ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাধারণ উদ্দেশ্য(General Purpose of Five years Plan in India)
ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সমস্ত প্রধান উদ্দেশ্যগুলিকে সামনে রাখা হয়, সেগুলি হল-
• উপযুক্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে সার্বিকভাবে আর্থিক উন্নয়ন বৃদ্ধির হার বাড়িয়ে দেশ এবং জনগণের মলাল করা।
আর্থিক স্ব-নির্ভরতা অর্জন ও দেশের আধুনিকীকরণে প্রাতিধানিকভাবে জোর দেওয়া।
• ধনী-দরিদ্র বা উন্নত- অনুন্নত সমস্ত ক্ষেত্রে যাবতীয় উন্নয়ন অসাম্য দূর করে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
• কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়িয়ে সারা দেশব্যাপী বেকারাত্বের পরিমানকে যথাসম্ভব কমানো।
• খাদ্যের জন্য আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলির ওপর থেকে নির্ভরশীলতা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা।
• দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় সার্বিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, প্রভৃতি।
পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনার কৌশলগত ভিত্তি (The strategic basis of the five-year plan)
বিভিন্ন সময়কাল জুড়ে ভারতে যে সমস্ত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল, সেগুলির বেশ কিছু নির্দিষ্ট কৌশলগত ভিত্তি রয়েছে। যেমন-
Harrod Domar Model অনুসরণ: অর্থনীতিতে কেইন্সীয় ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত Harrod Domar Model-টি উন্নয়ন বা প্রবৃদ্ধির হার সংরক্ষণ এবং মূলধনের স্তরকে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করে থাকে। ভারতের
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কৌশলটিকে মূলত Harrod Domar Model-এর উপর ভিত্তি করেই গড়ে তোলা হয়েছিল। এই মডেল অনুসারে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় মূলধনকে কুক্ষিগতকরণের দ্বৈত চরিত্র বিশ্লেষণের ওপর বিশেষ জোর দেওয়ার নীতি গৃহীত হয়। এই ধরনের নীতিতে চাহিদা ও সরবরাহের দিকটি যথেষ্ট গুরুত্ব পাওয়ায়, জাতীয় আয় বৃদ্ধি এবং উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটাতে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। তাছাড়া, উৎপাদন ক্ষেত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক ভারসাম্যের পরিবেশ দেশে কর্মসংস্থানের পথটিকে যথেষ্ট সুগম করে তোলে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কেইনসীয় মডেলকে সামনে রেখে হ্যারড ডোমার ভোগাপশ্যের উৎপাদনগত মাত্রা এবং সময়ভিত্তিক বিনিয়োগ প্রকল্পের নীতিটিকে নিম্নলিখিত সমীকরণে প্রকাশ করেছিলেন,
এখানে কোনও একটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় সামগ্রিক আউটপুট (g) হল মূলধন আউটপুট (K) এবং সঞ্চয় (S)-এর আনুপাতিক হার।
• নেহর্ মহলানবিশ মডেল (Nehru Mahalanobis Model) অনুসরণ: Indian Statistical
Institute-এর প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ শ্রী প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ 1955 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত অর্থনীতির অনুকরণে দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধির কৌশলরূপে দেশে ভারী শিল্পের বিকাশের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। শ্রী মহলানবীশ জাতীয় পরিকল্পনার বিষয়টিকে একটি নির্দিষ্ট মডেলের মাধ্যমে উপস্থাপনার সময় নিম্নলিখিত সমীকরণটিকে আয় উন্নতিকল্পের ধ্রুবকরূপে বিবেচনা করেছিলেন।
সমীকরণটি হল-
To(1+off-pit এখানে হল নির্দিষ্ট (1) বছরে মাথাপিছু দেশের জাতীয় আয়, ৫ হল নীট বিনিয়োগের হার, 3 হল প্রতি একক পিছু নীট বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং চু? হল দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার।
তাঁর এই সমীকরণ অনুসারে একটি বিষয় খুব স্পষ্ট, দেশে নীট বিনিয়োগের হার (০৫) যত বাড়ানো হবে, উন্নয়নের মাত্রাও আশানুরূপ হয়ে উঠবে। এই কৌশলটিতে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কিছুটা পরিবর্তন এনেছিলেন, যেটি ভারতের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নেহরু-মহলানবিশ মডেল আকারে দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভরতার কৌশল- রূপে প্রয়োগ করা হয়।
