নিরক্ষীয় জলবায়ু (Equatorial Climates)
নিরক্ষরেখার উভয়দিকে এই ধরনের জলবায়ু লক্ষ করা যায় বলে এটি নিবন্ধীয় জলবায়ু নামে পরিচিত। তবে ৫ জলবায় ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য জলবায় ও ক্রান্তীয় উদ্বু ও আর্দ্র জলবায়ু নামেও পরিচিত। দক্ষিণ আমেরিকার আমা অববাহিকা-এই জলবায়ুর দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় এর অপর নাম হল আমাজনীয় প্রকৃতির জলবায়
• ভৌগোলিক অবাজান (Geographical Locations)
• অক্ষাংশগত অবস্থান নিরক্ষীয় জলবায়ু ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য বা ক্রান্তীয় উয় ও আর্দ্র জলবায়ু নামে পরিচিত এই জলবায়ু নিরক্ষরেখার উভয় পার্শ্বে 5°-10° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষরেখার মধ্যে বিস্তৃত। মহাদেশগুলির পূর্ব প্রাক্টা দেশসমূহে এই জলবায় 15° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশ পর্যন্ত বিস্তুত, এমনকি এটি 25° উত্তর ও দক্ষিণ অক্ষাংশের লক্ষ করা যায়। জলবায়ুবিদ অস্টিন মিলার (Austin Millar) মাতে, আদর্শ নিরক্ষীয় জলবায়ু প্রকৃতপক্ষে ২' উদ্ধ অক্ষাংশ থেকে ৪° উত্তর অক্ষাংশের মধ্যে লক্ষ করা যায়, তবে নিরক্ষরেখা বরাবর নয়। এই জলবায়ু অঞ্চল মেরা দিকে সাভানা জলবায়ুর দ্বারা সীমাবন্দ।
• দেশীয় অবস্থান নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চল বিভিন্ন মহাদেশের অন্তর্গত যেসব দেশে বিস্তৃত, তা নিচে উল্লেক করা হল-
1. দক্ষিণ আমেরিকা আমাজন অববাহিকার ব্রাজিল (দক্ষিণাংশ ছাড়া), পেরু, বলিভিয়া, ইকুয়েডর, কলম্বিয় গায়ানার উপকূলভাগ ও ভেনেজুয়েলার অংশবিশেষ।
2. মধ্য আমেরিকা পানামা, নিকারাগুয়া, কোস্টারিকা, হন্ডুরাস প্রভৃতি দেশসমূহের পূর্বাংশ এবং পলিঃ ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের পূর্বাংশ।
3. আফ্রিকা কঙ্গো অববাহিকার অন্তর্গত কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, জায়ের, ক্যামেরুন। এ ছাড়া আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলের দেশসমূহ, যথা-গ্যাবন, দক্ষিণ-পূর্ব নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন, আইভরি কোস্ট, বারকিনোফসে গিনি, পূর্ব উপকূলের কেনিয়া, টাঙ্গানাইকা, জাঞ্জিবার, পেম্বা ও মাদাগাস্কারের পূর্বাংশ।
4. এশিয়া ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ অংশ ও শ্রীলঙ্কার দক্ষিণভাগ
5. ওশিয়ানিয়া পাপুয়া নিউগিনিসহ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী দ্বীপসমূহ।
• নিরক্ষীয় জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Equatorial Climate)
সূর্যরশ্মি সারাবছর প্রায় লম্বভাবে পতিত হয় বলে এই অঞ্চলে উচ্চ তাপমাত্রা বিরাজ করে। স্থায়ী নিম্নচাপ বলয়ের অধীন হওয়ায় উত্তর-পূর্ব আয়ন বায়ু ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই দুই প্রকার বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে আনে এবং পরিচলন প্রক্রিয়ায় সারাবছর প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। এখানে একটিমাত্র ঋতু, অর্থাৎ, আর্দ্র গ্রীষ্ম ঋতু লক্ষ করা যায়। ঋতুবৈচিত্র্যহীন এই জলবায়ুর বৈশিষ্টাগুলি নিচে আলোচন করা হল-
1. উষ্ণতা-সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য:
(i) এই জলবায়ু অঞ্চল 5°-10° অক্ষাংশের মধ্যে বিস্তৃত হওয়ায় মধ্যদিনের সূর্য প্রায় মাথার ওপরে অবসান করে। ফলে দিন ও রাতের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান থাকে এবং সারাবছর সূর্যরশ্মি প্রায় লম্বভাবে পতিত হওয়ায় উন্নত। প্রায় একই রকম থাকে।
(ii) এই অঞ্চলের গড় মাসিক উয়তা 24° থেকে 27° সেঃ হয়ে থাকে.
