welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

আঞ্চলিক উন্নয়ন তাত্ত্বিক ধারণা এবং মডেলসমূহ

আঞ্চলিক উন্নয়ন তাত্ত্বিক ধারণা এবং মডেলসমূহ 


কেন্দ্রে পরিরিথাল মান্ডেল (The Core Periphery model):

বিশ্বব্যাপী আঞ্চলিক তথা স্থানিক পরিসরে আর্থনৈতিক কাঠামোর আপাত ভারসাম্যহীনতার বাতাবরণে উন্নয়নের যে কাঠামোগত আন্তঃসম্পর্কমূলক অভিমুখ প্রদর্শন করে, সেটিকে যথার্থভাবে উপলব্ধির ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হল বেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেল। বিশেষ করে, এটি শিল্পভিত্তিক নগরের প্রতিনিধিত্বকারী এমন একটি পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো যেখানে উৎপাদন বা বণ্টনের বিশ্বব্যাবস্থায় উন্নয়নের কেন্দ্র এবং অনুন্নয়নের প্রান্তিক অঞ্চলগুলির পারস্পরিক সম্পর্ককে উৎপাদনভিত্তিক শ্রমনিবেশ, বাজার, বিনিয়োগ প্রভৃতির নিরিখে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। সেই কারণে, মডেলটি বিশ্বের উন্নত এবং উন্নয়নশীল প্রায় সমস্ত দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য এবং ভারসাম্যহীনতার পরিস্থিতি অনুধাবনে সমানভাবে প্রযোজ্য।

এ প্রসঙ্গে Encyclopedia.com নামক ওয়েবসাইটে উল্লেখ করা হয়েছে, 'centre-peripheyr model The centre-periphery (or core-periphery) model is a spatial metaphor which describes and attempts to explain the structural relationship between the advanced or metropolitan 'centre and a less developed 'periphery', either within a particular country, or (more commonly) as applied to the relationship between capitalist and developing societies."

 পটভূমি (Background):

কেন্দ্র-পরিধিস্থল সংক্রান্ত আঞ্চলিক উন্নয়নের তাত্ত্বিক মডেলটি দুটি প্রধান বিষয়কে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে, যার প্রথমটি হল উৎপাদন-বন্টনের সম্পর্ক, দ্বিতীয়টি হল উৎপাদন পদ্ধতিকে ঘিরে সমৃদ্ধ এবং পশ্চাদ্গামী অনালের আন্তঃসম্পর্কের পরিস্থিতি। অবশ্য এখানে এই দুটি ধারণাই অর্থনৈতিক দ্বৈতবাদ (Economic dualism) এবং উপনিবেশবাদ (colonialist)-এর প্রতিনিধিত্বকারী একটি সমন্বয়ী যুক্তিপূর্ণ সিদ্ধান্তরূপে প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

বস্তুত, উনবিংশ শতক থেকে বিংশ শতক পর্যন্ত বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলির রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কৌশল যে অর্থনৈতিক বঞ্চনার অসামঞ্জস্যের পরিবেশ গড়ে তুলেছিল, তাকে প্রশমিত করে উন্নয়নের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলিকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার ভাবনাকে প্রতিষ্ঠিত করতেই বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্র-পরিধি মডেলটিতে বিশেষ আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।

আর্জেন্টিনার বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ Raul Prebisch আঞ্চলিক অর্থনীতিতে গড়ে ওঠা এই ধরনের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রকে Core এবং Periphory' রূপে প্রথম চিহ্নিত করেছিলেন 1929 খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য, তাঁর এই ধারণাটি তাত্ত্বিক মডেল রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল 1950 খ্রিস্টাব্দে। ওই বছর United Nations Economic Commission for Latin America (UNBCLA)-র একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে প্রকাশিত The Economic Development of Latin America and its Principal problems নামক একটি বিশেষ প্রবন্ধে Prelisch মজুরি কর উৎপাদন, রপ্তানি, বিনিয়োগের স্তর অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী দুটি বিপরীতধর্মী আঞ্চলিক ক্ষেত্র (যথা-অর্থনৈতিকভাবে উন্নত কেন্দ্র এবং অনুন্নত পরিধি) চিহ্নিত করে, এদের পারস্পরিক সম্পর্ককে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে, Prebisch বলেছিলেন- "অসম বিনিময় পরিধি অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে উদ্বৃত্ত মূল্যের প্রবাহ ঘটাচ্ছে funequal exchange is causing the flow of surplus value from periphery regions to core regions)। তিনি বিশ্বাস করতেন, যখনই কোনো একটি স্থানে উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি ঘটবে, সেটি একটি উন্নত অর্থনৈতিক কেন্দ্রে উপনীত হয়ে অনুন্নত পরিধি অঞ্চলগুলির অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট পরিসরে ধনী-দরিদ্রের প্রসঙ্গটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তৎকালীন অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে Prebisch-এর এই ধারণাগুলি বিশ্বের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ এবং উন্নয়ন চিন্তাধারায় অসাধারণ প্রভাব ফেলেছিল।

এরপর, ষাটের দশকের শেষের দিকে Johin Friedman এই ধারণাটিকে আরও সমৃদ্ধ কাঠামোয় উপস্থাপন করেন। তিনি, এ-বিষয়ে F. Perroux (1955) উপস্থাপিত ভারসাম্যহীন প্রবৃদ্ধি মেরু তত্ত্বের input-outpot linkage -এর নীতিটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 1974 খ্রিস্টাব্দে Immanuel Wallerstein তাঁর The world system theory'-তে আন্তর্জাতিক স্তরে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সক্ষমতার বিষয়টিকে তুলে ধরতে নিম্নলিখিত তিনটি বিশেষ অঞ্চলকে চিহ্নিত করেছিলেন, যেগুলি হল- Core, semi-periphery এবং Periphery.

অবশ্য ধনতান্ত্রিক কাঠামোয় নগরোন্নয়ন, এমনকি আঞ্চলিক অর্থনীতির বিকাশ প্রসঙ্গে এই ধারণাটিকে একে একে যাঁরা প্রয়োগ করতে শুরু করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন-Nemeth, Smith, Hirschmen, Snyder, Krugmen প্রমুখ।

মূল বক্তব্য (Fundamental ideas):

কেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেলটি সম্পূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেন্দ্রিভূতভাবে আঞ্চলিক সমৃদ্ধি এবং সাহচর্যের বিশেষ এক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে অনুন্নয়ন কখনই চিরাচরিত সমাজব্যবস্থার পরিণতি নয়, বরং কেন্দ্রীয় পুঁজিবাদী দেশগুলির চরম বিকাশের জন্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার সার্বিক প্রক্রিয়ার একটি অংশমাত্র। সেই কারণে, উন্নত ও উন্নয়নশীল প্রায় সমস্ত দেশের অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল তথা উৎপাদনশীল বণ্টন কাঠামোটি আপেক্ষিকভাবে ভারসাম্যতা বা ভারসাম্যহীনতা উভয়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি হতে পারে। এই মডেলের তাত্ত্বিক ধারণা অনুযায়ী, পুঁজিবাদী দেশগুলি বাজার অর্থনীতি ধরে রাখতে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি প্রধান উৎপাদনক্ষেত্র গড়ে তোলে, যেখানে মূলধনের উচ্চ যোগানের পাশাপাশি ইউনিট প্রতি মজুরির মূল্যমান তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট বেশি থাকে। অন্যদিকে, পরিধিস্থ অঞ্চলে মূলধন পুঁজির ঘাটতি শ্রমশক্তিকে যথার্থভাবে পরিচালিত করতে পারে না। এই অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলি অন্য কোনও প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ভর্তুকি বা আর্থিক সহায়তা নিয়ে ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। আসলে, এককভাবে কোনও দৈশিক এলাকাই উন্নয়নের শীর্ষে উপনীত পারে না। তাই কার্যক্ষেত্রে দেখা যায়, কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে উৎপাদিত দ্রব্যের সঠিক বণ্টন এবং পার্শ্ব অঞ্চলগুলির সম্পদ এবং শ্রমিক সরবরাহের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই একটি দেশ তার সার্বিক উন্নয়নের কাঙ্খিত লক্ষ্যপূরণে সহায়তা করে।

কেন্দ্র-পরিধিস্থল তত্ত্ব প্রসঙ্গে মতামত ব্যক্ত করতে গিয়ে 1998 খ্রিস্টাব্দে McCann এবং Gunn বলেছেন, 'Regions vary widely in their achieve full development, and certainly in their ability to attain heartland status. Few regions ever achieve a position of dominance in a core-periphery system.