• গান্ধীবাদী কৌশল (Gandhian Strategy) অনুসরণ: ভারতের উন্নয়নমূলক পরিকল্পনায় গান্ধিবাদী ভাবধারাকে সামনে আনা হয়েছিল 1994 খ্রিস্টাব্দে আচার্য শ্রীমান নারায়ণ আগরওয়াল-এর সময়কালে। এই কৌশলটিকে অতীতের বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ব্যবহার করেই সমগ্র ভারতবাসীর মৌলিক (basic) জীবনযাত্রার মান উন্নতকরণের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। বিশেষ করে, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ভারতের কৃষিভিত্তিক অগ্রগতি, গ্রামীণ ও কুটির শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থানগত একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণে গান্ধীবাদী কৌশলের বিশেষ প্রয়োগ ঘটেছে।
• উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়ন (Liberalisation, Privatisation and Globalisation) ভারতে নব্বইয়ের দশক থেকে গৃহীত আঞ্চলিক পরিকল্পনার নীতিতে যে নতুন একটি অর্থনৈতিক কৌশলগত পরিবর্তন ঘটেছে, সেটি হল উদারিকরণ, বেসরকারিকরণ ও বিশ্বায়নের পথে সার্বিক উন্নয়ন। এই কর্ম পন্থাটিকে একত্রে "LPG" কৌশল বলা হয়ে থাকে। এর দ্বারা লাইসেন্স ব্যবস্থার উদারিকরণ করে বেসরকারি সংস্থা ও বিদেশি সংস্থাকে এদেশে বিনিয়োগে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। দেশীয় অর্থনীতিতে এই ভাবধারাতে বিকেন্দ্রীভূত উন্নয়ন প্রচেষ্টা শুরু করা হয়। | বিস্তারিতভাবে 210 পাতায় 5.5.7 শীর্ষক point-এ আলেচন করা হয়েছে।।
• গ্রামীণ স্তরে শহুরে সুযোগ-সুবিধা প্রদান কৌশল (Providing Urban Amenities in Rural Areas or PURA Strategy): ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ. পি. জে. আব্দুল কালাম পরিকল্পনায় গ্রামীণ স্তরে শহুরে সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছিলেন, যেগুলিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েই পরবর্তীকালে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিশেষ করে-
(i) গ্রামীণ ক্ষেত্রে রাস্তা, রেল, সেতু প্রভৃতির মাধ্যমে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তিকরণ।
(ii) গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের সম্প্রসারণ।
(iii) শিক্ষা সংযোগের সার্বিক প্রসার ও উন্নতিকরণ।
(iv) আর্থিক সংযোগ বৃদ্ধি এবং নতুন করে কর্মসংস্থান ঘটানো প্রভৃতি।
পরবর্তীকালে, ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়নমুখী PURA-2-এর দৃষ্টিভঙ্গীকে সামনে রেখে সেই সমস্ত শহরগুলিকে পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যেখানকার-
মোট জনসংখ্যা 5000 জন।
জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিমিতে 400 জন এবং
সেখানকার অন্তত 75% পুরুষ কর্মী কৃষিকাজে যুক্ত।
পরিকল্পনার বিরতি (Plan break)
ভারতের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে গৃহীত পরিকল্পনাগুলি কমিশন কর্তৃক বিভিন্ন সময় প্রণয়ন করা হলেও, সেগুলি কিন্তু কখনোই একটানা বাস্তবায়িত হয়নি, বরং মাঝে মধ্যেই বেশ কিছু কারণে বাধা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাগুলিতে সাময়িকভাবে বিরতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। এরকমই কয়েকটি অন্যতম বিরতি পর্যায হল -
হলিডে প্ল্যান(Holiday Plan)
ভারতে 1966 1969 খ্রিঃ পর্যন্ত এই ও বছর অর্থনৈতিক উন্নয়নের ইতিহাসে 'পরিকল্পনার ছুটির পর্যায়' নামে পরিচিত। কারণ, বিশেষত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিী পরিকল্পনার চরম ব্যর্থতা, সাধারণ দ্রব্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, দেশের কয়েকটি স্থানে খরার পরিস্থিতি, দুর্বল প্রশাসন, বৈদেশিক মুদ্রার চরম সঙ্কট এবং ভারত-চিন, ভারত- পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের কারণে এই সময়কালে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বন্ধ রেখে তিনটি বার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। যেমন-
• তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সময় যে প্রবল খাদ্যাভাব এবং কৃষি সংকট দেখা গিয়েছিল, তার মোকাবিলায় 1966 খ্রিস্টাব্দের বার্ষিক পরিকল্পনায় ভারতের বিভিন্ন কৃষিক্ষেত্রগুলিকে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়, যার ফলশ্রুতিস্বরূপ সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছিল।
• এই সময় থেকে তার পরের বছর পর্যন্ত ভারতের কৃষিক্ষেত্রের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার, অত্যধিক হারে সার প্রয়োগ, সেচ-এর বিস্তার এবং মৃত্তিকা সংরক্ষণের ব্যবস্থা ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়।
1969 খ্রিস্টাব্দে ভারতের মোট। 4 টি ব্যাংকের জাতীয়করণ ঘটানো হয়।
এইভাবে, ভারতীয় পরিকল্পনায় ছুটির পর্যায়কাল উত্তোরণকে পাথেয় করেই উত্তরণের পরবর্তী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পুনঃপ্রবর্তিত হয়।
রোলিং প্ল্যান (Rolling Plan)
ভারতে 1978-1980 খ্রিস্টাব্দে রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটিকে মাঝপথে হঠাৎ খামিয়ে দিয়ে সদ্য গঠিত নতুন সরকার যে বার্ষিক মূল্যায়নকেন্দ্রিক পরিকল্পনার পন্থা গ্রহণ করেছিল, সেটিই রোলিং প্ল্যান নামে পরিচিত। এখানে তিনটি উল্লেখযোগ্য পরিকল্পনার প্রস্তাব রাখা হয়। যথা-
• প্রথমটি ছিল 1978 খ্রিস্টাব্দের জন্য, যেখানে ওই বছরের জন্য একটি উন্নয়নমূলক বাজেট নির্দিষ্ট অর্থ সাপেক্ষে স্থির করা হয়।
• দ্বিতীয় পদক্ষেপটি ছিল পরিকল্পনায় 5 বছর মেয়াদি, যেটিতে ভারতীয় অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
• তৃতীয়টি ছিল দীর্ঘ মেয়াদের জন্য, যেখানে 10, 15 বা 20 বছরের সময়কালকে বেঁধে দিয়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পন্থা স্থির করা হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রোলিং প্ল্যানের শুরু ও সমাপ্তির জন্য যেমন কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি, একইভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতি অনুযায়ী এখানে পরিকল্পনার অনুশীলনগত লক্ষ্য এবং বরাদ্দকৃত অর্থের খাতগুলিকে সংশোধন করা যেত বলে, এটি ছিল যথেষ্ট নমনীয় প্রকৃতির। তবে, পরিকল্পনাটিতে ঘন ঘন সংশোধনের নীতি অর্থনীতিতে হিথতিশীলতা রক্ষায় বিশেষ সমস্যা সৃষ্টি করেছিল। অবশ্য, 1980 খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সরকারে এসে পুনরায় এই পরিকল্পনাটি প্রত্যাখ্যান করে নতুনভাবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বলবৎ করে।
বার্ষিক পরিকল্পনা (Yearly Plan)
ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দ্রুত পরিবর্তিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে 1990 খ্রিস্টাব্দের অষ্টম পরিকল্পনাটিকে প্রথমদিকে চালু করাই যায়নি। ফলে, 1990-91 এবং 1991-92 খ্রিস্টাব্দকে সামনে রেখে বার্ষিক পরিকল্পনা রূপায়ণের জন্য বিবেচনা করা হয়েছিল। অবশেষে, 1992-1997 খ্রিস্টাব্দের জন্য পুনরায় অষ্টম পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়।
পণ্যবার্ষিকী পরিকল্পনার তাৎপর্য (Significance of Five year Planning)
ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বিভিন্ন সময়কালের গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনা করলে এর বেশ কতকগুলি তাৎপর্য অনিবার্যভাবেই চোখে পড়ে। যেমন-
পরিকল্পনার প্রকৃতি (The nature of planning) ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি একটি অত্যন্ত বিধিবন্ধ এবং দায়িত্বশীল পদক্ষেপ। এখানে সমগ্র পরিকল্পনায় দুটি বিশেষ দিক গুরুত্ব পেয়েছে। তার মধ্যে একটি হল উন্নয়নমূলক দিক এবং অন্যটি হল সংশোধনমূলক দিক। এখানে, উন্নয়নমূলক বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জাতীয় আয় বৃদ্ধি সহ একাধিক অর্থনৈতিক কর্মকৌশলগুলি সর্বাধিক প্রাধান্য পেয়েছে। অপরদিকে, পরিকল্পনা সংশোধনমূলক ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত বিভিন্ন কৌশলগুলিকে আধুনিক উৎপাদনমুখী কাঠামোয় উপস্থাপিত করা হয়েছে।
সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা (The time based planning) ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাগুলি রূপায়ণের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর মেয়াদী নির্দিষ্ট একটি সময়কাল বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। যদিও বেশ কয়েকটি পরিকল্পনার মাঝে তিনটি বিরতি দেখা দিয়েছিল, তা সত্ত্বেও এই সময়গুলিতে উন্নয়নমুখী সমস্ত কাজের ধারাবাহিকতা কখনোই কিন্তু থেমে থাকেনি।
পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা (Complete plan): ভারতের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবেই একটি নিয়মতান্ত্রিক পূর্ণাঙ্গ্য পরিকল্পনা। কারণ, বিভিন্ন সময়কালে এদেশের কৃষি, শিল্প, পরিবহণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ একাবিং ক্ষেত্রগুলির উন্নয়নের জন্য সার্বিক লক্ষ্যের বাস্তবায়নকে বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
মিল অর্থনীতির সুবিধা (Advantages of mixed economy) 194৪ খ্রিস্টাদে প্রথম মিল অর্থনীমিয়কাল থেকেই উন্নয়নের একটি প্রগতিশীল কাঠামো রূপে মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ কর শিল্পনীতির সহ পদক্ষেপ স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিকল্পনার বছরগুলিতেও একারনে ছিল। ফলে, ি অর্থনৈতিক কাঠামোকে সামনে রেখে ভারতে কৃষি, শিল্প এবং অন্যান্য পরিসেবামূলক ক্ষেত্রগুলিতে বিচ্ছি সরকারি উদ্যোগের প্রচেষ্টাগুলি সাফল্যের সঙ্গে গৃহীত হয়েছে।
