পৌর পরিকল্পনা (Urban planning):
ইংরাজিতে "Urban" কথাটি ল্যাটিন শব্দ "urbanus" অথবা "urbs" থেকে উদ্ভূত, যেটি অর্থগত দিক থেকে শহর অথবা নগরের ধারণার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্কযুক্ত। অনেকে আবার মনে করেন," Urban" শব্দটির সাথে আরবি তথা তুর্কি শব্দ "imar" বা "umur"-এর যথেষ্ট গভীর সংযোগ লক্ষ্য করা যায়, যেটি "নির্মাণ করা", "আদেশ" বা "ক্রিয়াকান্ড"-কে বুঝিয়ে থাকে। এখানে, উল্লেখ্য সমস্ত শব্দই কোনো একটি পৌরক্ষেত্রের প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক বা সাংস্কৃতিক মানদন্ডকে উপস্থাপন করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সঙ্গতিপূর্ণ।
• অর্থ (Meaning): প্রচলিতভাবে পৌর বা শহরে পরিকল্পনা নামক যে শব্দটিকে আমরা ব্যাবহার করি সেটি তুর্কি ভাষায় " şehir planlamas" শব্দের প্রায় সমতুল্য, যার ঐতিহ্যগত আক্ষরিক অর্থ হল "নগর পরিকল্পনা"।
নগরকেন্দ্রিক পরিকল্পনা হল বিকশিত মানব সভ্যতার এমন একটি সম্ভাবনাময় কর্মসূচী, যেখানে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কোনো একটি শহর বা নগরের বৃদ্ধি বা বিকাশকে উৎসাহিত করতে উন্নত স্থানিক অবকাঠামো বা স্থাপত্যগত নকশা এবং সামগ্রিক ভূমিব্যবহার প্রণালিকে সংশ্লিষ্ট পরিবেশীয় কাঠামোয় সুরক্ষিত রাখা হয়। এর ফলে, নগর পরিকল্পনায় শিল্প, প্রযুক্তি, কর্মসংস্থান, জনস্বাস্থ্য, নিকাশি ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, গবেষণা এবং সার্বিক অংশগ্রহণের সামগ্রিক সুযোগগুলি পরিপূর্ণতা লাভ করে।
নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে বিখ্যাত নগর বিশারদ Lewis Keeble বলেছেন-"the art and science of ordering the land uses and sitting the buildings and communication routes so as to secure the maximum level of economy, convenience and beauty".কাজেই, যে নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় একটি সাধারণ জনপদকে নগরীয় জনপদরূপে পুনরুজ্জীবিত করতে নানাবিধ উন্নয়নমূলক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়, তাকেই নগর পরিকল্পনা বলে। বর্তমানে, মানুষের কল্যাণ, পূর্ণতা প্রাপ্তি, ভূমির ব্যবহারিক নিয়ন্ত্রণ, পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, শহুরে পরিবেশের সুরক্ষা প্রদান এবং অর্থনীতির সার্বিক প্রগতি রক্ষার স্বার্থে এই ধরনের নগর পরিকল্পনা হল স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপনের অন্যতম ধারক ও বাহক।
প্রাচীন শহর ও নগর পরিকল্পনার সূত্রপাত ও ধারাবাহিকতা(Begining of Town and Urban Planning in Ancient world):
বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির কাঠামো এবং সেখানকার যাবতীয় পরিসেবার প্রকৃতি উন্নয়নের নিরিখে ঠিক কিরকম ছিল, সে নিয়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক, প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ভৌগোলিকদের অনুসন্ধিৎসু আগ্রহ থেকেই নগর পরিকল্পনার প্রেক্ষাপটটি যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে পশ্চিমী দুনিয়ায় নগর পরিকল্পনার প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়নমূলক দায়বদ্ধতা হিসেবে কাজ করলেও, সেক্ষেত্রে নগরকেন্দ্রিক