আঞ্চলিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন
ধারণা (Concept):
উন্নয়ন হল এমন একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেটি সময় ও অবস্থার প্রেক্ষিতে সর্বদা নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করে। সমাজবিজ্ঞানে, উন্নয়নকে সুসভা সমাজ গঠন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সংস্কৃতির প্রসার এবং পরিবেশগত বিভিন্ন গুণমান রক্ষার ধারক ও বাহক রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সাধারণত, উন্নয়নে বিদ্যমান প্রতিটি অবস্থা বা উপাদান প্রতিটি দেশে এমন কিছু কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ঘটায়, যার ফলাফলগুলি বহুমুখী মাত্রায় পরিব্যাপ্ত থাকে (desirable change of existing situation encompassing multidimensions)। তবে, এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, সমস্ত ধরনের পরিবর্তন মানেই উন্নয়ন নয়। বরং সেই পরিবর্তনটি ইতিবাচক বা কাঙ্ক্ষিত হলেই তাকে উন্নয়ন বলে গণ্য করা যেতে পারে।
উন্নয়ন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, 'While elaborating on the meaning of development suggests that what is development and what is not, it should be a universally acceptable aim of development while there can be value judgements make for conditions that lead to a realisation of the potentials of human personality," অর্থাৎ-উন্নায়ন কী এবং কী নয় সে বিষয়টিকে মূল্যবোধের দ্বারা বিচার করা যেতে পারে, তবে উন্নয়নের একটি সর্বজনীন গ্রহণযোগ লক্ষ্য হওয়া উচিত, যা মানুষের ব্যক্তিত্বকে সম্ভাবনাগত উপলব্ধির দিকে পরিচালিত করে।
প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়নের ধারণাটি একটি আপেক্ষিক বিষয় হলেও এটি প্রবৃদ্ধি এবং সর্বজনীন সমৃদ্ধিকে সর্বদা ভারসাম্যে উপনীত করে। তাই বলা হয়-
উন্নয়ন প্রবৃদ্ধি সমতা জনগণের অংশগ্রহণ।
উন্নয়নের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা (Some notable definitions of Development):
"উন্নয়ন” শব্দটি বিশেষজ্ঞদের কাছে বহুমুখী অর্থে গৃহীত হয়েছে। এখানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্নয়নের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোকপাত করা হল। যেমন-
• প্রথাগত সংস্তর (Traditional Definition): উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রভাবকে স্বীকৃতি দিয়ে।সংজ্ঞা উঠে এসেছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উৎপাদনশীলতা, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং অর্থনীতিনির্ভর জীবনধারার সার্বিক অগ্রগতির অভিমুখগুলিকে যথেষ্ট প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এই দিক থেকে উন্নয়নের কয়েকটি প্রচলিত ধারণা হল-
অধ্যাপক Schumpeter-এর মতে, "Development is an uninterrupted spontaneous change in the economy that permanently changes the previous balance." অর্থাৎ-উন্নয়ন হল অর্থনীতির এক নিরবচ্ছিন্ন স্বতঃস্ফূর্ত পরিবর্তন, যেটি স্থায়ীভাবে পূর্বেকার ভারসাম্যাবস্থার পরিবর্তন ঘটায়।"
অধ্যাপক Snider বলেছেন-উন্নয়ন হল মাথাপিছু উৎপাদনক্ষমতার দীর্ঘকালীন বৃদ্ধি (Development is the long-term increase im per capita productivity)
U. K. Hiks উন্নয়নকে "অনুন্নত দেশের সমস্যা দুরীকরণ সংক্রান্ত বিষয়" বা "Issues related to problem solving in underdeveloped countries -রূপে উল্লেখ করেছেন।
Kindleberger মনে করেন-উন্নয়ন হল অধিক উৎপাদন এবং সেই উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় কারিগরি ও প্রাতিষ্ঠানিক কোনো বিশেষ পরিবর্তন ।
সমকালীন সংজ্ঞা (Contemporary definition): সাম্প্রতিককালে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ উন্নয়ন সংক্রান্ত ধারণা এবং নীতির ক্রমবর্ধমান বিস্তৃতিকে সামনে রেখে বিগত কয়েকটি সমকালীন দশককে উন্নয়নের যুগ হিসেবে মনোনীত করেছেন।
প্রসঙ্গত, উন্নয়নের কয়েকটি সমকালীন তথা আধুনিক সংজ্ঞা হল নিম্নরূপ-
1978 খ্রিস্টাব্দে A.P. Thirwall বলেছেন-উন্নয়ন হল এমন একটি পরিবর্তন যেটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরের ফলশ্রুতি।
