আঞ্চলিক উন্নয়নের তাত্ত্বিক ধারণা এবং মডেলসমূহ
আর. পি. মিশ্র'র প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্ব (Growth Foci theory by R. P. Mishra) :
বিংশ শতাব্দীতে ভারতের আঞ্চলিক পরিকল্পনা তথা উন্নয়নের ক্ষেত্রপটে যে কয়েকজন প্রথিতযশা গবেষক উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন অধ্যাপক রামেশ্বর প্রসাদ মিশ্র (R. P. Mishra)| তিনি আঞ্চলিক বিকাশের মেরুতত্ত্বীয় কাঠামোয় উন্নত পশ্চিমি দেশগুলির সাথে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলির একটি স্পষ্ট পার্থক্য চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁর মতে, আপেক্ষিকভাবে উন্নত এবং উন্নয়নশীল সমস্ত দেশেরই বিকাশের ধারা কখনোই সমানভাবে একই ধরনের প্রেক্ষাপটে সম্পন্ন হয় না। অধ্যাপক মিশ্র এই ধারণাকে স্থানিক দৃষ্টান্তের মাধ্যমে সর্বসম্মত ভাবে তুলে ধরতেই প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্ব (Growth foci theory)-টির অবতারণা করেন।
প্রবৃদ্ধি নাভির ধারণা (Concept of Growth foci):
প্রবৃদ্ধি নাভি হল আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠা এমন কতকগুলি পরিসেবা প্রদানকারী উদ্ভাবনামূলক ক্ষেত্র, যেগুলিকে সাধারণত প্রশাসন, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থ, বিনোদন, বাজার এবং অন্যান্য বেশকিছু নির্দিষ্ট আর্থসামাজিক সূচকের সাহায্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রসঙ্গো 'প্রবৃদ্ধি নাভি'-র বেশ কতকগুলি পরিসর বা পরিস্থিতি চিহ্নিত করা যায়। এগুলি হল-
• স্থানীয় আর্থসামাজিক পরিসর,
• পরিচালন ব্যাবস্থারূপে 'প্রবৃদ্ধি নাভি'-র প্রশাসনিক কাঠামো।
প্রবৃদ্ধি নাভির আধালিক অর্থনীতি বা পরিসেবার অভিমুখ প্রভৃতি।
আসলে, আমাদের দেশে সামন্তস্যপূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সমস্ত প্রবৃদ্ধি নাভিগুলি একযোগে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন-দিল্লিকে যদি একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল ধরা হয়, সেক্ষেত্রে এখানকার জেলা সদর, ছোটো শহর এবং গ্রামীণ স্তরে গড়ে ওঠা প্রবৃদ্ধির সবকটি নাভির সম্পদ, শ্রমশক্তি, পণ্য এবং বিভিন্ন পরিসেবা স্থানীয় স্তর থেকেই দিল্লির দিকে অথবা দিল্লি থেকে ওই সকল স্থানীয় ক্ষেত্রের অভিমুখে ধাপে ধাপে প্রবাহিত হয়েছে।
মূল বক্তব্য (Implied meaning):
প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্ব প্রদানে অধ্যাপক আর. পি. মিশ্র সরাসরি মেরু তত্ত্বের চুইয়ে পড়া নীতির বিপরীতে, আঞ্চলিক বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে বহুমাত্রিক পরিসেবা সরবরাহের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, পদানুক্রম অনুযায়ী স্থানিক তথা আঞ্চলিক পরিসরে (যেমন-কেন্দ্রীয় গ্রাম থেকে শুরু করে সমৃদ্ধ মেরুক্ষেত্র পর্যন্ত) বৃদ্ধির সমস্ত কেন্দ্র বরাবর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটানোর বেশকিছু ধারাবাহিক উদ্ভাবনা এমনকি, জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা অনুযায়ী পরিসেবা প্রদান ক্ষেত্রগুলি বিভিন্ন Growth foci' বা Growth promoting centre'-এ উপনীত হয়। আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠা এই বৃদ্ধিকেন্দ্রগুলিই জনমুখী আঞ্চলিক উন্নয়নের পথকে আরো প্রশস্ত করে তোলে। সেই কারণেই অধ্যাপক মিশ্র বলেছেন-
To suit the socio-economic conditions of the developing countries, the growth pole theory has been modified and the concept of system of growth foci has been evolved. In a very limited way the concept has been accepted in several developing countries as a tool to develop backward areas and regions while at the same time integrate the traditional and modern sectors of the economy into a single whole".
