ভারতের উপজাতি জনগোষ্ঠী(Tribes of India)
উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষেরাই ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রাচীনতম অধিবাসী। এই কারণে তারা আদিবাসী (Adibasis) নামে পরিচিত। ২০১১-এর জনগণনা অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮.৬% উপজাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত।
ভারতে ১৯৫১ থেকে ২০১১-এর মধ্যে উপজাতি জনসংখ্যার তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি ঘটেছে। ১৯৫১ সালে মোট তফসিলি উপজাতি জনসংখ্যা যেখানে ছিল ১.৯১ কোটি বা মোট জনসংখ্যার ৬.২৩%, ২০১১ সালে তা হয় ১০.৪ কোটি যা মোট জনসংখ্যার ৮.৬%।
উপজাতি জনসংখ্যার উপরোক্ত বৃদ্ধির কারণগুলি হল-প্রথমত জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধি প্রক্রিয়া এবং দ্বিতীয়ত পরবর্তীকালে আরো আরো জনগোষ্ঠীর তফসিলি উপজাতিভুক্ত হওয়া। তবে সরকারী নির্দেশিকা পূরণকারী তফসিলিরাই কেবল ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠী এই ধারণা ঠিক নয়। এই তালিকার বাইরেও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা সরকারী মাপকাঠি বা সমীক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এছাড়াও বৈষম্য দেখা যায় বিভিন্ন রাজো তফসিলি নিবন্ধীকরণে। গোল্ড উপজাতি মধ্যপ্রদেশে তফসিলি তালিকাভুক্ত হলেও উত্তরপ্রদেশে তারা এই তালিকার বাইরে থেকে গেছে। অন্যান্য কিছু আদিবাসীর ক্ষেত্রেও এই বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে।
ভারতের প্রধান কয়েকটি উপজাতি গোষ্ঠীর ভৌগোলিক বন্টন এবং জীবনযাত্রা প্রণালী (Geographical Distribution and Mode of Living)
ভূমিকাঃ হিমাচলপ্রদেশের প্রধান উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছেন কিন্নর, লাহলি, স্পিটি, গাদ্দি ও গুজর প্রভৃতি। পার্বত্য ভূখন্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছেন আরো অনেক ছোটো বড় উপজাতি গোষ্ঠী। গাদ্দিগন সংবিধানের নির্দিষ্ট ধারা অনুযায়ী তফশীলী উপজাতিভুক্ত হয়েছেন।
অবস্থানঃ গাদ্দিগণ হিমাচলপ্রদেশের চাম্বা ও কাংড়া জেলায় বসবাস করলেও চাম্বা জেলার ভারমুর তহশীল (Bharmour Tehsil)-এ এবং ধওলাধর শৈলশ্রেণীর পার্বত্য ঢাল ও নদী উপত্যকায় গাদ্দিগনের বসবাস।
সমাজ জীবন ও জীবিকা: কৃষিকাজ ও পশুপালন মূখ্য উপজীবিকা। পর্বতের ঢালে ধাপ কেটে ছোট ছোট জমিতে চাষ করা হয়। চাষের জমির সীমাবদ্ধতা গাদ্দিদের পার্বত্য তৃণভূমিতে পশুপালনে উৎসাহ জুগিয়েছে। উচ্চ পর্বত গাত্রে শীতকালে তুষারপাতের ফলে তৃণাঞ্চল ও কৃষি জমি বরফে ঢাকা পড়ে যায় বলে গাদ্দিগণ পশুর পাল নিয়ে উদ্বুতর নিম্ন ঢালে ও উপতাকায় নেমে আসে। ঋতুনির্ভর এরুপ যাযাবর পশুপালনবৃত্তিকে ট্রান্সহিউম্যান্স (Transhumance) বলে। গাদ্দিগণকে যাযাবর বলা যাবে না, যেহেতু তাদের নিজস্ব বাসগৃহ রয়েছে। পর্বতের নিম্নঢালে বাসগৃহ হলেও গ্রীষ্মে তারা সমৃদ্ধ তৃণ-এর সন্ধানে উচ্চতর ঢালে পশুর পাল নিয়ে গমন করে এবং অস্থায়ী বাসগৃহ গড়ে শীতের আগমণ পর্যন্ত সেখানে পশুচারণ করেন এবং কিছু চাষবাস করেন। শীতে তৃণভূমি ও চাষভূমি বরফাবৃত হয়ে পড়ে বলে তারা ঐ সময় পর্বতের নিম্নঢালে স্বগৃহে ফিরে আসেন। আয়ের জন্য তাই গাদ্দিরা পশু যেমন ভেড়া, ছাগল, গাধা ও ঘোড়া বিক্রয় কারেও অর্থ উপার্জন করেন।
আগমণের ইতিহাস: গাদ্দিগণ তাদের পূর্বপুরুষেরা কোথা থেকে এই অঞ্চলে এসেছেন সে সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা পোষণ করেন না। তাদের ধারণা পূর্বপুরুষেরা ভারতের সমভূমি অঞ্চল থেকে নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে এই অঞ্চলে আগমণ করেছেন। বিশেষতঃ মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব-এর নিপীড়ন নীতি এড়াতে পূর্বপুরুষেরা সমতু মি ছেড়ে এই পার্বত্য অঞ্চলে চলে এসেছেন। তবে বিভিন্ন লোকগাথা থেকে গবেষকরা চেষ্টা করেছেন তাদের মূল (root) খুজতে এবং এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাদের লোকগাথা ও প্রচলিত ধ্যান ধারণার সংগে সংগতিপূর্ণ।
সমাজ ও সংস্কৃতি: গাদ্দি উপজাতি সমাজ বিভিন্ন জাতিগত শ্রেণীতে বিভক্ত যেমন-ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, রাজপুত,ঠাকুর ও রানা। ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতায় তারা বিশ্বাসী। হিন্দু ও মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষ বেশি দেখা যায়। হিন্দুগণ শিব ভক্ত। আগে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রথা চালু থাকলেও বর্তমানে গাদ্দিগণের জীবনযাত্রায় আধুনিক সমাজের প্রভাব পড়েছে। হিন্দু মুসলমান যেই হোক, গাদ্দি পুরুষ ও গাদ্দি নারী ২৫ গজ লম্বা পরিধেয় কোমরে জড়িয়ে পড়েন উপজাতি পোশাকের ঐতিহ্য অনুসারে।
পোষাক- পুরুষের পরিধেয়র মধ্যে রয়েছে চোলা (Chola) ও পাগড়ী (Turban)। মহিলাদের পরিধেয় লাউঝিরি (Launchiri)। খুব জাকজমকপূর্ণ রঙিন পোশাক পরতে মেয়েরা ভালবাসেন। পোশাকটি গৃহেই বোনা হয়ে থাকে। মেয়েরা মাথায় স্কার্ফও পড়েন যা সৌন্দর্য ও আবহাওয়া উভয় বিবেচনায় পরিহিত হয়। বাচ্চা বহনের প্রয়োজন হলে পিঠে কালো ঝোলা পড়ে তাতে বাচ্চাকে বসিয়ে রাখেন।।
