ভারতে মানব উন্নয়নের মান ও উন্নয়নের তারতম্যের নিয়ন্ত্রকসমূহ(Status of Human Development in India and Factors Responsible for Different Levels of Developments)
ভূমিকা:
ভারতের সুবিশাল জনসম্পদ সম্ভাবনা মানব উন্নয়নের ভিত্তি বলে ধরা যায়। সাম্প্রতিককালে মানব উন্নয়নের উল্লেখণীয় অগ্রগতি হয়েছে যা লক্ষ্য করা যায় গণতান্ত্রিক মাপকাঠিগুলিকে যেমন, স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা ও প্রাপ্তবয়স্কের সাক্ষরতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে উন্নতির পরিসংখ্যান থেকে। বিভিন্ন পরিকল্পনায় Gross Domestic Product বৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৮ শতাংশ এবং বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানব উন্নয়নে। পরিকল্পনায় জোর দেওয়া হয়েছে কেবল GDP বৃদ্ধির ওপর নয়, সঙ্গে সঙ্গে মানব কল্যাণ ও জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের দিকেও। এর মধ্যে কেবল সকলের জন্য যথেষ্ট খাদ্য ও অন্যান্য ভোগ্যদ্রব্য পৌছে দেওয়াই নয়, লক্ষ্য রাখা হয়েছে মূল সামাজিক পরিষেবা বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল এবং পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকেও। এই প্রকল্পে আরও রয়েছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা যাতে প্রতিটি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর কাছে পৌছোয়, সামাজিক বৈষম্য দূরীভূত হয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়ে সকলে যোগদানের বা মতপ্রকাশের অধিকার পায় ইত্যাদি।
রাষ্ট্রীয় প্রয়াসঃ মানব সম্পদ উন্নয়নে রাষ্ট্রীয় প্রয়াসে উৎসাহ দিতে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকতর যোগদানের প্রমাণ পাওয়া যায় ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণ বৃদ্ধি থেকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার কল্যাণ, পুষ্টি, প্রয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা, গ্রামোন্নয়ন, গৃহনির্মাণ, সমাজ কল্যাণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ। ১৯৯২-৯৩ সালের ৯,৬০৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০০১-০২ সালে হয়েছে ৪০,২০৫ কোটি টাকা।
মোট ব্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যয় বরাদ্দ ১৯৯২-৯৩ এর ৮.১ শতাংশ-এর তুলনায় ২০০০-০১ সালে বেড়ে হয়েছে ১০.৭ শতাংশ। ২০০১-০২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যয় বরাদ্দ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে ১৯.৬ শতাংশ, স্বাস্থ্য খাতে ২৪.২ শতাংশ, পরিবার কল্যাণখাতে ৩১.৬ শতাংশ এবং নারী ও শিশুদের উন্নয়নে ২২.২ শতাংশ।
UNDP-র মানবোন্নয়ন সূচক (Human Development Index বা HDI) অনুসারে ভারত মানবোন্নয়নে (২০১১) বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১২৭ স্থান অধিকার করে। বলা হয়েছে, এদেশে মাঝারি মানের মানবোন্নয়ন হয়েছে।
• ২০০৭-এর মধ্যে দারিদ্রের অনুপাত ৫ শতাংশ কমানো যা ২০১২-র মধ্যে ১৫ শতাংশ কমবে।
• দশম পরিকল্পনাকালের মধ্যেই বর্তমানের শ্রমশক্তির সলোই উচ্চমানের শ্রমনিযুক্তি ঘটানো হবে।
• ২০০৩-এর মধ্যে সর্বশিক্ষা চালু করতে হবে; ২০০৭-এর মধ্যে সব বাচ্চাকেই ৫ বছর স্কুল শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে হবে।
• সাক্ষরতা ও শ্রমের মজুরিতে লিঙ্গ বৈষম্য ২০০৭-এর মধ্যে অন্ততঃ ৫০ শতাংশ কমানো হবে।
• ২০০১-২০১১-এর মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দশবর্ষীয় হার ১৬.২ শতাংশ-এ নামাতে হবে।