■প্রস্তাবনার তাত্ত্বিক ভিত্তি (Theoretical basis of the proposal):
অধ্যাপক আর পি. মিশ্রের প্রবৃদ্ধি নাভি (Growth foci) মডেলটি আসলে বেশ কতকগুলি উন্নয়ন তত্ত্বের পরিমার্জিত সংস্করণ, যেখানে অত্যন্ত সুকৌশলে প্রবৃদ্ধি মেরুতত্ত্ব (Growth pole theory), কেন্দ্রীয় অবস্থান তত্ত্ব (Central place theory) এবং স্থানিক বিক্ষেপণ তত্ত্ব (Spatial diffusion theory)-এর সমন্বয় ঘটেছে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে কীভাবে একাধিক পরিসেবা কেন্দ্র আঞ্চলিক উন্নয়নের ভিতকে মজবুত করে তোলে, সেই ব্যবহারিক দিকটি এখানে ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। অধ্যাপক মিশ্র মনে করতেন, উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গড়ে ওঠা যে সমস্ত তত্ত্বের ভিত পাশ্চাত্যের শিল্পকেন্দ্রিক তথা নগরকাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত হয়।
হলে সেগুলিতে কথার সার মতো দেশগুলির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে যেভাবে প্রাসা তাহরের অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা কখনোই সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করা যায় না। তাঁর মতে, ভারতের আঞ্চলিক স্বরে সোম, জেলা সদর, ছোটো শয়ন করার পর্যাপ্ত) উৎপাদন ও পরিসেবাভিত্তিক অসংখ্য উদ্ভাবনাকের ম্যারোলিক হরে নিবেন্দ্রগুলি সর্বদাই সংশ্লিষ্ট পরিসরের আয়তন এবং জন বন্টনের সাথে যথেষ্ট সঙ্গতিপূর্ণ। অথচ, প্রবৃদ্ধি মের তন্তে মাকাদিক উন্নয়ন প্রসঙ্গের জনসংখ্যার কটনের বিষয়টি নিয়ে কোনো রকম আলোকপাত করা হয় নি। শুধুনি নেই কয়েল এই দূরনের দুর্বার গুলিটিয়ে তুলতেই অধ্যাপক মিশ্র আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য (দিন। ি মায় গ্রামীণ ও শহতে অনুরমতিগুলির আর্থসামাজিক কার্যকলাপের রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আর্থসামাজিক কোরালগুলির তাপ বিশ্লেষণ করতে তত্ত্ব গড়ে তোলেন।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মিশ্র প্রবর্তিত বিকেন্দ্রীভূত সমাবেশ (Decentralized Concentration)- দৃষ্টিভঙ্গিতে তাত্বিকভাবে যে সমস্ত সমস্যা বা অসামপ্লস্যতার বিষয় প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বের অন্যতম ভিত গড়ে দেয়, সেগুলি হল-
• বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলের সমস্যা নির্ধারণে মেরু তত্ত্বের ব্যর্থতা,
• প্রকল্পিত মেরু তত্ত্বের অর্থনৈতিক কাঠামোয় অনমনীয়তা,
• শিল্পভিত্তিক নগরায়িত অর্থনৈতিক কাঠামোয় প্রান্তিক অথচ পরিসেবা প্রদানকারী গ্রামীণ ক্ষেত্রের পিছিয়ে থাকার হয়।
• উন্নয়নের নিরিখে প্রান্তিক অঞ্চলগুলির ভারসাম্যহীন অর্থনৈতিক কাঠামো, প্রভৃতি।
প্রসঙ্গার উল্লেখ্য, অধ্যাপক মিশ্র প্রস্তাবিত তত্ত্বে প্রবৃদ্ধি মেরু তত্ত্বের প্রায় কাছাকাছি অথচ বিপরীতধর্মী আন্দুলিক উন্নয়নের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলি সুচিন্তিতভাবে এবং বহুমাত্রিক ধারায় পরিবেশিত হয়েছে বলে, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ Modified Growth pole theory' নামেও অভিহিত করেছেন।
