পৌর নিক্ষেপণ (Urban sprawl)
• ধারণা (Concept): সাধারণত, কোনও বৃহদায়তন নগর, মহানগর বা অভিনগরায়িত এলাকার চারপাশে অপরিকল্পিত এবং অবিন্যস্ত পৌরক্ষেত্র গঠনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়াকে পৌর বিক্ষেপণ বলা হয়।
পৌর বিক্ষেপণ সম্পর্কে "Everything Connects নামক একটি ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে- "Urban preal refers to the expansion of poorly planned, low density, auto-dependent development, which sprrade out over large amounts of land putting long distances between homes, store and work and creating a high segregation between residential and commercial uses anth harmful impacts on the people living in these areas and the ecosystems and wildlife that have been displaced
• প্রেক্ষাপট (Background): বিগত প্রায় দুশো বছর ধরে উন্নত এবং উন্নয়নশীল সমস্ত দেশগুলিতেই কোনও রকম ঝুঁকি বা নেতিবাচক চিন্তাধারাকে গুরুত্ব না দিয়েই অসমন্বিত, অপরিকল্পিত ও ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে একাধিক পৌরক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল। বিশেষ করে, 19 শতকে শিল্পবিপ্লবের অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আধুনিক দ্রুতগামী পরিবহণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শিল্প-প্রযুক্তিকেন্দ্রিক কর্মসংস্থানের সুবাদে কেন্দ্রীয় নগরের বেশিরভাগ মানুষজন নাটকীয়ভাবে আশেপাশের সংলগ্ন কৃষি অঞ্চলগুলির দিকে সরে আসতে থাকে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের একাধিক দেশ অতি দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পর্যায়ে উপনীত হয়। এইসময়, সেখানকার সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধি, মোটরগাড়ি শিল্পের সম্প্রসারণ, অত্যাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ফেডারেল সরকারের নতুন ঋণ কর্মসূচি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং 1956 খ্রিস্টাব্দে নতুন আন্তঃরাজ্য হাইওয়ে সিস্টেমের সূচনার ফলে মূল নগরের আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে বিপুল জনসমাগম পৌর বিক্ষেপণের সহায়ক হয়ে ওঠে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Carruthers, Ulfarsson, Bruikner, Gilham প্রমুখ বিশেষজ্ঞ তৎকালীন পৌর বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে তিনটি অন্তর্নিহিত প্রভাবকে চিহ্নিত করেছেন। এগুলি হল-
প্রথমত, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শহুরে এলাকার বাহ্যিক সম্প্রসারণজনিত ঘটনার প্রভাব।
৩। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত মানুষজনের আয় যথেষ্ট বেশি, তাদের নতুন বিকল্প পৌরক্ষেত্রের কাছাকাছি বসতি অঞ্চল গড়ে তোলার দিকে সর্বাধিক আগ্রহ।
তৃতীয়ত, পরিবহণ ও অবকাঠামোগত ক্ষেত্রে অধিক বিনিয়োগ শহরের বহির্মুখী সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করার প্রবণতা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে, Daniel (1999 খ্রিঃ) শহর-নগর এবং শহরতলির বিক্ষেপণে জাতিগত আকাঙ্ক্ষাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সূচক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং ডেট্রয়েটের মতো উন্নত শহুরে কেন্দ্রগুলিতেও মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্বেতাঙ্গদের জাতিগত বিবাদের ফলে পৌর বিক্ষেপণে সহায়ক হয়েছে। এই ধরনের ঘটনাটিকে অনেকেই আবার "White flight" বলে থাকেন। তবে, কোনো কোনো ভৌগোলিক পৌর বিক্ষেপণকে মহানগরীয় এলাকার বর্ধিত স্থান সংকুলান এবং অন্যান্য আবাসিক সুযোগ-সুবিধার সম্ভাব্য বহিঃপ্রকাশ রূপেও দেখেছেন।
• বৈশিষ্ট্য (Characteristics): অনিয়মিত পদ্ধতিতে ঘটতে থাকা পৌর বিক্ষেপণের বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য। বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন-
(i) শহর ও গ্রামীণ এলাকার অনির্ধারিত যেকোনো প্রান্তেই এই ধরনের বিস্তৃত পৌরক্ষেত্রগুলির আত্মপ্রকাশ ঘটে থাকে।
এখানে বসতির ঘনত্ব যেমন কম তেমনই একক পরিবারের বাসস্থানগুলি অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত প্রকৃতির।
(ii) এই ধরনের পৌরক্ষেত্রটি কখনও কখনও মূল শহুরে সীমার বাইরে কয়েকশো মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
(iii) পৌর বিক্ষেপণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ বসতি অঞ্চল বিদ্যমান মূল শহুরের কেন্দ্রগুলি থেকে বাইরের দিকে ক্রমশ সর্পিলভাবে বৃদ্ধি পায়।
দৃষ্টান্ত: 1970 থেকে 1990 খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে, পশ্চিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মহানগরীয় এলাকার (যেমন-ওয়াশিংটন, লাস ভেগাস, সিয়াটেল, উটা, সল্টলেক সিটি প্রভৃতি। নতুন বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যাপক অভিগমন প্রবাহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। অনুরূপ দৃষ্টান্তগত নিদর্শন পূর্ব ও মধ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহানগরীয় এলাকাগুলিতেও রয়েছে। বিশেষকরে, শিকাগো, কানসাস সিটি, ইলিনয়, বাল্টিমোর, মেরিল্যান্ডের মহানগরীয় এলাকার জনসংখ্যা 1970 এবং 1994) খ্রিস্টাব্দের মধ্যে যথাক্রমে । শতাংশ থেকে প্রায় 20 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট পৌর এলাকার ভৌগোলিক ব্যাপ্তি প্রায় 24 শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 55 শতাংশ বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে 91 শতাংশে উপনীত হয়েছে। উত্তর-পূর্বের ডেট্রয়েট, মিশিগান এবং পিটসবার্গ, পেনসিলভানিয়া, মিডওয়েস্ট প্রভৃতি নগর 30 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে, সময়ের সাথে সাথে সংশ্লিষ্ট পৌরক্ষেত্রগুলির জনসংখ্যা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। 2002 খ্রিস্টাব্দে European Environment Agency প্রদত্ত একটি পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, 1980 থেকে 2000 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ইউরোপের অধিকাংশ নগরায়িত অঞ্চলের জনসংখ্যা যেখানে মাত্র 6 শতাংশ বৃদ্ধি ঘটেছে, অথচ সেখানে পৌর বিক্ষেপণের মাত্রা প্রায় 20 শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। 1950-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে 1990-এর দশকের শেষের দিকে ইতালি, স্লোভানিয়া, লুক্সেম্বাগ, পালেরমোর মতো কিছু মহানগরীয় এলাকার স্থানিক পদচিহ্নগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে। প্রসারিত হয়েছিল। বিশেষকরে, পালেরমোর পৌর বিক্ষেপণ মাত্রা প্রায় 200 শতাংশ বেড়েছে। পৌরবিক্ষেপনের ফলে ভারতের একাধিক মহানগরের পরিসরগত মাত্রা এবং জনসংখ্যা উভয়ই বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে ভারতের চারটি গুরুত্বপূর্ণ মহানগরীয় অঞ্চলের পৌর বিক্ষেপণের গতিপ্রকৃতিকে 15.22-এর একটি ধারণাচিত্র দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে।
• প্রভাব (Effect): অনিয়ন্ত্রিতভাবে নগরীয় ক্ষেত্রের বিস্তৃতির ফলে স্থানীয় পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিতে একাধিক নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশেষকরে, যে সমস্ত অঞ্চলে এই ধরনের পৌর বিক্ষেপণ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ঘটে, সেখানে বসতি এলাকার মাঝেও অপ্রয়োজনীয় কিছু পরিত্যক্ত স্থান রয়ে যায়, যেগুলি মূলত বিভিন্ন বজ্রা নিক্ষেপ স্থলরূপে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে অবৈজ্ঞানিক ভূমি ব্যবহার জমির ওপর অযথা চাপ তৈরি করে। অন্যদিকে, পৌর বিক্ষেপণের ধারাবাহিকতা যানজট বা পার্কিং সমস্যা, বসতি অঞ্চলে সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ সৃষ্টি, এমনকি সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলিতে উপযুক্ত আবাসন গঠনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে অল্পকিছু উৎপাদনশীল জমিগুলিকে বিপুলভাবে গ্রাস করে শিল্প বা অন্য কোনও পরিকাঠামোর জন্য ব্যাবহার করায় সংশ্লিষ্ট এলাকার নগরীয় বাস্তুতন্ত্র ভীষণভাবে বিঘ্নিত হয়। এই সমস্ত সমস্যাগুলিকে কাটিয়ে উঠতে মূল নগরাঞ্চলে পরিকল্পিতভাবে উপনগরীকরণ (sub-urbanization), "স্মার্ট গ্রোথ", অথবা "কমপ্যাক্ট ডেভেলপমেন্ট"-এর ওপর ভীষণভাবে জোর দেওয়া হয়, যা পরোক্ষভাবে নতুন এক নগরবাদী ধারণা সৃষ্টি করে।