• দশম পরিকল্পনাকালের মধ্যেই সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি করে ৭৫ শতাংশ করতে হবে।
• প্রতিহাজারে জীবিত শিশুর জন্ম সংখ্যায় নবজাতকের মৃত্যু হার (Infant Mortality Rate) ২০০৭-এর মধ্যে ৪৫ ও ২০১২-র মধ্যে ২৮-এ নামাতে হবে।
• সন্তানদাতৃ মায়ের মরণশীলতা (Maternal Mortality Rate) প্রতি হাজার জীবিত শিশুর জন্মসংখ্যা পিছু ২০০৭-এর মধ্যে ২ এবং ২০১২-র মধ্যে ১-এ নামাতে হবে।
• দশম পরিকল্পনাকালেই সকল গ্রামে পানীয় জলের সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে।
(Source: Economic Survey 2001-02, Published by The Ministry of Finance, Govt. of India)
এর পরে একাদশ ও দ্বাদশ পরিকল্পনায়ও মানোবোন্নয়নে অনুরূপ কর্মসূচীতে গুরুত্ব ছিল। বর্তমানে পরিকল্পনা কমিশন-এর বদলে নীতি আয়োগ গঠিত হয়েছে। নীতি আয়োগ-এর অধীনে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়নে সরকার সচেষ্ট রয়েছে।
▲ দারিদ্র (Proverty)
ব্যাপক দারিদ্র হল জীবনযাত্রার নিম্নমান, বঞ্চনা, অপুষ্টি, অশিক্ষা ও নিম্ন মানব-সম্পদ-এর সমার্থক। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য দারিদ্র দূরীকরণ। ভারতে দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা সাম্প্রতিককালে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭৩-৭৪ সালে যেখানে দেশের ৫৫ শতাংশ লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করত, ১৯৯৩-৯৪ সালে তা হ্রাস পেয়ে ৩৬ শতাংশ এবং বর্তমানে তা আরো হ্রাস পেয়ে প্রায় ২২ শতাংশ (২০১২-১৩) হয়েছে। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে প্রতি ৪ জনের ১ জন এখনো দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করেন।
দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার তুলনায় যথেষ্ট বেশি ওড়িশা, বিহার ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। ওড়িশা ৪৭.১৫ শতাংশ ও বিহারে ৪২.৬ শতাংশ লোক দারিদ্রসীমার নিচে বাস করেন।
রাজনগুলির মধ্যে গোয়ায় দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা সবচেয়ে কম (৫.০৯ শতাংশ), এর ওপরে যথাক্রমে কেরালা (৭.০৫ শতাংশ) ও হিমাচল প্রদেশের (৮.০৬ শতাংশ) স্থান। রাজাগুলির মধ্যে দারিদ্রসীমার উপরে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশী ছত্তিশগড়ে। এর পরে রয়েছে ঝাড়খন্ড ও মণিপুরের স্থান।
রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী জনসংখ্যা রয়েছে আন্দামানে (১ শতাংশ) এবং সবচেয়ে বেশী রয়েছে ছত্তিশগড়ে (৩৯.৯৩ শতাংশ)।
শ্রম ও নিযুক্তি (Labour and Employment): ভারতে মানব উন্নয়নের অন্যতম উপায় শ্রম ও নিযুক্তির সুযোগ বৃদ্ধি করা। অর্থনৈতিক কাজকর্মের বৈচিত্র বৃদ্ধি ঘটিয়ে এবং অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটিয়ে শ্রম ও নিযুক্তির সুযোগে বৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে।
National Sample Survey-র সমীক্ষায় দেখা গেছে যে সামগ্রিক লোক নিয়োগ বৃদ্ধির হার ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৭-৭৮-এ ছিল ২.৭৩ শতাংশ, ১৯৮২-৮৩ থেকে ১৯৮৭-৮৮-তে এই বৃদ্ধির হার কমে হয় ১.৫৪ শতাংশ। তবে ১৯৮৭-৮৮ থেকে ১৯৯৩-৯৪-এ লোক নিয়োগ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে হয় ২.৪৩ শতাংশ। ১৯৯৩-৯৪ থেকে ১৯৯৯-২০০০-এ সামগ্রিক লোক নিয়োগ বৃদ্ধির পুনরায় হ্রাস পেয়ে মাত্র ১.৫৭ শতাংশ-এ নেমে গেছে।
