ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের ধারণা(Concept of Regional Disparity in India)
■ সমতা থেকে বৈষম্যের দিকে অভিমুখিতা (A Shift from inequality to disparity)
আমরা আগেই জেনেছি, প্রয়োগমূলক বা ব্যবহারিক দিক থেকে অসমতা এবং বৈষম্যের মধ্যে বেশ কয়েকটি পার্থক্য থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে বিষয় দুটির মধ্যে বেশ কিছুটা স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। আঞ্চলিক অসাম্যের বিষয়টিতে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের চিরাচরিত সাধারণ আর্থসামাজিক পরিস্থিতি অনুসারে বিবেচনা করা হয় বলে, তা থেকে আর্থসামাজিক ভারসাম্যহীনতার মাত্রা ঠিক কতটা প্রকট তা বোঝা যায় না। সেই কারণে, আঞ্চলিক উন্নয়নের নিরিখে বর্তমানে প্রায় সমস্ত দেশ আঞ্চলিক বৈষম্য কথাটিকেই ব্যবহারে সর্বাধিক আগ্রহী। বস্তুত, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির নিরিখে বৈষম্যের ধারণাটি অসাম্যের তুলনায় আরও বেশি প্রকট, স্বতঃপ্রণোদিত এবং যথেষ্ট উদ্বেগজনক, তাই উন্নয়নের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য সমস্ত দেশ এই ধরনের সীমাবদ্ধতাগুলি হ্রাস করার ক্ষেত্রে ইতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেআমরা আগেই জেনেছি, প্রয়োগমূলক বা ব্যবহারিক পার্থক্য থাকলেও, কার্যক্ষেত্রে বিষয় দুটির মা বেশ করেী স্বতন্ত্রতা পরিলক্ষিত হয়। আঞ্চলিক অসাম্যের বিষয়া পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের চিরাচরিত সাধারণ আর্থসামারির পরিমিতি অনুসারে বিভোর করা হয় বলে, তা থেকে আর্থসামাজিক ভারসাম্যহীনতার মাত্রা ঠিক কতটা প্রশ্নটা বোঝা যায় না। সেই কারণে, আঞ্চলিক উন্নয়নের নিবিয়ে বর্তমানে প্রায় সমস্ত দেশ আঞ্চলিক বৈষম্য কথাটির ব্যবহারে সর্বাধিক আগ্রহী। বস্তুত, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির নিরিখে বৈষম্যের ধারণাটি অসাম্যের তুলনায় আরও বেশিহয়।
তবে এখানে একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখা দরকার, আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ধারকগুলিকে বৈষম্য (Disparity)-এর আকারে উপস্থাপন করা হলেও, সামাজিক নির্ধারকগুলির ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা প্রায়শই অসামা (Inequality) কথাটিকে অধিক ব্যবহার করে থাকেন।
■ ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রকাশ (Disclosure of regional disparities)
ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের বহিঃপ্রকাশ প্রসঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় খুব সহজাতভাবেই উঠে আসে, যেমন-
1. প্রাকৃতিক সম্পদ বণ্টনের দিক থেকে ভারতের সমস্ত অঞ্চলগুলি সমানভাবে সমৃদ্ধ নয়। ফলে, সম্পদ বণ্টন ও তার ব্যবহারের নিরিখে এদেশের অগ্রসর এবং অনগ্রসর অঞ্চলগুলির মধ্যে অর্থনৈতিক ব্যবধান অত্যন্ত সুস্পষ্ট। যেমন- খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছোটোনাগপুর মালভূমির আশেপাশের অঞ্চলগুলি (লৌহইস্পাত শিল্পের নিরিখে। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় যথেষ্ট এগিয়ে।
2. ভারতের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলকে উন্নয়ন পরিকল্পনায় শহরাঞ্চলগুলির তুলনায় সব সময়ই পিছিয়ে থাকতে দেখা যায়। এর ফলে, দেশের অধিকাংশ গ্রাম এখনো উন্নয়নের উচ্চ স্তরে পৌঁছতে সক্ষম হয়নি, যেটি দেশেরএদেশের মানুষের প্রচলিত জীবনযাত্রা ও আর্থিক মাপকাঠির নিরিখে জনগোষ্ঠীর দুটি পৃথক রূপ পরিলক্ষিত হয়, যার মধ্যে একটি হল দরিদ্র গোষ্ঠী এবং অপরটি হল সমৃদ্ধ বিত্তবান গোষ্ঠী। বাস্তবে দেখা যায়, এখানকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, যাদের সাথে বিত্তবান জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক জীবনধারাগত পার্থক্যের মাত্রা যথেষ্ট বেশি।
দাশগুপ্ত (1971), রাও(1977) প্রমুখ কৃষি, শিল্প, ব্যাঙ্কিং, আয়, মজুরি এবং শিক্ষার ভিত্তিতে ভারতের যে সমস্ত অনগ্রসর অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছেন, সেখানে আর্থসামাজিক বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট।