গহনা পড়তে ভালবাসেন গাদ্দি নারীরা। স্বল্প মূল্যবান ধাতু, নেক্লেসে ছোটো ছোটো কাঁচের আয়নার কাজ থাকে। কানের দুল মেয়েরা ছাড়া ছেলেরাও পড়ে থাকেন।
খাদ্যাভ্যাস: তারা মূলত আমিষাষী হলেও শাক-সব্জী চাষাবাদ করে বা বাজার থেকে কিনে খান। মাংস, ঘরে তৈরী বিয়ার (Beer) ও বিভিন্ন শাক-সব্জী সহ ময়দাজাত খাবার বাবর (Babru) খাদ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
ভাষা: অধিকাংশই নিজেদের মধ্যে গাদ্দি ভাষায় কথা বলেন। কিন্তু তাদের লেখ্য লিপি হল টাক্রি (Takri)। তবে দেবনাগরী লিপিও প্রচলিত। বর্তমান প্রজন্ম হিন্দি ভাষাতেও রপ্ত।
মানব সম্পদ: গাদ্দিগণ খুব সৎ ও সাহসী। হিমালয়ের পার্বত্য পরিবেশ তাদের কঠোর পরিশ্রমি করে গড়ে তুলেছে। তারা বন্ধুত্বপূর্ণভাবে, শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রায় প্রকৃতির সংঙ্গে সহাবস্থান করেন। মানবসম্পদ হিসাব তারা পার্বত্য পরিবেশে স্বাবলম্বী জীবনযাত্রায় সফল। শ্রমবিভাজন হিসেবে তাদের মধ্যেই আছেন কৃষক (Farmer), তন্তবায়ী (Weaver) ও কর্মকার (Blacksmith)। কেউ কেউ পার্বত্য পথে পন্য পরিবাহকের কাজও করে থাকেন।
উৎসবঃ গাদ্দি জীবনযাত্রা উৎসবমুখর হয় 'বৈশাখী' বা 'বিশ্ব' (Baisakhi or Bisu), সায়ের (Sair), পাত্রোর সাগ্রান্ড, লোহার ও শিবরাত্রিতে।
'বৈশাখী'- এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি গাদ্দি নববর্ষ বৈশাখী উদযাপিত হয়। ঐতিহ্য অনুসারে চাল ও ময়দার পিঠেপুলি খাওয়া হয়। 'সায়ের' (Sair) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে অশুজ (Asuj) মাসের ১ম দিনে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। মাংস, ঘরে তৈরী বিয়ার (Beer) ও বিভিন্ন শাক-সব্জী সহ ময়দাজাত খাবার বাবরু (Babru) খাওয়া হয়। এই সময় বিবাহিত মেয়েরা মা-বাবার গৃহে চলে আসেন, বাইরে যারা থাকেন তারাও এই সময়ে গৃহে স্বজনের কাছে ফিরে আসেন উৎসব পালনের জন্য। নতুন বস্তু ক্রয় ও পরিধান করা হয় এই উপলক্ষে। পাত্রোর্ সাগ্রান্ড (Patroru Sagrand): ভাদোন মাসের (Augyst-September) ১ম দিনে এটি উদ্যাপিত হয়। এই দিন কাচালু পাতা (Katchalu leaves) বেসন মিশিয়ে তেলে ভাজা হয় এবং ময়দাজাত বাবরু (Babru) পরিবেশন করা হয়।
লোহরি (Lohri): এই উৎসবে চাল ও মুশুর ডাল দিয়ে ঘি সহযোগে খিচুরি এবং দই পরিবেশিত হয়। শিবরাত্রি (Sivratri): ফাল্গুন মাসে (ফেব্রুয়ারী-মার্চ) শিবরাত্রি পালিত হয়। কেউ কেউ উপোষ করেন এবং কেউ কেউ এদিন দানাশস্য জাতীয় খাদ্য গ্রহন করেন না।
এছাড়াও দোল, দশেরা ও জন্মাষ্টমী উৎসব উদ্যাপিত হয়।
সাঁওতাল (Santal)
ভূমিকা: সাঁওতাল জনজাতি প্রায় ছয় শতাব্দী আগে থেকে ছোটনাগপুর অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের লিখিত কোনো ইতিহাস না থাকায় ঠিক কোথা থেকে এই সাঁওতাল জনজাতির আগমন হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা যায় না, তবে ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন তারা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এসেছেন, কেউ আবার ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকে তাদের অতীত অবস্থানের কথা মনে করেন। তবে সম্ভবত তারা উত্তর-পশ্চিম দিক থেকেই মধ্য ভারতের ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে এসেছেন এবং পরবর্তীকালে উত্তরপূর্ব দিকে তাদের বসতি বিস্তার করেছেন। ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে তারা স্থায়ী বসতি গড়ে তোলেন। পরে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল যেমন ওড়িষা, অসম ও পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে পড়েন। ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে তার কেন্দ্রীভবন দেখা যায় ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার, অসমে সাঁওতালদের অধিক সংখ্যায় দেখা যায়। সাঁওতালদের অনেকে দ্রাবিড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী ভুক্ত বলে মনে করেন। তবে এই বিষয়ে নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না, কারণ সাঁওতালদের ভাষা অস্ট্রিক ভাষা হলেও ঠিক কোন ভাষা প্রসূত এটিও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না, যেহেতু তাদের কোন লিখিত ইতিহাস নেই। ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিকগণ বিভিন্ন গবেষণালব্ধ যুক্তি থেকে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে সাঁওতালরা সম্ভবত দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী এবং ভাষাগত দিক থেকে তারা অস্ট্রিক ভাষাভুক্ত।
সাঁওতাল জনসংখ্যা ও জনবসতির ভৌগোলিক বন্টন: অস্ট্রিক নৃতাত্বিক গোষ্ঠীর এই জনজাতির লম্বাটে মুখাবায়ব, অনুচ্চ নাসিকা এবং চাঁপা বাদামি গাত্রবর্ণ। সাঁওতালদের বর্তমান জনসংখ্যার ভৌগোলিক বণ্টন থেকে দেখা যায় অধিকাংশ সাঁওতাল জনবসতি ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলের ঝাড়খন্ড এবং সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমের জেলাগুলিতে কেন্দ্রীভূত। সাঁওতাল জনসংখ্যার বর্তমান (২০১১) বণ্টনটি নিম্নরূপ.