পরিকল্পনার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে একটি সুপ্রাচীন ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন পুরাতন নথি, ঐতিহ্যবাহী সৌধ বা স্থাপত্যকলা বিশ্লেষণ মারফত জানা গিয়েছে নব্যপ্রস্তর যুগে কৃষিভিত্তিক আর্থসামাজিক কাঠামোকে অবলম্বন করেই নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার প্রাথমিক সূত্রপাত ঘটেছিল। তবে, অধিকাংশ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রাচীন পরিকল্পিত নগর সভ্যতার প্রকৃত সূচনা ঘটে খ্রিস্টজন্মের প্রায় 5000-3000 বছর আগের সময়কালে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অতীত থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে যে সমস্ত শহর বা নগর পরিকল্পনার ধারাবাহিক পটভূমি আমরা বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের মাধ্যমে জেনে এসেছি, তার কয়েকটি দৃষ্টান্ত সারণী 2-এ করা হল।
প্রাচীন ভারতের শহর পরিকল্পনা (Urban Planning of Ancient India):
প্রাচীন ভারতের স্থাপত্যশিল্প ভিত্তিক নগর পরিকল্পনাগুলিকে বিশেষজ্ঞরা আধুনিক বাস্তু-বিদ্যার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশরূপেই স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। অতীত থেকে আজ পর্যন্ত, ভারতের প্রায় সমস্ত নগর কাঠামোশৈলীতে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বিভিন্ন ভাবধারা এবং রীতিনীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। এখানে, ভারতের শহর বা নগর পরিকল্পনার প্রেক্ষাপট কয়েকটি মূলনীতি, এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ গাঠনিক শৈলী সম্পর্কে আলোচনা করা হল।
• মূলনীতি (Principle): অতীতে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে পরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শহর বা নগরগুলির ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি নীতিকে প্রাধান্য পেয়েছিল, যেমন-
(i) যেকোনো শহর বা নগর পরিকল্পনায় নিরাপত্তাকে সর্বাধিক মান্যতা দেওয়া। (ii) শহরের মুখ্য প্রবেশপথগুলিতে নির্দিষ্ট প্রাচীরবেষ্টিত দরজার ব্যবস্থা রাখা। (iii) শহরের রাস্তাঘাটগুলিকে অত্যন্ত সরলভাবে নির্মাণ করা। (iv) শহরের মূল পরসিরটিকে বর্গাকার বা আয়তাকারে গড়ে তোলা। (v) শহরের মূল কেন্দ্রস্থলটিতে প্রশাসনিক কার্যালয় অথবা মন্দির স্থাপন। (vi) সাধারণ মানুষের বাড়িঘরগুলিকে কিছুটা নীচু এবং দুর্গগুলিকে সুউচ্চভাবে প্রতিষ্ঠা করা। (vii) বসতি অঞ্চলের কাছাকাছি জলের প্রতিটি উৎসকে গুরুত্ব দেওয়া, (viii) নদীর বাঁধকে সুকৌশলে আরও শক্তিশালী করা এবং কৃষির সাথে সম্পর্কযুক্ত নিত্যবহ নদীকেন্দ্রীক প্রতিটি সেচখালের সম্প্রসারণ ঘটানো প্রভৃতি।
সিন্ধু সভ্যতার শহর পরিকল্পনা (3000 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 1300 খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত)