গণতান্ত্রিক পরিকল্পনা (Democratic planning): পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন এবং যাবতীয় কর্মপন্দাগুলি স্থির করার ক্ষেত্রে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। মূলত, এই ধরনের কাঠামোয় পরিকল্পনা কমিশনের একটি নির্দিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি থাকে। এখানে কমিটির সদস্যরা পরিকল্পনার যথাযথ মূল্যায়ন এবং সংশোধনের কাজগুলিকে অত্যন্ত নিপুণভাবে পরিচালনা করে থাকেন। তাছাড়া, জাষ্ঠীর উন্নয়ন পর্ষদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদ তাদের বিশেষ মতামত প্রদানের মাধমে পরিকল্পনার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সদা অক্ষুন্ন রাখতে যথেষ্ট সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
নির্দেশাত্মক পরিকল্পনা (Instructional plan): যেহেতু ভারত একটি পুরোপুরি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নং তাই এখানকার পরিকল্পনায় গৃহীত পদক্ষেপগুলির সমস্ত ক্ষেত্রেই নির্দেশাত্মক ভাব বজায় থাকে। যার ফলে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে আদেশমূলক নীতি বুপে বিবেচনা করে সেটিকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রয়োগ ঘটানে কখনই সম্ভব নয়। তাছাড়া, এই ধরনের পরিকল্পনায় বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা যদি ঠিকঠাক পূরণ না হয়, তার জন্য কিন্তু কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এদেশে গ্রহণ করা যায় না।
বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা (Decentralised planning): ভারতের প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে রূপায়িত হলেও, চতুর্থ পরিকল্পনা থেকে যাবতীয় উন্নয়নমূলক কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্ব বিভিন্ন রাজ্যের প্রশাসনিক পর্যায়ে, এমনকি জেলাগুলিকেও দেওয়া হয়। এই দিক থেকে বিচার করলে সমা পরিকল্পনাটির বিকেন্দ্রীভূত রূপটিই সর্বাধিক চোখে পড়ে।
স্বতন্ত্র উদ্দেশ্য (Unique purpose): ভারতের প্রতিটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাই স্বতন্ত্রভাবে যথেষ্ট। বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারণ, বিভিন্ন সময়কালে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনাগুলির প্রত্যেকটিতে এক একটি বিশেষ বা পৃথক উদ্দেশ্য প্রণোদিত স্বতন্ত্র কৌশলকে সামনে রেখেই গ্রহণ করা হয়েছে।
অর্থ সংগ্রহের বহুমুখী উৎস (Versatile source of fund raising): পরিকল্পনাকে সঠিকভাবে কার্যকর ব বাস্তবায়িত করে তুলতে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিকভাবে দেশীয় তথা বিদেশের বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করার কৌশলটিতেও বিশেষ মান্যতা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যগুলির উন্নয়নের অর্থপ্রাপ্তি, এমনকি স্থানীয় উদ্দেশ্য পূরণের প্রেক্ষাপটে উৎসাহ-উদ্দীপনা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে।
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্য (The successes of five-years plan)
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে আর্থিক তথা আঞ্চলিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও সেগুলির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারতকেই অন্যতম পথিকৃৎ বলা হয়ে থাকে। কারণ, বিগত সত্তর বছরে এদেশে গৃহীত বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উন্নয়নমূলক পদক্ষেপে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খতিয়ান রয়েছে। যেমন-
ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা আশাতীতভাবেই সাফল্য পেয়েছিল। কারণ, পূর্ববর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে যে ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, সেগুলিকে সঠিকভাবে অনুধাবন করেই সম্ভাষ সুযোগ-সুবিধাগুলিকে পরিকল্পনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে, রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে মূলধনকেন্দ্রিক উৎপাদন ক্ষেত্রগুলি যথেষ্ট লাভের মুখ দেখেছিল।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের ধারণা অনুযায়ী অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর ভিত বিজ্ঞানসম্মতভাবে গড়ে ওঠার ফলে সমগ্র দেশে ভারী শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছিল।
পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ভারতীয় কৃষিক্ষেত্রগুলিতে উৎপাদনের মাত্রা রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছিল (প্রায় 126 কোটি টন) যা ছিল ভারতীয় অর্থনীতির অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক।
