায়ু অতি শীতল ও শুদ্ধ। এই সময় ITCZ নিরক্ষরেখা থেকে আরও দক্ষিণে সরে গিয়ে অবস্থান করে। শীতকালে চাপবলয়গুলি একটু একটু করে দক্ষিণ দিকে সরে যায়। তখন উত্তর ভারত পশ্চিমা বায়ুর অন্তর্গত হয়। ভূমধ্যসাগর থেকে আগত জলীয় বাষ্পপূর্ণ বায়ু উত্তর-পশ্চিম ভারতে ঢুকে পড়ে ও উত্তর ভারতে হালকা ঝড়-বৃষ্টি ও তুষারপাত ঘটায়। একে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা (Western Disturbances) বলে।

মেঘাচ্ছন্নতা ও বৃষ্টিপাত-সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য:

(i) মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। তবে ক্রান্তীয় অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের তীব্রতা বেশি থাকে। এই জলবায়ুতে স্বল্পকালীন একটি স্পষ্ট শুষ্ক ঋতু বিরাজ করে। কিন্তু বর্ষাকালে এত বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয় যে, তা শুদ্ধ ঋতুর মাসগুলিতে বৃষ্টির ঘাটতি পূরণ করে দেয়।

(ii) এই অঞ্চলে বেশির ভাগ বৃষ্টিপাত ঘূর্ণবাত-জনিত ও শৈলোৎক্ষেপ-জনিত প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়। তবে সামান্য পরিমাণ বৃষ্টিপাত পরিচলন প্রক্রিয়ায়ও ঘটে থাকে।

(iii) 90 ভাগেরও বেশি বৃষ্টিপাত আর্দ্র দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দ্বারা ঘটে থাকে। তাই, এই জলবায়ু আর্দ্র ও উয়। বৃষ্টির মাসগুলিতে ঘূর্ণিঝড় (টাইফুন, হ্যারিকেন) প্রায়শই হয়ে থাকে।

(iv) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনিশ্চিত এবং সমহারে সর্বত্র বন্টিত নয়। El-nino' বছরগুলিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম হয়।

(v) উপকূলবর্তী এলাকায় সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় এবং দেশের অভ্যন্তরভাগের দিকে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। জলীয় বাষ্পপূর্ণ বাতাস পাহাড়-পর্বতে বাধা পেলে প্রতিবাত ঢালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন উপদ্বীপীয় ভারতের পশ্চিমঘাট পর্বতের পশ্চিম ঢালে (আরবসাগরীয় শাখার জন্য) বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 250 সেমির বেশি। অনুরূপভাবে, মায়ানমারের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়.

(vi) ইন্দোচীন উপদ্বীপ ও ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। কম্বোডিয়ায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি এবং মাত্র দুই বা তিন মাসে বৃষ্টি 2 সেমির কম থাকে। অন্যদিকে, থাইল্যান্ডের মধ্যভাগে পাঁচ বা ছয় মাস কোনো বৃষ্টি হয় না, শুষ্কতা বজায় থাকে। ফিলিপাইনে অধিকাংশ বৃষ্টি টাইফুন নামক বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় থেকে আসে। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বেশি ঘটে থাকে।

(vii) পরোক্ষ ফলাফল হিসেবে দেশের কৃষি অর্থনীতি এই জলবায়ুর ওপর প্রায় নির্ভরশীল। কারণ চাষ-আবাদের দিনক্ষণ, অর্থাৎ শস্য উৎপাদনের সময়কাল মৌসুমি বায়ুর আগমন ও প্রত্যাগমন কাল দ্বারা সুনির্দিষ্ট হয়।

(viii) ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে স্বাভাবিক উদ্ভিদের প্রকৃতি বিশেষভাবে নির্ভর করে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বন্টনের ওপর। নিরক্ষীয় সীমানার দিকে বৃষ্টিপাত বেশি হওয়ায় এই দিকের বনভূমি ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যের মতোই হয়। তথাপি, এখানে উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা কম। উলটোদিকের সীমানায়, অর্থাৎ শুদ্ধ জলবায়ুর সীমানার দিকে হালকা জঙ্গল, কাঁটা ঝোপঝাড় ও সাভানা তৃণভূমি জন্মায়। বেশি বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে চিরহরিৎ অরণ্য এবং তুলনামূলক কম বৃষ্টিপাতযুক্ত স্থানগুলিতে আর্দ্র ক্রান্তীয় পর্ণমোচী অরণ্য গড়ে ওঠে। এই দুই বনভূমির গাছগুলি হল-শাল, সেগুন, শিশু, মধুয়া, আম, জাম, নিম, বকুল, পলাশ প্রভৃতি।

• প্রাণী গোষ্ঠী (Animals): মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে প্রজাপতি, ফড়িং সহ নানা ধরনের কীটপতঙ্গা, হরিণ, গন্ডার, হাতি, মহিষ, শেয়াল, বাঘ ইত্যাদি তৃণভোজী ও মাংসাশী প্রাণী লক্ষ করা যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01