Pearson (1992) বলেছেন, "An improvement qualitative, quantitative or both in the of available resources," অর্থাৎ প্রাপ্ত সম্পদের ব্যবহারের ওপর গুণগত, পরিমাণগত-উভয়ের সমৃদি হজ উন্নয়ন।
2006 খ্রিস্টাব্দে Todaro এবং Smith উল্লেখ করেছেন- "Development is a process meant fo equitable social and economic transformation of the society trough institutionalised sode structures, and people's positive attitudes, অর্থাৎ, উন্নয়ন হল সামাজিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় মানুষের ইতিবাচক মনোভাবের মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত সামাজিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি প্রক্রিয়া।
2015 খ্রিস্টাব্দে Richard Peet Elanine Hartwick তাঁদের "Theories of Development' ন গ্রন্থে বলেছেন-“উন্নয়ন মানে জীবনের অবস্থাগত উন্নতি" (Development means improving the condition of life)
Brundtland Report-এ উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- "Development that meets the needs of the present without compromising the ability of future generations to meet their own needs অর্থাৎ-উন্নয়ন যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিজস্ব চাহিদা মেটাতে সক্ষমতার সাথে আপস না করে বর্তমানের চাত্রিদ পূরণ করে।
জাতিসংঘ প্রদত্ত ধারণা- "জাতিসংঘের প্রধান অগ্রাধিকারগুলির মধ্যে উন্নয়ন হল একটি বহুমাত্রিক উদোগ যার দ্বারা সকল মানুষ নিজেদের জন্য উচ্চমানের জীবনযাত্রা অর্জন করতে পারে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক উন্নয়ন এবং পরিবেশ সুরক্ষা পরস্পর নির্ভরশীল এবং পারস্পরিকভাবে টেকসই শক্তিশালীকরণের উপাদান হল উন্নয়ন (Development is one of the main priorities of the United Nations. Development.as multidimensional undertaking to achieve a higher quality of life for all people. Econimi development, social development and environmental protection are interdependent and mutually reinforcing components of sustainable development)।
• সমন্বয়ী সংজ্ঞা (Cohesive definition): উন্নয়নের উপরিউক্স সংজ্ঞাগুলিকে সমন্বিত করে বলা যায় উন্নয়ন এমন একটি ধারাবাহিক, পরিবর্তনমূলক ইতিবাচক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানুষের বহুমাত্রিক উৎকর্ষতাসম্পর জীবন-জীবিকা, সামাজিক সমতা এবং পরিবেশগত সুস্থতা বজায় রেখে পছন্দমতো জীবনযাত্রার মান বেছে নেওয়ার হয়।
উন্নয়নের পটভূমি (Background of Development):
উন্নয়ন এমনই একটি প্রক্রিয়া যা মানব ইতিহাসের বিভিন্ন সময়জুড়ে অতি কৌশলী বুদ্ধিমত্তায় গৃহীত হয়েছে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রই আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে অতীতে উন্নয়নমূলক একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, সেসময় উন্নয়নের অধিকাংশ ধারণা সংকীর্ণ অর্থেই প্রয়োগ করা হত। প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়ন সম্পর্কে প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন, গ্রিক ও রোমান দার্শনিকরা। অতীতে, গ্রিক দেশে ব্যবহৃত 'ফিসিস' (Physis) শব্দটি উন্নয়ন সংক্রান্ত ধারণাকে প্রকাশ করত, যার আক্ষরিক সমার্থ হল বৃদ্ধি, উন্মোচিত বা বিকশিত হওয়া। গ্রিকরা তৎকালীন 'ফিসিস' অভিধাটিকে পার্থিব সবধরনের জীবন্ত উপাদান যেমন গাছ, প্রাণী, মানুষ এমনকি সমাজের ক্ষেত্রেও রূপক হিসাবে সর্বাধিক ব্যবহার করত। সেই থেকে আজ পর্যন্ত, বিভিন্ন দেশের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-বিজ্ঞান এমনকি দার্শনিকদের চিন্তাধারায় উন্নয়নের ধারণা ও মতবাদগুলি স্বতন্ত্রভাবে উঠে আসে।সপ্তদশ শতকে উন্নয়নের ধারণাটি বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের চিন্তাধারাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল। 