ষষ্ঠ পরিকল্পনার প্রাক্কালে বাণিজ্য ঘাটতি, তেল আমদানির ব্যয় বৃদ্ধি, শস্য উৎপাদনে পরিকাঠামোগত ব্যাঘাতসহ একাধিক অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকলেও, এই পরিকল্পনায় তাৎপর্যপূর্ণভাবে বার্ষিক 5.5% লক্ষ্যমাত্রা সাফল্যের সঙ্গে অর্জিত হয়। আবার, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও এই পরিকল্পনার যথেষ্ট কাঙ্ক্ষিত অবদান ছিল। বিশেষ করে, এই সময়কালে ভারতে সার্বিকভাবে দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা পূর্বের 48.3%-এর চেয়ে হ্রাস পেয়ে 36.9%-এ নেমে আসে।
ভারতের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটিও যথেষ্ট সাফলের মুখ দেখেছিল। কারণ, সামাজিক পরিকাঠামো বৃদ্ধি, নিয়োগ, দারিদ্র্য দূরীকরণসহ একাধিক কর্মপ্রচেষ্টা উন্নয়নের ধার্যসীমা অনেকটাই অর্জন করতে পেরেছে। যেমন-এই সময়কালে GDP-এর লক্ষ্যমাত্রা 23.3% থেকে বেড়ে 25.3%-এ পৌছায়। সেবাক্ষেত্রে ধার্য 6.1% লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি পায় 7.3%, নিয়োগ বৃদ্ধি ঘটে 2.6% থেকে 2.8% (গড়ে প্রায় ৪5 লক্ষ কর্মী), মানুষের প্রত্যাশিত জীবনসীমা 60.8 বছর (1992 খ্রিঃ) থেকে বেড়ে হয় 62.4 বছর (1997 খ্রিঃ), জন্মহার প্রতি হাজারে 29.2 থেকে কমে 27.2-তে পৌঁছায়, শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে 79 থেকে কমে 71 হয়, স্বচ্ছ পানীয় জল সরবরাহের পরিমাণ ৪২% থেকে বেড়ে ৪5%, হয়, গ্রাম ও শহরাঞ্চলে পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার আশাতীত উন্নতি হয়।
নাম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা সম্পর্কে তৎকালীন পরিকল্পনাবিদেরা একটি বিবৃতিতে উল্লেখ করে, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে সরকারি এবং বেসধকারী প্রতিষ্ঠানগুলি একে অপরের পরিপূরক। তাছাড়া, নবম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেই মানুষের জন্য ন্যায়বিচারে বিশেষ জোর দেওয়া হয়, যা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।
একবিংশ শতকে ভারতীয় অর্থনীতি পূর্বের তুলনায় আরো পরিণত হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে, এই সময় উন্নয়নের বিভিন্ন স্তর পরিকল্পনায় যেমন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, একইভাবে উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের মুক্ত আলো আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতেই প্রায় কম-বেশি সমৃদ্ধ করেছে।
পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার উল্লিখিত তাৎপর্যকে উপলব্ধি করেই প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথন এটিকে সমাজের সেবা করার জন্য জ্ঞান এবং শক্তি সংযোগে তৈরি ভারত গঠনকারী স্বপ্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ বলে অভিহিত করেছেন।
পদ্মবার্ষিকী পরিকল্পনার ব্যর্থতা (Falure of Five-year Planning)
প্রকৃত অর্থে ভারতে গৃহীত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাফল্যের খতিয়ান যেমন স্পষ্ট, একইভাবে পরিকল্পনার বেশ কিছু ব্যর্থতাকে কখনোই উপেক্ষা করা যায় না। এখানে, শুরুর সময় থেকে পরিকল্পনার সমাপ্তিকাল পর্যন্ত উঠে আসা বেশ কয়েকটি ব্যর্থতাকে দৃষ্টান্ত সহকারে উল্লেখ করা হল।
ভারতের প্রথম পরিকল্পনাটি যথেষ্ট সফল হলেও, দ্বিতীয় পরিকল্পনার সময় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা এমনকি বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র সংকটের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য এমনকি শিল্পের সহায়ক বিভিন্ন যন্ত্রপাতির দাম যথেষ্ট বেড়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, কৃষিতে চিরাচরিত প্রথা অটুট থাকায় ভারতের আঞ্চলিক কৃষিব্যবস্থাও খুব একটা সফল হয়নি।
তৃতীয় পরিকল্পনার সময় আর্থ-সামাজিক এবং বৈদেশিক ক্ষেত্রের নানা দিক থেকে ভারত যথেষ্ট কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিশেষ করে, এই সময়কালে ভারত সরকার আর্থিকভাবে সহায়তা গ্রহণের জন্য বিদেশের ওপর অধিক নির্ভরশীল হয়ে যায়। ফলে, বিপুল পরিমাণ ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ায় দেশে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি 1965 খ্রিঃ), ব্যাপক খরা পরিস্থিতি (1965-66 খ্রি:) প্রভৃতির কারণে তৎকালীন পরিকল্পনার ধার্য 5.6% (1965 খ্রি)। ছুঁতে পারেনি। দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হার এই সময় পারে আশেতালে নিচে নেমে যায়। লক্ষ্যমতে, 1960-61 খ্রিস্টাব্দে ভারতের খাদ্যশস্য উৎপাদনের মাত্রা ছিল মেগুনে প্রায় ৪ মেটি 20 লম্ব মেট্রিক টন, সেটি 1965-66 খ্রিস্টাব্দে কমে মাত্র 7 কোটি 23 লক্ষ মেট্রিক টনে পৌঁছায়। তাই, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির নিরিখে এই পরিকল্পনা বহু ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে।