ভারতীয় উপমহাদেশে প্রাচীন নগর পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক হল সিন্ধু অঞ্চল, যেটি 3000-2250 খ্রিস্টপূর্বাব্দে অধুনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলা এবং উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইরান সীমান্ত বরাবর গড়ে উঠেছিল। সমসাময়িক মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে কয়েকটি সভ্যতার মতোই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রচীনতম সিন্ধু সভ্যতা অত্যন্ত প্রভাবশীল একটি আধুনিক নগরীয় ক্ষেত্রে উপনীত হয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতায় নগরবাদের উদ্ভব প্রসঙ্গ্যে Paolo Biagi বলেছেন The occurrence of the first-couzation from fuck the emergen of the city and urhany care be wnderstood"
তৎকালীন, সিন্ধু সভ্যতায় যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী নগর পরিকল্পনা উজ্জ্বল কৃতিত্ব বজায় রেখেছিল, সেগুলি হল হরতা এবং মহেঞ্জোদারো।
হরপ্পার নগর পরিকল্পনা
হরপ্পার ছিল ব্রোঞ্জ যুগের বৈচিত্রতাপূর্ণ এবং সমৃদ্ধির দিক থেকে গতিশীল একটি সংস্কৃতিক জনপদের অন্যতম পীঠস্থান। সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার অনুসারে, হরপ্পার বসতিগুলি সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীভূত ছিল মজে যাওয়া সরস্বতী নদী এবং এর উপনদী রিসাদবর্তী উপত্যকায়। তবে, এই সভ্যতার সামগ্রিক নিদর্শন মাকরান, বেলুচিস্তান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর রাজস্থানের বেশ কয়েকটি অঞ্চল বরাবর বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। তৎকালীন, হরপ্পার নগরকেন্দ্রিক সভ্যতাটিতে যেভাবে উন্নত মানের স্থাপত্য, পরিবহণ, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, কারুকাজ এবং পরিসেবার একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র গড়ে উঠেছিল, তার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হল-
(i) গাঠনিক অংশ হরপ্পা নগরটির মূল গাঠনিক অংশটি দুটি ভাগে বিভত্ব, যার একটি ছিল পশ্চিমের উঁচু দুর্গবেষ্টিত অঞ্চল (শস্যাগারের জন্য) এবং অপরটি ছিল পূর্বের নিম্নাঞ্চল (সাধারণ মানুষের জন্য।।
(ii) নির্মাণশৈলী অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন, যেহেতু শহরটি আর্যদের আসার বহুকাল আগেই গড়ে উঠেছিল, তাই হরপ্পার নির্মাণশৈলীতে দ্রাবিড় পরিকল্পনার সুস্পষ্ট ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়।
(iii) পৌর প্রণালী। অধ্যাপক সরসীকুমার সরস্বতী বলেছেন, "এখানে একই প্রকৃতির শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থা ছিল যা জনগণের জীবনযাত্রাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করত।"
(iv)হরপ্পা শহরের বাড়িঘরগুলি ছিল যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশেষকরে, এখানে ছোটো ছোটো দু'কামরা বিশিষ্ট বাসগৃহ এবং প্রায় ত্রিশ কামরাবিশিষ্ট একতলা, দোতলা বা তিনতলা বাসগৃহের অস্তিত্ব ছিল। গৃহ নির্মাণে আগুনে পোড়া অথবা রোদে পাকানো দুই ধরনের ইট ব্যাবহার করা হত। প্রতিটি গৃহেই শোয়ার ঘর, বসার ঘর, রান্নাঘর, স্নানঘর ও শৌচাগারের বিশেষ ব্যবস্থা ছিল।
(v) পয়ঃপ্রণালী হরপ্পা শহরে নোংরা-বর্জ্য জল নিকাশের জন্য শহরের বিভিন্ন প্রান্তে একাধিক নালা-নর্দমা খনন করা হয়েছিল, যেগুলি উন্মুক্ত না রেখে ইট বা পাথরের ঢাকনা দেওয়া থাকত।