মডেলটির তাত্ত্বিক বিশেষত্ব (The theoritical specification of the model):

(১) কেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেলটি সামগ্রিকভাবে আঞ্চলিক অর্থনীতির শক্তিশালী পরিসরকে সুসংহত কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত করার ওপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

(1) স্থানীয় তথা আঞ্চলিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার বিষয়গুলি এই মডেলে বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে।

(ii) এই তত্ত্বটিতে আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে দ্বৈত সত্তারূপে ভারসাম্য এবং ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণভাবে স্থান করে নিয়েছে।

(iv) মূলত নগরায়িত বা শিল্পায়িত কাঠামোগত পরিসরে, উৎপাদন পদ্ধতির বিভিন্ন স্তর, অর্থনীতির অগ্রবর্তী বা পশ্চাদপদ সহযোগী সম্পর্ক, বিনিয়োগ, বল্টন, বিকেন্দ্রিকরণ এবং উন্নয়নের প্রয়োগমুখী অসংখ্য দিক এই তত্ত্বে উপস্থাপন করা হয়েছে।

(v) আঞ্চলিক উন্নয়নের এই তত্ত্বটিতে কেন্দ্রীয় এবং পারিপার্শ্বিক অঞ্চলগুলির কৃষি ও শিল্পভিত্তিক কাঠামোর মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করে।

বিকাশের ক্ষেত্র (Areas of development):

উন্নয়নের কেন্দ্রীভূত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিক্রিয়াশীল মাত্রা অনুধাবনের ক্ষেত্রে কেন্দ্র এবং পরিধিস্থ প্রতিটি অঞ্চল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। সেই কারণে, আঞ্চলিক তথা বৈশ্বিক কাঠামোয় গড়ে ওঠা কেন্দ্র এবং পরিধিসদ্ধ এলাকা দুটিকে বিকাশের স্বতন্ত্র ক্ষেত্ররূপে এখানে উপস্থাপন করা হল।

(a) কেন্দ্রস্য অব্দুল (Core region):

কোনো একটি দৈশিক পরিসরে আর্থসামাজিক কাঠামোর অধিবৃত্তে থাকা সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী ক্ষেত্রটিকে কেন্দ্রস্য অঞ্চল বলা হয়। এই ধরনের কেন্দ্রস্থলগুলি সর্বদা উচ্চপ্রযুক্তি, উচ্চবিনিয়োগ এবং সর্বোচ্চ মুনাফা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। সাধারণত, ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে সর্বাধিক অনুকূল কেন্দ্রস্থলগুলি ধরেই একটি দেশের বিকাশের পথ অতিক্রম দ্রুত গতিতে সম্প্রসারিত হয়। 

দৃষ্টান্ত: যে-কোনও দেশের অনুন্নত অথচ সম্পদশালী অঞ্চলগুলি পরিধিস্থ অঞ্চলের মধ্যে পড়ে। যেমন-

ভূমি সম্পদ, খনিজ সম্পদ এবং জল সম্পদ সমন্বিত লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশ পরিধিস্য অঞ্চলের অন্তর্গত। এ ছাড়াও, পৃথিবীতে এমনকিছু অঞ্চল রয়েছে, যেগুলিকে আধা-পরিধি (Semi-peripheri) অঞ্চল বলা হয়ে থাকে। যদিও কেন্দ্র-পরিধিস্থল উন্নয়ন তত্ত্বে এই ধরনের অঞ্চলগুলিকে সেভাবে তুলে ধরা হয়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আঞ্চলিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় এই পরিসরগুলির ভূমিকাকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। যেমন-ব্রাজিলের আমাজন অববাহিকা অঞ্চল।

কয়েকজন অঞ্চল বিশারদের দৃষ্টিভঙ্গিতে কেন্দ্রস্থল-পরিধি মডেল (Core-periphery Model in the View of Some Regional Experts):

আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন পরিকল্পনাবিদ তথা অর্থনীতিবিশারদ কেন্দ্র-পরিধিস্থল তত্ত্বটিকে সামনে রেখে বহুমুখী ধারণা পোষণ করেছেন। যেমন-

Albert O. Herscmen (1956 খ্রিঃ): অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অসম বণ্টনকে গুরুত্ব দিয়ে হার্সম্যান বলেছেন, যদি কোনো একটি দেশে ছোটো ছোটো অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলির বিকাশ ঘটানো যায়, তাহলে সামগ্রিকভাবে কেন্দ্র ও পরিধিস্থ অঞ্চলের মধ্যে গড়ে ওঠা উন্নয়নমূলক সমতার সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোকে যথেষ্ট মজবুত করে তুলবে।

Gibbs (1963 খ্রিঃ) গিবস ফিনল্যান্ডের নগরায়িত আঞ্চলিক কাঠামোয় বিকাশের কেন্দ্রীকরণ দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে রেখে বলেছেন, কেন্দ্র-পরিধিস্থল অর্থনৈতিক সম্পর্কটি আসলে নগরায়ণভিত্তিক জনসমাগম এবং পরিসেবা বৃদ্ধির ঘটনা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এ প্রসঙ্গে তিনি পাঁচটি পর্যায়ের কথা বলেছেন, যথা-

(i) প্রথমে একটি শহর গড়ে উঠবে এবং দেশের চারপাশের অঞ্চল থেকে সংশ্লিষ্ট শহরটির জনসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটবে,

(ii) শহরগুলি আয়তনে ক্রমশ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে,

(iii) এরপর, দেশের প্রান্তিক অঞ্চলগুলি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে,

(iv) ছোটো শহরগুলির জনসংখ্যাও ক্রমশ হ্রাস পেতে শুরু করে,

(v) সবশেষে, কেন্দ্র এবং পরিধিস্থ অঞ্চলের পারস্পরিক আন্তঃসংযোগে আঞ্চলিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

John Friedmann (1966 খ্রিঃ): ফ্রেইডম্যান বলেছেন, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত অঞ্চলেই কেন্দ্র এবং পরিধি অঞ্চলের পারস্পরিক আদানপ্রদানমূলক সম্পর্কের মাধ্যমেই বেশ কয়েকটি স্তরে আঞ্চলিক বিকাশ ঘটে থাকে।

প্রসঙ্গার উল্লেখ্য, বিশিষ্ট আঞ্চলিক অর্থনীতিবিদ Gari Raagman কেন্দ্র এবং পরিধিস্থলের পারস্পরিক সহচর্যতার বিষয়টিকে উপস্থাপনে 'The European Regional Science Association'-এর 43 তম মহাসভায় কয়েকটি সার্বজনীন স্তর চিহ্নিত করেছেন, যেগুলিকে ফ্রেইডম্যান, গিবস, হোতামাকি প্রমুখ বিশেষজ্ঞের Core periphery model-এর সমন্বয়ী ভাবনাও বলা চলে। এই স্তরগুলি হল-

