ভারতে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের খেয়ালিপনা(Vagaries of Indian Monsoon)
ভারতে মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ খুব অনিশ্চিত। কোনো বৎসর মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের আগমন নির্ধারিত সময়ের আগে ঘটে, কোনো বৎসর আবার নির্ধারিত সময়ের পরে আসে। কোনো বৎসর এই বায়ুপ্রবাহের হয় অতি বৃষ্টি ও বন্যা, আবার কোনো বৎসর বৃষ্টির অভাবে খরা সৃষ্টি হয়। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এই বায়ুপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য। কখনো খুব স্বল্প সময়ে এত বেশি বৃষ্টি হয় যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলপ্লাবিত হয়ে বন্যা পরিস্থিতি তৈরী হয়। আবার দীর্ঘসময় বৃষ্টির অভাবে খরা প্রায় অবস্থার উদ্ভব হয়।
সুতরাং মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের তথা বৃষ্টিপাতের খামখেয়ালিপনার ফলশ্রুতি হল দুটি বিষয় (১) বন্যা (Flood) এবং (২) খরা (Draught)। ভারতে বন্যা ও খরার প্রকৃতি ও প্রভাব সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল।
বন্যা (Flood):
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু কর্তৃক অতিরিক্ত বৃষ্টির প্রভাবে ভারতবর্ষের কোনো না কোনো অংশে প্রতি বৎসরই বন্যা ঘটে থাকে। কখনো এটি দেশের বিস্তীর্ণ অংশে ব্যাপক আকারে, আবার কখনো স্বল্প পরিসরে বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে এই বন্যা সৃষ্টি হতে দেখা যায়।
ভারতে স্থলভাগের মোট আয়তনের প্রায় ১/৮ অংশ (প্রায় ৪ কোটি হেক্টর এলাকা) বন্যাপ্রবণ। প্রতি বছর দেশে গড়ে প্রায় ৮০ লক্ষ হেক্টর এলাকা বন্যাপ্লাবিত হয়, যার প্রায় অর্ধেক কৃষি এলাকা।
বন্যাপ্রবণ অঞ্চল: উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও অসম বন্যাপ্রবণ রাজ্য। মূলতঃ মৌসুমি বৃষ্টিপাতই এই রাজাগুলিতে বন্যার কারণ।
গঙ্গা নদী মধ্য ও নিম্নপ্রবাহে উত্তরপ্রদেশ, উত্তর বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এর গতিপথে যমুনা, গোমতী, ঘর্ঘরা, কোশি, গণ্ডক, শোন প্রভৃতি বড় বড় উপনদী প্রচুর জল বহন করে আনে। বর্ষায় গঙ্গা নদী এই বিপুল জলরাশি ধারণ করতে না পেরে প্রায়শঃই বন্যার সৃষ্টি করে। পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় গঙ্গা ছাড়াও দক্ষিণবঙ্গে দামোদর এবং উত্তরবঙ্গ্যে তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা প্রভৃতি নদী বন্যার কারণ হয়। ওড়িশায় মহানদী, অসমে ব্রহ্মপুত্র এবং তার উপনদীগুলি যেমন ডিহাং, ডিবং, লোহিত প্রভৃতি নদী মৌসুমী বর্ষণের সম্পূর্ণ জলধারণে প্রায়ই অসমর্থ হয়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি করে।
ভূমি, জল, পশু ও মনুষ্য-সম্পদ সংরক্ষণ ও উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী প্রতিকারের লক্ষ্যে কর্মসূচী গৃহীত হয়। এর উদ্দেশ্য হল
(ক) শস্য উৎপাদন, পশুসম্পদ, ভূমি, জল ও মানবসম্পদের উপর খরার ক্ষতিকর প্রভাব ন্যূনতম করা এবং প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি গ্রহণ করা। জলাধারে জল সঞ্চয় করে সেই জলের সাহায্যে সেচের সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারলে।
খরার কিছুটা মোকাবিলা করা যায়। দীর্ঘমেয়াদী হিসাবে অরণ্যসুজন, বায়ুদূষণ রোধ, ইত্যাদি ব্যবস্থা কার্যকরী হতে পারে।
(খ) ভূমি, বৃষ্টি সহ জল ও অন্যানা প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবহার যাতে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য পুনরুদ্ধার হয়।