আয় ও সম্পদ বন্টনের সাম্যতা, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র্য দূরীকরণের ক্ষেত্রে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পন সেভাবে কোনও আশার আলো দেখাতে পারেনি। কারণ, এই সময়কালে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা 5.5% থেকে নেমে 2.৪% এ উপনীত হয়। অন্যদিকে, বার্ষিক শিল্প বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রাও নিম্নগামী হয়ে 3.9%-এ পৌঁছায়। যার ফলে, খাদ্য সমস্যা এবং বেকার সমস্যাকে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোনওভাবেই রোধ করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের সময় থেকেই সরকারের ওপর যথেস্ট চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। এই পর্বে আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে, মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে দেশ ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাকালে, কৃষিক্ষেত্রে প্রথম 2 বছর রেকর্ড উৎপাদন হলেও, পর পর। শেষ 3 বছর বর্ষার খারাপ পরিস্থিতির জন্য সামগ্রিক উৎপাদনের নিরিখে কৃষিক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হয়। 1971 খ্রিস্টাব্দের ভারত-পাক যুদ্ধের পটভূমিতে প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশী শরণার্থী ভারতে স্থায়ী আশ্রয় গ্রহণে পরিব্রাজন করে। 1973 খ্রিস্টাব্দে তীব্র তৈল সংকটের ফলে মুদ্রাস্ফীতির হার বিপুল পরিমাণে বৃদি পায়। ফলে, ভারতীয় উন্নয়ন অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রভাব পড়ে। সংশ্লিষ্ট পরিস্থিতিতে সবদিক বিবেচনা করে 1977 খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রে নতুন করে ক্ষমতায় আসা জনতা দল পরিকল্পনাটির ইতি ঘটায়। সুতরাং, শিল্পায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর করতে ভারতের পঞ্চম পরিকল্পনাটিও প্রায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছিল।
ভারতে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু থেকেই একাধিক সঙ্কটজনক অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল। বিশেষ করে এই সময়, প্রতিকূল লেনদেন পরিস্থিতি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যথেষ্ট কুপ্রভাব ফেলেছিল। এই পরিস্থিতি দেশে বাণিজ্যিক ঘাটতির পরিমাণটিকে প্রায় 18% এরও ওপরে নিয়ে চলে যায়।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাটি খুব একটা যে সফল হয়েছে তা বলা যায় না। কারণ, এই পরিকল্পনায় ধার্য প্রায় প্রতিটি লক্ষাই কাঙ্ক্ষিত সীমার খুব কাছেই থেকে যায়। বিশেষত, কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির হার যথেষ্ট ওঠানামার মধ্য দিয়ে লক্ষ্যমাত্রা 4% থেকে হ্রাস পেয়ে 3.6%-এ পৌঁছায়। বাৎসরিক বিদ্যুৎক্ষেত্রে ধার্য লক্ষ্যমাত্রা 125 থেকে নেমে 9.4% হয়েছিল। তবে, ভারতের সার্বিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সপ্তম পরিকল্পনা কিছুটা মিশ্র প্রভাব ফেলেছিল।
দু-বছর পরে শুরু হয়ে ভারতের অষ্টম পরিকল্পনাটি উন্নয়নের কিছুটা সফলতা পেলেও, পরবর্তী নবম পরিকল্পনাটি তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। বিশেষ করে, শিল্পোন্নতির ক্ষেত্রে ধার্য লক্ষ্যমাত্র ছিল যেখানে 8.2%, সেটি প্রায়-3.3%-এ নেমে গিয়ে বাস্তবে 4.9%-এ পৌঁছে সামগ্রিক এক হতাশার। সৃষ্টি করেছে। বেকারত্বের হার এই সময়কালে যেমন যথেষ্ট বৃদ্ধি ঘটেছিল, তেমনই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের মাত্রা ছিল পূর্ববর্তী অষ্টম পরিকল্পনার মতোই। এই সময় দেশের বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে রপ্তানি হারও 11.8% থেকে 7.9%-এ নেমে এসেছিল।
দশম পরিকল্পনায় বার্ষিক স্কুল অভ্যন্তরীণ মূলধন গঠনের হার 32.0 শতাংশে পৌঁছালেও, তার সুফল দেশের দরিদ্র বা অসহায় মানুষদের কাছে পৌঁছতে পারেনি।
একাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতে দেখা যায়, দেশের উৎপাদিত দ্রব্যের মুনাফায় মালিক শ্রেণি যথেষ্ট লাভবান হয়ে উঠলেও, শ্রমিকদের মজুরি বাবদ আয় যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছিল। আবার, অধিক পরিমাণে আমদানিকৃত কৃষিজ পণ্যের জন্য কৃষক সুরক্ষার দিকটিও এই সময় যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়।
অন্যান্য দুর্বলতা (Others Weakness)
ভারতের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার বিভিন্ন সময়কালে একাধিক ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞরা আরও যে কয়েকটি রিশেষ দুর্বলতাকে সামগ্রিকভাবে চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-