■তত্ত্ব গঠনের মূল উদ্দেশ্য (The main purpose of theory formation):
যে কয়েকটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অধ্যাপক আর পি. মিশ্র প্রবৃদ্ধি নাতি তত্ত্বটি গড়ে তোলেন, তার কয়েকটি হল-
(i) স্থানীয় তথা আঞ্চলিক পরিসেবার ভিত্তিতে বিভিন্ন গদানুক্রম অনুযায়ী উন্নয়নক্ষেত্রগুলিকে চিহ্নিতকরণ।
(ii) ক্ষুদ্র পরিসরে কেন্দ্রীয় গ্রামগুলিকেও প্রবৃদ্ধি নাভিৰূপে প্রতিষ্ঠিত করা।
ⅲ) আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গ্রাম, শহর ও শিল্পভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিসেবা ক্ষেত্রগুলির মধ্যে একটি দৃঢ় ( আর্থসামাজিক সম্পর্ক বা পারস্পরিক যোগসূত্র গড়ে তোলা।
(iv) আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন পরিসেবা প্রদানকারী ক্ষেত্রগুলির গতিশীলতাকে উদ্বুদ্ধ করা।
(v) সমগ্র দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সমস্ত ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটানো, প্রভৃতি।
■ প্রবৃদ্ধি নাভির বিশেষত্ব (Speciality of Growth foci):
আঞ্চলিক উন্নয়নের স্বতন্ত্র কাঠামোরূপে প্রবৃদ্ধি নাভির বেশ কয়েকটি বিশেষত্ব রয়েছে, যেমন-
(1) নির্দিষ্ট অনুক্রমভিত্তিক প্রবৃদ্ধি নাভি ক্ষেত্রগুলি গ্রাম, জেলা, পৌর গুণসম্পন্ন এলাকা, শিল্পাঞ্চল, অথবা প্রাদেশিক কোনও সমৃদ্ধ মেরুকে নির্দেশ করে থাকে।
(ii) আঞ্চলিক স্তরে প্রবৃদ্ধি নাভিগুলি মাইক্রো-ম্যাক্রো সহ সমস্ত আঞ্চলিক স্তরে বিভিন্ন ধরনের উৎপাদন বা পরিসেবার সাথে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।
(iii) প্রবৃদ্ধি নাভি ক্ষেত্রগুলি প্রাথমিক স্তরের কৃষিনির্ভর কোনও গ্রামাঞ্চলকেন্দ্রিক অথবা গৌণ ভরের শিল্প বা নগরভিত্তিক পরিসেবানির্ভর উভয়ই হতে পারে।
(iv)আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামোয় গড়ে ওঠা সমস্ত ধরনের প্রবৃদ্ধি নাভিক্ষেত্র অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবে আঞ্চলিক চাহিদা অনুযায়ী বিপণন, বিনোদন, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহণ, যোগাযোগ, ব্যাংকিং সহ একাধিক পরিসেবাগুলির যৌথ সমন্বয় ঘটায়।
(v) আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠা সমস্ত ধরনের প্রবৃদ্ধি নাভির পদানুক্রমিক দিক থেকে স্বতন্ত্র ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়।
(vi) কোনো একটি দেশের আয়তন যত বড়ো হবে, আঞ্চলিক স্তরে পরিসেবা প্রদানকারী প্রবৃদ্ধি নাভিগুলির সংখ্যাও তত বেশি হবে।
(vii) সাধারণত ক্ষুদ্র প্রবৃদ্ধি নাভি থেকে স্বল্প পরিসেবা এবং বৃহদায়তন প্রবৃদ্ধি নাভি থেকে অধিক পরিসেবা পাওয়া যায়।
(viii) কোনও একটি দেশের সার্বিক সমৃদ্ধি তথা আঞ্চলিক উন্নয়ন ঘটাতে প্রবৃদ্ধি নাভিগুলি সম্মিলিতভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে।
■বিকাশের অনুক্রমিক ক্ষেত্র (Sequential Field of Development):