শতন্ত্র, বিপাশা প্রভৃতি নদী বরফগলা জলে পুষ্ট হলেও মৌসুমি বৃষ্টিপাতে জলস্ফীতি ঘটে এবং পাঞ্জাব, হরিয়ানার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এমনকি শুদ্ধ রাজ্য রাজস্থান এবং গুজরাটেও মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের খামখেয়ালিপনায় বন্যার ঘটনা ঘটেছে।
উপদ্বীপ অঞ্চলের মহানদী, কুয়া, কাবেরী ও গোদাবরী অববাহিকায়ও মাঝে মাঝে বন্যা হয়। নদী অববাহিকাগুলিতে অরণ্য ছেদনের ফলে মৃত্তিকা ক্ষয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভূমিক্ষয়ের কারণে নদীবক্ষে পলি সঞ্চয়ের ফলে হঠাৎ অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে নদীর ধারণ ক্ষমতাকে তা প্রায়ই ছাড়িয়ে যায় এবং বন্যার সৃষ্টি করে। মধ্যভারতে নর্মদা এবং তাপ্তী নদীর অববাহিকায়ও বন্যা হয়। তবে মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের বন্যাজনিত সমস্যা উত্তর ভারতের মতো অত প্রবল নয় এবং বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এই অঞ্চলগুলিতে অনেক কম।
বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতি: ভারতে বন্যাজনিত ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের খামখেয়ালিপনার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। দেশে বন্যাজনিত কারণে বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিম্নরূপ
বন্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা: স্বাধীনতার পর ১৯৫৪ সালে জাতীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী (National Flood Control Programme) গৃহীত হয়। এই কর্মসূচীর অধীনে নদী তীরে বাঁধ দিয়ে, জলনির্গম খাত-এর নিকাশী ব্যবস্থার সংস্কার করে, নীচু গ্রামগুলিতে মাটি ফেলে উঁচু করে, বন্যাপ্রবণ শহরগুলিতে যাতে জল না ঢুকতে পারে সেরূপ ব্যবস্থা করে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানোর প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন নদী পরিকল্পনায় অনেকগুলি জলাধার নির্মাণ করা হয়। শতদ্রু নদীর উপর ভাক্তা, বিপাশা নদীর উপর পঙ, তাপ্তী নদীর উপর উকাই, দামোদরের উপর ভিলাইয়া, মাইথন, কোনার ও পাঞ্চেৎ, কুয়া নদীর উপর তুঙ্গভদ্রা ও নাগার্জুন সাগর জলাধার নির্মাণ করে ঐ সকল নদী দিয়ে প্রবাহিত বর্ষার উদ্বৃত্ত জলরাশি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নদী অববাহিকাগুলিতে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী গ্রহণ, নদীতে জমা পলি তুলে ফেলার ব্যবস্থা, যত্রতত্র নদী বাঁধ না কাটার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি, পুরাতন বাঁধগুলির সংস্কার ইত্যাদিও বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
এছাড়া উপগ্রহ প্রেরিত তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দিবার চেষ্টা করা হচ্ছে। বন্যা সম্পর্কে আগাম সতর্কতা জীবন ও সম্পত্তিহানি অনেক হ্রাস করবে।
খরা (Draught):
মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের খামখেয়ালিপনার অপর এক প্রকাশ হল খরা। মৌসুমি চলাকালীন অতিবৃষ্টি যেমন বন্যা ঘটায়, তেমনি বৃষ্টির অভাবে সৃষ্টি হয় খরা। বন্যা ও খরা মৌসুমি খামখেয়ালিপনার দুটি পিঠ। স্বাভাবিক মৌসুমি (Normal Monsoon) যেমন ভারতবর্ষের অধিবাসীদের কাছে আশীর্বাদ, তেমনি যখন তা অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি ঘটায় তখন তা দেশের একাংশে জনগণের কাছে অভিশাপ নিয়ে আসে।
খরার কারণ (Causes of Draughts): যখন একটি দুর্বল মৌসুমি বায়ুপ্রবাহের আগমনে বৃষ্টি কম হয়, মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ বিলম্বে আগমন করে, মৌসুমি বায়ুপ্রবাহ নির্ধারিত সময়ের বেশি আগে ফিরে যায়
বৃষ্টিপাতের মধ্যে বিরতির সময় বেশি দীর্ঘায়িত হয়, তখন খরা হয়।খরার পরোক্ষ কারণ হিসাবে অরণ্য হ্রাস, গ্রীণ হাউস প্রভাব এবং এল নিনো সংক্রান্ত ঘটনা ইত্যাদিকেই দায়ী করা যায়।
খরাপ্রবণ অঞ্চল (Drought-prone areas): ভারতে মোট ভূমিভাগের প্রায় ১/৩ ভাগেই খরা পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলেও বারংবার খরার কবলে পড়ে এরূপ অঞ্চলের পরিমাণ মোট ভূমিভাগের ১৬ শতাংশ। সাধারণতঃ ৭৫ সে.মি.-এর কম বৃষ্টিযুক্ত অঞ্চল এবং বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা খুব বেশি এরূপ অঞ্চল খরাপ্রবণ। ভারতের খরাপ্রবণ রাজ্যগুলি হল মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা। এই রাজনগুলি ছাড়াও কতকগুলি রাজ্যের বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে খরা প্রবণতা দেখা যায়। জলসেচের সুবিধা থাকলে কোনো কোনো অঞ্চলে খরা পরিস্থিতি ততটা প্রকট হয় না।
ভারতে অদ্যাবধি যতগুলি খরাজনিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাদের মধ্যে সর্বাধিক ব্যাপক খরা হয়েছিল ১৯১৮ খ্রীস্টাব্দে। ঐ সময় দেশের প্রায় ৭০% ভূমিভাগ খরা কবলিত হয়। খরাপীড়িত এই অঞ্চলগুলির মধ্যে ছিল উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অংশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশের পশ্চিমাংশ, গোয়া, দিউ, মধ্য মহারাষ্ট্র, মারাঠাওয়াড়া বিদর্ভ, রায়ালাসিমা, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটকের মধ্য ভাগ ও উপকূলবর্তী অঞ্চল, পন্ডিচেরী, তামিলনাড়ু, কেরালা ও লাক্ষাদ্বীপ।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে সর্বাধিক খরাজনিত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল ১৯৮৭ খ্রীস্টাব্দে। দেশের অর্ধেকের বেশি অঞ্চল (৫১.৬%) খরার কবলে পড়ে। যে সকল অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেগুলির মধ্যে ছিল ওড়িশা, উত্তর প্রদেশের পশ্চিমভাগ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, রাজস্থানের পূর্বভাগ, গুজরাট, দিল্লী, চন্ডীগড়, দিউ, মধ্য মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ এবং উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশ।
খরার ফলে কোটি কোটি টাকার শস্যহানি ঘটে, পানীয় জলের সংকট দেখা দেয়। প্রচুর গবাদি পশু মারা যায়। দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষের ফলে বহু মানুষ খাদ্যাভাবে বা অপুষ্টিতে মারা যায়।
খরার মোকাবিলা (Draught Control measure): সরকারী ও বেসরকারীভাবে খরার মোকাবিলা করা প্রয়োজন। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্মসূচীর অন্তর্গত খরা মোকাবিলায় ন্যাশনাল ডিজাসটার ম্যানেজমেন্ট
অথরিটি (NDMA) প্রদত্ত নির্দেশিকা সমূহ হ'ল: রাজ্যস্তরে খরা তদারকি কমিটি গঠন খরা ঝুঁকিপ্রবন এলাকা সমূহে মানচিত্র প্রস্তুতকরণ খরা ঘটে গেলে সে সম্পর্কে তথ্য প্রযুক্তিগত পরিসংখ্যা সংগ্রহ খরা অঞ্চলের তথ্যের সঙ্গে উপগ্রহ প্রেরিত তথ্যের সমন্বয়। খরা মোকাবিলার জন্য জলবিভাজিকা উন্নয়ন কর্মসূচী • ধরার ক্ষয়ক্ষতি যেমন কৃষি উৎপাদন, জলসম্পদ হ্রাসের পরিমান, অরন্য হ্রাস পশু সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও মনুষ্য স্বাস্থ্য-এর উপর ক্ষতিকর প্রভাব নির্নয় খরা সহাকারী ফসল ও বীজ নির্বাচনে গবেষনায় গুরুত্ব প্রদান জল সাশ্রয়কারী সেচ পদ্ধতি (যেমন, স্প্রিংলার, ড্রিপ ইরিগেশন) প্রচলনে উৎসাহ। খরা কবলিত এলাকায় দ্রুত
ঋণ দানের ব্যবস্থা এবং ফসলের সহায়ক মূল্য প্রদান ও বিক্রয় ব্যবস্থার সম্প্রসারণ। খরা সহ্যকারী বৃক্ষ দ্বারা বনায়ন খরা কবলিত অঞ্চলে দ্রুত পশুখাদ্য প্রেরণ ও পশুর পানীয় জলের ব্যবস্থা করা এবং খরাপ্রবন অঞ্চলে শস্য বীমা কর্মসূচী রূপায়ন ও সম্প্রসারণ ইত্যাদি।