কোপেনকৃত জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগের দোষ-গুণের পর্যালোচনা (Demerits-Merits of climatic classification by Koppen)
বিখ্যাত জলবায়ুবিদ কোপেন বৃষ্টিপাত ও উন্নতা, এই দুটি প্রাকৃতিক উপাদানের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর দ্বিত্তি করে তাঁর জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগটি উপস্থাপন করেন। খুব সহজেই জলবায়ুর এই উপাদান দুটির পরিমাপ করা যায় বলে কোপেনের এই শ্রেণিবিভাগটি সর্বাধিক প্রচলিত। কোপেনের এই শ্রেণিবিভাজনটি সারা পৃথিবীতে প্রথম জলবায়ুর বিজ্ঞানভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ হিসেবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। কিন্তু কোপেনের পরবর্তী জলবায়ুবিদগণ ও গবেষকগণ তাঁর জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগের অনেকগুলি গুরুতর ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন।
(ক) দোষ বা ত্রুটি (Demerits):
(i) কোপেন তাঁর জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগে পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে বৃষ্টিপাত ও উন্নতা ছাড়া অন্য কোনো উপাদানকে না নেওয়ায়, জলবায়ু অঞ্চলের পরিসংখ্যান অতি অল্প হয়ে দাঁড়ায় বলে শ্রেণিবিভাগটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
ii) কোপেন তাঁর শ্রেণিবিভাগের ক্ষেত্রে, স্বাভাবিক উদ্ভিদের বণ্টনের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন, যা জলবায় অঞ্চলের শ্রেণিবিভাজনটিকে অনেকক্ষেত্রে জটিল করে তুলেছে। যেমন-তিনি আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে পাগেড সাউন্ড অঞ্চল ও মধ্য ক্যালিফোর্নিয়াকে একই ভূমধ্যসাগরীয় (Cs) অঞ্চলের অন্তর্গত করেছেন। কিন্তু এই দুটি অঞ্চলের উদ্ভিদ বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
(iii) কোপেনের জলবায়ু অঞ্চলের সীমানাগুলি যদিও সমতল অঞ্চলের ওপর প্রযোজ্য, কিন্তু কোনো উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করলে তা ভুল তথ্য প্রদান করে।
(iv) পৃথিবীর প্রধান প্রধান জলবায়ু অঞ্চলগুলি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করলেও দুটি প্রধান জলবায়ু অঞ্চলের প্রান্তবর্তী অংশের জলবায়ু যে ভিন্ন প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য বহন করে, সেই সম্পর্কে কোপেন কোনোরকম ব্যাখ্যা দেননি। অর্থাৎ, তাঁর শ্রেণিবিভাজনে দুটি অঞ্চলের অন্তর্বর্তী জলবায়ু অঞ্চলকে আলাদা করে দেখানো সম্ভব হয়নি।
(v) কোপেনকৃত জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগ (1936 অনুযায়ী) মূলত পাঁচ প্রকার। ফলে বিশাল পৃথিবীর শ্রেণিবিভাগের জন্য তিনি এই পাঁচটি অঞ্চলকে বহু উপবিভাগে ভাগ করেন। এর ফলে অনেকক্ষেত্রে প্রধান শ্রেণিবিভাগের সঙ্গে অসংখ্য উপবিভাগের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না।
(vi) কোপেন তাঁর শ্রেণিবিভাগে গড় তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন, যথা-A. C. ও D। কিন্তু অধ্যক্ষেপণের সঙ্গে বাষ্পীভবনের সম্পর্কের ভিত্তিতে শুষ্ক জলবায়ুর জন্য কেবলমাত্র B ও E জলবায়ুকেই নির্দেশ করেছেন।
(খ) গুণ (Merits):
(i) কোপেন তাঁর জলবায়ুর শ্রেণিবিভাজনে অধঃক্ষেপণের পরিমাণ ও ঋতুগত বণ্টন এবং বায়ুর তাপমাত্রাকে মূল ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ফলে শ্রেণিবিভাজনটি অনেকটাই সরল ও সকলের বোধগম্য হয়েছে।
(ii) কোপেন তাঁর জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগে পৃথিবীর প্রধান প্রধান স্বাভাবিক উদ্ভিদ অঞ্চলের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কারণ উদ্ভিদের জন্ম ও বৃদ্ধি শুধুমাত্র অধঃক্ষেপণের ওপর নির্ভর করে না, বাষ্পীভবন ও প্রস্বেদনের হারের ওপর নির্ভরশীল। তাই তিনি বৃষ্টিপাতের কার্যকারিতা (Precipitation effectiveness) এবং বাষ্পীভবনের প্রাবল্য (evaporation intensity) নির্ণয় করার জন্য বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রাকে একই ফর্মুলায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