অধ্যাপক আর পি. মিশ্র তাঁর বিকেন্দ্রিভূত কৌশলী দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতের প্রচলিত আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রথমে বিকাশের মোট চারটি এবং পরে আরও একটি ক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছেন। এগুলি হল-
• স্থানীয় স্তরে সেবাকেন্দ্র (Local level service centre): সাধারণত ক্ষুদ্রায়তন প্রশাসনিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা সমষ্টিগত যে সমস্ত এলাকা বিভিন্ন পরিসেবামূলক কার্যাবলি পরিচালিত করে থাকে, তাদেরকেই স্থানীয় স্তরের সেবাকেন্দ্র বলা হয়।
• বিশেষত্ব (Speciality):
(i) প্রধান ক্ষেত্র: মাঝারি থেকে বৃহদায়তন গ্রাম, অথবা কোনও ছোটো আধা পৌর এলাকায় এই ধরনের স্থানীয় পরিসেবাক্ষেত্রগুলি গড়ে ওঠে।
(ii) জনসংখ্যা: সাধারণত, এই সেবাক্ষেত্রের জনসংখ্যা 5-10 হাজারের মধ্যে থাকে।
(iii) প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ: এখানকার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণমূলক মুখ্য কাজগুলি পঞ্চায়েতের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
(iv) পরিসেবাকেন্দ্র: স্থানীয় স্তরে মুখ্য পরিসেবা প্রদানকারী কেন্দ্রগুলি হল-পাইকারী মুদিখানা দোকান, খাবারের দোকান, প্রাথমিক বিদ্যালয়, ডাকঘর, সমবায় কেন্দ্র, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রভৃতি।
(v) মুখ্য কার্যাবলি: স্থানীয় স্তরগুলি মূলত পার্শ্ববর্তী ছোটো ছোটো গ্রাম বা হ্যামলেটগুলিকে পরিসেবা প্রদান এবং আর্থসামাজিক সমন্বয়সাধনের কাজ করে থাকে।
যেমন-কেন্দ্রীয় গ্রাম (Central village)-গুলি স্থানীয় স্তরে সেবামূলক প্রবৃদ্ধি নাভিরূপে কাজ করে থাকে।
উপ-আঞ্চলিক স্তরে প্রবৃদ্ধি বিন্দু (Sub-regional level Growth point): পরিসেবা ক্ষেত্রের দ্বিতীয় ক্রমের অধীনে থাকা যে এলাকাটি বাণিজ্যভিত্তিক সমস্ত চাহিদার নিরসন ঘটিয়ে থাকে, তাকেই উপ-আঞ্চলিক স্তরে প্রবৃদ্ধি ক্ষেত্র বলা হয়।
• বিশেষত্ব (Speciality):
(i) প্রধান ক্ষেত্র: বাণিজ্যনির্ভর পরিসেবার প্রদানের তুলনামূলক বৃহদায়তন এই প্রবৃদ্ধি বিন্দু মূলত 10 থেকে 20টি সেবাক্ষেত্র নিয়ে গঠিত।
(ii) জনসংখ্যা: এখানকার মোট জনসংখ্যা 50 হাজার থেকে 1 লক্ষের মধ্যে হয়ে থাকে।
(iii) পরিসেবা কেন্দ্র: পরিসেবামূলক এই ক্ষেত্রটিতে বৃহদায়তন বাজার, অধিক সংখ্যক উচ্চ বিদ্যালয়, তুলনামূলক বড়ো ডাকঘর বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে ওঠে।
মুখ্য কার্যাবলি: উপ-আঞ্চলিক স্তরে মূলত কৃষিজাত পণ্য সংগ্রহ এবং তার বণ্টনকে ঘিরে এখানকার যাবতীয় অর্থনৈতিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়ে থাকে।
যেমন-মফঃস্বলের কোনো আধা পৌর গুণসম্পন্ন এলাকাগুলি এই প্রকৃতির।
• আধালিক স্তরে প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র (Regional Growth centre): সাধারণত শিল্পোৎপাদনভিত্তিক কার্যাবলির সমন্বয়ে যে সমস্ত উদ্ভাবন ক্ষেত্র গড়ে ওঠে, সেগুলিকে আঞ্চলিক স্তরের প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র বা প্রবৃদ্ধি নাভি বলা হয়।