1. স্থানীয় নগরায়ণ (Local urbanization) পর্যায়,

2.কেন্দ্রীয় নগরায়ণ (Core urbanization) পর্যায়, উপনগরায়ণ (Suburbanization)-এর সাথে সাথে অন্যান্য শহর এবং প্রান্তিক কেন্দ্রের সম্প্রসারণ,

3. নগরায়ণের বিস্ফারিত রূপ এবং কেন্দ্রীয় শহরাণালের বাইরে নতুন পৌরক্ষেত্র গঠন,

4. প্রতিমুখী নগরায়ণ (Counter suburbanization)-এর প্রভাবে গ্রামাঞ্চলের জনসংখ্যাবৃদ্ধি এবং নতুন নতুন নগর কেন্দ্রের উদ্ভব।

উল্লিখিত পর্যায়গুলিকে সামনে রেখে বলা যায়, প্রথম দিকে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে নগরায়ণের ধনাত্মক (Positive) প্রভাব এবং পরিধি অঞ্চলগুলিতে ঋণাত্মক (Negetive) প্রভাব দেখা দিলেও, পরে অবশ্য সামগ্রিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক প্রভাবগুলির যৌথ মিথস্ক্রিয়ার ক্রমপ্রবাহ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক চালিকা শক্তিকে যথেষ্ট মজবুত করে দেশের সার্বিক বিকাশে সহায়ক হয়।

কেন্দ্র-পরিধিস্থলের সম্পর্ক (Relation between Core-periphery Region):

কেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেলে যে তাত্ত্বিক সম্পর্কের কথা বলা হয়েছে, সেটিকে মূলত দুইভাবে প্রদর্শন করা যায়, যেমন-

দীর্ঘকালীন সম্পর্ক (Long-term relation) :

কেন্দ্র-পরিধিসস্থল তত্ত্বের দীর্ঘকালীন সম্পর্কটি শিল্পায়ন এবং শিল্প-পরবর্তী পর্যায়ে লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে, নগরায়িত কোনো একক কেন্দ্রীয় অঞ্চলকে ঘিরে অন্যান্য অর্থনৈতিক উপকেন্দ্রগুলির বিকাশ সংঘবন্ধভাবে কেন্দ্রৎ-পরিধি অঞ্চলগুলির দীর্ঘকালীন পারস্পরিক আদানপ্রদানমূলক সম্পর্ক মজবুত করে আঞ্চলিক উন্নয়নের সুসংহত পথ প্রশান্ত রাখে। তাই সংশ্লিস্ট সম্পর্কটিকে এখানে ধনাত্মক (Positive)-রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে।

সাধারণত উৎপাদন এবং সম্পদের বন্টন বা প্রবাহগত দিক থেকে কেন্দ্র এবং পরিধি অঞ্চলের সম্পর্ক ধনায়ক বা গুণাত্মক হলেও, অনেকসময় দীর্ঘ সময়ের অবকাশে কেন্দ্রীয় অঞ্চলটির অর্থনৈতিক কাঠামোয় বিচ্যুতি ঘটার দরুন, সেখানকার নেতিবাচক প্রভাবগুলি পরিধিস্থ অঞ্চলগুলিতে নতুন করে অর্থনৈতিক উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ফলে পরিধিস্থ, অঞ্চলের অর্থনৈতিক কাঠামো নতুন করে পুনর্গঠিত হয়ে প্রবৃদ্ধি তথা উন্নয়নে যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকে। এখানে বিষয়টিকে 9.3৪ নং ধারণাচিত্রটির দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে।

কেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেলের ত্রুটি (Demerits of Core-Periphery model):

কেন্দ্র-পরিধিস্থল মডেলটির বেশ কয়েকটি ত্রুটিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না, যেমন-

(i) কেন্দ্রস্থল-পরিধি তত্ত্বে যে ধরনের শিল্পায়নের কথা বলা হয়েছে, সেখানে শিল্পের ধরনগুলি সম্পর্কে যথার্থবিশ্লেষণ করা হয়নি।

 (ii) কেন্দ্র এবং পরিধিস্থ অঞ্চলের মধ্যে সম্পদ এবং পুঁজির ধারাবাহিক সঞ্চালন প্রক্রিয়াটি অনেকসময় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়, যে বিষয়টিকে এই মডেলে উল্লেখ করা হয়নি।

(iii) সংশ্লিষ্ট মডেলে বর্ণিত অর্থনীতির চারটি স্তরের (ফ্রেইডম্যানের তত্ত্ব অনুযায়ী) সব কটি একত্রে পৃথিবীর সকল দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে কিন্তু সমানভাবে লক্ষ্য করা যায় না।

(iv) পৃথিবীর বেশকিছু উন্নয়নশীল দেশে এমনকিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেন্দ্র রয়েছে, যেটি অনেকক্ষেত্রে তার পার্শ্বস্য অঞ্চলগুলির সাথে একটি চিরকালীন দূরত্ব বজায় রেখে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছে। অথচ এই মডেলে সেটিকে দেখানোই হয়নি।

(v) এখানে উন্নয়নের চরম পর্যায়ে আঞ্চলিক ভারসাম্যের কথা বলা হলেও, সেই নিরিখে পৃথিবীর সমস্ত দেশের কেন্দ্রীয় এবং পরিধিস্থ অঞ্চলগুলির মধ্যে সম্পদ তথ্য পরিসেবামূলক সমবন্টন কখনোই লক্ষ্য করা যায় না।

অবশ্য, এই তত্ত্বের উল্লিখিত একাধিক ত্রুটি থাকলেও, বিভিন্ন দেশের আঞ্চলিক উন্নয়নের সামগ্রিক পরিসরে কেন্দ্রস্থল এবং পরিধিস্থলের ধারণাটিকে কখনোই প্রত্যাখ্যান করা যায় না। কারণ, আঞ্চলিক অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতায় এদের মধ্যে যে সুক্ষ্মতম সীমানা থেকে যায়, সেগুলিকেই আরেকটি উন্নয়ন ক্ষেত্রের পুনর্জন্ম বলা চলে। কারণ, উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-পরিধিস্য এই দুটি অঞ্চল যখন একে অপরের ওপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করে, তখন প্রান্তিক সীমানা অঞ্চলগুলি সর্বাধিক সম্ভাবনা প্রদর্শন করে থাকে। এইভাবে উন্নয়ন শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে চারপাশের সমস্ত ক্ষেত্রগুলিতে একে অপরের পরিপুরক হয়ে ওঠে।

কেন্দ্র-পরিধিস্থলের প্রাসঙ্গিকতা (The relevance of the core-periphery):

কোনও একটি দেশের নগরায়িত বা শিল্পসমৃদ্ধ কেন্দ্রস্থল এবং কৃষি বা অন্যান্য খনিজসম্পদ সমৃদ্ধ গ্রামীণ পার্শ্বাসস্থ ক্ষেত্রগুলি সমানভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আঞ্চলিক উন্নয়নমূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে এই দুটি ভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সমৃদ্ধি বা সৌভাগ্য প্রায় একই সূত্রে গাথা রয়েছে। ঠিক সেই কারণেই, কেন্দ্রীয় শিল্পাঞ্চলটি তার উৎপাদনের জন্য সর্বদা পার্শ্বস্থ কোনও সম্পদশালী কাঁচামালের উৎস অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অন্যদিকে, সম্পদশালী প্রান্তিক অঞ্চলটির সার্বিক উন্নতি একইভাবে নির্ভর করে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো শিল্পক্ষেত্রের উৎপাদিত প্রধান উপকরণের ওপর। এইভাবে, একটি দেশে কেন্দ্রস্থ এবং প্রান্তিক অঞ্চল গুলি পারস্পরিক উন্নতি ধারাবাহিকতা চিরকাল বজায় থাকে।