1676 খ্রিস্টাব্দে স্যার উইলিয়াম পেটি লিখেছিলেন, "ফরাসিরা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়" (The French grow too fast)। পেটি তদানীন্তন ফ্রান্সের রাষ্ট্র পরিচালনার আয়, ব্যয়, মানুষের অবস্থা, সাধারণ নিরাপত্তা এবং কার্যক্ষেত্রে প্রতিটি মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার বিশেষ প্রয়াসগুলিকে কয়েকটি সারদের ভ্যা সাধার উপস্থাপন করেছিলেন। স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, এটি ছিল উন্নয়ন সম্পর্কে তৎকালীন এমন এক নথিভুক্ত অভিব্যক্তি, যা অন্যান্য দেশের চিন্তাবিদদের উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গিকেও যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করে। এই দিক থেকে, স্যার ইউহিয়াম পেটিকে উন্নয়ন অর্থনীতির প্রাক্-প্রতিষ্ঠাতাও বলা যায়। পরবর্তীকালে, রেনেসাঁ এবং শিল্পবিপ্লবের পরে পশ্চিমী সভ্যতায় অর্জিত পুঁজিভিত্তিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা সেখানকার ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অগ্রগতির প্রধান স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।
বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ট্রুম্যানের আন্তর্জাতিক নীতিতে প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রগুলিকে প্রসারিত করার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, তা উন্নয়নের প্রাসঙ্গিকতাকে অনিবার্য করে তোলে। পরবর্তীকালে, গ্রেগরি কিং, ফ্রাঙ্কোইস, আন্টনিও লেভেসিয়র, জেশফ লুইস লাগরাঙ্গে প্রমুখ উন্নয়নকে দক্ষতাপূর্ণভাবে পরিচালিত করার জন্য একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রকাশ করেন। অবশ্য, পদ্ধতিগত দিক থেকে উন্নয়নের ধারাবাহিক অনুশীলন শুরু হয়েছিল বিংশ শতকের প্রথম কয়েক দশকের পরবর্তী সময়কালগুলিতে। 1929 খ্রিস্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে সর্বপ্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে শিল্পায়নকে দক্ষতাপূর্ণভাবে পরিচালিত করার জন্যই অ্যাডাম স্মিথের "Wealth of National-কে উন্নয়ন অর্থনীতির প্রথম গ্রন্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এর ফলে, উন্নয়নকে একটি পদ্ধতিগত কৌশল বিবেচনা করে অধিকাংশ রাষ্ট্র জাতীয় তথা আঞ্চলিক পরিকল্পনায় মনোনিবেশ ঘটায়। এই সময়, সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলো, পশ্চিমী সভ্যতায় উন্নয়নের পদক্ষেপগুলি দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
1945 খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির প্রায় সাথে সাথেই, ইউরোপের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলির আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এই সময়, উন্নয়নমূলক পুনর্গঠনের কাজে জড়িত ইউরোপীয়, মার্কিন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির পাশাপাশি আফ্রিকা, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার একাধিক দেশ কার্যত স্বীকার করে নিয়েছিল, প্রাক্তন ঔপনিবেশিক অধিকৃত দেশগুলির জনগণ দীর্ঘদিন যাবৎ যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তা নির্মূল করা আশু প্রয়োজন। ফলে, সাম্রাজ্য বিস্তারের ঔপনিবেশিক পথ বিশ্বের প্রায় সমস্ত উন্নত দেশ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। এরপর থেকে, স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক মর্যাদা অর্জন করার সুবাদে বিশ্বের একাধিক দেশে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিগুলি বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত হয়। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় এবং স্থানীয় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন এবং ব্যক্তিগত সুযোগ বৃদ্ধি প্রত্যাশিতভাবেই নতুন সরকার, আমলাতন্ত্র, প্রশাসনিক সংস্থাগুলির ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে। যার ফলশ্রুতিতে, উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপগুলি স্থানীয় এবং আঞ্চলিক স্তরের জাতীয় সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। ইভান ইলিচের মতে (1949 খ্রিস্টাব্দের 10 জানুয়ারি) প্রথাগতভাবে বিশ্বে আধুনিক উন্নয়নমূলক পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল বিংশ শতাব্দিকে ঘিরে।