বিভিন্ন পরিকল্পনাকালে ভারতে শিল্পায়নের ব্যাপক অগ্রগতি ঘটা সত্ত্বেও দেশের কর্মশস্তির উন্নতিকরণে পেশাগত ক্ষেত্রগুলিতে সেরকম কোনও পরিবর্তন আসেনি। বিশেষত, বৃহদায়তন শিল্প ও অবকাঠামো খাতে চিত্তাকর্ষক উন্নয়ন ঘটা সত্ত্বেও, বিগত পঞ্চাশ বছরে ভারতে কৃষিতে নিযুক্ত শ্রমিকের পরিমাণ এবং তাদের প্রচলিত জীবনযাত্রা লক্ষ্যণীয়ভাবে প্রায় একই থেকে যায়।
সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনাকালে শিল্পে উৎপাদন-মিশ্রণ এবং প্রযুক্তি-মিশ্রণ এতটাই পুঁজিনিবিড় হয়েছে, যার ফলে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন যথেষ্ট উচ্চহারে বৃদ্ধি ঘটেছে। যেমন-1961 এবং 1976-এর মধ্যে, অত্যধিক কারখানার আধুনিকীকরণ খাতে বিনিয়োগ 139% এবং উৎপাদন 161% বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু এই সময়কালে কর্মসংস্থান মাত্র 71% বেড়েছে। অন্যদিকে, মোট উৎপাদনে প্রতি ইউনিট প্রতি কর্মসংস্থান 34% এবং ইউনিট প্রতি মূলধন 28% হ্রাস পেয়েছে। এই তথ্যানুসারে বলা যায়, তৎকালীন প্রেক্ষাপটে বিনিয়োগের জন্য মূলধনের তীব্রতা বেশি থাকা সত্ত্বেও শিল্পখাতে তেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। এই একই ধারাবাহিকতা অন্যানা কয়েকটি পরিকল্পনার বছরগুলিতেও সমানভাবে বজায় ছিল। 1999-2000 খ্রিস্টাব্দে মাধ্যমিক খাতে কর্মসংস্থান ছিল কর্মক্ষম জনসংখ্যার 15.8%। পরবর্তী অর্থনৈতিক সংস্কারের সময়গুলিতেও দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির হার যথেষ্ট হ্রাস করা হয়েছে।
ভারতীয় পরিকল্পনায় সামাজিক লক্ষ্যমাত্রার পরিবর্তে আর্থিক লক্ষ্যমাত্রাকে এত বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল যে বিগত সত্তর বছরেও এই পরিকল্পনার সুফল দেশের জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশের ভাগ্যকে কোনোভাবেই স্পর্শ করতে পারেনি। আসলে, সহায়ক সম্পদের (অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণ) একটি বড়ো অংশ বরাবরই বিদেশি উৎস থেকে আসায়, বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতগুলিও পর্যাপ্ত সহায়ক সম্পদ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে। আবার, বিভিন্ন সরকারি নীতিতে সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য প্রচ্ছন্নভাবে টিকিয়ে রাখার ফলে দেশের প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলগুলির লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের ন্যূনতম সীমান্তরেখারও নিচেই থেকে গেছে।
যদিও আমরা পরিকল্পনার মাধ্যমে দেশের উৎপাদনগত বেশকিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছি, কিন্তু তাসত্ত্বেও সামাজিক বা রাজনৈতিক নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, নারী সুরক্ষাসহ একাধিক সমস্যাগুলি আগের চেয়ে অনেক বেশি করে প্রকট হয়েছে।
ভারতীয় অর্থনীতি একাধিক পরিকল্পনাকালে নিরবচ্ছিন্ন মুদ্রাস্ফীতির মুখোমুখি হয়েছে। কখনো কখনো এই মুদ্রাস্ফীতি বার্ষিক 5% থেকে 10% পর্যন্ত বর্ধিত মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। এর ফলে, একদিকে যেমন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে, অন্যদিকে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি ঘটিয়ে দেশের অর্থনীতিকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন করেছে। এই পরিস্থিতিতে ধনিক শ্রেণির সমৃদ্ধিতে কোনও পরিবর্তন না দেখা দিলেও, সাধারণ মানুষের জীবন কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়।
ভারতীয় পরিকল্পনায় নতুন দৃষ্টিভভিগ "এলপিজি (LPG)" (LPG in Indian Planning)
1991 খ্রিস্টাব্দে ভারতের আঞ্চলিক তথা অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় এলপিজি সংস্কার হল এমন একটি কৌশলগত পরিবর্তন, যা এদেশের উন্নয়নমূলক বাস্তবতার অভিমুখটিকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। নতুন এই দৃষ্টিভঙ্গিটি শুধু ভারতীয় অর্থনীতির ভিত্তি গঠন করেছে তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্তরের বেশ কিছু পরিমার্জিত কৌশল ভারতের আঞ্চলিক পরিকল্পনার পথকে যথেষ্ট সম্প্রসারিত করেছে।
• অর্থ (Meaning): LPG দৃষ্টিভঙ্গি আসলে তিনটি বিশেষ শব্দের সমন্বয়মূলক ধারণা যেটিকে বর্তমানে ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারে প্রয়োগমূলক নীতিরূপে গ্রহণ করা হচ্ছে। এই ধরনের পরিকল্পনা কৌশলের তিনটি উল্লেখযোগ্য শব্দ হল-
• উদারীকরণ (Liberalization): এখানে উদারীকরণ বলতে খোলা বাজারের উন্মুক্তকরণ নীতির মাধ্যমে ভারতে শুল্ক হ্রাস বা শুল্কবিহীন বাধা অপসারণের প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়ে থাকে।