গ্রাম বসতিঃ বর্তমানে মূলত কৃষিজীবি সাঁওতাল বসতি সাধারণত কৃষিক্ষেত্র সংলগ্ন হয়। গ্রামের রাস্তার ধারে দন্ডাকৃতিতে গোষ্ঠীবদ্ধ জনবসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়। গ্রামগুলি মাঝারি থেকে বৃহৎ আকারের হয়। গৃহের দেয়াল রঙিন কাঁদায় ও রং-এ লেপা থাকে। নিম্নভাগে কালো মাটি লেপে দেওয়া হয়। মাঝখানে ও উপরে সাদা ও লাল মাটি লেপা থাকে। রং দিয়েও দেওয়াল রঞ্জিত হয়। বেশ বড় পরিচ্ছন্ন এবং অনেকগুলি ঘর বিশিষ্ট গৃহ হয় সাঁওতালদের। মাটির দেয়াল বাহিরে এবং ভিতরে ঘর গুলোকে আলাদা করার জন্য গাঁথা হয়। রান্নার ঘর গৃহ লাগোয়া থাকে। গোয়াল ঘর গৃহ প্রাঙ্গনের একধারে থাকে। রান্নার কাজে মাটির উনুন এবং মাটির হাড়ি কুড়ি ব্যবহার এখনো জনপ্রিয়। সাঁওতাল জনবসতি সাধারণত রাস্তার দুই ধারে রৈখিক আকারে হয়ে থাকে। ৫০ থেকে ১০০ টি ঘর নিয়ে এক একটি সাঁওতাল পাড়া বা গ্রাম গড়ে ওঠে, কখন এর থেকে বেশি গৃহ বসতিও দেখা যায়।
সাঁওতালদের গৃহের বৈশিষ্ট্য- মাটির ঘর, টালির ছাদ, কখনও ইটের দেয়াল, ওপরে টালির ছাদ, মাটির ঘর, শনের ছাউনি, কখনও এ্যাসবেস্টারের ছাউনি, ইটের দেয়াল, মাটির মেঝে অথবা ইট বালির মেঝে সাঁওতালদের গৃহের বৈশিষ্ট।
অর্থনীতিঃ এই ভ্রাম্যমান জনগোষ্ঠী ছোটনাগপুর মালভূমিতে আসার পরে অথবা আগে থেকেই আরণ্যক জীবন পরিত্যাগ করে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করেন। বর্তমানে সাঁওতালরা স্থায়ী কৃষিজীবি। নারী এবং পুরুষ উভয়েই কৃষির কাজে যুক্ত থাকেন। প্রান্তিক ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষিজীবিদের মধ্যে বনজ দ্রব্য সংগ্রহ, জ্বালানি কাঠ, শালপাতা, মধু, মহুয়া ফুল, ফলমূল সংগ্রহ এখনো জীবিকা সংগ্রহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপায়। সাঁওতালদের মধ্যে অনেকে কাছে দূরে পাথর খাদানে বা খনিতে শ্রমিক এর কাজ করেন। মৎস সংগ্রহ ও কাঠের কাজ অন্যতম। উপজীবিকা। বর্তমানে বন্য জন্তু শিকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎসবের সময় অল্প সময়ের জন্য শিকারের অনুমতি পাওয়া যায়। শিকারের জন্য তীর ধনুকে পারদর্শীতা দেখা যায় সাঁওতাল পুরুষদের মধ্যে। এক ফসলি কৃষি এলাকার অধিকাংশ ক্ষেত্রে হওয়ায় তাদেরকে কৃষি কাজ ছাড়াও শ্রমিকের কাজে বিভিন্ন স্থানে গমন করতে হয় এবং ছোটনাগপুর অঞ্চলে অনেকেই খনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন।
খাদ্য ও পানীয়: চাল বা ভাত প্রধান খাদ্য। ফেনা ভাত, পান্তা ভাত, সব্জি ও নুন লঙ্কা সহযোগে খাওয়া হয়। কদাচিৎ মুরগি বা পাঁঠার মাংস খাওয়া ছাড়াও, কাঁকড়া জলাশয় থেকে সংগৃহীত ছোট মাছ, গেড়ি গুগলি খ াদ্যে প্রোটিন এর জোগান দেয়।
ভাত পঁচিয়ে তৈরি হাঁড়িয়া সাঁওতালদের মধ্যে প্রিয় পানীয়। উৎসবে উপাচারে পুরুষ ও নারী উভয় মিলেই এটি পান করতে পছন্দ করেন, তবে পুরুষেরাই হাঁড়িয়া পানে বেশি আকৃষ্ট হন।
গ্রামের হাট সাঁওতাল জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। সাপ্তাহিক হাট থেকে তারা দৈনন্দিন পণ্য সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় করেন হাটের এক অংশে হাড়িয়া ঠেক-এ কিছুটা সময় পান সহযোগে কাটাতে অনেকে পছন্দ করেন। হাট তাদের অন্যতম সামাজিক মিলনক্ষেত্রও বটে।
বিবাহ: তারা নিজেদের উপজাতীয় সমাজের বাইরে বিবাহ মেনে নিতে চান না। ভালবেসে বিবাহে সাধারণত বাধা হয় না যদি তা সাঁওতাল জনজাতিদের মধ্যেই গোত্র মেনে হয়। বিবাহিত যুগল-এর মধ্যে পাত্রের চেয়ে পাত্রী বড় হলেও বাধা নেই। বিয়েতে পাত্রপক্ষ পাত্রীদের সামান্য যৌতুক দেন। পাত্রী এবং কন্যাপক্ষ উপস্থিত হন এবং গ্রামবাসীরা সকলে মিলেই ভোজ সহযোগে বিবাহ পর্বটি উপভোগ করেন। ডিভোর্স বা বিবাহ বিচ্ছেদে নারী ও পুরুষের সমান অধিকার আছে।
ধর্ম- সাঁওতালরা মূলত উপজাতীয় ধর্ম পালন করেন, তবে হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে তারা হিন্দু দেব দেবীর পুজোও করেন। সাঁওতালরা প্রকৃতির মধ্যেই দেবত্ব খুঁজে পান। বনভূমি, পাহাড়, সূর্যকে তারা পূজা করেন। সূর্য হচ্ছে পরম দেবতা বা ঠাকুর বা সিংবোঙ্গা, যিনি বিশ্বের সৃষ্টি কর্তা হিসেবে পূজিত হন। তাদের গ্রামের প্রধান দেবতা হলেন মারাংবুরু। এই দেবতা গ্রামে পবিত্র উপাসনা স্থানে থাকেন বলে তারা বিশ্বাস করেন। গ্রামের দেব দেবী হলেন মারাংবুরু, মোনেকো-তুরিকো, এবং গোসানে এরা। পাহাড়ের দেবতা গুরুবোঙ্গা, বনের দেবতা রাষ্ম সবোঙ্গা, ধরীত্রি দেবী বসুমাতা, পূর্ব পুরুষদের আত্মা হাপরাং বোঙ্গা, আবগে বোঙ্গা প্রমুখ দেব-দেবী সাঁওতালদের দ্বারা পুজিত হন।
তাদের দৈনন্দিন জীবনে এই দেব দেবীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তারা গৃহে দেবদেবীর পূজা করেন এবং ধরিত্রী মাতার পুজোও করেন। হিন্দু দেবদেবীর পূজাতেও তারা অংশগ্রহণ করেন। নাইকে হলেন গ্রামের প্রধান পুজারী পুরোহিত।
সাঁওতালদের মধ্যে ব্ল্যাক ম্যাজিক বা ডাইনি বিদ্যা ইত্যাদি অন্ধবিশ্বাস এখনও রয়েছে, তবে শিক্ষার প্রসারে এগুলি কমে আসছে। গ্রামে ওঝাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।
উৎসব: সাঁওতালরা উৎসব প্রিয়। যেহেতু তারা কৃষিজীবী, তাই ধান বোনা ও ধান কাটার সঙ্গে তাদের উৎসব জড়িয়ে আছে। তারা নৃত্যগীত ভালবাসেন এবং নৃত্যগীতে পারদর্শী। তারা গান গাইতে গাইতে নাচেন বা নাচতে নাচতে গান করেন। ছেলেরা। মেয়েরা হাতে হাত ধরে নাচেন। নানা বয়সের মহিলা ও পুরুষেরা এই সংগীত ও নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন এবং ধামসা মাদল বাজিয়ে তারা নাচ গান করেন। ঢাকের সঙ্গে বাঁশি বাজে, ধামসা মাদল, সঙ্গে বাঁশির তালে তালে তারা নৃত্য গীত পরিবেশন করেন। ছন্দে তালে তালে সুশৃংখলভাবে তারা নৃত্য পরিবেশন করেন। শিকার উৎসব দিশাম সেন্দ্রা প্রতীকি উৎসব হিসাবে টিকে আছে। নাচ গানের মধ্য দিয়ে উৎসবের দিন গুলি আনন্দময় হয়ে ওঠে। তারা সাঁওতাল বিদ্রোহের স্মরণে হুল দিবস উদ্যাপন করেন।
সামাজিক সংগঠন পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা হলেও সাঁওতাল সমাজে নারীরা কর্মঠ হওয়ায় তাদের ভূমিকা চাষের ক্ষেত্রে এবং গৃহকাজে গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত গ্রহনে অবশ্য পুরুষেরাই বিশেষ ভূমিকা নেন। বয়স্ক পুরুষ হলেন পরিবারের কর্তা ব্যক্তি। বিয়ের পর ছেলেদের পৃথক বাসগৃহে বাস করতে দেওয়া হয়। ফলে গড়ে ওঠে ছোট ছোট পরিবার, যদিও বৃহৎ আকার পরিবার এখনো দেখতে পাওয়া যায়। সাঁওতালদের একটি সুগঠিত সামাজিক সংগঠন আছে। আঞ্চলিক স্তরে তাদের সংগঠনের সাংগঠনিক কথাবার্তা হয়। সেখানে আছে প্রথাগত ভিলেজ কাউন্সিল বা গ্রাম সভা যেখানে গ্রামের বয়স্করা, মাতব্বররা একসঙ্গে হন এবং নানারকম বিষয়ে আলোচনা করেন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
সাঁওতাল সমাজের পরিবর্তন ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও শিল্পায়নের হাত ধরে সাঁওতাল জনজাতির জীবনে পরিবর্তন আসছে। তারা তাদের সন্তান-সন্ততিদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করছেন। সাঁওতালি ভাষা লেখা ও লিপি তৈরি হয়েছে, তার নাম অলচিকি। পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মু অল চিকি ভাষা তৈরি করেন সাঁওতাল কথাকে লেখা রূপ দেওয়ার জন্য। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে অলচিকি ভাষায়ও শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা অলচিকি ভাষায় পড়াশোনা করেন অথবা হিন্দি, বাংলা বা ইংরেজী মাধ্যমে বিদ্যালয়ে শিক্ষা লাভ করেন।
উপসংহার: সাঁওতালরা ভারতের উপজাতি সম্প্রদায় সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রধান এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবেশী নেপাল ও বাংলাদেশে ছড়িয়ে রয়েছেন। বর্তমানে তাদের জীবন যাত্রায় শিল্পায়ন ও নগরায়নের প্রভাব পড়ছে। শিক্ষার প্রসার ঘটছে সাঁওতালদের মাতৃভাষা সাঁওতালি লিপি অলচিকিতে। এছাড়াও, অঞ্চলভেদে হিন্দি, বাংলা, ইংরেজিতে শিক্ষালাভের সুযোগ ঘটছে স্থানবিশেষে। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিতরা শিক্ষা ও চাকরিতে সংরক্ষণের সুযোগ গ্রহণ করে নিজেদের জীবনযাত্রাকে উন্নত করে তুলছেন। তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব, প্রথাগত কৃষিকাজ, কাজে শ্রমনিযুক্তির অভাব, উপযুক্ত স্বাস্থ পরিষেবার অভাবে এবং অনেক স্থানে মাতৃ ভাষায় শিক্ষার সুযোগ না থাকায় সাঁওতাল জনজাতির এক বৃহদাংশ এখনো অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া এক জনজাতি হিসাবেই রয়ে গেছেন। এ বিষয়ে উন্নততর সাঁওতাল জনসমাজ এবং উপযুক্ত সরকারী উদ্যোগকে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে.
টোডা (Toda)
ভূমিকা- দ্রাবিড় নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জনজাতি টোডা, টোডা জনসংখ্যা বর্তমানে মাত্র ৮০০-র কাছাকাছি। চোডা জনজাতির বাসভূমি নীলগিরি বায়োস্ফিয়ারে অবস্থিত। টোডাদের বসতিকে বলা হয় মান্ড (Mund), তিন থেকে সাতটি কুটির নিয়ে গঠিত এই মান্ড কতকটা অর্ধব্যারেলের আকৃতি এবং তৃণাচ্ছাদিত পার্বত্য ঢালের আরাআরি স্থাপিত যেখানে তারা বসবাস করেন এবং মহিষ প্রতিপালন করেন।
বিবাহ- পূর্বে টোডা মহিলাদের মধ্যে বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল। একই গৃহে সকল ভাইকে বিবাহ করার নিয়ম। বর্তমানে এই প্রথা অবলুপ্ত হয়েছে। একজন স্বামীকেই টোডা নারী তার জীবনে গ্রহণ করেন। টোডা জনজাতির মধ্যে বাল্যবিবাহ প্রচলিত রয়েছে।
পোষাক- টোডা পুরুষ বা নারী একটি মাত্র অঙ্গবস্ত্র পরিধান করেন। সারা শরীর জড়িয়ে রাখেন একটি মাত্র বস্তু। এটি দেখে মনে হয় যেন ধুতির ওপর শাল জড়িয়ে রাখা হয়েছে ছেলেদের ক্ষেত্রে এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে, স্কার্টের মত পোশাকের ওপর শাল জড়ানো রয়েছে, এমনভাবে তারা পোষাক পরিধান করেন।
খাদ্য- টোডারা মূলতঃ শাকাশী। মাছ, মাংস, ডিম গ্রহণ করেন না। মহিষের দুধ পান করেন তারা। বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য তৈরি হয় মহিষের দুধ থেকে। মাখন, ঘি, দই, পনির অথবা তরল দুধ খাওয়া হয়। চাল প্রধান খাদ্য। ভাতের সঙ্গে দুধ ও সবজি খাওয়া হয়।
বসতি- টোডা কুটির গুলিকে বলে ডুগলস্(Dogles)। সেটা উত্তল আকৃতি বা অর্ধব্যারেল আকৃতির হয়। মোটামুটি ১০ ফুট উঁচু, ১৮ ফুট দীর্ঘ ও ৯ ফুট চওড়া বাসগৃহগুলি। বাঁশের তৈরি কাঠামোয় খড়ের ব্যবহার হয়। খুঁটিগুলি গম্বুজ আকৃতি করার জন্য মোটা বাঁশের ব্যবহার হয়। ছাদের উপরে শুকনো ঘাস বা খড় বিছিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি কুটির শীথিল প্রস্তর নির্মিত দেয়াল দিয়ে ঘিরে রাখা থাকে। বাড়ির সামনে ও পেছনে সাধারণত প্রস্তর সাজিয়ে রাখা হয়। গৃহে পাথরের দেওয়াল থাকে। কুটিরের সামনে একটি ক্ষুদ্র দরজা প্রায় তিন ফুট লম্বা ও তিন ফুট চওড়া, যার ভেতর দিয়ে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই সম্ভবত এরূপ ক্ষুদ্র দরজা।
ধর্মবিশ্বাস- টোডাগণ মনে করে টিক্রিসি দেবী (Teikrishy) এবং তার ভাই প্রথম মহিষ সৃষ্টি করেন এবং তারপর প্রথম টোডা মানুষ তৈরি করেন। প্রথম টোডা মহিলা তৈরি হয় প্রথম টোডা পুরুষের ডান পাঁজর থেকে। মহিস ও মহিষ দুগ্ধ বিভিন্ন ধর্মীয় আচারে এবং দৈনন্দিন খাদ্যে ব্যবহৃত হয়। দুধওয়ালা (Milkman) টোডাধর্মে খুব উঁচু স্থানে থাকেন। তিনি পুরোহিতের কার্যটি সম্পাদন করেন। এই পুরোহিত পায়ে হেঁটে কোন সেতু পার হতে পারবেন না। নদীর উপর সেতু থাকলেও তাকে নদী পার হতে হবে সাঁতার কেটে অথবা শুকনো নদী হলে বা জল কম থাকলে পায়ে হেঁটে। টোডা মানুষদের পায়ে জুতো পরা নিষেধ। মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশে নিষেধ আছে।
ভাষা- তারা কথা বলেন যে ভাষায় সেটিও টোডা ভাষা। তবে অনেকেই এখন পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশীদের ভাষা যেমন কানাড়া, তেলেগু ও মালায়ালাম ভাষায়ও কথা বলতে পারেন।
অর্থনীতি - টোডাগণ মূলতঃ পশু পালক। মহিষ প্রধান পালিত পশু, এছাড়া অন্যান্য গবাদি পশুও পালন করেন। মহিষের দুধ উৎপাদন ও সঞ্চয়ের জন্য দুগ্ধ গৃহ বা গোয়ালঘর তৈরি হয় যা তাদের কাছে পবিত্র। মহিষের দুগ্ধ.
অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্য তারা পার্শ্ববর্তী নীলগিরি পাহাড়ের অন্যান্য জনজাতির কাছে বিক্রি করেন এবং এই সুদ্ধ উৎপাদন সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডই তাদের ধর্মীয় আচারকে প্রভাবিত করে। পুরোহিত হলেন দুগ্ধসংক্রান্ত নিয়মাবলী প্রনেতা ও পুজারী।
হস্তশিল্প- টোডাগণ সূচিশিল্পে নিপুন। তাদের হাতে তৈরি এমব্রয়ডারী বংশ পরম্পরায় চলে আসছে এবং এই এমব্রয়ডারীর চাহিদা রয়েছে। অতি সূক্ষ হাতের কাজ এবং উন্নত মানের কাজের জন্য টোডা এমব্রয়ডারি প্রসিদ্ধ।
টোডা সমাজ জীবনে পরিবর্তন বাইরের জনগণের সঙ্গে
ক্রমবর্ধমান সংযোগ এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার শুরু হওয়ায় তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথাগতভাবে তারা পশুপালক হলেও বর্তমানে কৃষি ও অন্যান্য কাজে তারা ব্যাপৃত আছেন। তারা মূলত শাকাশী হলেও কেউ কেউ বর্তমানে আমিষ খাদ্য গ্রহণ করেন। অনেক টোডাই তাদের প্রথাগত ঘর ছেড়ে পাকা ঘর তৈরি করেছেন। তবে অনেকেই অর্ধ ব্যারেল আকৃতির গৃহ পছন্দ করেন। তাদের পবিত্র দুগ্ধশালাটি তৈরিতেও তারা কিছু আধুনিকতা এনেছেন। টোডা নারীদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা যা আগে ছিল এখন আর নেই। আগে সকল ভাইয়ের একটি স্ত্রী এবং তাদের সন্তান সন্ততি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সন্তান বলেই পরিচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে এই প্রথা অবলুপ্ত। একজন পুরুষের একটি স্ত্রী এবং একজন মহিলার একটিই স্বামী।
জারোয়া (Jarwa)
