গ্রামীণ বসতির গৃহবিন্যাস ভারতের উদাহরণ(Rural House types with special reference to India)
ভারতের যে-কোনো অঞ্চলের গ্রামীণ বসতির গৃহবিন্যাসে সেই স্থানের পরিবেশ, মানুষের সাস্কৃতি, সামাজিক পরিস্থিতি প্রভৃতির প্রভাব লক্ষ করা যায়। গৃহসজ্জা, গৃহের আকৃতি, গৃহের দেওয়াল ও হানের গঠন, গৃহের চারপাশে জায়গার ব্যবহার প্রভৃতি ক্ষেত্রে চিরাচরিত এবং বংশানুক্রমিক ধারার সঙ্গেঙ্গ সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়াও লক্ষনীয়। তবে এখনও উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিবাসীদের মধ্যে সেই প্রাচীন চিরাচবিং ও প্রথায় ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ আমরা দেখতে পাই। উত্তর, দক্ষিন, উত্তর-পূর্ব কিংবা পশ্চিম ভারতের গ্রামীন গৃহবিন্যাস এক-এক ধরনের হয়ে থাকে।
ভূমি নক্সা (Ground Plan):
গ্রামীণ বসতির খরগলির ভূমি নকশা (Ground Plan) লক্ষ করলে দেখা যায় যে, মানুরে বাস করাদ জন্য ন্যূনতম স্থান রাখা হয়। অধিবাসীর অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে ঘরের জায়গা, রান্না ওঠে এবং চারপাশে জায়গা ছেড়ে রাখা হয়। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত জমির মাঝখানে ঘর তৈরি করা হয়। সামনে এতে বসা ও পিছনে বেশ ফাঁকা জায়গা রাখা হয়। ঘর যদি জমির একেবারে একবারে তৈরি হয়, তাহলে বাকি দিক বেড়া দিয়ে বাড়িকে ঘিরে দেওয়া হয়। ভারতের পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া প্রায় সব গ্রামাঞ্চলে বাড়ির অন্যতম অংশ হল এর সলো অবস্থিত উঠান (Yard)। পার্বত্য অঞ্চলে পর্বতের উঁচু অংশে বাড়িগুলির বেশির ভাগ একঘর বিশিষ্ট (Single roomed) বাসগৃহ তৈরি করা হয়।
গৃহের আকৃতি (Shape of the rooms):
N. K. Bose তাঁর রচিত Peasant Life in India (Anthropological Survey of India)-প ভারতীয় গ্রামগুলিকে আকৃতি অনুসারে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেছেন। যেমন-
আয়তাকার ভূমিভাগ যুক্ত অনুভূমিক ছাদের বাড়ি (House with Rectangular Ground and Horizontal Roof)
(i) আয়তাকার ভূমিভাগযুক্ত হেলানো বা তির্যক ছাদের বাড়ি (House with Rectangular Ground Plan and Inclined Roof)
(ii) বৃত্তাকার ভূমিভাগযুক্ত শঙ্কু আকৃতির ছাদের বাড়ি (House with Circular Ground Plan and a Conical Roof)
(i) আয়তাকার ভূমিভাগ যুক্ত অনুভূমিক ছাদের বাড়ি ভারতের যেসমস্ত অঞ্চলে বছরে km-এ কম বৃষ্টিপাত ঘটে সেইসব অঞ্চলে এই ধরনের বাসগৃহ লক্ষ করা যায়। অত্যধিক খরা প্রবণ, মধু এবং মরুপ্রায় অঞ্চলেই অধিবাসীরা এই ধরনের বাসগৃহ নির্মাণ করে বসবাস করেন।
(ii) আয়তাকার ভূমিভাগযুক্ত হেলানো বা তির্যক ছাদের বাড়ি এই ধরনের বাড়ি ভারতে প্রায়ই দেখা যাচ্ছে। ভারতের যেসমস্ত অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটে সেইসব এলাকায় এই ধরনের বাড়ি নির্মাণ করা হয়। কারণ বাড়ির ছাদ যত বেশি ঢালু হবে বৃষ্টির জল তত দ্রুত ছাদ বেয়ে নিচে নেমে আসবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে, ওডিশা, তামিলনাড়ু, কেরালার উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই জাতীয় গৃহ নির্মাণ করে স্থানীয় অধিবাসীরা বসবাস করছেন।
(iii) বৃত্তাকার ভূমিভাগযুক্ত শঙ্কু আকৃতির ছাদের বাড়ি ভারতের কিছু কিছু উপজাতি এলাকায়
প্রাচীন প্রথা মেনে উপজাতিরা এই ধরনের গৃহ নির্মাণ করে। দক্ষিণ ভারতে নীলগিরির টোডা উপজাতিরা এই ধরনের গৃহে বসবাস করে। অন্ধ্রপ্রদেশের 'Chenchus' উপজাতি এবং ঝাড়খন্ডের 'Birhots' উপজাতির লোকজনও বৃত্তাকার ভূমিভাগযুক্ত শঙ্কু আকৃতির ছাদের বাড়িতে বসবাস করেন।
গ্রামের মানুষজন স্থানীয় যেসমস্ত উপাদান পাওয়া যায় সেগুলি তারা গৃহনির্মাণ কাজে ব্যবহার করে। ছের ডাল, পাতা ব্যবহার করে অনেকে তাঁবু জাতীয় গৃহ নির্মাণ করে। ভারতের কিছু কিছু পশুপালক প্রাবা সম্প্রদায় পশুর চামড়া দিয়ে তাঁবুর ছাদ ঢেকে দেয়।
ভারতের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন ডালপালা বা বাঁশের কঞ্চি ব্যবহার করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে প্রবাল তৈরি করে। এসব ঘরের ছাদ টালি কিংবা অ্যাসবেস্টস দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
গ্রামীণ বসতির পরিবেশগত দিকসমূহ(Environmental Issues in Rural Settlement):
গ্রামীন বসতির ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক অতীতে দেখা যায় যে, এখানে বেশির ভাগ জমি বনভূমি দ্বারা আবৃত রেবা বিস্তীর্ণ এলাকার জমিতে কৃষিকাজ করা হয়। প্রচুর পরিমাণে ফাঁকা জায়গা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে একে। কোনো অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষজন এবং ওই অঞ্চলের স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ড়ে ওঠে। ফলে মানুষ পরিবেশকে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। যেহেতু শহরের মতো এখানে দ্রুত প্রিতে বসতিস্থাপন কিংবা অট্টালিকা নির্মাণ চলে না সেইজন্য শহরের মতো পরিবেশগত সমস্যা গ্রামীণ প্রতিতে বেশি প্রকট হতে পারে না।
গ্রামীণ বসতিতে গৃহ নির্মাণের জন্য পরিবেশ বান্ধব দ্রব্যের ব্যবহার বেশি হয়। মাটি, খড়, টালি, বাঁশ, খো, কাঁচা, ইট প্রভৃতি দ্বারা গ্রামের মানুষ গৃহ নির্মাণ করেন। এসব বস্তু থেকে পরিবেশে কখনও দূষণ ঘটে না। কৃষিকাজ প্রধান জীবিকা হওয়ায় শিল্প-কলকারখানার সংখ্যা অনেক কম হয়। পরিবেশ দূষণের হার এজন্য গ্রামীণ এলাকায় কম ঘটে। তবে যত্র-তত্র বর্জ্য পদার্থ ফেলার ফলে ভূমি ও বায়ুতে দূষণ ছড়ায়। প্রমীণ এলাকার সুস্থায়ী উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের নীতি পালিত হচ্ছে। গৃহকাজে ব্যবহৃত বস্তুসমূহ ব্যবহারের শেষে পচে মাটিতে পরিণত হয়। চিরাচরিত গ্রামীণ সমাজে খুব কম পরিমাণে বর্জ্য পদার্থ তৈরি হয়। যে জর্জ পদার্থ তৈরি হচ্ছে সেটি আবার ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা হচ্ছে। যেমন ধান কাটার পর ড় পড়ে থাকে। এই খড় গবাদি পশু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
গ্রাম এবং শহরের মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। জনপরিসেবা গ্রামে অনেক সীমিত। সেই তুলনায় নগরে নাগরিক পরিসেবা অনেক বেশি। সরকারি নীতিরূপায়ণ, যথা পুলিশ পরিসেবা, বিদ্যালয় গরসেবা, দমকল, লাইব্রেরী, পানীয় জল প্রভৃতি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু গ্রামে এই ধরনের পরিসেবার মরা তুলনামূলকভাবে কম আছে। গ্রামে যেখানে সেখানে আবর্জনা পড়ে থাকে। পানীয় জলের সংকট, বিদ্যুৎ সংকট এবং অন্যান্য পরিসেবা এখনও কম আছে।
বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর গ্রাম উন্নয়ন দপ্তর রাস্তাঘাটের উন্নতিতে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন NGO গ্রামকে 'মডেল গ্রামে' পরিণত করেছে। টেলিফোনের পরিসেবা বিশেষ করে মোবাইল ফোনের জন্য গ্রামাঞ্চলে জনসংযোগ ব্যবস্থার বিশেষ উন্নতি ঘটেছে।
বর্তমানে গ্রামাঞ্চলেও জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে পরিবেশ দূষণ, পরিবেশের অবনমন দুটোই ঘটছে। পরিবেশ উন্নয়ন মন্ত্রক গ্রামের প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।