গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকা বা শহরতলি (Rural-Urban Fringe):
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকা বলতে গ্রাম কিংবা শহরের বাইরের সীমানাকে বোঝানো হয়। গ্রাম এবং তারের এই সীমান্তে গ্রামীণ এবং শহুরে ভূমিব্যবহারের মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক লক্ষ করা যায়। 1968 খ্রিস্টাব্দে 1. Pryor আম-শহর উপকণ্ঠ এলাকার ধারণা দেন। তিনি বলেন, "It is a zone of transititon between continuously built up urban and suburban areas of the central city and the rural hinterland." এবাং, এটি হল ধারাবাহিকভাবে গঠিত শহর এবং শহরের উপকণ্ঠের সীমান্ত অঞ্চল যা প্রধান নগরকেন্দ্রের শ্চাদভূমিরূপে বিবেচিত হয়।
Blizzard এবং Anderson-এর মতে, "the rural-urban fringe is that area of mixed urban rural landuse between the point where full city services to be available and the somt where agricultural landuse predominate."
ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে-
"গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকা হল এমন একটি অঞ্চল যেখানে মিশ্র গ্রাম ও শহুরে লোকের বসবাস আছে এবং যেখানে কৃষিজমির ব্যবহার শেষ হয় এবং শহরের শুরু হয়। এই অঞ্চল থেকে প্রত্যেকদিন শহরে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাজে মানুষের যাতায়াত আছে। গ্রাম এবং শহরের উপকণ্ঠ এলাকায় বসতগৃহ নির্মাণের ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের দুটি বৈশিষ্ট্যই দেখা যায়। এই এলাকায় জমির ব্যবহারের পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটতে থাকে। উদ্যান নির্মাণ, বিভিন্ন farm house নির্মাণ, ঘোড়া রাখার জায়গা, গল্ফ খেলার মাঠ, বিমানবন্দর, সবজি ও ফুল উৎপাদনের কাজে প্রচুর জমি ব্যবহৃত হয়। প্রকৃত অর্থে গ্রাম-শহর উপকণ্ঠ এলাকা শহর নয় আবার গ্রামও হয়।
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার সংজ্ঞা:
(a) H. Carter-এর মতে, গ্রাম-শহর উপকণ্ঠে এলাকা হল এমন একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চল, যার কিছু অংশ শহরের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশে যায় কিন্তু কিছু অংশ তখনও গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য বহন করে।
(b) R.L.. Singh-এর মতে, গ্রাম-শহর সীমান্ত অঞ্চল বলতে এমন এলাকাকে বোঝায় যেখানে শহরে প্রভাব বা বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে গ্রামীণ বৈশিষ্ট্য বা শক্তিগুলির সামঞ্জস্য বিধান চলতে থাকে এবং শহরের বিস্তার গ্রামের বাইরের সীমানার দিকে পরিকল্পনাহীনভাবে ঘটতে থাকে।
(c) GS. Wehrwein-এর মতে, গ্রাম-শহর সীমান্ত হল সুপ্রতিষ্ঠিতভাবে শহরের জমির ব্যবহারের সীমানা ও গ্রামের কৃষিজমির সীমানার মধ্যবর্তী অংশ (The rural-urban fringe is an area of transition between well-recognised urban landuse and the area devoted to agriculture.)
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকা বা শহরতলির বৈশিষ্ট্য:
(1) শস্য-উৎপাদন সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক হারে করা হয়। বিশেষত ফলমূল ও শাকসবজি উৎপাদন প্রচুর পরিমাণে এই শহরতলি অঞ্চলে করা হয়।
(ii) জনগণের এক বৃহৎ অংশ এই অঞ্চল থেকে প্রত্যহ শহরে (কর্মস্থলে) উন্নতমানের কাজে যোগদানের জন্য যাতায়াত করেন। সুতরাং, একে "দৈনন্দিন যাত্রী বলয়" বলা যায়।
(iii) রেল ও সড়কপথে এই অঞ্চলের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ খুব উন্নতমানের হয়।
(iv) শহরের কিছু মানুষ এই অঞ্চলে এসে বসতবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করেন। আবার গ্রামের মানুষ শহরের এই সীমান্ত এলাকায় অপেক্ষাকৃত উন্নত জীবনযাপনের জন্য এসে বসবাস করতে থাকেন। সুতরাং বলা যায় যে, It is the transition zone between town and country. The Rural-urban fringe also known as outstrikers or the urban hinterland can be described as "the landscape interface between town and country.
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকায় বিমানবন্দর, গল্ফ খেলার মাঠ, রেস কোর্স, আবর্জনা বিশ্বদকর প্ল্যান্ট, বড়ো বড়ো গুদামঘর এবং কৃষিখামারযুক্ত ঘর গড়ে ওঠে।
(vi) জমির ব্যবহারের প্রকৃতি অনেকটা প্রগাঢ় ধরনের। জমিতে পচনশীল দ্রব্যের উৎপাদন কর হয়। যেমন- শাকসবজি উৎপাদন, ফল ও ফুলের উৎপাদন, দুগ্ধজাত দ্রব্যের উৎপাদন এই অঞ্চলে করা হয়।
(vi) বসতভূমি ও শিল্পের এলাকার সম্প্রসারণ ঘটতে থাকে। শহরের আয়তন এখানে ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
(viii) জমির প্লটগুলির এবং কৃষিজমির আয়তন কম হয়।
(2x) সামাজিক সুযোগ-সুবিধা এবং জনগণের চাহিদা পূরণের সুযোগ-সুবিধাগুলি পর্যাপ্ত নয়।
(x) জমির ব্যবহারের প্রকৃতি সর্বদা পরিবর্তিত হচ্ছে। কৃষিজমির ব্যবহার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্তরে উন্নীত হচ্ছে।
(xi) বিভিন্ন প্রমোটারগণ বসবাসের কলোনি (residential colony) তৈরি করেন।
(xii) এই অঞ্চলকে প্রকৃতপক্ষে সবুজ বলয় বা সবুজক্ষেত্র বলা হয়।
(xiii) কলেজ, স্কুল, হাসপাতাল, খেলার মাঠ, বসত এলাকার জন্য নির্দিষ্ট জায়গা বরাদ্দ করা হয়।
(xiv) এই অঞ্চলে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
(xv) এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন প্রত্যেক শহরে তাঁদের কর্মস্থলে যাতায়াত করেন।
(xvi) প্রশাসনিক দিক থেকে এই অঞ্চলে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা দেখা যায়। এখানে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কাজ করার পর অপরাধীরা অন্য এলাকায় পলায়ন করে।
উদাহরণ: বৃহত্তর কলকাতার সীমান্তে অবস্থিত ডায়মন্ডহারবার, বারুইপুর, সোনারপুর, বারাসাত (উত্তর ২৪ পরগনা) এই স্থানগুলি কলকাতা মহানগরের 'শহরতলি' অঞ্চল। পরবর্তীকালে এদের বেশ কিছু অঞ্চল মূল নগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু স্থান এভাবে মূল নগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন- হুগলি জেলার ডানকুনি।
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার গঠন (Structure of the Rural-Urban Fringe):
শহরতলি অঞ্চলের গঠন বেশ জটিল ধরনের। শহর ও তার চারপাশের অঞ্চল দু'ধরনের প্রশাসনিক ক্ষেত্রের অন্তর্গত হয়। মিউনিসিপ্যাল শহর অথবা গ্রাম পঞ্চায়েত এবং রাজস্ব গ্রাম অথবা গ্রাম পঞ্চায়েত এই দুটি প্রশাসনিক ক্ষেত্র এখানে থাকে। ছোটো পৌর শহরটি প্রধান নগরের খুব কাছে অবস্থিত হয় এবং এই অঞ্চলটি ক্রমশ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলে। বাস্তবে এগুলি শহরের ভৌগোলিক এলাকার অন্তর্গত হয়। শহর যেটি মূল নগর থেকে বেশ দূরে অবস্থিত হয় তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বা স্বকীয়তা থাকে, তবে এই অঞ্চলের পরিসেবা (পরিবহণ ও অন্যান্য পরিসেবা) উন্নতমানের হয় না। গ্রামের এই পশ্চাদভূমিতে বেশ কিছু বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। যেমন- কৃষি অঞ্চল বা কৃষিজমি বসতবাড়ি ও শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়। এই অঞ্চল daily commuter অঞ্চলে রূপান্তরিত হয়। শহরের সীমান্তেরও পিছনে গ্রাম সীমান্ত (ninal fringe) অবস্থান করে। এই এলাকা সম্পূর্ণভাবে গ্রামের অন্তর্গত। নগরায়ণের প্রভাব প্রায় থাকেই না।