অধ্যাপক হার্সম্যান তাই বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশের নিম্নস্তরীয় অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতার যে ফাঁদ রয়েছে, তাকে অতিক্রম করার জন্য মূল্যনিরূপক ন্যূনতম প্রচেস্টার (Critical minimum effort) বাস্তবায়ন ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। হার্সম্যান এখানকার আঞ্চলিক সমৃদি ঘটানোর পদক্ষেপৰূপে একটি বিশেষ জোরালো ধাক্কা দেওয়াকে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত মনে করেছেন। যেহেতু এই সকল দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে সমানভাবে বিনিয়োগের সামর্থ্য এখানে থাকে না, তাই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিল্প সংযোগ মাত্রা যেখানে সর্বাধিক, এরকম কয়েকটি ক্ষেত্রে কৌশলগত (Strategic sector) বিনিয়োগ মারফত অর্থনীতির অন্যান্য সহায়ক ক্ষেত্রগুলিকে উৎসাহ প্রদান বা সমৃদ্ধক্ষেত্ররূপে গড়ে তোলা যায়। সেইজন্য হার্সম্যানের বক্তব্য হল- 'Growth being communicated from the leading sector of the economy to the followers, from the one industry to another, from one firm to another."

স্বরোয়ত অর্থনীতির প্রধান বাধাসমূহ:

এইভাবে, অসম বিনিয়োগের নীতিটিই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ধীরে ধীরে সমগ্র অঞ্চলের বিকাশের পথ সম্প্রসারিত করবে এবং দারিদ্র্যের ঘেরাটোপ থেকে সেখানকার জনগোষ্ঠীকে নিষ্কৃতি দেবে।

আঞ্চলিক ক্ষেত্রগুলির বিন্যাস (Formating of regional sectors):

হার্সম্যান স্বল্পোন্নত দেশগুলির অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে মূলত তিনটি ক্ষেত্র (sector)-কে চিহ্নিত করেছেন, যথা- 

প্রবৃদ্ধি মেরু ক্ষেত্র(Growth pole sector): আঞ্চলিক পরিমণ্ডলের যে অংশটি অধিক বিনিয়োগ, শিল্পায়ন পরিসেবা, বর্ধিত আয় এবং অর্থনৈতিক সমস্ত ধরনের সুযোগসুবিধাকে সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করে উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র- রূপে আত্মপ্রকাশ করে, তাকে হার্সম্যান প্রবৃদ্ধি মেরুক্ষেত্র বলেছেন।

প্রগতিশীল ক্ষেত্র (Developing sector): কোনো প্রবৃদ্ধি অদলকে বেষ্টন করে গড়ে ওঠা অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশীল যে ক্ষেত্রটির যথেষ্ট সার্বিক উন্নয়ন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কেন্দ্রীয় প্রবৃদ্ধি মেধু অতিরি শরিফালিত থাকে, তাকেই প্রগতিশীল ক্ষেত্র বলা হয়।

 পশ্চারগামী ক্ষেত্র (Backward sector): আঞ্চলিক স্তরের একেবারে প্রান্তিক এই ক্ষেত্রটি অসম অর্থনীতির দেখে সর্বাধিক দৃষ্ট হওয়ায় এখানে উন্নয়নের মাত্রাও খুব মন্দর প্রকৃতির।

এ প্রসঙ্গো হার্সম্যান উল্লেখ করেছেন, এই ধরনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি দেশের ভারসাম্যহীন উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে, কোনও শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা পুঁজিপতি বিনিয়োগের জন্য সর্বদা প্রবৃদ্ধি মেবুস্থলটিতেই অধিক মনোনিবেশ করে থাকে।

উন্নয়নের প্রস্তাব ও বাহ্যিক অর্থনীতি সৃষ্টি (Development Proposals and Creation of External Economy):

হাসম্যান বলেছেন, কোনও স্বয়ংক্রিয় ভালো যানবাহনের অস্তিত্ব যেমন আধুনিক সড়কপথ ছাড়া কল্পনা করা যায়.একইভাবে ভালো সড়কপথের অস্তিত্বও কোনও স্বয়ংক্রিয় যানবাহন ছাড়া অস্তিত্বহীন। এক্ষেত্রে হার্সম্যান, দ্রুত পরিবহণ ব্যবস্থা এবং শিল্পকে উদ্দীপিত করতে পারে এমন কোনও একটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের নিউক্লিয়াস তৈরির কথা বিবেচনা করেছেন, যেখান থেকে উন্নয়নের প্রভাব চুইয়ে পড়ে সমগ্র অঞ্চলের পরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাবে। যেহেতু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পুঁজির পরিমাণ খুবই কম, তাই এখানকার আঞ্চলিক সমৃদ্ধকরণ প্রসঙ্গো হর্সম্যান বলেছেন- If the economy she kept moving a head, the of development policy is to mantain tensions, disproportions and disequilibrium অর্থাৎ, এখানকার অর্থনীতিকে যদি মাথা তুলতে হয়, উন্নয়ন নীতির কাজ হল উদ্দীপনা, বৈষম্য এবং অসমতা বজায় রাখা। সেই কারণে, "look at the dynamics of the development process in the small" অর্থাৎ, ক্ষুদ্র পরিসরে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার গতিশীলতার দিকে দৃষ্টি আরোপ-কে হারম্যান হয়।

প্রণোদিত পদ্ধতি (Creating method): কোনও একটি স্থানে যখন প্রাথমিক পর্যায়ে গড়ে ওঠা একটি শিল্পকেন্দ্রে অতিরিক্ত বিনিয়োগ এবং তাদের মুনাফাকে লক্ষ্য করে অপর কোনও প্রদর্শক (Exhibitor) আর্থিক প্রতিষ্ঠান সদর্থকভাবে এগিয়ে আসার দরুণ পারস্পরিক যে আন্তঃসংযোগক্ষেত্র গড়ে তোলে, সেটিকেই বাহ্যিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্র বলা হয়। এখানে, একটি শিল্প অন্য আরেকটি শিল্পের সম্প্রসারণে উদ্যোঙ্কাবুলে সর্বদা ক্রিয়াশীল থাকে। ধরা যাক-এ শিল্পকেন্দ্রকে ঘিরে AI শিল্পকেন্দ্রস্থাপন অথবা A1 শিল্পকেন্দ্রকে ঘিরে A2 শিল্পকেন্দ্র স্থাপন কিংবা সেখানে বিনিয়োগের সম্প্রসারণমূলক সম্পর্কটি বাহ্যিক অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রণোদিত পদ্ধতির মধ্যে পড়ে।

উপযোগী পদ্ধতি (Appropriate method): একটি স্থানে নতুন কোনও শিল্প গঠনের পরিস্থিতি না থাকা সত্ত্বেও, যখন প্রধান শিল্পকেন্দ্রের উৎপাদিত দ্রব্য তথা "Output"-কে অন্য কোনও একটি শিল্পকেন্দ্র কাঁচামাল তথা "Input"-রূপে ব্যবহার করে তাদের উৎপাদনগত কাঠামোকে সুসংহত করে তোলে, সেটিকেই বাহ্যিক অর্থনীতি সৃষ্টির উপযোগী পদ্ধতি বলা হয়। 

অর্থনৈতিক কার্যাবলির অভিমুখ (Direction of economic activity): বাহ্যিক অর্থনীতির আবার দুটি বিশেষ ধরনের অভিমুখ দেখতে পাওয়া যায়। যেমন-