(iii) কোপেনের জলবায়ুর শ্রেণিবিভাগের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দিক হল বিভিন্ন জলবায়ুর সাংকেতিক নামকরণ। প্রত্যেকটি সাংকেতিক নামকরণে অক্ষর-চিহ্নের নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে বলে জলবায়ুর বৈশিষ্ট্যগুলি খুব সহজে বোঝা সম্ভব।
(iv) বিভিন্ন অঞ্চলে বায়ুর তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের তথ্যের ওপর নির্ভর করে শ্রেণিবিভাগটি করা হয়েছে বলে শ্রেণিবিভাজনটি বাস্তব অভিজ্ঞতাভিত্তিক (empirical classification)
(v) এই শ্রেণিবিভাগের কোনো কোনো জলবায়ু অঞ্চল অথবা উপঅঞ্চলের সঙ্গে পৃথিবীর প্রধান বায়ুসঞ্চালন অঞ্চলসমূহের (আয়ন বায়ু, প্রত্যয়ন বায়ু) বেশ কিছু কিছু মিল লক্ষ করা যায়।
(vi) এই শ্রেণিবিভাগের মধ্যে খুব সহজেই পরবর্তী নতুন জলবায়ু বিভাগের সংযোজন করা যায়।
(vii) তাঁর শ্রেণিবিভাগে শীতল অঞ্চলের শীতকালে এবং উয় অঞ্চলের গ্রীষ্মকালে যদি একই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়। তবে উন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির কার্যকারিতা অনেক কম হয়, কারণ বাষ্পীভবন উদ্বু অঞ্চলে বেশি হয়।
থর্নথওয়েটের শ্রেণিবিভাগ (Thornthwaite's classification)
কোপেনের সমসাময়িক আরও একজন আমেরিকান আবহবিদ CW.Thornthwaite কোপেনের থেকে একটু এলাদাভাবে পৃথিবীর জলবায়ুকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করার চেষ্টা করেন। 1931 সালে 'Geographical Review' পত্রিকায় প্রকাশিত 'The climates of North America according to a new classification' শীর্ষক প্রতিবেদনে ধর্মথওয়েট প্রথম জলবায়ুর শ্রেণিবিন্যাসসম্পর্কে তাঁর ধারণা উপস্থাপন করেন। তবে এই শীর্ষকে তিনি কেবলমাত্র উত্ত আমেরিকার ওপর শ্রেণিবিন্যাসটি প্রয়োগ করে উত্তর আমেরিকার একটি জলবায়ু-মানচিত্র প্রকাশ করেন। 1933 সালে পুনরায় Geographical Review' পত্রিকায় The climates of the Earth' শীর্ষক প্রতিবেদনে 1931 সালে নির্ণীত জলবায়ু অঞ্চল নির্ধারণ সংক্রান্ত তাঁর ধারণাগুলির ওপর ভিত্তি করে পৃথিবীকে কতকগুলি জলবায়ু অঞ্চলে বিভাজিত করে বিশ্ব মানচিত্রে তা তুলে ধরেন। পরবর্তীকালে 1948 সালে পৃথিবীর জলবায়ু নির্ধারণ সংক্রান্ত তাঁর ধারণাগুলিকে আমূল পরিবর্তন করে কিছু নতুন সূচক তৈরি করেন যার ভিত্তিতে তিনি সমগ্র পৃথিবীর জলবায়ুর পুনরায় শ্রেণিবিভাজন ও তাদের উপবিভাজন করে Geographical Review পত্রিকায় "An Approach Towards a Regional Classification of Climate" শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশ করেন। এরপর 1955, 1957 এবং 1958 সালে তাঁর প্রদত্ত নতুন সূচকগুলিকে পুনর্বিন্যাস করলেও পৃথিবীর জলবায়ুর শ্রেণিবিন্যাসের কোনোরূপ পরিবর্তন তিনি করেননি।
থনওয়েট-কৃত জলবায়ুর শ্রেণিবিন্যাসটি অন্যান্য আবহবিদের সৃষ্ট জলবায়ুর শ্রেণিবিন্যাসগুলি থেকে একটু আলাদা। বেশির ভাগ শ্রেণিবিভাজনেই তিনি তাপমাত্রার পার্থক্যের ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিকভাবে জলবায়ু অঞ্চলের শ্রেণিবিন্যাস করেন। কিন্তু Thornthwaite-ই প্রথম যিনি অধঃক্ষেপণ ও বাষ্পীভবনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে উপযুক্ত তথ্যের সাহায্যে গাণিতিক ও সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতিতে জলবায়ু অঞ্চলের বিভাজন করেন। থর্নর্থওয়েটের পূর্বে আরও বেশকিছু গবেষক জলবায়ু অঞ্চল নির্ধারণের ক্ষেত্রে অধঃক্ষেপণ ও বাষ্পীভবনের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে জলবায়ুর শ্রেণিবিভাজন করার কথা উল্লেখ করলেও উপযুক্ত তথ্যের অভাবে তাঁরা তাঁদের এই মতামত প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। সুতরাং Thornthwaite-এর বিশ্ব জলবায়ু বিভাজন নির্ধারণের দুটি মূল ভিত্তি হল-
(a) তাপমাত্রার পরিবর্তে অধঃক্ষেপণ ও বাষ্পীভবনের পারস্পরিক সম্পর্কের বিশ্লেষণ ।
(b) স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও মৃত্তিকার বণ্টনের পার্থক্যের ভিত্তিতে দুটি জলবায়ু অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ না করে গাণিতিক ও সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতির ব্যবহার।