এ হার্ভে আর্মস্ট্রং এবং জিম টেলর দাবি করেছেন, ভারতে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন স্তরেও আঞ্চলিক বৈষম্যের মাত্রা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে, যা দেশের সামাজিক সংহতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এসঙ্গার উল্লেখ্য, বিগত দশকে ভারতের 19 টি রাজ্যের অবকাঠামো, সামাজিক পরিষেবা, আর্থিক কর্মক্ষমতা, ন্যায়বিচার, আইনশৃঙ্খলা এবং আইনসভার গুণমানের ভিত্তিতে আঞ্চলিক বৈষম্য সংক্রান্ত একটি বিশেষ গবেষণা করা হয়। পরে, সেই গবেষণার ফলাফলটিকে 2016 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের "Economic and Political Wickly"-র একটি আনুষ্ঠনিক প্রতিবেদন প্রকাশে বলা হয়, ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যেই আঞ্চলিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। ওই গবেষণাটিতে গুজরাট, তামিলনাড়ু, অস্ত্রপ্রদেশ, কেরালা এবং পাঞ্জাব-দেশের মাত্র এই ছয়টি রাজ্যকে সেরা পারফরম্যান্সকারীর তালিকায় রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে, সবচেয়ে খারাপ পারফরম্যান্সকারী রাজ্যরূপে ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যকে চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তীকালে, ভারতের আঞ্চলিক স্তরের বৈষম্যকে যুক্তিসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করতে আরও দুটি উন্নয়ন ক্লাস্টারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছিল, যেগুলি নির্দিষ্ট মানসম্পন্ন সেবা প্রদান এবং উচ্চ মাথাপিছু আয়কেন্দ্রিক। তাতেও দেখা যায়, দেশের মুষ্টিমেয় কয়েকটি রাজ্য অন্য রাজ্যগুলির চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে। বিশেষ করে, ভালো পারফরমেন্স করা রাজ্যগুলির অধিকাংশই ভারতের দক্ষিণ এবং পশ্চিমে অবস্থিত, কিন্তু খারাপ পারফরম্যান্সকারী রাজ্যগুলি প্রধানত পূর্ব অন্যলে সর্বাধিক কেন্দ্রীভূত।
■ ভারতের আঞ্চলিক বৈষম্যের বিশেষত্ব (Speciality of Regional Disparity of India)
ভারতে আঞ্চলিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিশেষত্ব লক্ষ্য করা যায়, যেমন-
(i) ভারতের দীর্ঘকালীন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটের নিরিখে আঞ্চলিক বৈষম্য অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ। এখানকার আঞ্চলিক বৈষম্যের অধিকাংশ বিষয় ঔপনিবেশিক স্বার্থ, রাষ্ট্রীয় পরিচালনাগত অব্যবস্থা, অর্থনৈতিক বণ্টনগত ত্রুটি এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বকে প্রদর্শন করে থাকে।
(ii) ভারতের অন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্যের তুলনায় অন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্যের মাত্রা যথেষ্ট বেশি।
(iii) অর্থনীতির উচ্চ বৃদ্ধির হার ভারতের ক্রমবর্ধমান অন্তঃরাজ্য বৈষম্যের পাশাপাশি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বৈষমাও ।
(iv) এখানে মাথাপিছু রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ পণ্য বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য বৃদ্ধি অটুট থাকলেও, মানব উন্নয়নের রাষ্ট্রীয় সূচকগুলি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে।
(v ) ভারতের প্রধান অঙ্গরাজ্যগুলির মধ্যে আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য অত্যন্ত বেশি এবং স্থায়ী প্রকৃতির।
(vi) 1980-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণের কারণে ভারতে আয় এবং সম্পদের বৈষম্য চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
(vii) ভারতে এমন কিছু রাজ্য রয়েছে, যেখানে উন্নয়নের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ কয়েকটি সূচক পরস্পর বিপরীতধর্মী অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। যেমন-কেরালা 1981, 1991 এবং 2001 খ্রিস্টাব্দে উচ্চ মানব উন্নয়ন সূচক (Human Development Index)-এর নিরিখে ভারতীয় রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করলেও ,এখানকার মাথাপিছু আয় জাতীয় গড় আয়ের থেকে অনেক কম ছিল।এই ধরনের বৈপরীত্য অবস্থা আন্তঃরাষ্ট্রীয় বৈষম্যকে যথেষ্ট প্রকট করে তোলে।