 অভিসৃতি (Convergent): যে অর্থনৈতিক পরিমন্ডলে দক্ষ বাজার, সর্বাধিক পুঁজি এবং সর্বোত্তম সম্পদসূচক অধিক মাত্রায় থাকার দরুন, সেখানে শিল্পকেন্দ্রিক output এবং Input-এর মধ্যে সর্বাধিক সমন্বয় ঘটলে, তা অর্থনীতির অভিসৃতিমূলক ক্ষেত্র নামে পরিচিত। এটি মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে অধিক মুনাফা লাভের নীতি দ্বারা পরিচালিত হয়।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, এখানে প্রণোদিত (Create) পদ্ধতির তুলনায় উপযোগী পদ্ধতি (Appropriate)-র প্রভাব সর্বাধিক থাকবে। অর্থাৎ-

সুসংহত পদ্ধতি > প্রণোদিত পদ্ধতি অভিসৃতি ক্ষেত্র

(ii) অপসৃতি (Divergent): অর্থনীতির এই অবস্থাটি অভিসৃতির ক্ষেত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত। সাধারণত, আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে সহযোগী বা সম্প্রসারণমূলক ক্ষেত্রগুলিতে একাধিক নতুন নতুন শিল্প সমাবেশের নিরবচ্ছিন্ন পরম্পরা অপসৃত অর্থনীতির অভিমুখ তৈরি করে। সামাজিক স্তরে বহুমুখী উন্নয়নের সাথে অপসৃতিমূলক কার্যাবলীর একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, এখানে উপযোগী পদ্ধতি (Appropriate)-র তুলনায় প্রণোদিত (Create) পদ্ধতির প্রভাব সর্বাধিক থাকবে। অর্থাৎ-

প্রণোদিত পদ্ধতি > সুসংহত পদ্ধতি অপসৃতি ক্ষেত্র

যদিও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে অপসৃতির ইতিবাচক বা নেতিবাচক উভয় প্রভাবেরই সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু তাসত্ত্বেও ক্ষুদ্রতর কোনও উৎপাদনমুখী ক্ষেত্রে দ্রুত মুনাফার প্রত্যাশিত সংযোগের আশায় হার্সম্যান আঞ্চলিক উন্নয়ন তথা আর্থিক বিনিয়োগের জন্য অপসৃতিমূলক ক্ষেত্রের অভিমুখটিকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

বিনিয়োগের নীতি (Principle of investment):

হাসম্যান তাঁর তত্ত্বে আর্থিক বিনিয়োগের কৌশলরূপে যে কয়েকটি নীতির কথা উল্লেখ করেছেন, তার মধ্যে কয়েকটি হল-

(i) উৎপাদনের কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রে অধিক বিনিয়োগে মনোনিবেশ করা।

(ii) যে শিল্পক্ষেত্রগুলি বিনিয়োগের জন্য নির্বাচিত হবে, তাদের মধ্যে যেন দৃঢ় সংযুক্তিকরণ প্রভাব (Linkage effect) থাকে।

পরিবর্ত বিনিয়োগ গছন (Substitution choice of investment): এখানে ভোগ্যপণ্য উৎপাদনকারী অথবা মূলধন সংহতিকরণ শিল্পের ঠিক কোন ক্ষেত্রটি বিনিয়োগের জন্য প্রাধান্য পাবে, তা খতিয়ে দেখা হয়।

অগিতকৃত বিনিয়োগ পছন্দ (Postponment choice of investment): এখানে ভোগাপনা উৎপাদনমুখী অথবা মূলধন সংহতিকরণ শিল্পকেন্দ্রের ঠিক কোনটিতে প্রথম বিনিয়োগ করা হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। পুঁজিহীন উন্নয়নশীল দেশগুলির যেহেতু সর্বত্র সমানভাবে বিনিয়োগের সক্ষমতা থাকে না, তাই হাসমান এখানে স্থগিতকৃত বিনিয়োগ নীতিকেই অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

সংযোগমূলক প্রভার এবং বিনিয়োগের আদর্শ মানদs Linkage effect and ideal investment area):

কোনও একটি অঞ্চলের সামাজিক মূলধন গঠনের দায়িত্ব যেহেতু ওই দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের ওপর বতায়, তাই সেখানে বিনিয়োগমূলক যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে (বিভিন্ন প্রত্যক্ষ উৎপাদনশীল ক্ষেত্রের) হার্সম্যান পারস্পরিক সংযোগমূলক দিকটিকেই অধিক গুরত্বপূর্ণ মনে করেছেন।কাঁচামাল হাসমান প্রদত্ত নির্দেশিত পথে একটি দেশের উৎপাদনমূলক ক্ষেত্রগুলির পরস্পরিক সংযোগ তথা নির্ভরশীলতার বিষয়টিকে দুটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক যোগসূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন-

অগ্রগামী সংযোগ প্রভাব (Forward linkage effect): একটি সম্মুখগামী সংযোগ পরিকল্পিত আন্তঃসম্পর্ক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের কোনো উৎপাদন কাঠামোর সম্প্রসারণ এবং সমৃদিকে প্রভাবিত করে, সেটি সংযোগমূলক প্রভাব (Linkage effect) নামে পরিচিত। সাধারণত, প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের বিনিয়োগ যখন অন্য কোনো পরবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের‌ উৎপাদনে উৎসাহ সৃষ্টি করে তার input বৃদ্ধি ঘটায়, তখন অগ্রগামী সংযোগ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

পশ্চাদমুখী সংযোগ প্রভাব (Backward linkage effect) একটি প্রধান অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের মোট উৎপাদনের বিনিয়োগ যখন তার পূর্ববর্তী কোনও output সরবরাহকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির সমৃদিতে সহায়ক হয়, সেক্ষেত্রে পশ্চাদগামী সংযোগ প্রভাব দেখা যাবে। বিষয়টিকে পেরক্সের তত্ত্বেও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, উপরিউল্লিখিত আন্তঃসংযোগ প্রভাবের নিরিখে হার্সম্যান এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, যেসমস্ত শিল্প তথা উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে অগ্রগামী এবং পশ্চাদগামী সংযোগসূত্রের সম্মিলিত প্রভাব সর্বাধিক, সেই ক্ষেত্রটিই বিনিয়োগের মানদণ্ডে আদর্শ বলে বিবেচিত হবে।

 বিনিয়োগের পরম্পরা (Series of Investments):

উন্নয়নশীল বা পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে বিনিয়োগকৃত মূলধনের পরিমাণ যথেষ্ট কম থাকায়, হার্সম্যান এখানে এমন একটি বিনিয়োগক্ষেত্র নির্বাচন করার কথা বলেছেন, যেখানে বিনিয়োগ বর্ধিত হলেই উৎপাদন যথেষ্ট বাড়বে এবং সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের অর্থনীতি ক্রমশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলবে।

এক্ষেত্রে হার্সম্যান দুই ধরনের বিনিয়োগমূলক পরম্পরার কথা উল্লেখ করেছেন, যথা-

সামাজিক বুনিয়াদি মূলধন (Social Overhead Capital/SOC): যে সমস্ত বিনিয়োগ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারি প্রচেস্টায় সমাজের মৌলিক পরিসেবা প্রদানকারী একাধিক ক্ষেত্রের উন্নয়নের সাথে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত থাকে, তাকেই সামাজিক বুনিয়াদি মূলধন বলা হয়। এই ধরনের মূলধন ব্যতিরেকে প্রাথমিক, গৌণ এবং প্রগৌণ স্তরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানো কখনোই সম্ভব নয়।

যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, জনসাধারণের বিনোদন পার্ক, পরিবহণ, যোগাযোগ, জলসেচ ব্যবস্থা সহ একাধিক ক্ষেত্রে SOC বিনিয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