ভূমিকা: জারওয়া জনজাতির বসবাস ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে। তারা এই দ্বীপপুঞ্জের প্রাচীনতম অধিবাসী। মূলতঃ দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামান-এ জারোয়াদের বসবাস। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের জনগণনা অনুযায়ী জারোয়াদের সংখ্যা মাত্র ৩৮০ জন। তারা বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্ক এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করেন। মূলতঃ তাদের সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ে যথেষ্ট জানা সম্ভব হয় না। জারোয়া শব্দটির অর্থ গ্রেট আন্দামানিদের ভাষায় 'আগন্তুক' (Stranger)। কিন্তু জারোয়াগন নিজেদেরকে বলেন ইয়া-এঙ্গা (Ya-engnga) যার অর্থ 'মানুষ'।
বসতিঃ জারোয়া বসতি রয়েছে দক্ষিণ ও মধ্য আন্দামান দ্বীপে ও পার্শ্ববর্তী ক্ষুদ্র দ্বীপগুলিতে। নিজেদের বসতিকে ওরা বলেন চাড্ডা (Chadda)। ব্রিটিশদের নিধন নীতির ফলে জারোয়াদের সংখ্যা হ্রাস ঘটে প্রায় দুই শতাব্দি আগে। বর্তমানে আন্দামান দ্বীপের রাজপথ জারোয়া বাসভূমির সংলগ্ন এলাকা দিয়ে চলে যাওয়ায় এবং এই দ্বীপভূমিতে উদ্বাস্তু বসতি বিস্তারের ফলে জারোয়াদের সংঙ্গে বহিঃবিশ্বের কিছুটা যোগাযোগ ঘটছে এবং পর্যটকদের সঙ্গেও তাদের সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ ঘটছে। কিন্তু আধুনিক সভ্যতা যে ধরণের রোগ বয়ে এনেছে তা জারোয়াদের মধ্যে সংক্রামিত হবার ভয় রয়েছে। অতীতে (১৭৮৯-এর মধ্যে) ব্রিটিশদের সংস্পর্শে এলে এরুপ সংক্রমণের ফলে জারোয়া আদিবাসীর সংখ্যা বিশেষ হ্রাস পেয়েছিল।
নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী: অতীতে আফ্রিকা থেকে আগত এই জনজাতি জারোয়া জাতিগত দিক থেকে নেগ্রিটো নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর। যুদ্ধে পারদর্শীতা এবং নিজ ভূখন্ড রক্ষায় তাদের দৃঢ় সংকল্পতা তাদের বাসভূমি রক্ষায় সাহায্য করেছে। শাররীক দিক দিয়ে সুঠাম চেহারা, কালো কোঁকড়ানো চুল তাদের দেহ সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য।
উপজীবিকা: শিকার- ভ্রাম্যমান আদিবাসী জারোয়াগণ শিকার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ান।শিকারে পটু এই জনজাতি বন্য বরাহ ও গোসাপ (Monitor Lizard) ইত্যাদি তীর, ধনুক দিয়ে শিকার করে। তাদের সঙ্গে অনুসরণকারী কুকুর বন্য জন্তু শিকারে সাহায্য করে। উপকুলীয় বাসভূমি হওয়ায় এরা সমুদ্র থেকে মৎস শিকার করে। মেয়েরাও ঝুড়ি দিয়ে মাছ ধরে। কচ্ছপ, কাঁকড়া শিকার করে খাবার জন্য। এছাড়া ফল, মূল, মধু ইত্যাদি অরণ্য থেকে সংগ্রহ করে আনে। তীর জারোয়া শব্দে 'পাথো' (Patho) এবং ধনুক হল 'আও' (Aao)। তীরের কাঠের ফলা তৈরি হয় এরিকা কাঠ (Arica Wood) দিয়ে। এছাড়া তীরে লোহার ফলাও লাগানো হয়।
সংস্কৃতি: প্রকৃতির সন্তান হিসাবে সাধারণতঃ নগ্ন থাকতে পছন্দ করেন এই জনজাতির মানুষেরা। কিন্তু তারা গহনা যেমন- নেকলেস, মাথার ব্যান্ড, কোমর বন্ধ, হস্ত বন্ধ (armlet) পড়তে পছন্দ করেন। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষেরা গাছের ছাল দিয়ে তৈরী 'তোহে' (Tohe) কোমরের আবরণী হিসাবে কখনো কখনো বাইরে যাবার জন্য পড়ে থাকেন। নারী-পুরুষ উভয়ই শরীর ও মুখাবয়ব কদম রঞ্জিত করে সাজতে ভালবাসেন। তারা মুখে মুখে গান রচনা করেন যার উপজীব্য তাদের শিকার ও সংগ্রাহক জীবনযাত্রা। জারোয়া মৌখিক লোকগাঁথায় সূর্য, চাঁদ, তারা, আকাশ ও মেঘের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
বিবাহঃ একটিই বিবাহ করার রীতি। তবে পুনরায় বিবাহ করতে পারেন। সন্তান ৬-৭ বৎসর বয়স হলে মা-বাবার সঙ্গা ছেড়ে সমবয়সীদের সঙ্গে থেকে এক স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে বেড়ায়।
উপসংহার: জারোয়াদের বাসভূমি-র বিচ্ছিন্নতা ভঙ্গ হচ্ছে বিশেষতঃ আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড স্থাপনের পর থেকে এবং পর্যটকদের সাথে মিশতে দেওয়ার ফলে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে গিয়ে জারোয়া সংস্কৃতি বিপন্ন হচ্ছে। জারোয়া সংস্কৃতি রক্ষায় সরকারীভাবে প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে এবং পর্যটকদের সচেতনতা ও জারোয়া সংস্কৃতির প্রতি সম্মানবোধ জাগ্রত করতে পারলে জারোয়া ঐতিহ্য ধরে রাখতে সাহায্য করবে।
.jpg)
আন্দামানী (Andamanese)
ভূমিকাঃ আন্দামানীগণ বঙ্গোপোসাগরের পূর্বদিকে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী একটি খাদ্য সংগ্রাহক জনগোষ্ঠী। ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে দূরে সমুদ্রে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপীয় অবস্থানে, আরণ্যক পরিবেশে বসবাস করেন বলে আন্দামানীগণ আধুনিকতার প্রভাবমুক্ত থেকে নিজস্ব সামাজিক বৈশিষ্ট্য, সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বজায় রাখতে পেরেছেন।
জলবায়ুঃ ক্রান্তীয় উদ্বু আর্দ্র জলবায়ু এবং উদ্বুতা ও আর্দ্রতা সারাবছর প্রায় সুষমভাবে বণ্টিত। নিরক্ষরেখা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান হওয়ায় এখানে মে থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সুস্পষ্ট বর্ষা ঋতু পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ বৃষ্টিপাত নিরক্ষীয় জলবায়ুর প্রভাবাধীন না হয়ে প্রাক্ মৌসুমি, মৌসুমিবায়ুর আগমন এবং প্রত্যাবর্ত মৌসুমি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অধিক বৃষ্টিপাত হলেও নদীর সংখ্যা আন্দামানে খুব কম এবং ছোটো ছোটো। অধিকাংশ বৃষ্টির জল নিম্নভূমিতে জলাশয় সৃষ্টি করে সঞ্চিত হয়।