জনপ্রশাসনিক দিক থেকে উন্নয়ন শব্দটি 1950-এর দশক থেকে সামাজিক তথা অর্থনৈতিক বিভিন্ন নীতি, প্রকল্প এবং কর্মসূচিগুলি রূপায়ণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। অবশ্য, 1960-এর দশক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী এবং রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ উন্নয়নের প্রাথমিক মডেলগুলির দুর্বলতা সম্পর্কে নানা প্রতিক্রিয়া জানাতে শুরু করে। তাঁদের মতে, বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর একাধিক সুযোগসুবিধা যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। তাই, এই সমস্ত দেশগুলিতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক ভাবাদর্শ, শিক্ষা, ইলাবোধ, উন্নত প্রযুক্তি এবং সার্বিক পরিসেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেখানকার ঐতিহ্যগত সমাজকাঠামোকে রূপান্তরিত করার বহুমুখী প্রচেষ্টা শুরু হয়ে যায়।
1970-এর দশকে গ্যান্ডার ফ্রাঙ্ক এবং অন্যান্যরা উন্নয়নের বাহ্যিক কাঠামোগুলির সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিমার্জিত বা প্রয়োগমূলক উন্নয়নমুখী নতুন কর্মপন্থাগুলিকে সমর্থন জানান। ফলস্বরূপ, 1980-1990-এর দশকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন নির্ভরত্য তত্ত্বের প্রতি অধিকাংশ দেশেরই আগ্রহ ক্রমশ হ্রাস পায়। এই সময়কালে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monetary Fund) বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতেও নয়া-উদারনীতিমূলক কার্যকরী বহুমুখী প্রচেষ্টাগুলি উন্নয়নের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে ।
একবিংশ শতকে গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় উন্নয়নের ধারণাটি আবারও পুরোপুরি বদলে গিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিসরে সমষ্টিগত (নাগরিক) এবং স্থিতিশীল উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপগুলিকে ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এর ফলে প্রতিটি মানুষের জন্য অধিকতর আয় বৃদ্ধি, উন্নতমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ব্যবস্থাপনা, দারিদ্র্যের ক্রমাবনতি, দূষণমুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি, সুযোগের সমতা, ব্যক্তি-স্বাধীনতা এবং সংস্কৃতিসম্পন্ন উন্নত জীবন গঠনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ পূরণের পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে।
উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Development):
উন্নয়নের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হল নিম্নরূপ:-
• বহুমুখী ও কল্যাণকামী প্রক্রিয়া (Versatile and benevolent process): উন্নয়ন এমন একটি বহুমুখী কার্যসম্পাদনকারী উপায় বা অবলম্বন, যেটিকে বিশ্বের সমস্ত মানব অধিকৃত স্থানেই লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া, উন্নয়ন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পূর্ববর্তী যেকোনো পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সার্বিক কল্যাণের পথ সুগম করে তোলে।
• অজ্বলভেদে পৃথক (Depending on the region): পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান তথা অঞ্চলভেদে প্রাকৃতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিগুলি ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। তাই, উন্নয়নের ধারণাটিও সব জায়গায় সমান নয়।
• গতিশীল প্রক্রিয়া (Dynamic process): সময়ের সাথে সাথে উন্নয়নের ধারণাগুলির পরিবর্তন ঘটে থাকে। অর্থাৎ, উন্নয়নের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াটি নিয়মিত এবং ধনাত্মকভাবে ঘটতে দেখা যায় বলেই, এটি সর্বদা গতিশীল প্রকৃতির।
• মিশ্র প্রতিক্রিয়া (Mixed reactions): উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক উপাদানগুলির ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে সচল থাকে। তাই, উন্নয়নের সমস্ত উপাদানগুলিতে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা য়ায়।
সমাজবন্দতা (Socialization) : উন্নয়ন একটি সামাজিক প্রক্রিয়া। সমাজবহির্ভূত পরিসরে উন্নয়ন কখনও ফলপ্রসূ হতে পারে না।