(vi) রাস্তাঘাট হ্যাঙ্গার প্রায় সমস্ত রাস্তা ছিল অত্যন্ত প্রশস্ত (প্রায় 9-34 ফুট চওড়া) ও সরল প্রকৃতির, যেগুলির প্রায় সবকটিই চুন, সুরকি, পাথর এমনকি পোড়া ইট দ্বারা নির্মিত। রাস্তাগুলি মূল শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম এবং উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে সমান্তরাল, আয়তকার কিংবা বর্গাকারে বিস্তৃত ছিল।
মহেঞ্জোদারোর নগর পরিকল্পনা:
2600 খ্রিস্টপূর্বাব্দে উন্নতির মধ্যগগনে থাকা মহেঞ্জোদারো ছিল দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি সমৃদ্ধশালী নগরী তথা সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম প্রশাসনিক কেন্দ্র। যুগ্ম শব্দ মহেঞ্জোদারোর আক্ষরিক অর্থ হল মৃতের পাহাড়। যদিও শহরটির আসল নাম নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতানৈক্য রয়েছে। তবে, মহেঞ্জোদারোয় প্রাপ্ত বেশকিছু পুরানো শিলা লিখন দেখে পুরাতাত্ত্বিকরা যে দ্রাবিড় নামটি খুঁজে পেয়েছিলেন, সেটি হল কুক্তৃতার্ম Kukkutarma)। বিখ্যাত এই শহরটিকে 1922 খ্রিস্টাব্দে শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় নামক এক বাঙালি বিশেষজ্ঞ পুনরাবিষ্কার করেছিলেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মহেঞ্জোদারোর নগর পরিকল্পনা ও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবস্থা ছিল এখনকার অনেক শহরগুলোর থেকে অনেকটাই এগিয়ে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য থেকে এখানকার সুষ্ঠু নগর পরিকল্পনার যে সমস্ত নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, সেগুলির কয়েকটি হল।
সথাপত্যশৈলী: মহেন্দ্রোদারোর বাসিন্দারা গণিতশাস্ত্রে যথেষ্ট দক্ষ হওয়ায় তার সুস্পষ্ট ছাপ এখানকার স্থাপত্যশৈলীতে বিশেষভাবে পড়েছিল। এখানকার অধিকাংশ বাড়িঘরগুলিই ছিল দোতলা এবং পোড়ামাটির তৈরি। এর মধ্যে কয়েকটি বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগার ও বর্জ্য জল নিষ্কাশনের জন্যে নালা-নর্দমার ব্যবস্যাটি চোখে পড়ার মতো।
(i) পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা: সমগ্র শহরাঞ্চলের নোংরা-আবর্জনা সমৃদ্ধ জল যাতে সঠিকভাবে নিষ্কাশিত হতে পারে, তার ব্যবস্থারূপে মহেঞ্জোদারোর প্রত্যেক বাড়ির জন্যে পৃথক পৃথক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল।
(ii) নগরীর স্নানাগার: মহেক্কোদারো শহরের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল একাধিক ধাপবিশিষ্ট বৃহৎ জানাগার। স্নানাগারটির চারিদিকে প্রায় ৪ ফুট উঁচু ইটের দেওয়াল ছিল, যেটি দৈর্ঘ্যে ছিল প্রায় 180 ফুট ও শুশে ছিল প্রায় 108 ফুট। এখানে, ঋতুভেদে জল গরম অথবা ঠান্ডা করার বিশেষ ব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল।
(iii) শিল্প সংস্কৃতি: মহেঞ্জোদারোর মহিলা অধিবাসীদের মধ্যে গলার হার, কানের দুল, আংটি, হাতের ব্রেসলেট জাতীয় অলঙ্কার ব্যবহারের যথেস্ট প্রচলন ছিল। শুধু তাই নয়,
মহেঞ্জোদারোর নগরকেন্দ্রিক বাসিন্দারা নাচ-গান ও খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী ছিল।
মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা তাদের শহরকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারে যথেষ্ট দায়বন্ধ
শহরের রাস্তাঘাটগুলিকে নিয়ম করে সাফাইয়ের উপর এরা বিশেষ নজর দিতেন।