• সাব-আরবান অঞ্চলে (Sub-urban Area): গ্রামের সীমান্তে ছোটো শহর কিংবা ছোটো ছোটো শহরের ন্যায় বসতি অঞ্চল গড়ে ওঠে। একে শহরের সীমান্তের ভিতর অঞ্চল (inner area) বলা হয়। মুম্বাই, কলকাতা ও চেন্নাই শহরে এরকম 'suburban area' আছে।
• উপনগরী (Satellite Town): Urban Fringe বা শহরতলি অঞ্চলে অনেকক্ষেত্রে উপনগরী গড়ে ওঠে। এখানে উন্নত বসতি, শিল্প ও শিক্ষাকেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে ওঠে। অনেকক্ষেত্রে দ্বৈত নগরীও (Twin City) গড়ে ওঠে এই অঞ্চলে। রাজারহাট-নিউটাউন, ডানকুনি পশ্চিমবঙ্গের উল্লেখযোগ্য উপনগরী। প্রধান নগরের জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য এসব উপনগরী অঞ্চল গড়ে ওঠে।
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার পুনর্বিন্যাস (Dohimitation of the Rural-chan Fringe) :
করাগভারতীয় নগরগুলির ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার বাইরের ও ভিতরের নির্দিষ্ট সীমানা নির্ধারণ এশ অসুবিধাজনক। একটি নগরকেন্দ্র থেকে 10-12 কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে যেসব গ্রাম অবস্থান করে করারকে যথাযথভাবে ক্ষেত্র সমীক্ষার মাধ্যমে গ্রাম-শহর সীমান্তে পড়ছে কিনা তা দেখা দরকার। এই অঞ্চলের এই প্রশ্ন 100-200 গ্রাম অবস্থান করে। শহরকেন্দ্রগুলির সঙ্গে সীমান্তের গ্রামগুলি উন্নত সড়কপথে যুক্ত এমনকি সাইকেলে চেপে। খুব অল্প সময়ে শহরে চলে আসা যায়। শহরের বাসগুলি সীমান্তের গ্রামগুলিতে । যাতায়াত করে। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি শহরে গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার সীমানা নির্ধারণের এ করা হয়েছে। দিল্লি এবং বেঙ্গালুরু শহরে গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার বাইরের সীমানা নিম্নলিখিত।
লাগুলির সাহায্যে নির্ধারণ করা হয়েছে। যথা-10 জনঘনত্ব 400 জন/বর্গকিমি বা তার বেশি।
(i) বিগত দশকে জনসংখ্যার 40% বা তার বেশি বৃদ্ধি।
(ii) প্রতি 1000 জন পুরুষ জনসংখ্যায় ৪০০ বা তার কম স্ত্রী লোকের উপস্থিতি।
(iii) অকৃষিকাজে 50% বা তার বেশি নিযুক্ত থাকেন।
(৮) বাস পরিসেবা বা Local Train পরিসেবা থাকে।
গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, দিল্লি নগরকেন্দ্রের 8-16 km পর্যন্ত এর প্রসার ঘটেছে। আবার বেঙ্গালুরু শহরের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, শহরের বাইরের সীমানার দিকে নগরকেন্দ্র থেকে প্রায় 20 km পর্যন্ত rural-urban fringe area বিস্তৃত। Nangia গ্রাম-শহর সীমান্ত এলাকার পুনর্বিন্যাসের ছত্রে কয়েকটি নিয়ন্ত্রকের উল্লেখ করেছেন। যেমন- জনসংখ্যার ঘনত্ব, জনসংখ্যার এবং জনঘনত্বের পরিবর্তন, জনঘনত্বের আপেক্ষিক পরিবর্তন, প্রতি 1000 জন পুরুষ প্রতি নারীর সংখ্যা, মোট কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তির সাপেক্ষে জকৃষিকাজে নিযুক্ত ব্যক্তির সংখ্যা প্রভৃতি। এ ছাড়া নিকটবর্তী প্রতিবেশী-দূরত্ব (nearest neighbour distance). নির্দিষ্ট কতকগুলি রাস্তা ধরে জনবসতির বিস্তার, বাস পরিসেবা, Shuttle Service, দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ, স্থানীয় বা Local Train-এর সুবিধা এগুলিও গ্রাম শহরের সীমান্ত বা উপকণ্ঠ এলাকার সীমানা নির্ধারণে সাহায্য হয়।