(iii) বার্ষিক উদ্বৃতার প্রসর খবই কম-2° থেকে 3° সেঃ সমুদ্র উপকূলে এবং দ্বীপসমূহে উন্নতার প্রসর আরও কম। পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে বার্ষিক উন্নতার প্রসর ০° সেঃ।
(iv) নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে গড় বার্ষিক উন্নতার তারতম্য অপেক্ষা দৈনিক উন্নতার তারতম্য বেশি। দৈনিক উয়তার প্রসর 5° থেকে 15° সেঃ পর্যন্ত হয়ে থাকে। রাতের উয়তা দিনের সর্বোচ্চ উন্নতা থেকে 15° সেঃ পর্যন্ত কমে আসে, ফলে, স্থানীয় অধিবাসীরা রাতে শীতকালের মতো শীত অনুভব করে। সেজন্য বলা -Night is the winter of the Tropics
(v) দিনের বেলা সর্বোচ্চ উন্নতা কদাচিৎ 38° সেঃ অতিক্রম করে। তবে সর্বনিম্ন উন্নতা কখনোই। ২° সেঃ-এর নিচে নামে না
(vi) একদিকে অত্যধিক আপেক্ষিক আর্দ্রতা ও উচ্চ তাপমাত্রা এবং অনাদিকে বায়ু-চলাচল প্রায় থাকে না বালে বিকালের আবহাওয়া অসহনীয় হয়ে ওঠে
(vii) রাতে উন্নতা হ্রাসের ফলে ভোরের দিকে কুয়াশা ও শিশিরের সৃষ্টি হয়।
(viii)সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সময় নিরক্ষীয় নিম্নচাপ বলয়ের স্থান পরিবর্তনের জন। কোনো কোনো অংশে আয়ন বায়ু প্রবেশ করলে আবহাওয়া কিছুটা আরামদায়ক হয়।
(ix) এই অঞ্চলে উয়তার প্রসর বিশেষ না থাকায় এখানে কোনো ঋতু পরিবর্তন হয় না। এখানে একটিা মাত্র ঋতু অথাৎ, উদ্বু-আর্দ্র ঋতু বিরাজ করে।
বায়ুর চাপ ও বায়ুপ্রবাহ সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য:
(i) সারাবছর বেশি উদ্ভুতার কারণে এই অঞ্চলে একটি স্থায়ী নিম্নচাপ বলয় সৃষ্টি হয়েছে। এখানে বায়ুর গড় চাপ 1009 থেকে 1012 মিলিবারের মধ্যে থাকে।
(ii) সারাবছর এই অঞ্চলে একই রকমের উচ্চ তাপমাত্রা থাকায় উদ্বুতার পার্থক্য এবং বায়ুর চাপীয় ঢাল (Pressure gradient) খুবই কম থাকে। ফলে, বাতাস প্রায় গতিহীন হয়ে পড়ে। তাই, এই অঞ্চল নিরক্ষীয় শাস্ত্রমণ্ডল (Equatorial Doldrum) নামে পরিচিত।
(iii) এই অঞ্চলের বায়ু তীর সৌরকিরণের জন্য উত্তপ্ত হয়ে পরিচলন স্রোত (Convection current) সৃষ্টি করে। উকর্ণমুখী বায়ু প্রসারিত হয়ে শীতল হয় এবং ঘনীভূত হয়ে প্রচুর পরিমাণে পরিচলন বৃষ্টিপাত ঘটায়।
(iv) উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু এই অঞ্চলে মিলিত হয়ে আন্তঃক্রান্তীয় অভিসারী অঞ্চল (Inter Tropical Convergence Zone সংক্ষেপে ITCZ) সৃষ্টি করে।
(v) উল্ল বাতাস জলীয় বাষ্পপূর্ণ হওয়ায় মহাদেশগুলির অভ্যন্তরভাগে আবহাওয়া ঘর্মাক্ত ও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। কিন্তু উপকূলবর্তী অঞ্চলে ঠান্ডা সমুদ্রবায়ু বিকালের আবহাওয়াকে মনোরম করে তোলে।
(vi) মাঝে মাঝে বজ্রঝড় (Thunderstorm) ও বৃষ্টির সঙ্গে দমকা বাতাস কষ্টদায়ক ভ্যাপসা গরমের হাত থেকে রক্ষা করে।
মেঘাচ্ছয়তা ও বৃষ্টিপাত সংক্রান্ত বৈশিষ্ট্য:
(i) নিরক্ষীয় জলবায়ুর অন্যতম বৈশিস্টন হল বর্ষব্যাপী মেঘাচ্ছন্নতা। এই অঞ্চলের প্রায় পুরো আকাশ নীরদ পুঞ্চমেযে (Cumulonimbus) ঢাকা থাকে।
(ii) মেঘাচ্ছন্নতা ও আর্দ্রতা-এই অঞ্চলের জলবায়ুকে অসহনীয় করে তোলে। অতি আর্দ্র অঞ্চল রাতের বেলায় দিনের মতো সমানভাবে অসহনীয়।
(iii) সাধারণত প্রতি সকালে ও রাতের বেলায় আকাশ নির্মল ও মেঘমুক্ত থাকে। দুপুরের আগে থেকেই মেঘ জমতে শুরু করে এবং তা বিকাল ওটে থেকে এটের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎ-সহ প্রবল বৃষ্টিপাত ঘটায়। এজন্য একে Four O'Clock Rain বলে।
(iv) এই অঞ্চলে মেঘাচ্ছন্নতার কারণেই সৌরশক্তির তাপীয় ফলের অধিগ্রহণ-উপক্রান্তীয় অঞ্চল অপেক্ষা কম।
(v) নিরক্ষীয় অঞ্চলে সারাবছর ধরে পরিচলন বায়ুস্রোতের জন্য প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 250 সেমি।
(vi) শুষ্কতম মাসেও 6 সেমি-র কম বৃষ্টিপাত হয় না।
(vii) বৃষ্টিপাতের বণ্টন সর্বত্র সমান নয়। পেরুর ইকুইটসে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ 261 সেমি এবং আকাসায় এর পরিমাণ 365 সেমি। ওসেন আইল্যান্ডে কিছুটা কমে 213 সেমি হয়।
(viii) স্থলভাগ অপেক্ষা জলভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি।
(ix) পরিচলন প্রক্রিয়ায় বৃষ্টি হলেও বায়ুর গতিপথ পর্বতগাত্রে বাধা পেলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হয়। যেমন আফ্রিকার ক্যামেরুন পর্বতের পাদদেশ অঞ্চলে (প্রতিবাত ঢালে) এটি প্রায় 1000 সেমি।
(x) বৃষ্টিপাতের সময় বজ্রঝড় সংঘটিত হয়। এই অঞ্চলের সর্বত্র 75 থেকে 150 দিন বজ্রঝড় হয়ে থাকে। জাভা দ্বীপে প্রায় 300 দিন বজ্রঝড় হয়ে থাকে। পরিচলন বৃষ্টি ছাড়াও, এই অঞ্চলে দুর্বল ঘূর্ণিবাতের আবির্ভাবের কারণেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।
(xi) সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়নের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি বলয়ও উত্তর ও দক্ষিণে সরে যায়। তাই বলা যায়, বষ্টি সূর্যের অনুগামী (Rain follows the Sun)। এই কারণে নিরক্ষরেখার কাছাকাছি জায়গায় উদ্বুতা ও বৃষ্টিপাতসূচক লেখচিত্রে বৃষ্টিপাতের দুটি শীর্য লক্ষ করা যায়।
(xii) নিরক্ষীয় অনালে মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেমন বেশি, তেমনি বর্ষীর দিনসংখ্যাও বেশি। এই অঞ্চলে বছরে 200 থেকে 3030 দিন বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আমাজন অববাহিকার বেথেম শহরে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত 239 সেমি এবং বর্ষণ দিনের সংখ্য 243।
• স্বাভাবিক উদ্ভিদ (Natural Vegetation):
বর্ষব্যাপী উচ্চ তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের জন্য এই জলবায়ু অঞ্চলে ঘন চিরহরিৎ অরণ্য গড়ে উঠেছে। এটি প্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্য (Equatorial Rain Forest) বা সেলভা (Selva) নামে পরিচিত। এই অরণ্যের সর্বোচ্চ দূরে সূর্যালোক প্রাপ্তির পরিমাণ বেশি (25%), কিন্তু নিম্নাংশে এর পরিমাণ। শতাংশেরও কম। তাই সূর্যালোক শাওয়ার জন্য বৃক্ষগুলির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা চলে। এই কারণে বৃক্ষগুলি সুউচ্চ ও বড়ো বড়ো পাতা বিশিষ্ট হয়। ভূমিভাগে সূর্যের আলো কম পড়ায় বীজের অঙ্কুরোদদম যেমন কম, তেমনি চারাগাছেরও বিশেষ বৃদ্ধি ঘটে না। শালোকের প্রাপ্যতার ওপর নির্ভর করে এই অঞ্চলে বৃক্ষের পাঁচটি সুস্পষ্ট স্তর লক্ষ করা যায়।
• উদ্ভিদগোষ্ঠী: এই অরণ্যে বৃক্ষ, লতানো উদ্ভিদ বা আরোহী ও পরজীবী উদ্ভিদই প্রধান। এই অঞ্চলের প্রধান প্রধান বৃক্ষগুলি হল-আয়রন উড, মেহগনি, আবলুস, বন্য রবার, রোজউড প্রভৃতি। এই অরণ্যের বৃক্ষগুলি প্রশস্ত শরবিশিষ্ট ও চিরহরিৎ প্রকৃতির। বৃক্ষগুলি প্রচণ্ড ভারী ও শক্ত, কাঞ্চলযুক্ত হয়।
* প্রাণীগোষ্ঠী (Animals): এই অঞ্চলে বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ, পাখি, বাদুড়, পোকামাকড়, তৃণভোজী প্রাণী ও মাংসাশী প্রাণী লক্ষ করা যায়। তৃণভোজীদের মধ্যে হরিণ, ইদুর, কাঠবিড়ালী উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে বাদুড়, হনুমান, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং মাংসাশীর মধ্যে শকুন, বাজপাখি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।