• পরিসরগত মাত্রা (Range of dimensions): উন্নয়নের পরিসরটি ব্যপ্তি-গোষ্ঠী, সমাজ-অর্থনীতি, সম্পদ-পরিবেশ, সংস্কৃতি-রাজনীতি প্রভৃতি সমস্ত ক্ষেত্রের সাথেই গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত।
• বিবেচনাগত দৃষ্টিভঙ্গি (Considerable approach): উন্নয়ন হল মানুষের প্রত্যাশিত জীবনধারার একটি সুস্পষ্ট এবং তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত। তাই, উন্নয়নকে সর্বদা সমসাময়িক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিবেচনা করা হয়।
• প্রবৃদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত (Related to growth): উন্নয়ন ঘটলে আনুষঙ্গিকভাবেই প্রবৃদ্ধি (Growth) ঘটবে। তাই উন্নয়নের সাথে প্রবৃদ্ধির বিষয়টিও নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
উন্নয়নের পরিবর্তিত ধারণা (Changing concept of Development) :
উন্নয়নের ধারণাটি খুব একটা পুরোনো নয়। শুরুতেই যেমন বলা হয়েছে, এক সময় উন্নয়নকে শিল্পায়ন এবং দ্রুত আর্থিক বিকাশের মূল চাবিকাঠি বিবেচনা করা হত। তবে, বেশ কিছুকাল আগেও এই ধারণার প্রাধান্য থাকলেও,পরবর্তীকালে মানবসম্পদ, শিতিশীল পরিবেশ এবং সার্বিক পরিষেবা গত ক্ষেত্রের নিরপেক্ষ এ উন্নয়নে বুনিয়াদ ক্রমশ নতুন দিকে মোর নেয়। সময়ের সাথে সাথে উন্নয়নে এইরূপ পরিবর্তন ধারা গুলি সম্বন্ধিতভাবে নামে পরিচিত। এখানে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নে পরিবর্তিত ধারণা বিষয়টিকে নিম্নলিখিত দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হলো।
অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ (Economic perspective): উন্নয়নের মৌলিক চাহিদার প্রেক্ষাপটকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠা দৃষ্টিভঙ্গিটি পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিকেই সর্বাধিক মান্যতা দেয়। প্রথমদিকে উন্নয়নকেন্দ্রিক যাবতীয় ধারণাগুলি হুপদী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিকে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে, উন্নয়নের আবহে জমি, শ্রম, পুঁজি এবং প্রযুক্তির মতো উৎপাদনের কার্যকরী উপাদানগুলি বিশ্লেষণের জন্য মাথাপিছু আয়, জাতীয় আয় এবং শিল্প ইউনিটের সংখ্যাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে বিবেচনা করা হত। পরবর্তীকালে, এই ধারণাটিই আরও স্পষ্ট এবং সর্বজনীন হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিংশ শতকের প্রারম্ভে উন্নয়নমূলক অর্থনীতির নিরিখে সমগ্র বিশ্বকে প্রধান দুটি শ্রেণিতে শতক জুড়ে উৎপাদনের ব্যাপকতা এবং শিল্পের উন্নয়নের বিভক্ত করা হয়েছিল, যথা উন্নত দেশ (Developed country) বা প্রথম দুনিয়া এবং অনুন্নত দেশ (Underdeveloped country) বা তৃতীয় দুনিয়া। শিল্পবিপ্লবের কল্যাণে সমগ্র অষ্টাদশ ধারাবাহিক বৈচিত্রাকে ঘিরে পশ্চিম ইউরোপ এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বেশকিছু দেশকে উন্নয়নের প্রতিভূ করে তোলে। অন্যদিকে, আয় এবং সঞ্চয়ের দিক অথবা, সার্বিক পরিসেবার দিক থেকে পিছিয়ে থাকার জড়তাগুলি ক্রমেই প্রাচ্যের দেশগুলিকে অনগ্রসর ও অনুন্নত করে তোলে। বিশেষত, এই সমস্ত দেশেই পরবর্তীকালে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জরূপে গ্রহণ করা হয়।
• সামাজিক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ (Social Development Perspectives): উন্নয়ন পরোক্ষভাবে এমন একটি মানবীয় প্রক্রিয়া যা, নিরন্তরভাবে মানুষের বহুমুখী জীবনধারা এবং সমাজ পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রতিচ্ছবিকে বাস্তবের ইঙ্গিতবাহী করে তোলে। অর্থনীতি যেমন সমাজবিকাশের ক্ষেত্রে অবদান রাখে, তেমনই সমাজের উন্নতি অর্থনীতিকে ওতপ্রোতভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিপূরক প্রক্রিয়া- রূপে, সামাজিক উন্নয়নের বিষয়টিতেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই সমৃদ্ধির উপাদানগুলিকে উন্নয়নের সমাজতান্ত্রিক কাঠামোয় বিশেষ স্থান দেওয়া হয়েছে। যেমন-1950, 1960 এবং 1970- এর দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক মডেলগুলিকে উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োগ ঘটানো ছিল কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
লিঙ্গ সম্পর্কিত দৃষ্টিকোণ (Gender perspectives): কোনও একটি দেশের উন্নয়নের প্রাসঙ্গিকতায় নারী এবং পুরুষের সমান অংশগ্রহণ বা সমান অধিকার সুনিশ্চিতকরণের দৃষ্টিকোণটি যথেষ্ট প্রাচীন হলেও, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে শিল্প এবং কর্মসংস্থানের উন্নয়নমূলক লক্ষ্যে এই ধারণাটি আরো বেশি করে গুরুত্ব পায়। বিশেষত, তৎকালীন অধিকাংশ দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে মহিলাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দিয়ে অধ্যাপক বসরাপাস-এর লেখা "Women's Role in Economic Development in 1970' গ্রন্থটিতে উন্নয়নের লিঙ্গ সংক্রান্ত বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ, এই গ্রন্থটিতে বসরাপাস দেখিয়েছিলেন মহিলাদের কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ একটি দেশকে কিভাবে সমৃদ্ধির শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। বিশ্বব্যাপী মহিলাদের আর্থ-সামাজিক মর্যাদা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করে তাদেরকে সরাসরি উন্নয়নের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে রাষ্ট্রসংঘ 1975 খ্রিস্টাব্দটিকে আন্তর্জাতিক মহিলা বর্ষরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে।
• টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ (Perspectives on sustainable development): উন্নয়নের আধুনিকতম দৃষ্টিভঙ্গিঙ্গটি টেকসই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত, যেটি বিগত শতাব্দীর 70-এর দশক থেকে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রথমদিকে, উন্নয়নের নীতি এবং প্রয়োগমূলক ব্যাপ্তি যেমনটি কল্পনা করা হয়েছিল বাস্তবে তা সঠিকভাবে অনুসৃত হয়নি। বিশেষ করে, অধিক উৎপাদন বা সম্পদের নির্মম ব্যবহার, দ্রুত বিকাশের চূড়ান্ত অভিলিন্দা ক্রমেই সমগ্র মানবজাতি এবং প্রকৃতিকে এক ভারসাম্যহীনতা এবং অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়। এই ধরনের সঙ্কটপূর্ণ আবহ সম্ভাব্য উন্নয়নকে টেকসই নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে। এটি, এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে সার্বিকভাবে উন্নত জীবনযাত্রার মান এবং জীবনযাত্রার সম্ভাবনাগুলিকে সর্বদা পরিবেশমুখী করে তোলা হয়।
1970-এর দশকের গোড়ায় ক্লাব অফ ব্রোমের দ্বারা প্রকাশিত 'The limits to growth' রিপোর্টের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহার, জীব-প্রজাতি রক্ষা এবং বিকৃত শিল্প-প্রযুক্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুরক্ষিত এই ভাবনাটি উন্নয়ন সংক্রান্ত একাধিক বিতর্কের অবসান ঘটায়। উন্নয়নের টেকসই দৃষ্টিভঙ্গি একদিকে যেমন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নেতিবাচক প্রভাবগুলি ন্যূনতম করে তোলে, একইভাবে বাস্তুসংস্থান রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতা, এমনকি পরিবেশগত বিপদ এড়িয়ে সার্বিক বৃদ্ধির আপাত প্রয়োজনীয় সমস্ত দিকগুলিকে সমানভাবে উন্মোচিত করে। সেই কারণে, টেকসই উন্নয়নের দৃষ্টিকোণকে সচেতন ও সতর্কতামূলক উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা বলা হয়ে থাকে। অবশ্য, 1987 সালের বৃন্টল্যান্ড-এর 'Our common future' নামক প্রতিবেদনে স্থিতিশীল উন্নয়নের নীতিগুলিকে আরও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।
• অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ (Participatory Development Perspectives): সাম্প্রতিককালে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলিকে সঠিকপথে পরিচালিত করতে অংশগ্রহণমূলক সার্বিক প্রচেষ্টাকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়ে থাকে। সাধারণত, আঞ্চলিক স্তরে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে নিয়ে যেতে বিশ্বের উন্নয়নশীল প্রায় সমস্ত দেশগুলিতেই এই ধরনের প্রচেষ্টার সফল বাস্তবায়নের কৌশল বধের চোখে পড়ার মতো।
Oakley অংশগ্রহণমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ১টি বিশেষ দিক চিহ্নিত করেছেন, যেমন-
• পূর্বনির্ধারিত প্রকল্পের লক্ষাগত ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অবদান স্বীকার করে নেওয়া,