বিশ্ব উন্নায়নে মানুষের ভূমিকা (Influence of Human Beings on Global Warming)
বিশ্ব উন্নায়ন অথবা পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক প্রভাব থাকলেও মানুষের বৈচিত্র্যময় কার্যাবলি প্রকাশে প্রভাব বিস্তার করছে। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কার্যকলাপে বহুল পরিমাণে গ্রিনহাউস গ্যাস পরিবেশে উপছে। এর ফলস্বরূপ পৃথিবীর তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষের কার্যকলাপের ফলে বিশ্বে জলবায়ুর যে পরিবর্তন ঘটছে তার কারণগুলি হল-
1. অত্যধিক জীবাশ্ম জ্বালানির দহন: বিভিন্ন জীবাশ্ম জ্বালানি, যথা কয়লা, পেট্রোলিয়াম প্রভৃতি হাইড্রোকার্বন জাতীয় যৌগ দহনের ফলে বায়ুতে CO² CO, SO² প্রভৃতি ক্ষতিকারক গ্যাস মেশে। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশে শক্তির প্রধান উৎস হিসেবে কলকারখানা ও যানবাহন চালাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলে বায়ুতে সমান হারে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণও বাড়ছে। তাই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
2. অবাধে বৃক্ষচ্ছেদন: স্বাভাবিক উদ্ভিদই একমাত্র প্রাকৃতিক সম্পদ যা বায়ুমণ্ডলের CO² কে শোষণ করে O² পরিবেশে মুক্ত করে। কিন্তু কৃষিকাজ, বাসস্থান নির্মাণ, নগরায়নের সম্প্রসারণ, জ্বালানি কাঠের প্রয়োজনীয়তার কারণে মানুষ অবাধে গাছ কেটে বনভূমি পরিষ্কার করে দিচ্ছে। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে বায়ুতে CO² - এর পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। উপরন্তু জ্বালানি কাঠের ব্যবহারে CO² আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের উন্নতা বেড়েই চলেছে।
3. ক্লোরোফ্লুরোকার্বনের অতিব্যবহার ও ওজোন ক্ষত সৃষ্টি: CFC একটি গ্রিনহাউস গ্যাস। এটি রেফ্রিজারেটার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র, ইলেকট্রনিক্স শিল্পে এবং রং উৎপাদনে প্রচুর পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। মানুষের প্রয়োজনে এগুলির অধিক ব্যবহারে বায়ুতে CFC-এর পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে, যা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন স্তরকে ক্ষয় করার সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর পরিবর্তনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।
4. দ্রুত নগরায়ন: বাসস্থানের চাহিদা মেটাতে অধিক দ্রুতহারে নগরায়নের ফলে সিমেন্ট, ইট, লোহা দ্বারা নির্মিত বড়ো বড়ো অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে। এগুলির তাপ শোষণ ও বিকিরণ করার ক্ষমতা প্রচুর। তাই শহরাঞ্চল সংলগ্ন বায়ুমন্ডলের উন্নতা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় সবচেয়ে বেশি হয়।
5. দ্রুত শিল্পায়ন: শিল্পের প্রয়োজনে কলকারখানার সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে এসব কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া, গ্যাস, ছাই ও নানান আবর্জনা বায়ুকে যেমন দূষিত করছে, তেমনি গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
6. নাইট্রোজেন সারের অতিব্যবহার: কৃষিতে ফলন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচুর নাইট্রোজেনঘটিত রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হয়। এই রাসায়নিক সার নাইট্রেট ও পরে বায়ুর অক্সিজেনের সঙ্গেঙ্গ বিক্রিয়া করে নাইট্রাস অক্সাইড রূপে বায়ুমণ্ডলে মিলিত হয়। ফলে বিশ্ব উন্নায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
7. পারমাণবিক বিস্ফোরণ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার কিংবা বর্তমানে শক্তিশালী দেশগুলির পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জা তৈরিতে পরীক্ষামূলকভাবে পারমাণবিক বোমা ফাটানোর ফলে বায়ুতে প্রচুর গ্যাস মিশছে যা বিশ্ব উন্নায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
৪. অন্যান্য কারণ: উপরিউক্স বিষয়গুলি ছাড়াও পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক কুমচাষ, হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চনে পর্যটন শিল্পের বিকাশ, মুক্তিকার ওপর অধিক আচ্ছাদন ইত্যাদির প্রভাবেও বিশ্ব উন্নায়ন ঘটে।
বিশ্ব উন্নায়ন ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি :
বিশ্ব উন্নায়নের সরাসরি প্রভাব পড়েছে জলবায়ুর ওপর, যা প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করছে জলচক্রকে। জন্য আবার সরাসরি সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। জলচকের নিয়ম অনুযায়ী জল তিনটি অবস্থায় (কঠিন, তরল এবং গ্যাসীয়। জীবমণ্ডলে থাকে। তবে এই তিনটি অবস্থায় জলের পরিমাণ নির্ভর করে জলবায়ুগত অবস্থার ওপর। যেমন-বর্তমান হোলসিন অধিযুগের পূর্ববর্তী অধিযুগ প্লেইস্টেসিনে বায়ুমণ্ডলের উদ্বুতা কমে যাওয়ায় জীবমণ্ডলে উপস্থিত মোট জলের একটি বিরাট অংশ কঠিন অবস্থায় বরফরূপে অবস্থান করত। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা স্বাভাবিকভাবেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে (হোলসিন যুগে) পৃথিবীর গড় উন্নতা বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন আংশে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। ক্রান্তীয় মন্ডলের দেশগুলিতে গ্রীষ্মকালের দৈর্ঘ্য বাড়ছে এবং শীতকাল প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। অন্যদিকে উচ্চ অক্ষাংশের মেরু সন্নিহিত দেশগুলিতে শীতকালীন উন্নতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ও শীতকালের স্বারিত্ব কমছে। ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ, ভাসমান হিমশৈল, পার্বত্য উপত্যকার হিমবাহ গলতে শুরু করেছে। এর ফলে হিমবাহের পশ্চাদপসারণ ঘটছে ও হিমরেখার উচ্চতা বাড়ছে। সেই কারণে জীবমন্ডলে উপস্থিত জলের বেশির ভাগটাই বর্তমানে তরলরূপে অবস্থান করছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রের জলতলের গড় উন্নতা ক্রমশ বৃদি পাচ্ছে। IPCC-এর সমীক্ষায় পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর গড় উন্নতা 1.5° সেঃ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় 10-12 সেমি বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতিমধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরের কিরিবাতি অঞ্চলের দুটি দ্বীপ ডুবে গেছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এভাবে বিশ্ব উন্নায়নের প্রভাবে এই শতাব্দীতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রায় সা-না সেমি বৃদ্ধি পাবে।
বিশ্ব উন্নায়নের প্রভাবে-(i) সমুদ্র উপকূলবর্তী নিম্নভূমি জলপ্লাবিত হয়ে পড়বে। (ii) সমুদ্রজলের অনুপ্রবেশের ফলে নদীতে জলের লবণতা বৃদ্ধি পাবে, (iii) ম্যানগ্রোভ বনভূমি ধ্বংস হয়ে বন্যপ্রাণীর বিনাশ ঘটবে। (iv) কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় 10 থেকে 50 শতাংশ হ্রাস পাবে। (v) রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব অনুযায়ী, সারা পৃথিবীর প্রায় 5 কোটি সামুদ্রিক দ্বীপবাসী মানুষ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাস্তুতান্ত্রিক বাস্তুচ্যুত মানুষ (Ecological Refugees) পরিণত হবে।