জাতিসত্বা এবং দৈহিক গঠন : জাতিসত্বার দিক থেকে আন্দামানীগণ নিগ্রোয়েড নৃ-তাত্ত্বিক গোষ্ঠীকৃষ্ণ। কুরুকায়, হাল্কা রক্তিম আভা যুক্ত গাত্রবণ, কুষ্ণিত কেশ, প্রশস্ত মুখমণ্ডল ও উন্নত চোয়াল, খর্বাকৃতি চেহারা আন্দামানীদের দৈহিক বৈশিষ্ট্য। বিচ্ছিন্ন দ্বীপিয় অবস্থান এবং শতশত বর্ষ ধরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় আন্দামানীগণ তাদের স্বকীয় জাতীসত্ত্বার বিশুদ্ধতা এবং সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পেরেছেন।
জীবনযাপন প্রণালীঃ আন্দামানীগণ জীবন ধারণের জন্য প্রাকৃতিক বনজ উপাদান এবং সমুদ্র সম্পদের উপর নির্ভর করে থাকেন। তারা কৃষিকাজ বা অন্যভাবে ফসল বা ফল উৎপাদন অথবা হস্তশিল্প কোনোটিই করেন না। গৃহপালিত পশুও তাদের নেই, তবে পোষ্য কুকুর রয়েছে। কখনো কখনো শুরুর সংগ্রহে রাখেন, তবে তা কেবল মাংস ভঙ্কনের জন্য, গৃহে প্রতিপালনের জন্য নয়। খাদ্য সংগ্রহের জন্য তারা পশু পাখি শিকার, মৎস্য শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করেন। সুতরাং তারা মানব সমাজের ক্রমবিবর্তনের প্রাথমিক স্তরে অর্থাৎ খাদ্য সংগ্রহস্তরে রয়েছেন এবং খাদ্য উৎপাদন অর্থনীতি এখনো এই জনজাতির সমাজে অনুপস্থিত থেকে গেছে।
শিকার: শিকারের জন্য তারা পুরোপুরি তীর-ধনুকের উপর নির্ভর করেন: বর্তমানে পোষ্য কুকুরও এই শিকারে তাদের সাহায্য করে। এরা পশু পাখি ফাঁদ পেতে ধরতে জানেন না।
মৎস্য সংগ্রহ: মাছ ধরার জন্য জাল, ছোটো বড় ফলাবিশিষ্ট বর্শা বা কোচ, তীর ধনুক ব্যবহার করেন। মহিলারা ছোটো মাছ ও চিংড়ি ছোটো ছোটো জাল দিয়ে ধরে থাকেন। বর্তমানে মাছ ধরার জন্য এরা বর্শিরও ব্যবহার করছেন।
সংগ্রহ: মূল ও মূলজাতীয় শস্য সংগ্রহের জন্য এরা লাঠির ডগায় আংটা লাগিয়ে ব্যবহার করেন। ধারালো ফলা ব্যবহার করেন মৌচাক কাটা ইত্যাদির জন্য।
আশ্রয়: অস্থায়ী কুটির নির্মাণের জন্য আন্দামানীরা পরিষ্কার জলের উৎসের খোঁজ করেন এবং তা সাধারণত একটি মুক্ত বা খোলামেলা বনবেষ্টিত পরিবেশে হয়ে থাকে, যাতে তারা সামুদ্রিক ঝক্কা থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এঁরা আংশিকভাবে যাযাবর খাদ্য সংগ্রাহক। একাদিক্রমে কয়েকমাস একইস্থলে বসবাস করার পরে এঁরা অন্যত্র অভিগমন করেন স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের কাম্য সর্বাধিক ব্যবহারের সুযোগ নিতে। তাদের একটি মূল বাসস্থান থাকে, যেখানে এটি স্থায়ী এবং গোষ্ঠীর সকল সদস্যই বছরের বেশিভাগ সময়ে সেই বাসস্থলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একত্রে কাটান। এই বসবাস এলাকাটিও একটি সুচারুভাবে গৃহস্থালী গঠিত গ্রাম গড়ে উঠে থাকে। এটি মোটামুটি বৃত্তাকৃতি অনেকটা মৌচাক সদৃশ হয়। এরূপ কুটিরগুলি দুটি খুঁটি দ্বারা কেন্দ্রবেষ্টিত হয়, অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বৃত্তটি গঠিত হয় কেন্দ্রীয় অবস্থানে অপেক্ষাকৃত লম্বা খুঁটিকে ঘিরে এবং একটি মধ্যবর্তী বৃত্ত তৈরী হয় অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র খুঁটিটিকে ঘিরে এবং অনুই মিক ও ঢালু কাঠের বগা দ্বারা খুঁটিগুলি যুক্ত থাকে। এভাবে গঠিত কাঠামোয় ছাদের ছাউনিটি তৈরী হয়.
উপর্যুপরি তালপাতার মাদুর বা অনুরূপ মাদুর বিছিয়ে, এবং একটির সঙ্গে আরেকটি বেতের দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে। ছাউনিগুলি প্রায় মাটিতে নেমে আসে; একপাশে একটি ক্ষুদ্র দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করা হয়। কুটিরগুলি একই সারিতে পাশাপাশি একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত থাকে। যখন তারা শিকার বা মৎস্য সংগ্রহের জন্য বাইরে গমন করেন, তখন যে অস্থায়ী তাবুগুলি তৈরী করেন, সেগুলি এমনভাবে ঝুঁকে থাকে বা এমন আকৃতি হয় যাতে সামুদ্রিক বাতাস ভেঙে যায়।
পোষাক: খুব স্বল্প বসন পরিধান করেন।বাইরের জগতের সঙ্গেঙ্গ যোগাযোগ ছিন্নতাই এর কারণ। তবে বর্তমানে বাইরে তৈরী সুতির পোষাকও এরা পরিধান করতে শুরু করেছেন।
পুরুষ ও নারী উভয়ই গহনা পরতে ভালোবাসেন। গলায়, হাতে এরা অস্থি, ঝিনুকের খোলস কাঠ ও বাঁশ লতাপাতা দিয়ে গহনা প্রস্তুত করে পরিধান করেন।
বিবাহ: বিবাহ প্রথাটি চমৎকার। খুব অনাড়ম্বর একটি বিবাহ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। যখন পরিবারের বড়রা জানতে পারেন পরিবারের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ একই গোষ্ঠীর অন্য একটি পারিবারের একটি মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা বিবাহের ব্যবস্থা করেন। হবু কনেকে যে গৃহে বিবাহ হবে সেখানে যখন নিয়ে যাওয়া হয়, হবু বরটি তখন জঙ্গলের দিকে ছুটে পালায়। এইসময় পাত্রটির সাথে আত্মীয়-স্বজনদের একটি ধস্তাধস্তি হয়। এভাবে পূর্ব পরিকল্পিত রীতিটি সম্পন্ন হলে পাত্রটিকে বলপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে বিবাহ প্রাঙ্গনে উপবিষ্ট পাত্রীর কাছে নিয়ে গেলে তাকে পাত্রীটির কোলে বসতে হয়। এরপর অনাড়ম্বর উপজাতীয় রীতিনীতি অনুসারে বিবাহ সম্পন্ন হয়।
