অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Region)
সামগ্রিক ভাবে প্রতিটি অঞ্চলেরই কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য থাকে, যেগুলিকে বিশেষজ্ঞরা ভৌগোলিক দিক থেকে অঞ্চলের বিশেষ গুণাবলি (Attributes) রূপে আখ্যায়িত করে থাকেন। অঞ্চলের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য এখানে উপস্থাপন করা হল।
অবস্থান (Location): অঞ্চল যেহেতু পৃথিবীপৃষ্ঠের সালভাগ বা জলভাগকেন্দ্রিক বিভিন্ন বস্তুগত ও অবস্তুগত উপাদানের গুরুত্বপূর্ণ আধার, সেইকারণে অঞ্চল মাত্রই তার একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থাকবে। যেমন- প্রাকৃতিক দিক থেকে কোনও ভূমিরূপ (যেমন-পাহাড়, পর্বত, মালভূমি, সমভূমি), জলাশয় (যেমন-নদী, হ্রদ, সাগর, মহাসাগর, পুকুর বা অন্য কোনও জলাধার), মৃত্তিকাবলয়, স্বাভাবিক উদ্ভিদাঞ্চল কিংবা বিভিন্ন মানবীয় (যেমন-বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, কৃষিক্ষেত্র, শিল্পক্ষেত্র, বাজার এলাকা, রাজনৈতিক পরিমণ্ডল প্রভৃতি) ক্ষেত্রগুলি আঞ্চলিক অবস্থানের নিরিখেই যথার্থ পরিচিতি পায়। এই ধরনের ভৌগোলিক অবস্থান দ্বারা যেকোনো অঞ্চলের বণ্টনগত অবস্থাকে সহজেই অনুধাবন করা যায়। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে মূলত দুই ধরনের অবস্থান বিশেষভাবে বিবেচ্য-
আপেক্ষিক অবস্থান (Relative location): আপেক্ষিক অবস্থান পারিপার্শ্বিকতাকে প্রতিনিধিত্বকারী, যা বাহ্যিক ভৌগোলিক পরিস্থিতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। যেমন, ভারতবর্ষের আপেক্ষিক অবস্থান উত্তর পূর্ব গোলার্ধে।
পরম অবস্থান (Absolute location): একটি অঞ্চলের পরম অবস্থান নিখুঁতভাবে কোনও গাণিতিক পদ্ধতিতে নির্ধারণ করা হয়। যেমন-ভারতের পরম অবস্থান অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশের মধ্যে সীমাবন্ধ।।
সীমানা (Boundary): পরিসরগত দিক থেকে ক্ষুদ্রঅথবা বৃহৎ-যে-কোনও আয়তন বিশিষ্ট অঞ্চল সর্বদা একটি স্থানিক একক (Spatial unit)-কে নির্দেশ করে। সেই কারণে অঞ্চল মাত্রই একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা লক্ষ্য করা যায়। তবে, অঞ্চলের প্রাকৃতিক সীমানাগুলি সুবিস্তৃত এবং সর্বব্যাপী হলেও, অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক সীমানাকে একটি রাষ্ট্রের পরম অবস্থানের মধ্যেই সীমাবন্ধ করা যায়। যেমন-সুন্দরবন অঞ্চলের সীমানা ভারত এবং বাংলাদেশ- উভয়েরই অন্তর্গত, কিন্তু জামশেদপুর অথবা দুর্গাপুর শিল্পাঞ্চলের সীমানা দুটি পৃথক পৃথক ভাবে ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গা রাজ্যের অন্তর্গত। অনেকসময় দুটি ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যেও এক-একটি বিশেষ সীমানাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়, যেখানে দুটি অঞ্চলই সুক্ষ্মভাবে মিশে থাকে। যেমন-এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে স্বীকৃত ইউরেশিয়া সিমার ।
সমধমিতা (Homogeneity): অঞ্চলের সমধর্মীতা হল এমন একটি গুণাবলি, যেটি একটি অঞ্চলকে অপর একটি অঞ্চল থেকে স্বতন্ত্রভাবে পৃথক করে রাখে।
সমধর্মিতার বিষয়টিকে কোনও কোনও ভৌগোলিক অঞ্চলের বাহ্যিক আরোপিত একটি বিশেষ গুণাবলি মনে করেন। অঞ্চলের সমধর্মিতার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিটি নির্ধারকগুলিকে প্রাধান্য দেওয়া। হয়। যেমন-ক্রান্তীয় সাভানা জলবায়ু অঞ্চল, শুদ্ধ মরু জলবায়ু অঞ্চলগুলির মধ্যে পারস্পরিক বাহ্যিক সমধর্মিতার বিষয়টি স্পষ্ট লক্ষ্যণীয়।
স্প্যানিক পরিচিতি (Spatial identity): অঞ্চল মাত্রই তার একটি নির্দিষ্ট স্থানিক পরিচিতি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। এই ধরনের স্থানিক পরিচয়ের মধ্য দিয়ে কোনও একটি অঞ্চলের বিশেষ কিছু গুণাবলি প্রকাশ। পায়, যেটি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলটির স্বাতন্ত্রতার ক্ষেত্রে মুখ্য নির্দেশক হয়ে ওঠে। যেমন-ভারতের ভূস্বর্গের কথা বললে। খুব সহজাতভাবেই কাশ্মীর উপত্যকা অঞ্চলটির কথা মনে আসে। একইভাবে, একটি লবণান্ত জলাভূমি অঞ্চলের। দৃষ্টান্তস্বরূপ সুন্দরবন অঞ্চলের নামটিও এসে যায়।