• বিশেষত্ব (Speciality):
(i) প্রধান ক্ষেত্র: দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরের অর্থনীতির সাথে এই ক্ষেত্রগুলি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থেকে বিভিন্ন পরিসেবা প্রদান করে।
(ii) জনসংখ্যাঃ এখানকার জনসংখ্যা 1-2 লক্ষের মধ্যে থাকে।
(iii) পরিসেবা কেন্দ্র: উচ্চ শিক্ষালয়, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বৃহদায়তন স্থায়ী বাজার, থানা, ব্যাঙ্ক, যন্ত্রপাতি মেরামতস্থল প্রভৃতি এখানকার অন্যতম পরিসেবা কেন্দ্র।
(iv) মুখ্য কার্যাবলি: আঞ্চলিক স্তরের প্রবৃদ্ধি নাভিক্ষেত্রে শস্য সংগ্রহ ও গুদামজাতকরণ, কৃষি যন্ত্রপাতি, সার, কীটনাশক দ্রব্যের জোগান সহ একাধিক পরিসেবাগুলি প্রদান করে।
• যেমন-প্রাদেশিক শহর বা নগরগুলি আঞ্চলিক স্তরের প্রবৃদ্ধি নাভিরূপে বিবেচিত হয়।
• জাতীয় প্রবৃদ্ধি মেরুক্ষেত্র (National Growth pole) দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রায় সর্বোচ্চ স্তরে থাকা উল্লেখযোগ্য বৃহৎ পরিসরটি জাতীয় প্রবৃদ্ধি মেরুক্ষেত্র নামে পরিচিত।
• বিশেষত্ব (Speciality):
(i) প্রধান ক্ষেত্র: জাতীয় স্তরের এই ধরনের ক্ষেত্রগুলি সর্বাধিক পরিসীমা বিশিষ্ট বৃহৎ কোনো নগর অঞ্চল কেন্দ্রিক হয়ে থাকে।
(ii) জনসংখ্যাঃ এখানকার জনসংখ্যা কমপক্ষে 5-25 লক্ষের মধ্যে হয়ে থাকে।
(iii) পরিসেবা কেন্দ্র: এই ক্ষেত্রে পরিসেবাকেন্দ্ররূপে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক ভবন, উচ্চমানের চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়।
(iv) মুখ্য কার্যাবলি: এটি দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের মুখ্য প্রাণকেন্দ্র হওয়ায়, কৃষি ও শিল্পখাতের আন্তঃমিশ্রিত অর্থনৈতিক উন্নতি বজায় রাখতে যাবতীয় পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন এখান থেকেই ঘটে থাকে।
• যেমন-কোনো বৃহদায়তন প্রাদেশিক শিল্পভিত্তিক মহানগর।
তাত্ত্বিক পরিমার্জন (Theoritical refinement):
আর পি. মিশ্র তাঁর প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বটিকে তাত্ত্বিকভাবে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করতে গিয়ে, গ্রামভিত্তিক অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলির গুরুত্বকেও যথাযথভাবে অনুধাবন করেছিলেন। তাঁর পরিসেবার সরবরাহ ঘটে, তখন খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেখানকার পরিব্রাজনের মাত্রা কমে গিয়ে একটি উন্নত বাজার কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এইভাবে, কেন্দ্রীয় গ্রামীণ এলাকা উন্নয়ন কেন্দ্রীয় গ্রামীণ এলাকা উন্নয়ন ক্রমেই পার্শ্ববর্তী শিল্প বাজার এলাকা অভিমুখ হয়ে আঞ্চলিক উন্নয়নে একটি দৃঢ় স্তর গড়ে ওঠে।
ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়নের নিরিখে প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বের গুরুত্ব (Significance of the Growth foci theory in context of Indian regional development):
ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়নের পটভূমিকায় আর. পি. মিশ্রর প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ-
(i) এই তত্ত্বটির মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন স্থানিক পরিসরে উন্নয়নে লিপ্ত বহুমুখী অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপগুলি (কেন্দ্রীয় গ্রাম থেকে জাতীয় প্রবৃদ্ধি মেরু ক্ষেত্রীয় কাঠামোয়) কতটা প্রাসঙ্গিক তা স্পষ্টত উপলব্ধি করা যায়।
(ii) প্রবৃদ্ধি নাভিগুলিতে বিভিন্ন পরিসেবামূলক উদ্যোগ আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক সমন্বয় ঘটিয়ে ভারতের উন্নয়নক্ষেত্রকে যথেষ্ট সম্প্রসারিত করেছে।
( iii) এই তত্ত্বটি গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য একটি সংশোধনমূলক উন্নয়ন পথের ইঙ্গিত প্রদান করে।
(iv)তত্ত্বটিকে ব্যবহার করে ভারতের ক্ষুদ্র গ্রামগুলিও নিজেদেরকে একটি বৃদ্ধিকেন্দ্র মেনে নিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাজারের সুফলগুলিকে সমাজের সমস্ত স্তরে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে
(v)ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে স্থানীয় থেকে প্রাদেশিক স্তরে বিভিন্ন প্রাথমিক, গৌণ এবং প্রগৌণ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বজায় রাখতে প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
(vi) তত্ত্বটির বিধিসম্মত প্রয়োগ ঘটিয়ে ভারতের উন্নয়ন প্রসঙ্গে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির বিশেষ দায়বদ্ধতা বা আঞ্চলিক পরিকল্পনার পদক্ষেপগুলি আরো দ্রুত বাস্তবায়িত হয়েছে।
( vii) প্রবৃদ্ধি নাভিক্ষেত্রে উন্নয়নের সাফল্য পরোক্ষভাবে আঞ্চলিক বিকাশের ধারায় সমগ্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
ভারতে প্রবৃদ্ধি নাভিক্ষেত্রের বাস্তবায়ন(Implementation in the Field of Growth foci Theory in India):
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যে সমস্ত গ্রামীণ এবং প্রান্তিক ক্ষেত্র রয়েছে, সেগুলি বিভিন্ন পরিসেবা বা পরিকল্পনার নিরিখে বরাবরই অবহেলিত। আসলে, উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে অবহেলিত বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চল এবং অনুন্নত জনগোষ্ঠী বলতে একসময় গ্রামাঞ্চল এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষকেই বোঝানো হত। কিন্তু, ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়নে বিকেন্দ্রীভূত নীতি বর্তমান রাষ্ট্র পরিচালনার একটি অন্যতম দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা স্বাধীনোত্তর কালে দেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামকে এক-একটি বিশেষ প্রবৃদ্ধি কেন্দ্রে উপনীত করেছে। রাষ্ট্রের শীর্ষনেতারা আজ সকলেই উপলব্ধি করেছেন, ক্ষুদ্র আঞ্চলিক স্তরে থাকা পশ্চাদপদ এই গ্রামগুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে দেশের