প্রস্তাক উৎপাদনশীল ক্রিয়াকলাপ (Direct Productive Activities / DPA): কোনও একটি যানে উৎপাদন তথা মুনাফালাভের উদ্দেশে। বেসরকারিভাবে যে ধরনের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়, সেটি প্রত্যক্ষ উৎপাদনশীল বিনিয়োগের অন্তর্গত। এটি, এক অর্থে স্বায়ত্বশাসিত বিনিয়োগ (Autonomous investment) যা মূলত ব্যক্তিগত মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। সাধারণত, বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি এই ধরনের বিনিয়োগে লিপ্ত থাকে

বিনিয়োগের পরিপূরক পথে ভারসাম্য সৃষ্টি এবং উন্নয়ন (Unbalancing and Development in the Complementary ways of Investment):

হার্সম্যান বিশ্বাস করতেন, আন্তঃআঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য অনিবার্যভাবেই বৃদ্ধির কয়েকটি সহগামী পথ রচনা করে। তাই তিনি বিনিয়োগ ক্ষেত্রের অনুপূরক (Complentaities)-নীতি বোঝাতে একটি বিশেষ লেখচিত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন, যার উল্লম্ব অক্ষ (OY) বরাবর DPA এবং অনুভূমিক অক্ষ (OX) বরাবর SOC-কে প্রদর্শন করেছেন। এখানে OZ একটি সুষম সমৃদ্ধির পথ (Balanced growth path) নীচের রেখচিত্রে AB, CD এবং EF নামক বক্ররেখা তিনটি আসলে DPA-তে নিয়োজিত ক্ষমতার (Installed capacity) পরিপূর্ণ ব্যবহারে উৎপাদিত দ্রব্যসমূহের মোট ব্যয় রেখা।

প্রারাবাহিকভাবে কল্পিত AB, CD এবং EF রেখারয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। যে অবস্থায় SOC বৃদ্ধির সাথে সাথে DPA ক্ষেত্রের ব্যয় কমতে থাকে, সেখানে AB, CD এবং EF রেখাগুলি নিম্নমুখী এবং উৎসের দিকে উত্তল প্রকৃতির হয়ে থাকে।

DPA-তে উৎপাদন শুরু করতে গেলে যে ন্যূনতম SOC-র প্রয়োজন সেটিকে এ বিন্দুতে গঠিত OS রেখা দ্বারা কল্পনা করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, SOC যত বৃদ্ধি পায়, DPA-তে উৎপাদন ব্যয় সেইভাবেই ক্রমশ হ্রাস পায়। এই নীতি অনুযায়ী কীভাবে এক বিন্দু থেকে অপর বিন্দুর ভারসাম্যহীনতার দ্বারা উন্নয়ন মাত্রার কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছানো যায়, তার দুটি বিকল্প ভাবনা এখানে তুলে ধরা হল।

(a) SOC-র দ্বারা অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা (Unbalancing the economy with SOC): অপসৃতিমূলক (Divergent) প্রক্রিয়ায় SOC-তে অধিক বিনিয়োগ করলে, তার মাধ্যমে এ থেকে ৫-তে পৌঁছানো সম্ভব। যেমন- বিন্দুতে অধিক বিনিয়োগ করলে উন্নয়নের অভিমুখিনতা সর্বদা a থেকে bl-এর দিকে থাকবে। এরপর তা ক্রমান্বয়ে b1 থেকে b. b থেকে dl এবং সবশেষে, dl থেকে -এর দিকে অগ্রসর হবে।

(b) DPA-র দ্বারা অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা (Unbalancing the economy with DPA): এরপরে অভিসৃতিমূলক (Convergent) প্রক্রিয়ায় SOC-এর তুলনায় DPA-তে অধিক বিনিয়োগ কল্পনা করা হয়ে থাকে। এখানে, উন্নয়নের অভিমুখটি সর্বদা a থেকে 62-এর দিকে থাকবে। এই অবস্থাটি ক্রমান্বয়ে। চলতে থাকলে অর্থাৎ, b2 b, b> d2 এবং সবশেষে d2 থেকে ৫-তে উপনীত হবে।।

হার্সম্যান বলেছেন, কোনও একটি উৎপাদনক্ষেত্রে ভারসাম্যহীনতা SOC বা DPA উভয়ের মাধ্যমেই সৃষ্টি করা সম্ভব। DPA-তে যদি প্রথমেই বিনিয়োগ ঘটে সেটিকে Pressure creating investment বলা হয়। কারণ, কোনো একটি দেশের উৎপাদনখাতে শিল্পপতিরা হঠাৎ DPA-তে বিনিয়োগ করে দেওয়ার পর সরকার যদি তাতে সায় বা উৎসাহ না দেয়, সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি হবে। অন্যদিকে, SOC-তে প্রথম বিনিয়োগ করলে তাকে Pressure releasing investment বলা হয়। কারণ, এক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক পরিকাঠামোগুলিতে সরকারের পূর্ণ সমর্থন বা সহযোগিতা থাকে। সাধারণত, অনুন্নত দেশগুলিতে পণ্য এবং সেবামূলক ক্ষেত্রে উৎপাদনের স্থিতিশীল কাঠামো ধরে রাখতে বিশেষজ্ঞরা SOC-তেই সর্বাধিক বিনিয়োগ ঘটানোর কথা বলেছেন। পক্ষান্তরে, যেটি আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে DPA-র বিনিয়োগকে টেনে এনে আঞ্চলিক উন্নয়নে সহায়ক হবে।

হার্সম্যান নির্দেশিত কেন্দ্র পরিধিস্থ আঞ্চলিক উন্নয়নের পদ্ধতি (Core-Periphery regional development approach directed by Hirschman)

হার্সম্যানের নির্দেশিত ভারসাম্যহীনতার মধ্য দিয়ে ঘটা বিনিয়োগের পথগুলি কেন্দ্র-পরিধিস্থ অঞ্চলের সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলে, সেটিকে নিম্নলিখিতভাবে উপস্থাপন করা হল।

অর্থনৈতিক মেরুকরণ (Economic Polarization): অর্থনৈতিক মেরুকরণ এমন একটি পদ্ধতি যা মূল শিল্পাঞ্চলটির প্রভুত উন্নতি ঘটিয়ে সেটিকে প্রবৃদ্ধির একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্রে উপনীত করে। যখন, কোনও একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করা হয়, তখন সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে সম্পদের জোগান এবং পরিকাঠামো ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। এই পর্যায়ে, সংশ্লিষ্ট অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে একাধিক পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়, যেমন-

(১) অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবাদে মেরুর সর্বত্র পরিবহণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি হয়।

(ii) বিনিয়োগকারীরা মুনাফালাভের স্বার্থে প্রবৃদ্ধি মেরুতেই সর্বাধিক বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশ করে।

(iii) প্রান্তিক অদুলগুলি থেকে কাঁচামাল এবং শ্রমিক কেন্দ্রীয় মেরু অঞ্চলের দিকে স্থানান্তরিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ধরনের মেরুকরণ পদ্ধতি দেশের প্রান্তবর্তী অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলগুলিকে প্রায়শই নিরুৎসাহিত করে আঞ্চলিক বৈষম্যের প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটায়।

ভূঁইয়ে পড়া প্রভাব (Trickle down effect): অর্থনৈতিক পরিমন্ডলের কোনও একটি বিশেষ ক্ষেত্রকে উদ্দীপিত করার ফলে, সংশ্লিষ্ট উৎপাদনক্ষেত্রের লভ্যাংশ, পরিসেবা এবং বিনিয়োগের আগ্রহ যখন ধীরে ধীরে প্রান্তিক অঞ্চলগুলির দিকে ক্রিয়াশীল হয়, সেটি চুঁইয়ে পড়া প্রভাব নামে পরিচিত। এখানে বেশ কয়েকটি অবস্থা চুইয়ে পড়া প্রভাবকে সম্প্রসারিত করে, যেমন-

(1) চারপাশের বাজারগুলিকে ধরে রাখতে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক পুঁজি প্রান্তবর্তী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে বিনিয়োগ করা হয়।

(ii) কেন্দ্রীয় অঞ্চলের ক্রমবর্ধমান মানবসম্পদের চাপের নিরিখে প্রান্তিক অঞ্চলগুলিতে পুনরায় শ্রমিকদের স্থানান্তর ঘটে।

(iii) আন্তঃবাণিজ্যিক আদানপ্রদানমূলক সম্পর্কের মাধ্যমে প্রান্তিক অঞ্চলগুলির উৎসাহ বৃদ্ধি ঘটায়।

বাহ্যিক অর্থনীতি সৃষ্টির ব্যার্থতার নিরিখে 'Tata Nano' বিনিয়োগ প্রকল্প: বিশেষ প্রণোদনার মাধ্যমে ভারসাম্যহীন অর্থনীতি সৃষ্টির ব্যর্থ প্রচেষ্টা কীভাবে হার্সম্যানের ইঙ্গিতপূর্ণ সতর্কতাবাণীর সাথে প্রায় হুবহু মিলে যায়, তার উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন ভারতের অটোমোবাইল শিল্পে 'Tata Nano' প্রকল্পকে ঘিরে লক্ষ্য করা যায়।

মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতার নিরিখে সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ একটি গাড়ির ডিজাইন নিয়ে 2003 খ্রিস্টাব্দে অটোমোবাইল শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটানোর দৃষ্টিভঙ্গি টাটা গোষ্ঠীর তরফ থেকে ঘোষণা হয়েছিল। টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান রতন টাটা, প্রায় 33,000 কোটি টাকা বিনিয়োগ করে একলাখি গাড়ি 'Tata Nano' প্রকল্পের সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছিলেন। সমস্ত আর্থিক, প্রযুক্তিগতএবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে বিশ্বের সর্বকালের সবচেয়ে সস্তা চারচাকা গাড়ি হিসাবে দেশীয় এবং বিদেশের বাজারে 'ন্যানো' অত্যন্ত প্রশংসিতও হয়েছিল। 2008 খ্রিস্টাব্দে লঞ্চ হওয়ার পর থেকেই টাটা ন্যানো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আবাসিক এবং ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলির গ্যারাজে স্থায়ী সদস্য হিসেবে জায়গা করে নেয়। কিন্তু দিন যত ঘনাতে থাকে, ততই টাটা ন্যানোর বিক্রিবাট্টায় ক্রমশ ভাঁটা পড়তে থাকে। শুরুতেই টাটা মোটরস 2246 কোটি টাটা বিনিয়োগ মারফত, প্রতি বছর 25,000০ ইউনিট ন্যানো গাড়ি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু, এই টার্গেটে সংস্থাটি কোনও দিনই পৌঁছতে পারেনি। 2011-12 আর্থিক বর্ষে টাটা ন্যানো সর্বাধিক 74,527 ইউনিট বিক্রি হয়েছিল। তারপর থেকে দেশীয় বাজারে গাড়িটির বিক্রি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে শুরু করে। ন্যানো প্রকল্পকেন্দ্রিক সমস্ত আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির কথা বিবেচনা করে, শেষমেশ 2018 খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতীয় বাজারে এই গাড়িটির উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় টাটা গোষ্ঠী।

আসলে, ন্যানো প্রকল্পকে ঘিরে টাটা গোষ্ঠীর তৎকালীন সেই বিনিয়োগটি ছিল একান্তই ব্যক্তিগত সিদান্তে গৃহীত একটি প্রত্যক্ষ উৎপাদনশীল ক্রিয়াকলাপ (Direct productive Activities বা (DPA)। অথচ, হার্সম্যানের তত্ত্বে আমরা জেনে এসেছি, অর্থনীতিতে এই ধরনের স্বপ্রণোদিত বিনিয়োগ সামাজিক বুনিয়াদি মূলধন (Social Overhead Capital বা SCC) ছাড়া কখনোই সাফল্যের মুখ দেখে না। অবশ্য, ন্যানো প্রকল্পটি প্রথম দিকে SOC-র সুবিধা না পেলেও পরবর্তীকালে টাটা গোষ্ঠী সেই সুবিধা পেয়েছে।

হার্সম্যানের তত্ত্বের সমালোচনা (Criticism of Theory of Hirchman):

হার্সম্যানের কেন্দ্র-পরিধিস্থল অর্থনৈতিক তত্ত্বটি বিভিন্ন কারণে সমালোচিত হয়েছে। যেমন-

কৃষিক্ষেত্রের প্রতি অবহেলা (Neglect of agricultural sector): যে-কোনও স্বল্পোন্নত দেশে কৃষি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক স্তম্ভ। কিন্তু, ভারসাম্যহীন তত্ত্বে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়োগমূলক অবহেলার দৃষ্টান্ত অনেকটা আত্মঘাতী হওয়ার সমান। কারণ, এই ধরনের অবহেলা শিল্পক্ষেত্রগুলিতেও একাধিক কুপ্রভাব ফেলতে সক্ষম।

মুদ্রাস্ফীতি (Inflation): এই তত্ত্বে শুধুমাত্র মূলধনী পণ্যভিত্তিক (capital goods oriented) শিল্পের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কারণে অন্যান্য ভোগ্যপণ্যভিত্তিক (consumer goods oriented) শিল্পগুলি যথেষ্ট উপেক্ষিত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের প্রচলিত আর্থিক কাঠামোয় এই ধরনের নীতির ফলে ব্যাপক হারে মুদ্রাস্ফীতি ঘটতে দেখা যায়।

জ্ঞানভিত্তিক অগ্রগতির প্রতি অবহেলা (Neglect of knowledge-based progress): কোনও কোনও দেশ তাদের বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে জ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন পরিকল্পনার মাধ্যমে দ্রুত অপসারিত করেও উন্নয়ন ঘটাতে পারে। হার্সম্যানের তত্ত্বে এই বিষয়টিতে কোনও গুরুত্বই দেওয়া হয়নি।

নমনীয়তার অভাব (Lack of flexibility): উৎপাদনক্ষেত্রে নমনীয়তার অভাব না থাকলে উৎসাহ তথা উদ্দীপনার প্রভাব কখনোই খাটে না। যেহেতু, অনুন্নত দেশগুলিতে যেখানে উৎপাদনের এক খাত থেকে অপর খাতে সম্পদ স্থানান্তরে যথেষ্ট বাধা রয়েছে, সেখানে বাহ্যিক অর্থনীতি সহজে সৃষ্টি করা যায় না। আবার, জোর করে গড়ে তোলা বাহ্যিক অর্থনীতি স্থানীয় উৎপাদনকে কখনো কখনো অনিশ্চয়তার দিকেও ঠেলে দেয়।

ভারসাম্যহীনতা নিয়ে উপহাস (Ridicule of imbalance): কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি প্রযুক্তি, আভিজাত্য, চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতির সাথে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। উন্নয়নশীল দেশে এই ভারসাম্যহীনতা হার্সম্যান কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে চাপানো একটি নির্দেশিকা মাত্র। তা ছাড়া, অর্থনীতিবিদ Paul Streeten এপ্রসঙ্গে বলেছেন, অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে ভারসাম্যহীনতা ঠিক কতটা রয়েছে তা এই তত্ত্বে সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

বহুমুখী সমস্যা (Versatile problem): বেশির ভাগ উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ভারী শিল্পগুলির কেন্দ্রীভবন একটি বিশেষ এলাকাতেই ঘটতে দেখা যায়। এই স্থানগুলিতে বাহ্যিক সুবিধার মাধ্যমে মেরুকরণ ঘটলে, সেখানে বস্তি সমস্যা, স্বাস্থ্যসমস্যা, পরিবহণ সমস্যা, দূষণ সমস্যা প্রভৃতি স্থানীয় জনজীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে।

সেই কারণে, কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ রূপকের ছলে মন্তব্য করেছেন-'It is not wise to keep all your eggs in one basket.

অন্যান্য (Others): উন্নয়নশীল দেশগুলির সম্মানিক অর্থনৈতিক পরিসর অনেকসময় আঞ্চলিক সম্প্রদায়, সামাজিক তথা রাজনৈতিক মিথস্ক্রিয়ার বিভিন্ন উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। তা ছাড়া, রোজগার বা লেনদেনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা স্বনির্ভরতার মানদণ্ডে সমাজে আর্থিকভাবে সুরক্ষিত এবং অরক্ষিত দুটি বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়। উন্নয়নের এই প্রেক্ষাপটে আর্থিকভাবে সক্ষমদের সাথে অক্ষমদের একটি নির্দিষ্ট ব্যবধানমূলক সমীকরণ চিরকালই বজায় থাকে। হার্সম্যানের তত্ত্বে এই সংক্রান্ত কোনও ইঙ্গিত বিশ্লেষণ করা হয় নি।

আঞ্চলিক উন্নয়ন প্রসলো হার্সম্যানের তত্ত্বের গুরুত্ব (Importance of Hirschman's theory in the context of regional development):

হার্সম্যানের তত্ত্বটি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সমালোচিত হলেও, আঞ্চলিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে এটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ-

স্বনির্ভরতা (Self-reliance): হার্সম্যানের নির্ধারিত ভারসাম্যহীন বিনিয়োগের পথ ধরেই উন্নয়নশীল দেশগুলিতে সম্পদের ঘাটতি সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যার সমাধান করে তাদের পিছিয়ে পড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিকে ক্রমশ স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়।

অর্থনৈতিক উদ্‌বৃত্ত (Economic surplus): এই তত্ত্ব অনুযায়ী মূলধনভিত্তিক শিল্পগুলিতে অধিক বিনিয়োগ প্রবণতা যে অর্থনৈতিক উদ্বৃত্তের জন্ম দেয়, তা পরোক্ষভাবে প্রান্তিক অঞ্চলগুলির উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে ভীষণভাবে উৎসাহিত করে তোলে।

প্রধান শিল্পের মাধ্যমে উন্নতি (Development by main industry): হার্সম্যানের তত্ত্বে প্রধান শিল্পাঞ্চলগুলি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে বলে, এটি যেমন উপভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন করতে সক্ষম, তেমনই আবার আঞ্চলিক স্তরে গড়ে ওঠা অন্যান্য সহায়ক শিল্পের সম্প্রসারণেও যথেষ্ট ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কর্মসংস্থান (Employment): ভারসাম্যহীন অর্থনীতিতে মেরুকরণ এবং চুইয়ে পড়া প্রভাব পরোক্ষভাবে কোনও একটি দেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থানের পথ সম্প্রসারিত করে, আঞ্চলিক উন্নয়নের সমস্ত সুফলগুলিকে সেখানকার সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হার্সম্যানের কেন্দ্র-পরিধিস্থল তত্ত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই H.W. Singer বলেছেন।

"Unbalanced growth is a better development strategy to concentrate available resources on types of investment, which help to make the economic system more elastic, more capable of expansion under the stimulus of expanded market and expanding demand

 ভারতীয় প্রেক্ষাপটে হার্সম্যানের তত্ত্বের প্রাসঙ্গিকতা (The Relevance of Hirschman's Theory in the Indian Context):

ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর প্রচেষ্টা স্বাধীনতার পরবর্তী বেশ কয়েক দশক পর্যন্ত ভীষণভাবে লক্ষ্য করা গিয়েছিল। যেহেতু, এদেশের অধিকাংশ শিল্পকারখানাগুলি ছিল কৃষিভিত্তিক কাঁচামালনির্ভর, তাই ভারতের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সরাসরি শিল্পক্ষেত্রে কোনও রকম বিনিয়োগ না করে, খাদ্য সংস্থান এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর বিশেষ নজর কেড়েছিল। তৎকালীন, কৃষিক্ষেত্রে স্বেচ্ছাকৃতভাবে অতিরিক্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে অসম সমৃদ্ধি অর্জনের নীতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলের অর্থনীতিকে বেশকিছুটা চাঙ্গা করে তোলে। একইভাবে, ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের একমুখী নীতি অনুসৃত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, বেশকিছু রাজ্য SEZ (Special Economic Zone) গঠনের মাধ্যমে কয়েকটি বিশেষ শিল্পে দেশি এবং বিদেশি পুঁজিকে আকৃষ্ট করার একাধিক ইতিবাচক অর্থনৈতিক গৃহীত হয়।

আসালার হয়েছিল। তবে, কার্যক্ষেত্রে কয়েকটি রাজ্যে SOC-তে অধিক বিনিয়োগ ঘটানো সত্ত্বেও, DPA-এর দ্বারা সামান্যার অর্থনীতি আশানুরূপ উপকৃত হয়নি। ফলে, এই সমস্ত রাজ্যগুলির রপ্তানি ও আমদানি-উভয় ক্ষেত্রগুলি রমশ পরিকাঠামোয় অধিক বিনিয়োগের দিকে ঝুঁকে পাড়ে।

এরপর, 1991 খ্রিস্টাব্দে ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগ (Foreign Direct Investment)-কে স্বাগত জানানো হয়। তাতে দেখা যায়, 1991 খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে 2005 খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ভারতে মোট প্রত্যক্ষ পুঁজি নিবেশ ঘটেছে প্রায় 355.22 বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর, এই ধরনের বিনিয়োগের জন্য তৎকালীন ভারতের প্রায় সমস্ত ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিকেই বেছে নেওয়া হয়। এর ফলে, ভারতীয় অর্থনীতি ক্রমেই ভারসাম্যযুক্ত পরিকাঠামো গঠনে অনেকটা এগিয়ে যায়। পাশের 9.50 নং লৈখিক চিত্রটিতে ভারতে 1991-2005 খ্রিঃ পর্যন্ত বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের পরিসংখ্যানটি তুলে ধরা হয়েছে।

ভারতের 2020 খ্রিস্টাব্দের 17 এপ্রিল ভারতের Foreign Direct Investment (FDI) স্নীতিতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছিল, সেখানেও দেশের বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক বিনিয়োগই যথেষ্ট প্রাধান্য গেয়েছে। তাই, সমস্ত দিক বিবেচনা করে এই সিধান্তে উপনীত হওয়া যায়, ভারতের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে বর্তমানে হার্সম্যান প্রদর্শিত একক শিল্পভিত্তিক বিনিয়োগ নীতিটি খুব একটা গুরুত্ব পায় না।

ভারতে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে 

পরিশেষে বলা যায়, একটি উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে কৃষি এবং শিল্পের যৌথ ভূমিকাকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে, এখানে অর্থনৈতিক দিক থেকে সুষম এবং অসম উন্নয়নের নীতিগুলি সর্বদা পরস্পর পরিপূরক হয়ে থাকে। তাই, ভারতের আঞ্চলিক উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিনিয়োগ কৌশল বিচারে করা হয় 












একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01