বিন্যাস (Layout): অঞ্চলের বিন্যাস তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে একটি অন্যতম গুণ। অঞ্চল ক্ষুদ্র-বৃহৎ যে ধরনেরই হোক না কেন, প্রতিটি অঞ্চলের ক্রিয়ামূলক কাঠামোয় গ্রন্থিকেন্দ্র (Nodal point), সংলগ্ন পরিবলয় (Adjacent zone) এবং প্রান্তিক এলাকা (Outlaying areas)-গুলির স্পষ্ট অবস্থান চোখে পড়ার মতো। একটি অঞ্চলের কেন্দ্র থেকে প্রান্তবর্তী বিন্যাস কাঠামোয় সমস্ত ধরনের বস্তুগত ও ভাবগত ধারাবাহিক প্রবাহ বা কার্যকরী মিথস্ক্রিয়া নিরন্তর চলতেই থাকে। যেমন-শিলিগুড়িকে বলা হয় উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার, যা একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক গ্রন্থিকেন্দ্র।
বৈধতা (Validity): অঞ্চলের বৈশিস্ট্যে তার বৈধতার ক্ষেত্রটিকেও অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। আসলে এখানে অঞ্চলের ধারণাটি সম্পূর্ণরূপেই স্বতন্ত্র একটি দৃষ্টিভঙ্গিকেন্দ্রিক। যেমন বস্তুগত ও বিষয়গত অঞ্চলের সত্ত্বায় আনুষ্ঠানিক ভাবে বাহ্যিক অথবা কার্যকরী গুণাবলিসমূহ বিশেষভাবে বৈধতা পায়। তাই অঞ্চলের ধারণায় প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক প্রতিটি উপাদানগুলি একটি বৈধ দৃষ্টিভঙ্গি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
কম্প্যাক্ট (Hierarchial dimension): প্রতিটি অঞ্চলেরই নিজস্ব বেশকিছু ক্রমিক মাত্রাসূচক থাকে, যেমন-দৈশিক পরিব্যাপ্তি, প্রকার, দৃশ্যমান কিছু ভৌগোলিক উপাদান, এমনকি স্থানিক গঠন প্রকৃতি ইত্যাদি। এইসমস্ত মাত্রাগুলি বিভিন্ন অঞ্চলকে চূড়ান্তভাবে কয়েকটি স্তর ক্রমাঙ্ক হিসাবে উপস্থাপন করে। যেমন-ক্ষুদ্র, মাঝারি এবং বৃহৎ ক্রমের অঞ্চলগুলি এই ধরনের ক্রমপর্যায়িত মাত্রার ইঙ্গিতবাহী।
উপাদান (Components): যে-কোনও অঞ্চলই প্রাকৃতিক ও মানবীয় বিভিন্ন বিষয় বা উপাদানগুলির অন্যতম আধার। তাই আঞ্চলিক কাঠামোয় প্রাকৃতিক দিক থেকে যেমন-ভূমিরূপ, জলবায়ু, মৃত্তিকা প্রভৃতি গুরুত্ব পায়, ঠিক সেইভাবেই জনসংখ্যা, জনঘনত্ব, মানবীয় কার্যাবলি, সংস্কৃতি সহ একাধিক মানবীয় বিষয়গুলিও স্থান করে নেয়।এ প্রসঙ্গে ডিকিনসন (1947 খ্রিঃ) যথার্থই বলেছেন- "Every region has its unique character to which contribute the features of soil, atmosphere, plants and man."পারস্পরিক নির্ভরশীলতা (Interdependency): পৃথিবীর কোনও অঞ্চলই এককভাবে পুরোপুরি স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। কারণ, আঞ্চলিক পরিসরের বস্তুগত এবং বিষয়গত প্রতিটি উপাদানগুলিতে যেমন আন্তঃসম্পর্কের বন্ধন যথেষ্ট স্পষ্ট, একইভাবে দুই বা ততোধিক অঞ্চলগুলিও তাদের কার্যকারিতার নিরিখে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার গভীর সম্পর্কে লিপ্ত থাকে। যেমন-উন্নত এবং উন্নয়নশীল অঞ্চলগুলির মধ্যে পারস্পরিক অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বিবেচনা করলে নির্ভরশীলতার বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সামগ্রিকভাবে অঞ্চল বহুধা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারক হলেও, কালিক নিয়মের গণ্ডিতে সেখানে নতুন। কোনও বিষয়ের সংযোজন বা পরিবর্তনশীলতাও অনিবার্য একটি দিক। এক্ষেত্রে, বিভিন্ন অঞ্চল বিশারদ দুই ধরনের পরিবর্তনের কথা বলে থাকেন, যথা-
স্বল্পকালীন পরিবর্তনশীলতা (Short term variability): বিশ্বের বিভিন্ন ক্রিয়াশীল পরিসরে মানুষ এমন কিছু স্বল্পকালীন পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়, যেগুলি কোনও বিশেষ অঞ্চলের একটি অন্যতম নির্দেশক হয়ে দাঁড়ায়। যেমন-মানুষের শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীল কাঠামোয় নতুন কোনও প্রযুক্তিগত অনুপ্রবেশ ও দ্রুত উন্নয়নমুখী প্রচেষ্টা অঞ্চলের স্বল্পকালীন পরিবর্তনশীলতার জন্য দায়ী
দীর্ঘকালীন পরিবর্তনশীলতা (Long term variability):
আঞ্চলিক বিশিষ্ট দীর্ঘকালীন পরিবর্তনশীলতাগুলি শতশত বছর ধরে কালিক বিবর্তনের ধারায় (যেমন-অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন), অথবা কোনও বিশেষ অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির চরম বহিঃপ্রকাশের মধ্যে দিয়ে (যেমন-শিল্প বা কৃষি বিপ্লবের প্রচেষ্টায়) এসে থাকে।