সামগ্রিক বিকাশ ঘটানো কখনোই সম্ভব নয়। তাই, বিগত শতকের সত্তরের দশক থেকে গ্রামীণ ক্ষেত্রগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার বিশেষ কৌশলগুলিতে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে, অধ্যাপক আর. পি. মিশ্রর প্রবৃদ্ধি নাভি তত্ত্বটির প্রাসঙ্গিকতা এবং প্রয়োগমুখী ইঙ্গিতগুলিরই সুষ্ঠ সমন্বয় ঘটেছে। দেশের উন্নয়নের সুষম গতি বজায় রাখতে বর্তমানে বুন্দেলখণ্ডের মতো বিস্তীর্ণ এবং দুর্গম গ্রামীণ এলাকাগুলিকে আঞ্চলিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভারতের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কেন্দ্রীয়ভাবে যোজনা আয়োগের স্বীকৃতি পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় সাত লক্ষেরও বেশি গ্রাম এবং প্রায় চার হাজারটির বেশি পৌর অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, ব্যাবসার উন্নতি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা, শিল্প সংযোগ প্রভৃতি একাধিক সুযোগ-সুবিধাগুলিকে অখণ্ড ইতিবাচকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে। দেশের কেন্দ্রীয় পরিচালনাধীন কৃষিমন্ত্রালয়ের উন্নয়ন অভিমুখী একাধিক Pilot Research Project-এর আওতায় বিভিন্ন 'Micro level planning' কর্মসূচি বাস্তবায়িত করতে অসংখ্য Field cell গঠিত হয়েছে। এই কর্মসূচিতে নিম্নস্তরের সমস্ত আর্থসামাজিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে আরো দ্রুত সমন্বয় ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। এইভাবে উৎপাদন, ভোগ, বণ্টন, বিপণন এবং কর্মসংস্থান সহ প্রায় সমস্ত পরিসেবার নিরিখে এক-একটি প্রবৃদ্ধি নাভি ভারতকে ক্রমেই ভারসাম্যযুক্ত উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
অন্যদিকে, ভারতের বিভিন্ন প্রাদেশিক স্তরে নবগঠিত প্রবৃদ্ধির নাভিগুলির উন্নয়নেও বর্তমানে যথেষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে, Backward Region Grant Fund (BRGF) গঠন করে প্রাদেশিক স্তরে প্রায় 272-টি জেলা চিহ্নিত করা হয়েছে। Prodhan Mantri Khanij Kshetra Kalyan Yojona (PMKKKY)-কে বাস্তবায়িত করতে ভারতের অধিকাংশ উপজাতি এলাকাগুলিতেও উন্নয়নের বিশেষ তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। ভারতের শহর বা বাজার অঞ্চলগুলিও উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখন আর পিছিয়ে নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, National Institute of Community Development-সহ বেশকিছু উদ্যোগে হায়দ্রাবাদের মতো একাধিক শহরে যেমন পরিকল্পনার কাজ করে চলেছে, একইভাবে মহারাষ্ট্রের ওয়ার্ধা জেলার বাজার কেন্দ্রের পরিকল্পনায় নিযুক্ত রয়েছে Institute of Regional Planning and Development-এর মতো সংস্থা। এর ফলে, খুব স্বাভাবিকভাবেই, দেশে গ্রাম থেকে শহর, ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ, কৃষি থেকে শিল্প সমস্ত ক্ষেত্রগুলিই এক-একটি স্বতন্ত্র প্রবৃদ্ধি নাভিতে উপনীত হয়েছে।