• বেসরকারীকরণ (Privatization): এই ধারণাটিকে উল্লেখযোগ্য স্তঞ্জ ব্যক্তিগত মালিকানাধীন সত্তায় কোনও সরকারী সম্পত্তি বা ব্যবসার মালিকানা হস্তান্তরের সমর্থনমূলক পদক্ষেপকে বোঝানো হয়েছে।
* বিশ্বায়ন (Globalisation): দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসার ঘটানোর লক্ষ্যে এই নীতিটি গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রাক-সংস্কার যুগের অর্থনৈতিক পটভূমি (The Economic Background of the Pre-reform eralt
জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখে ভারতে বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও, স্বাধীনতা পরবর্তী যুগের অর্থনীতিতে আরও কয়েকটি সমস্যা বিশেষভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। যেমন-
নকব্বইয়ের দশকের আশেপাশে মুদ্রাস্ফীতির হার 6.7% থেকে বেড়ে 16.7% হয়ে যাওয়ায় দেশে অর্থ সরবরাহের পরিমাণ অনেক কমে গিয়েছিল।
আর্থিক ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে সুদের হার যেমন গেড়েছিল, তেমনই অনুন্নত পরিকাঠামো, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাজস্ব ঘাটতিও তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র সুদের চাপে মোট প্রদেয় সরকারি অর্থ ব্যয়ের পরিমান 36.4% বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(iii) বিগত দশকগুলিতে আর্থিক ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে যে পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ ভারতকে গ্রহণ করতে হয়েছিল, তার জন্য প্রদেয় অর্থ সুদরূপে পরিশোধ করতেই প্রড়র পরিমানে অর্থ ব্যয় হয়ে যাচ্ছিল।
(iv) 1990-91 খ্রিস্টাব্দে ইরাকে যুদ্ধের পরিণতিস্বরূপ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে পেট্রোলের দাম ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। ফলস্বরূপ, ভারতের অর্থনীতিও সমস্যার সম্মুখীন হয়।
(v) সেই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর ভাঙ্গানকে ঘিরে আমাদের দেশেও সমালোচনার ঝড় ওঠে। অন্যদিকে, চিনে দেং জিয়াওপিং কর্তৃক বাজার-বান্ধব সংস্কারের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন, তার পক্ষে ভারতের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ ইতিবাচক মনোভাব ব্যস্ত করেন।
• নতুন অর্থনীতি ঘোষণা (New economic announcement): উল্লিখিত পরিস্থিতির মোকাবিলায় 1991 খ্রিস্টাব্দের 24 জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাওয়ের তত্ত্বাবধানে LPG বা উদারীকরণ, বেসরকারীকরণ এবং বিশ্বায়নের সমন্বয়ী মডেলরূপে ভারতের নতুন অর্থনৈতিক নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল। এই প্রচেস্টাটিকে 1996 খ্রিস্টাব্দে সেবেস্তিয়ান এডওয়ার্ডস (Sebastian Edwards) দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার বা "Second Generation Reform" বলে উল্লেখ করেছেন।
মূল উদ্দেশ্য (The Main Purpose): অর্থনৈতিক উদারীকরণে বাজারমুখী স্থিতিশীলতা অর্জনে ভারতীয় অর্থনীতিকে বিশ্বের আঙিনায় পৌঁছে দিতে LPG নীতি গ্রহণের প্রধান প্রধান লক্ষ্যগুলি ছিল-(1) শিল্প ক্ষেত্রে লাইসেন্সিং বা পারমিট রাজ বিলুপ্ত করা। (ii) পাবলিক সেক্টরের ভূমিকা বৃদ্ধিকরণ। (iii) বেসরকারীকরণ প্রচেষ্টার সম্প্রসারণ। (iv) অবাধ বিদেশি বিনিয়োগ এবং প্রযুক্তি প্রবেশের ধারাবাহিকতা রক্ষা। (v) শিল্প অবস্থান নীতিকে উদারীকৃত করা। (vi) বাধ্যতামূলক রূপান্তরযোগ্য কর অপসারণ বা কর কমানো। (vii) দেশে আমদানির শুল্ক কমানো। (viii) বাজার দরকে সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ, প্রভৃতি।
প্রভাব (Impact):
ভারতে LPG সংস্কারের বেশ কয়েকটি ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যেমন-
(i) 1990-91 খ্রিস্টাব্দে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল যেখানে মাত্র 1.1%, প্রতি বছর তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে 2015-16 খ্রিস্টাব্দে 7.5% হয়েছিল।
(ii) 1991 সাল থেকে, ভারতে যে বিদেশি বিনিয়োগের পথ সম্প্রসারিত করা হয়েছিল, তার ফলস্বরূপ 2019-20 খ্রিস্টাব্দে (আগস্ট পর্যন্ত) এদেশে প্রায় 19.33 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে আর্থিক মূল্যের বিদেশি বিনিয়োগ ঘটেছে।
(iii) 1991 খ্রিস্টাব্দে ভারতে বেকারত্বের হারও যথেষ্ট বেশি ছিল। কিন্তু নতুন এলপিজি নীতি গ্রহণ করার পর উদারীকরণের হাত ধরে একাধিক বিদেশি কোম্পানি বা উদ্যোক্তা এদেশে আসতে থাকায় কর্মসংস্থানে ব্যাপক জোয়ার আসে।
(iv) তাছাড়া, LPG মডেল গ্রহণে ভারতের রপ্তানি বাণিজ্য অক্টোবর, 2019 পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় 26.38 বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।