সময় শস্যভান্ডার। মহেঞ্জোদারোর বাসিন্দারা সেখানকার প্রধান খাদ্যশস্য গম, যব প্রভৃতি মজুত এবং সেই সঙ্গো এগুলিকে ঝড়, বন্যা বা খরার কবল থেকে সেগুলিকে রক্ষার জন্য প্রধান দুর্গের পাশেই পাথর এবং ইট দ্বারা যে সুবিশাল শস্যাগারটি নির্মাণ করেছিল তার মেঝেটি ছিল যথেষ্ট লম্বা এবং চওড়া। প্রত্নতত্ত্ববিদ জোনাথান মার্ক কেনোয়ার এটিকে 'মহাকক্ষ (Great hall)" ৰূপে আখ্যায়িত করেছেন।
বৈদিক যুগের শহর পরিকল্পনা (খ্রিস্টপূর্ব 2000 থেকে 4০০ খ্রিস্টাব্দ):
উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের বৈদিক সংস্কৃতির স্থপতিরা নগর পরিকল্পনা বিজ্ঞানে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। বিশেষকরে, তারা মহাজাগতিক তত্ত্ব এবং স্মৃতি শাস্ত্র অবলম্বিত জ্যামিতির ধারণা অনুসারে বসতির জন্যে উপযুক্ত স্থান নির্বাচন, বাস্তুর নকশা, রাস্তার বিন্যাস, জলসম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন, বৃক্ষ রোপণ প্রভৃতি কৌশলকে গুরুত্ব দিয়ে একাধিক ঐতিহ্যবাহী শহর গড়ে তোলে। বৈদিক সমাজে মন্দিরগুলিকে প্রায়শই শহরের কেন্দ্রস্থলে নির্মাণ করা হত।
ষোড়শ মহাজনপদের সময়কালে শহর পরিকল্পনা (600 খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে 200 খ্রিস্টাব্দ):
প্রাচীন ভারতে বৌদ্ধ স্থাপত্যের উত্থানের সময়কালে কিছু কিছু গ্রাম এবং সমৃদ্ধ শহরাঞ্চল পরস্পর যুক্ত হয়ে ষোড়শ। মহাজনপদ গড়ে উঠেছিল, যেগুলি ছিল আকারে যথেষ্ট ছোটো। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ছয়শ বছর আগে ভারতে মোট 16 টি অঞ্চল জুড়ে এই ধরনের মহাজনপদ স্বীকৃতি লাভ করে। সেখানে, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, মন্দির নির্মাণ, দুর্গ বা পাঠচর্চা কেন্দ্রগুলি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছিল। যেমন, প্রথমদিকে ছিল যথেষ্ট শক্তিশালী একটি আধুনিক বসতি অঞ্চল। বিশেষ করে, বারাণসী গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ায় বাণিজ্যিক সুবিধার পাশাপাশি কাশী সামরিক কৌশলগত সুবিধাও পেয়েছিল। ব্রোঞ্জ যুগের পতনের পর থেকে বারাণসীই ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের পীঠস্থানে পরিণত হয়। তৎকালীন, এখনকার মধ্যপ্রদেশের পশ্চিম অংশ উজ্জয়িনী ছিল মধ্য ভারতের অন্যতম প্রধান শহর, মাদুরাই ছিল সংস্কৃতি ও বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র এবং মগধের নালন্দা ছিল জ্ঞানচর্চার সর্বশ্রেষ্ঠ কেন্দ্র।
প্রাক-মধ্যযুগীয় সময়কালে শহর পরিকল্পনা (350 খ্রিস্টাব্দ থেকে- 18০ খ্রিস্টাব্দ):
প্রাক্-মধ্যযুগীয় সময়কালে ভারতের পরিকল্পিত নগর স্থাপত্যকলা বলতে মৌর্য সাম্রাজ্যর আধুনিক জনপদগুলিকে বোঝানো হয়ে থাকে। এই সময়কালে গ্রিক, রোমান এবং বৌদ্ধ সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা স্থাপত্য-ভাস্কর্যের একাধিক নিদর্শন পাটলিপুত্রেই সর্বাধিক লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এই সাম্রাজ্যে একাধিক দুর্গ নির্মাণ করে শহরের নিরাপত্তা প্রদানের কবস্থা করা হয়। এখানকার তিন লেন বিশিষ্ট মূল সড়কপথটি ছিল সমান্তরাল এবং চওড়ায় ছিল প্রায় ৬) ফুট প্রশস্ত। এছাড়াও, শহরগুলির সমৃদ্ধকরণে একাধিক মন্দির, সরাইখানা, খাবার দোকান, উচ্চ শিক্ষালয় ভ্রমনকি গ্রন্থাগারেরও ব্যবস্থা ছিল।
মুঘল আমলে শহর পরিকল্পনা (1526 খ্রিস্টাব্দ থেকে 1707 খ্রিস্টাব্দ):
ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ভারতে শহর বিকাশের ধারা এতটাই নজিরবিহীন ছিল, যা পশ্চিম ইউরোপের বেশ কয়েকটি শহর বৃদ্ধির হারকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। এই আমলে, স্থলপথ এবং জলপথকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যর সম্প্রসারণকে কেন্দ্র করে ভারতের নগর উন্নয়ন ব্যবস্থা যথেষ্ট উৎসাহিত হয়। আসলে, তৎকালীন সময়কালটি ছিল এদেশের প্রাক্ নগর পরিকল্পনার সুবর্ণ যুগ।
মুঘল আমলে ভারতের মূল শহরের প্রাণকেন্দ্রটি ইউরোপীয় শহরগুলির মতোই ছিল প্রাচীরযুক্ত। শহরের অধিকাংশ বাড়িঘরের দেয়ালগুলি অত্যন্ত পরিকল্পনা মাফিক জ্যামিতিক বিন্যাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল, যার মুখ্য প্রবেশ দ্বারটি দেখতে অনেকটা বহুভুজের ন্যায়। এখানকার রাস্তাগুলি সাধারণত সরু এবং আঁকাবাঁকা প্রকৃতির। তবে, রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো ছিল যথেষ্ট প্রশস্ত ও সোজা। এই সময়কার। যাবতীয় প্রশাসনিক কাজকর্ম নির্দিষ্ট দুর্গ থেকে পরিচালিত হত। শহরের মধ্যে থাকত বড়ো মাঠ, জলাশয়, মসজিদ, Pic: 15.7. আত্মা ফোট সমাধিস্থল, স্মারক ভবন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরাইখানা, বাজার প্রভৃতি। রাস্তার দুপাশে পথিকদের ছায়া দেওয়ার জন্য সারিবন্ধ গাছ লাগানোর পাশাপাশি, শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্যে নতুন নতুন স্থাপত্য এবং উদ্যান নির্মাণে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। সম্রাট আকবরের আমলে নগদে রাজস্ব আদায় সংগ্রহের জন্য উত্তর থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে শহরের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এই আমলে ভারতে মোট চার ধরনের শহরকে চিহ্নিত করা যায়, যথা-
(৩) প্রথম শ্রেণির প্রশাসনিক শহর। যেমন- আগ্রা, লাহোর, ফইজাবাদ, হায়দ্রাবাদ প্রভৃতি।
৩. দ্বিতীয় শ্রেণির বানিজ্যিক শহর: যেমন- আমেদাবাদ, পাটনা প্রভৃতি।
* তৃতীয় শ্রেণির তীর্থকেন্দ্রিক শহর যেমন- কাশি, মথুরা প্রভৃতি।
*চতুর্থ শ্রেণির শিল্প কেন্দ্রিক শহর: যেমন- ফতেয়াবাদ, দারিয়াবাদ প্রভৃতি।
ঔপনিবেশিক আমলে ভারতের শহর পরিকল্পনা: (1857-1947 খ্রিস্টাব্দ):
ভারতের সাথে বিভিন্ন উপনিবেশিক গোষ্ঠীর সম্পর্ক স্থাপন মোগল সাম্রাজ্যের সময়কাল থেকেই শুরু হয়েছিল। এই সময় ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো আগেভাগেই ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাদের বাণিজ্যিক ঘাঁটি গেড়েছিল। যেমন- ৭) 1510 খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজরা
*1605 খ্রিস্টাব্দে ডাচরা গোয়ার পানাজিতে,মাসুলিপত্তনমে,
* 1639 খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা মাদ্রাজে, এবং1673 ফরাসীরা পন্ডিচেরিতে, প্রভৃতি।
মুঘল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের পটভূমিতে কোম্পানির বাণিজ্যিক কর্মকান্ড যেভাবে বৃদ্ধি পায়, তার পরিণাম করণ অয়াজনে বিচিশীল শেষের দিকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন নীতির প্রধান কেন্দ্রম্পদ হয়ে দাঁড়ায় ভারত। আঞ্চলিক ভরে ব্রিটিশ শেক্তির মির্তত বৃশ্চিতে লখনউ, হায়দ্রাবাদ, সেরিশ্যাপটম, পুনা, পার হয়ে দাঁড়ায় ভারত। প্রভৃতি স্থানে নতুন করে একাধিক উপশহরাঞ্চল গড়ে উঠতে শুরু করে। 1757 খ্রিস্টাব্দে পাদ তাঙ্কোর দেশের বেশকিছু অংশের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে আসায়, উপমা পর বন্দ্যা-শহররূপে-মাদ্রাজ, কলকাতা এবং বোম্বাই দ্রুত নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই সমস্ত শহরগুলি ক্রমশ শিল্পাঞ্চলে পরিণত হওয়ায়, নিত্য নতুন পেশার আকর্ষণে এখানে জনসমাগম ক্রমশ বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঝাঁকে ঝাঁকে এই সমস্ত শিল্প-শহর গুলিতে প্রবেশ করতে শুরু করে। এর ফলশ্রুতিতে, 1800 খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে নগর পরিকল্পনা একটি নতুন মাত্রা পায়। এই সময়, শহর স্থাপনে ভূমি জরিপ, পরিসংখ্যান পৰ্ব্বতি প্রয়োগে, প্রযুক্তিভিত্তিক অবকাঠামো স্থাপন, শহরে জল সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন, রাস্তা নির্মাণ, রাস্তা আলোকিতকরণ, সৌন্দর্যায়ন, নাগরিক শৃঙ্খলা রক্ষা এবং উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থাসহ একাধিক অপরিহার্য পরিসেবাগুলি পৌর কর্পোরেশনের বিধিবদ্ধ কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়। অবশ্য ব্রিটিশ আমলে 1853 খ্রিস্টাব্দে রেলপথ প্রবর্তনের মাধ্যমে এখানকার শহরাঞ্চলগুলির ভাগ্য পুরোপুরি বদলে যায়। বিশেষকরে, দ্রুত পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সম্প্রসারনে নদীতীরবর্তী ঐতিহ্যবাহী শহরগুলি ক্রমশ ভারতের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে যায়। একাধিক রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এবং রেলওয়ে কলোনিকে ঘিরে নতুন নতুন শহর স্থাপিত হয় (যেমন- জামালপুর, ওয়ালটেয়ার, বরেলি প্রভৃতি)। 1857 খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপীয় স্থাপত্য নীতিতে ভারতীয় নগর পরিকল্পনা ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। এই সময়কালে ব্রিটিশরা পুরানো শহরগুলির চারপাশে চারণভূমি এবং কৃষিক্ষেত্রগুলির পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে ইংরেজদের বসবাসযোগ্য "সিভিল লাইন-এ পরিণত করে। ইউরোপীয় কমান্ডের অধীনে কর্মরত ভারতীয় সৈন্যদের বসবাসের জন্য এই সময় পৃথক ক্যান্টনমেন্ট"-এরও ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়াও, বিস্তীর্ণ রাস্তাঘাটের আশেপাশে বড়ো বড়ো বাগান, ব্যারাক, প্যারেড গ্রাউন্ড, হিল স্টেশন, শহরের মাঝে ভারসাম্য রক্ষাকারী উন্মুক্ত স্থান এবং গির্জার মাঝে বাংলো নির্মাণ প্রভৃতি ভারতের শহুরে পরিকল্পনাকে অন্যতম একটি মডেলে উপনীত করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ব্রিটিশরা প্রখ্যাত শহর পরিকল্পনাবিদ "এডউইন লুটিয়েন্স” দ্বারা নতুন দিল্লি নির্মাণের কাজ হাতে নেয়। 'ইম্পেরিয়াল' স্কেলের ভিত্তিতে শহর পরিকল্পনার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি ভবনের নকশাও তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে নির্মিত ভবনগুলিকে আবাসিক সেক্টর থেকে আলাদা করার বন্দোবস্ত করা হয়। এছাড়াও, লুটিয়েন এদেশে লন্ডনের 'পিকাডিলি সার্কাস'-এর মতো বৃত্তাকার পরিকল্পিত বাণিজ্যিক এলাকা "কনট প্লেস” তৈরির জন্যও বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।