আমোদ-প্রমোদ: আন্দামানীগণ খুবই হাসিখুসি প্রকৃতির। তারা নাচ গান ভালোবাসেন, হাসি মজা নিয়ে থাকেন। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে তারা ঘণ্টার পর ঘন্টা, এমনকি সারা রাতও নাচ গান করে কাটিয়ে দেন। উৎসব অনুষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে মুখে মুখে গান বাঁধেন। একসঙ্গে তারা সুর ও তালে গলায় গলা মিশিয়ে, পায়ে পা মিলিয়ে ঘুরে ঘুরে গান ও নাচ করেন। চাঁদের আলোয় বনভূমির মোহময় পরিবেশে মশালে আগুন ধরিয়ে আলো-আধারী পরিবেশে নাচ গান চলতে থাকে। অতিথি আপ্যায়ণেরও ব্যবস্থা থাকে।
ধর্ম: নিজেদের উপজাতীয় ধর্ম অনুসরণ করেন। প্রাকৃতিক শক্তি ও অরণ্যের পূজারী এঁরা। পুলুগা এদের উপাস্য দেবতা। খুব সহজ সরল জাকজমক হীন ধর্মীয় রীতিনীতি এরা অনুসরণ করেন। বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় অন্যান্য ধর্মের প্রভাব বা ধর্মান্তরকরণ এখানে ঘটেনি।
উপসংহারঃ বর্তমানে আন্দামানীদের সংখ্যা খুব কমে গেছে। বাইরের মানুষের যাতায়াত বেড়ে যাওয়ায় এবং প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে টিকে থাকার লড়াইয়ের ফলে, নানা রোগ ব্যাধির আক্রমণে এদের মরণশীলতা বেড়েছে অথচ প্রজনন হারও কম, যার ফলে আন্দামানী জনজাতির জনসংখ্যা বর্তমানে ৪০-এর নীচে এসে দাড়িয়েছে। কিন্তু প্রাচীন জীবনযাত্রার ঐতিহ্যবাহী উত্তরাধিকার ধরে রাখতে পেরেছে এরূপ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানে খুব কমে এসেছে। তাই উপযুক্ত প্রকল্প গ্রহণ মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরিবেশেই এই জনজাতীর সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে এই জনগোষ্ঠী বিপন্নই থেকে যাবে। এজন্য পরিবেশ সচেতনভাবে এদের বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় প্রশাসনকে এগিয়ে আসতে হবে।
► গোল্ড (The Gonds): এরা ভারতের বৃহত্তম ও অন্যতম প্রাচীন উপজাতি গোষ্ঠী। গন্ডোয়ানা ল্যান্ড কথাটি সম্ভবত গোল্ড উপজাতির নাম থেকে এসেছে। ভারতীয় প্রাচীন ভূখণ্ডের এই উপজাতি সম্প্রদায় নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত। ছত্তিশগড়ের অম্বিকাপুর (সরগুজা), জগদলপুর (বক্সার), মধ্যপ্রদেশের ছিন্দোয়ারা এবং মালা জেলায় গোল্ডদের অধিক সংখ্যায় বসবাস দেখা যায়। অপ্রপ্রদেশের আদিলাবাদ, করিমনগা ও ওয়ারাঙ্গলে, মহারাষ্ট্রের চান্ডা জেলায়ও যথেষ্ট সংখ্যায় গোল্ডদের দেখা যায়। গুজরাট, কর্ণাটক, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গেও কিছু সংখ্যায় গোল্ড বসতি দেখা যায়।
বর্তমানে গোল্ডরা মূলত স্থায়ী কৃষিজীবি। তবে স্থানান্তর কৃষিকাজ, খাদ্যসংগ্রাহক জীবনযাত্রা এদের মধ্যে এখনও স্থান বিশেষে টিকে আছে। গোল্ডরা সাধারণত গোন্ডি এবং ছত্তিশগড়ি কথ্য ভাষা ছাড়াও স্থানীয় কয়েকটি ভাষায় কথা বলায় অভ্যন্ত।
► ভিল (The Bhill): ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম উপজাতি ভিল অন্যতম প্রাচীন উপজাতি। বেদ-এ এদের উল্লেখ পাওয়া যায়। নৃতাত্ত্বিক দিক থেকে এরাও দ্রাবিড় গোষ্ঠীভুক্ত। ভিল কথাটির দ্রাবিড় অর্থ তীর (arrow)। ভিলরা বাস্তবিকই তীর-ধনুকে পারদর্শী। মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট ও রাজস্থানে অধিক সংখ্যায় ভিল বসতি দেখা যায়। ছত্তিশগড়, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটকেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভিল বসতি লক্ষ্য করা যায়। মধ্যপ্রদেশের ধর, পশ্চিম নিমার, পূর্ব নিমার, ঝাবুয়া, রামে; গুজরাটের পাঁচমহল, ভারুচ, দাঙ, সবরকান্ধা ও বনসকাস্থা জেলাগুলিতে: রাজস্থানের দুঙ্গারপুর, বাঁশওয়ারা, উদয়পুর জেলাগুলিতেই ভিলদের বসবাস বেশি।
ভিলদের প্রধান উপজীবিকা কৃষি। কিছু ভিল এখনও খাদ্য সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। ভিলদের কথ্য ভাষা ভিলি। এদের নিজস্ব কোন লিপি নেই।
ওরাওঁ (The Oraons): ভারতের অন্যতম উপজাতি ওরাওঁদের বসবাস মূলত ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে। ঝাড়খন্ডে সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় বসবাস করলেও ওরাওঁরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে দেখা যায়।
স্থায়ী কৃষিজীবি হিসেবেই ওরাওঁরা পরিচিত। ওরাওঁরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ছোটনাগপুরের মালভূমি অঞ্চল থেকে স্থানান্তরিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের চা বাগানগুলিতে এবং কৃষিকাজের জন্য সুন্দরবন অঞ্চলে চলে আসে।
ওরাওঁদের কথ্য ভাষা হল 'কুরুখ'। তবে স্থানান্তরিত ওরাওঁদের নতুন প্রজন্ম বহুক্ষেত্রেই নিজেদের ভাষায় নয়, স্থানীয় ভাষায় কথা বলতেই বেশি অভ্যন্ত দেখা যায়।
► মুন্ডা (The Mundas): মুন্ডারাও ভারতের অন্যতম উপজাতি এবং ছোটনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে এদের অধিক সংখ্যায় বসতি দেখা যায়। এই অঞ্চলের ঝাড়খন্ডে মুন্ডারা সর্বাধিক সংখ্যায় বসবাস করে। তবে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুন্ডাদের বসতি দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে সুন্দরবন অঞ্চলে এবং ডুয়ার্সের চা বাগানগুলিতে প্রচুর সংখ্যায় মুন্ডা বসবাস করে। কোলারিয়ান গোষ্ঠীভুক্ত এই সম্প্রদায় বর্তমানে মূলত স্থায়ী কৃষিজীবি। সাধারণত মুন্ডা ভাষায় কথা বললেও তারা স্থানীয়ভাবে হিন্দি, বাংলা, ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষায়ও কথা বলতে পারে।