সংগঠিত ক্ষেত্রে লোক নিয়োগ ১৯৯৯-২০০০-এ ছিল দেশের মোট কর্মচারী সংখ্যা (৩৯.৭ কোটি)-র ৭ শতাংশ-এর মতো। এই দুই-তৃতীয়াংশ সরকারী ক্ষেত্রে নিযুক্ত হয়। কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রে লোকনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে। বর্তমান কালেও এই অধোগতি অব্যহত রয়েছে।
সরকারী ক্ষেত্রে লোক নিয়োগ হ্রাসের কারণ ব্যয় কমানোর জন্য সরকারী দপ্তরে লোক নিয়োগ রদ এবং সরকারের লোক নিয়োগনীতির পুনর্বিন্যাস। সংগঠিত বেসরকারী ক্ষেত্রে অনুরূপ কারণ ছাড়াও কম্পুটারাইজেশন ও অটোমেশন-এর ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া। এছাড়া, ১৯৮৩-৯৪ থেকে ১৯৯৪-২০০১-এ সামগ্রিক শ্রম নিযুক্তি হ্রাসের অপর গুরুত্বপূর্ণ কারণ, কৃষিতে শ্রমনিযুক্তি হ্রাস। এর কারণ সম্ভবত কৃষিতে পাওয়ার টিলার, ট্রাক্টর প্রভৃতি অধিক সংখ্যায় ব্যবহার। এই সময়েই প্রথম কৃষি-নির্ভর শ্রমনিযুক্তি হ্রাস পায়। কিন্তু বাণিজ্য, আর্থিক পরিষেবা, পরিবহন, সংরক্ষণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় শ্রমনিযুক্তি বৃদ্ধি দ্রুততর হয়। মোট শ্রমনিযুক্তিতে এই সকল ক্ষেত্রে যোগদান বৃদ্ধি পায়। দেশের আর্থিক পরিকাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে-এ থেকে বোঝা যায়।
গ্রামাঞ্চলে একাধিক দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচী নেওয়া হয়। দশম পরিকল্পনায় (২০০২-২০০৭) গ্রামীণ শ্রমনিযুক্তি বৃদ্ধি ও দারিদ্র দূরীকরণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম সড়ক যোজনা ছাড়াও, ইন্দিরা আবাস যোজনা, শিক্ষা সহযোগ যোজনা প্রভৃতি কর্মসূচী রূপায়ণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
▲ শিক্ষা (Education):
মানব উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষার ভূমিকা সর্বজনবিদিত। মানব মূলধন (Human Capital)-এর কেন্দ্রীয় উপকরণ (Central Component) হল শিক্ষা। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রত্যাশিত আয়ু, শিশু মরণশীলতা, পুষ্টির মানোন্নয়ন ইত্যাদিতে শিক্ষার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুতঃ সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষার অবদান, শিক্ষাখাতে ব্যায়ের পরিমাণকে ছাড়িয়ে যায়।
ভারতে শিক্ষাখাতে ব্যায়ের পরিমাণ মোট জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ৩.৮ শতাংশ। দেশে শিক্ষানীতির মু ল লক্ষ্য হল ৬ থেকে ১৪ বছরের সব শিশুকে বাধ্যতামূলক বিনামূল্যে শিক্ষাদান, সম্পূর্ণ নিরক্ষতার দূরীকরণ, শিক্ষাকে বৃত্তিমূলক করা, নারী শিক্ষা এবং দূর্বলতর শ্রেণীর ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষার ওপর গুরুত্ব।
এই সকল প্রয়াসের ফলস্বরূপ দেশে সাক্ষরতা হারে আশাব্যাঞ্জক বৃদ্ধি ঘটছে। ১৯৫১ অর্থাৎ স্বাধীনতার পরবর্তী প্রথম আদমসুমারী (Census)-তে সামগ্রিক সাক্ষরতা ছিল মাত্র ১৮.৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ সাক্ষরতা ২৭.১৬ শতাংশ ও নারী সাক্ষরতা মাত্র ৮.৮৬ শতাংশ। ২০১১ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতার ৬ দশক পর এই সাক্ষরতা হার বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৪.০৪ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ সাক্ষরতা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৮২.১৪ শতাংশ ও নারী সাক্ষরতা ৬৫.৪৬ শতাংশ। তবে এটি এখনো চিন্তাজনক যে একবিংশ শতকে এসেও দেশের এত অধিক সংখ্যক নারী জনসংখ্যা এখনও শিক্ষার সুযোগ থেকেই কেবল বঞ্চিত নয়, তারা নিরক্ষরও বটে। এজন্য রাজনীতিক সদিচ্ছা, সুষ্ঠু প্রকল্প রূপায়ন ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন।