ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গ্রামীণ গৃহের প্রকারভেদ (Rural House types in different states of India):
ভারতের বিভিন্ন জল-আবহাওয়া ও ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চলে গ্রামীণ গৃহ নির্মাণ বিভিন্ন ধরনের হয়। এ জন্য বিভিন্ন রাজ্যে শুষ নির্মাণের নকশা কিংবা আকৃতি একই রকম হয় না।
1. পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal): পশ্চিমবাল্যের গ্রামীণ বসতির বাড়িগুলির সাধারণত চারটি কুঁড়েঘর(Hut) থাকে। উঠানের প্রায় মাঝখানে বাড়ি তৈরি করা হয়। বাড়ির বাইরে গবাদি পশুর থাকার জন্য পৃথক ঘর বা গোয়ালঘর রাখা হয়। দুটি ঘর পুরুষ ও মহিলাদের বসবাসের জন্য। একটি রান্নাঘর এবং অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য একটি ঘর 'বৈঠকখানা' হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
বাড়ির দেওয়াল সাধারণত মাটি কিংবা কাঁচা ইট দ্বারা তৈরি হয়। অনেকক্ষেত্রে দেওয়াল বাঁশ ও কব্বির সঙ্গে কাদা মিশিয়ে তৈরি করা হয়। ঘরের ছাদ টালি কিংবা অ্যাসবেস্টস দ্বারা ছাওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খড় কিংবা পাতা ঘরের ছাদ ঢাকার কাজে ব্যবহৃত হয়। কিছু মাটির দোতলা ঘরও দেখা যায়।
2. বিহার (Bihar): বিহারের গ্রামাঞ্চলে কৃষক সম্প্রদায় মাটির দেওয়ালযুক্ত কুঁড়েঘর নির্মাণ করে। কাদার সঙ্গে বিভিন্ন পদার্থ মিশিয়ে দেওয়ালকে আরও শক্ত করে তোলে। ছাদ হয় হেলানো বা তির্যক প্রকৃতির। বন্যার জলের তল থেকে বেশ কিছুটা ওপরে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়ে থাকে। গাঁয়ের কিছু ধনিক শ্রেণির লোক পাকা গৃহে বসবাস করে। বাঁশ দিয়ে কাঠামো তৈরি করেও ঘরবাড়ি এই রাজ্যে নির্মিত হয়। এখানকার ঘরগুলিতে জানালা প্রায় থাকে না বললেই চলে।
3. ঝাড়খণ্ড (Jharkhand): এই রাজ্যের গ্রামীণ বসতিগুলি বিক্ষিপ্ত ধরনের (Dispersed Type) হয়। তবে গোষ্ঠীবন্ধ বসতিও দৃষ্টিগোচর হয়। ছোটো ছোটো হ্যামলেট দেখা যায়। ঘরবাড়িগুলি ল্যাটেরাইট মাটির দেওয়াল দ্বারা তৈরি হয়। অনেক ক্ষেত্রে মাটির দ্বিতল ঘরও চোখে পড়ে।
4. ওডিশা (Odisha): ওডিশার গ্রামাঞ্চলে তিনটি দেওয়াল দ্বারা তৈরি ঘর নিয়ে বাসগৃহ গড়ে ওঠে।একটি ঘুমানোর জন্য, একটি রান্নাঘর এবং অপরটি গবাদি পশুর থাকার জায়গা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কোনো জমির এককোণে বাসগৃহ এবং অন্য তিনদিকে সবজি উৎপাদন করা হয়। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে বাসগৃহের পিছনে পৃথক ঘরে খাদ্যশস্য এবং গবাদিপশুর খাদ্য মজুত করে রাখা হয়। বাড়ির সামনে বারান্দা থাকে।
ওডিশার উপজাতি সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি একেবারে প্রাচীন ধরনের (Primitive type)। ঘরবাড়িগুলি খুব ছোটো ছোটো হয়। কাঠের দেওয়াল ও মেঝে এবং ছাদ হয় বিভিন্ন ঘাস দ্বারা ছাওয়া। কাঠের বাড়িগুলিতে দুটি করে ঘর থাকে। বন্য জন্তুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গাছের ওপর মাটি থেকে বেশ কিছুটা ওপরে ঘর তৈরি করে।
5. অস্ত্রপ্রদেশ (Andhra Pradesh): অন্মপ্রদেশ রাজ্যের অধিবাসীদের গৃহের ধরন বা প্রকৃতি একটু ভিন্ন ধরনের। বসতগৃহগুলি সাধারণত ধারাবাহিকভাবে দুটি সমান্তরাল সারি ধরে অবস্থান করে। বসত গৃহের ঘরের ছাদ 'Cholam' খড়ি কিংবা ঘাস দ্বারা আচ্ছাদিত হয়। সমস্ত বসতবাড়িগুলি প্রায় একই উচ্চতার হয়ে থাকে। সমস্ত বাড়িগুলিকে দূর থেকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো লম্বাটে ধরনের মনে হয়।
ঘরের দেওয়ালগুলি সুন্দরভাবে নকশা করে সাজানো হয়। প্রতিবছর নতুন করে ঘরবাড়িগুলি সাজানো হয়। ঘরগুলি স্ত্রীলোক এবং পুরুষের বসবাসের জন্য পৃথকভাবে ভাগ করা থাকে। বাড়ির মধ্যেই শস্যাগার সুন্দর করে তৈরি করা হয়। শস্যাগারগুলির আকৃতি অনেকটা গোলাকার হয়। রাস্তার ধার ধরে, উপকূলের ধার ধরে বসতবাড়িগুলি রৈখিক বিন্যাস সৃষ্টি করেছে।
6. তামিলনাড়ু (Tamilnadu): অঞ্চপ্রদেশ রাজ্যের মতো তামিলনাড়ু রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও রৈখিক প্রতি গড়ে উঠেছে। এই রাজ্যের পূর্বদিকে সমুদ্রের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রায় গোষ্ঠীবদ্ধ ধরনের বসতি। এজনীয়। গ্রামগুলিতে প্রচুর সংখ্যক জলাধার (Tank) আছে। অনেকক্ষেত্রে ঘরবাড়িগুলি নদীর পাড়ে কিংবা জলাশয়ের যাবে তৈরি হয়েছে
অস্তপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে গোদাবরী এবং তার উপনদী পেনগঙ্গার মধ্যভাগে রেড্ডি গ্রামগুলি Boddy Villages) অবস্থিত। গ্রামবাসীগণ এখানে ছোটো ছোটো হ্যামলেট তৈরি করে বসবাস করেন। এক-একটি বসতবাড়িতে দুটি-তিনটি করে ঘর আছে। পার্বত্য অঞ্চলে কিংবা পর্বতের উপত্যকা অঞ্চলে 12-এটি বসতবাড়ি একসঙ্গে। দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ঘরবাড়িগুলি জন্মালের প্রশ্ন লুকোনো অবস্থায় রয়েছে। নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে Badagas' নামে পশুপালকদল বাস করে। এরা প্রড়া বড়ো কুঁড়েঘরে বসবাস করে। ঘরগুলি গাছের পাতা দিয়ে ছাওয়া হয় এবং দেওয়াল বাঁশ ও মহুয়া এছের কান্ড দিয়ে ঘেরা থাকে।
টোডা নামে আরেকটি উপজাতি সম্প্রদায় নীলগিরি পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস করে। এদের বসতিতে বাটি করে কুঁড়েঘর থাকে। তিনটি ঘর বসবাসের জন্য এবং দুটি ঘর রাতে গোরু-বাছুর রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই ঘরগুলি অনেকটা ডিম্বাকার হয়। এদের উচ্চতা 1.5 মিটার, দৈর্ঘ্যা 6 মিটার এবং 3 মিটার চওড়া হয়। ঘরের মধ্যে প্রবেশ দরজাটি 100 সেমি উঁচু, 75 সেমি প্রশস্ত হয়। ঘরের মধ্যে প্রায় 2-5 বর্গমিটার জাঁকা জায়গা থাকে। ঘরের চারপাশের দেওয়াল শিথিল পাথরের টুকরো দ্বারা তৈরি হয়। গবাদি পশু রাখার জন্য স্বাদযুক্ত চালাঘর তৈরি করা হয়।
7. কেরালা (Kerala): কেরালা রাজ্যের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বসতগৃহ কাঠের তৈরি। মালাবার উপকূল অঞ্চলে এখনও অনেক ঘরবাড়ি লক্ষ করা যায় যেগুলি প্রায় 400 বছরের পুরোনো। তালগাছের পাতা দিয়ে ঘরের ছাদ ঢাকা হয়।
এখানকার বাসগৃহগুলিকে চারটি অংশে ভাগ করা হয়। যথা- (i) প্রধান বসতগৃহ (The Arappure), (৯) সদর দরজাসহ গৃহ (Gate house or Purippure), (m) দক্ষিণের অংশ (Takkentu) এবং (iv) উত্তরের আশ (Vataketu)। বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাধারণত জলাধার (Tank) তৈরি করা হয়। এমনকি বাড়ির প্রাঙ্গণে শাকসবজি এবং কিছু ফলের গাছও থাকে। ঘরগুলি আয়তাকার হয় এবং নুড়ি, গ্রানাইট, ইট, ল্যাটেরাইট মাটি প্রভৃতি দ্বারা দেওয়াল তৈরি করা হয়। ঘরের চারপাশের দেওয়াল চুনজাতীয় পদার্থ দ্বারা গ্লাস্টার করা হয়। দেওয়ালে পশু ও দেবতার ছবি এঁকে কারুকার্য করা হয়।
৪. মহারাষ্ট্র (Maharastra): মহারাষ্ট্র রাজ্যের বাসগৃহগুলি যথেষ্ট বায়ু চলাচলে সক্ষম খোলামেলা হয় এবং ঘরে পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যায়। বসতবাড়িগুলি ইটের দেওয়াল দ্বারা নির্মিত এবং এদের ছাদ জলু প্রকৃতির হয়। বাড়ির প্রবেশদ্বারের নিকট ছোটোঘর থাকে, যেখান প্রহরী সর্বদা পাহারা দেন। এই ছোট্ট ঘরটিকে 'Deori' বলা হয়। বাড়ির প্রাঙ্গণ বেশ খোলামেলা ধরনের হয়। প্রাঙ্গণের একধারে গবাদি পশু থাকে।
বাড়িগুলি দোতলা বিশিষ্ট হয়ে থাকে। প্রত্যেক মেঝেতে (floor) দুটি বা তিনটি করে ঘর থাকে। Ground Floor-এ ঘরের দেওয়ালে গণপতি, শিব এই সমস্ত দেবদেবীর ছবি এবং অন্যানা শৌখিন ছবি আঁকা থাকে। রায়ণ সম্প্রদায় অপেক্ষাকৃত ভালোমানের বাড়িতে বসবাস করেন। গ্রামের উচ্চ সম্প্রদায়ের লোকজন ইট দ্বারা নির্মিত দ্বিতলবিশিষ্ট ঘরে বসবাস করেন। কিন্তু দরিদ্র সম্প্রদায়ের লোকজন অতিসাধারণ মানের (অপরিচ্ছন্ন এবং স্বল্প আলোকযুক্ত) ঘরে থাকতে বাধ্য হন। এই সমস্ত গরিব সম্প্রদায়ের মানুষ একটি ঘরে সমস্ত পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করেন। এই ধরনের ঘরগুলি মাটির তৈরি হয় এবং গাছের পাতা দিয়ে ছাদ ঢাকা থাকে। ঘরগুলিতে একটি মাত্র দরজা ও জানালা থাকে এবং এটি প্রায় 2 মিটার উঁচু হয়। নারকেল গাছের পাতা, খড়, ঘাস প্রভৃতি ছাউনির কাজে ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন চিরাচরিত প্রথা মেনে ঘরবাড়িগুলি এভাবে আজও তৈরি করা হচ্ছে। ঘরের ছাদ কখনোই সমতল প্রকৃতির হয় না। সর্বদাই ঢালযুক্ত ছাদ নির্মাণ করা হয়।
দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলের গ্রামীণ ঘরবাড়িগুলির প্রকৃতি ভূমিঢাল দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। মালভূমি অঞ্চলের প্রান্তভাগ খাড়াঢালযুক্ত বলে এখানে তৈরি করা বাসগৃহগুলি ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কৃষক পরিবারের লোকজন বিক্ষিপ্তভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে এখানে বসবাস করেন। বাড়িগুলির পিছনে ছোটো বাগানে ভুট্টা, শাকসবজি, তামাক প্রভৃতি চাষ করা হয়।
9. গুজরাট (Gujarat): গুজরাটের গ্রামীণ বাসগৃহগুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এই যে, ঘরগুলি পরস্পর সংলগ্নভাবে অবস্থান করে এবং দুটি বাড়ির মধ্যে সাধারণ দেওয়াল (Common Wall) থাকে। পোড়ানো ইট, কাঠ এবং মাটি দ্বারা দেওয়াল তৈরি করা হয়। বাড়ির ছাদে 'Tile' বসানো হয়। বাড়িতে গৃহপালিত পশুর বসবাসের জায়গাও বাসগৃহের পাশে থাকে। অনেকক্ষেত্রে বাড়ির সামনে উন্মুক্ত বা ফাঁকা জায়গা থাকে।
প্রধান দরজা দিয়ে গৃহে প্রবেশ করলেই দেখা যায় যে, প্রথম ঘরটি Drawing Room হিসেবে ব্যবহত হচ্ছে। এর ভিতরের দিকে প্রধান বাসগৃহ অবস্থান করে। ছোটো ছোটো কুঁড়েঘরগুলিতে নিম্নবর্ণের লোকেরা বসবাস করেন। ঘরগুলি গ্রামের সীমানার দিকে অবস্থিত হয়। ছোটো কুঁড়েঘরগুলিতে প্রায় বর্গমিটার জায়গা থাকে। দুটি কুঁড়েঘর নিয়ে এক-একটি পরিবার বসবাস করেন।
10. মধ্যপ্রদেশ (Madhya Pradesh): মধ্যপ্রদেশ রাজ্যটি প্রধানত উপজাতি অধ্যুষিত। এই রাজ্যের এরকম একটি উপজাতি হল ভিল (Bhil)। এই উপজাতির লোকজন প্রধানত বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতের ঢালে বসবাস করেন। এরা কাঠের তৈরি ঘরে বসবাস করে। বিশেষ ধরনের কুঠার ব্যবহার করে এরা নিজেদের ঘর নিজেরাই তৈরি করে। কুঠার দিয়ে গাছের গুঁড়ি কেটে এবং খুঁটি পুতে বাড়ির কাঠামো তৈরি করে। এদের ঘরের ছাদ ঢাল তির্যক প্রকৃতির হয়। প্রত্যেক বছর বাড়ির ছাদ নতুনভাবে খড় দিয়ে ছাওয়া হয়।
এদের বসবাসের জন্য দুটি করে ঘর থাকে। একটি রান্না ও ঘুমানোর জন্য এরা ব্যবহার করে। অন্য ঘরটি গবাদি পশু রাখার কাজে ব্যবহার হয়। অনেকক্ষেত্রে এরা দোতলা ঘর তৈরি করে।
11. উত্তরপ্রদেশ (Uttar Pradesh): উত্তরপ্রদেশের গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলে বসবাসকারী লোকজনের বসতগৃহের ওপর স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। খুব স্বল্প জায়গায় অনেক বেশি বসতগৃহ গড়ে ওঠার কারণে বসতি-ঘনত্ব এখানে অনেক বেশি। ভূমিভাগ থেকে কিছুটা ওপরে গৃহ নির্মাণের রীতি আছে। মাটি এবং 'Kan' গৃহ নির্মাণের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পাথর ও ইট কিছু কিছু অঞ্চলে গ্রামের মানুষ গৃহ নির্মাণে ব্যবহার করেন। বাড়ির দেওয়াল মাটি দিয়ে প্লাস্টার করা হয়। গৃহের ছাদ খড় দিয়ে ছাওয়া হয়। ছাদ কিছুটা তির্যক প্রকৃতির হয়ে থাকে। গৃহের মেঝে খুবই মসৃণ ও পরিচ্ছন্ন ধরনের হয়। বাড়ির উঠোন সর্বদা পরিষ্কার থাকে। দন্ডাকৃতি, গোষ্ঠীবদ্ধ কিংবা প্রায় গোষ্ঠীবন্ধ জনবসতি এখানে লক্ষ করা যায়।
গঙ্গা-যমুনা-দোয়াবের সেচসেবিত অঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলে বসতগৃহগুলি অনেকটা দুর্গের মতো করে তৈরি করা হয়। অপেক্ষাকৃত আর্থিকভাবে স্বচ্ছল সম্প্রদায়ের মানুষজন মাটির প্রশস্ত ছাদ নির্মাণ করেন। কাঠ কিংবা খুব সাধারণ মানের টাইলসও ব্যবহার করা হয়। গরিব মানুষজন ছোটো ছোটো কুটির নির্মাণ করে বসবাস করেন। মাটির বাড়ি, খড়ের ছাউনি দিয়ে তাদের বসত গৃহ তৈরি করা হয়। উত্তরপ্রদেশের বেশির ভাগ গ্রামের মানুষ ইটের ঘর নির্মাণ করে সেই ঘর খড় কিংবা অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ছাদ ছেয়ে দেয়। প্লাবন ভূমি অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত বসতি গড়ে ওঠে।
উত্তরপ্রদেশের পূর্ব দিকের অঞ্চলের গ্রামগুলিতে প্রচুর সংখ্যক হ্যামলেট (hamlet) দেখা যায়। বসতগৃহ নির্মাণের জায়গা যত বেশি পাওয়া যায় হ্যামলেটের সংখ্যা তত বাড়তে থাকে। যেসব জায়গা বন্যার সময় প্রছে প্লাবিত হয় না সেইসব এলাকায় মানুষের বসবাস বেশি হয়। গ্রামের মানুষ কৃষিজমির কাছে বসতগৃহ নির্মাণ করে। কারণ এর ফলে তাদের কৃষিকাজে তদারকি করার সুবিধা পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশের দিয়ারা প্রমভূমি অঞ্চলে প্রত্যেক বছর বন্যা হলেও উর্বর পলিমাটি ও কৃষিকাজের জন্য মানুষ এখানে বসবাস করেন। ভারাই অঞ্চলের গ্রামবাসীদের বাড়ি নির্মাণে উপাদান সামগ্রী হল খড়, ঘাস এবং কাঠ। একটি বাসগৃহ থেকে আরেকটি বাসগৃহ বেশ দূরে দূরে অবস্থান করে। কিন্তু বসতবাড়িগুলো পাকা ঘর হলে সেগুলি বেশ কাছে কাছে থাকে। এই ধরনের বাসগৃহকে ছাপরা (Chlapras) বলে। গাঙ্গোয় সমভূমি অঞ্চলে উর্বর সমভূমি, একই ধরনের জলবায়ু এবং সমতল ভূপৃষ্ঠ থাকার জন্য গোষ্ঠীবদ্ধ বসতি গড়ে উঠেছে। বসতির স্থানগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে জল পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশের কিছু অঞ্চলে বাসগৃহগুলি অনেক দূরে দূরে অবস্থান করে। কারণ আগুন লাগলে যাতে কোনোভাবে সেই আগুন গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে না পারে।
12. উত্তরাঞ্চল: উত্তরাঞ্চলের গ্রামের অধিবাসীগণ তাদের নিজস্ব ভাবধারায় বসতবাড়িগুলি নির্মাণ করেন। এই গৃহগুলির আকৃতি এবং আয়তন ভিন্ন ধরনের হয়। বসতগৃহগুলির বিভিন্ন নাম আছে। যেমন-ভূমিন্ডা, ঝোপরা, দোপুরা ইত্যাদি।
ভূমিন্ডা বসতগৃহগুলি একতলা হয়। এগুলি খড় দিয়ে ছাদ তৈরি করা হয়। এই রাজ্যের দক্ষিণভাগে দরিদ্র সম্প্রদায়ের মানুষ ঝোপরা তৈরি করে বসবাস করে। এই ঘরগুলিতে মানুষ এবং গবাদি পশু একসঙ্গে খাকার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িগুলির ছাদ শ্লেট পাথর দ্বারা নির্মাণ করা হয়। দ্বিতল ঘরবিশিষ্ট বাড়িগুলিকে লোপুরা বলা হয়। ভূমিতলে যে দুটি ঘর থাকে তাকে 'ওবেরা' এবং ওপর তলের ঘরকে 'পান' বলা হয়। ঘরগুলির সামনে একটি করে দরজা থাকে। এই দরজাগুলিকে 'খোলি' বলা হয়। উত্তরাঞ্চলের 'Bhotiya উপত্যকায় বিভিন্ন ধরনের পাথরের দেওয়াল বিশিষ্ট বাড়ি লক্ষ করা যায়। গ্রীষ্মকালে এই ঘরে বসবাস করা খুবই আরামদায়ক। কিন্তু শীতকালে এই ঘরের ছাদে ঘাস কিংবা খড় দিয়ে ছাওয়া হয়। সাধারণত বাড়িতে দুটি থেকে চারটি ঘর থাকে। দু-একটি ঘরে গবাদি পশু রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
13. উত্তর-পূর্বের রাজ্যসমূহ: উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যসমূহ, যথা- অসম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর,মেঘালয় রাজ্যের গ্রামীণ অঞ্চলে বসতগৃহগুলি ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ আলাদা ধরনের হয়। ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত এই এলাকায় ঘটে। ফলে বসতগৃহের ছাতগুলি সবচেয়ে বেশি ঢালযুক্ত হয়। এক-একটি অঞ্চলে দুটি বা তিনটি সারি বিশিষ্ট ঘরগুলি একসঙ্গে পর পর অবস্থান করে। ঘরগুলির মধ্যেকার সারি রাস্তা হিসেবে এরা ব্যবহার করে। উপজাতি সম্প্রদায় সাধারণত ঘরগুলির অভিমুখ পূর্বদিকে রেখে তৈরি করে। গ্রামের কোনো প্রধান থাকলে তার বসতগৃহ একবারে গ্রামের মধ্যভাগে তৈরি করা হয়। বসতগৃহগুলির মেঝে ভূমিভাগ থেকে অন্তত। মিটার উঁচুতে অবস্থান করে। বেশির ভাগ বাড়ির আকৃতি আয়তাকার হয়। ঘরে ছাদের দুই দিকে ঢাল রাখা হয়। কারণ বষ্টির জল দুই দিকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অরুণাচল প্রদেশের মিশমি গ্রামে 'মিশমি' উপজাতিরা বসবাস করে। এদের বাড়িগুলি একে অপর থেকে আয় 500 মিটার দূরে দূরে অবস্থান করে। বাড়িগুলি খুব লম্বা হয়। বাঁশ, কাঠ ও বেত দ্বারা দেওয়াল এবং ঘাস দিয়ে ঘরের ছাদ নির্মাণ করা হয়। ঘরগুলির মধ্যে বিভিন্ন ভাগ থাকে। প্রত্যেক পৃথক ঘরে দম্পতিরা বসবাস করে। ঘরের মেঝে কাঠ কিংবা বাঁশ দিয়ে পাটাতন মতো তৈরি করে তার মধ্যে এরা বসবাস করে। বাড়িগুলি খুবই হালকা হয়। কারণ এগুলি ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। মিশমি উপজাতিদের ঘরে জানালা প্রায় থাকে না বললেই চলে। লম্বা ঘরগুলিতে একটি করে করিডোর থাকে। এই করিডোরগুলি যাতায়াতের পথ হিসেবে তারা ব্যবহার করে। ঘরের একদিকে এদের শস্য মজুত থাকে।
প্রত্যেকটি মণিপুরি পরিবারে বাড়িতে উঠোন থাকে। একে 'sumang' বলে। ব্রাহ্মণ পরিবারগুলিতে বাড়ির মধ্যে মন্দির থাকে। মন্দির ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে 'মণ্ডপ' তৈরি করা হয়। প্রত্যেক মণিপুরি বাড়ির পূর্বদিকে মুখ থাকে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দক্ষিণমুখি বাড়িও লক্ষ করা যায়।