জনসংখ্যার ভারসাম্য রক্ষায় কর্মসূচি (Programme to Keep balance of population)
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হন। তবে তা করা হয় পরোক্ষভাবে। বিভিন্ন পরিকল্পনাকালে সরকার আর্থসামাজিক উন্নয়নের উপর জোর দেন। শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলে জনসংখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই নিয়ন্ত্রিত হবে বলে মনে করা হয়। কিন্তু তাতে বৃদ্ধির হার হ্রাসের কখনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি, চতুর্থ পরিকল্পনাকালে (১৯৬৯-১৯৯৮) সরকার পরিবার পরিকল্পনা (Family Planing) কর্মসূচিকে রূপায়ন-এর উপর বিশেষ জোর দেন। আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহ দেওয়ার কথা বলা হয় পরবর্তী পরিকল্পনাগুলিতে।
১৯৭৬ সালে সরকার জাতীয় জনসংখ্যা নীতি (National Population Policy) ঘোষণা করেন।পরিকল্পনাকালে জন্মহার হাজারে ২৫ বা ২৫%-এ নামিয়ে আনতে লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়। ১৯৭৫-৭৭ সালে। দেশে জরুরী অবস্থা (Emergency rule) চলাকালীন জন্মনিয়ন্ত্রণে সরকার অবিচক্ষণতার পরিচয় দেন। বিভিন্ন রাজ্য সরকার গণবন্ধাত্বকরণ (Mass-Sterilization)-এর কর্মসূচি রূপায়নে সচেষ্ট হন। আর্থিক উৎসাহদান এবং পাশাপাশি প্রকল্প সার্থক করার জন্য অত্যুৎসাহের ফলে কোনো কোনো দরিদ্র শ্রেণির লোকেদের ছলে বলে কৌশলে বন্ধ্যাত্বকরণে সামিল করার প্রয়াস কোথাও কোথাও শুরু হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর ১৪ দফা-কর্মসূচি ও যুবনেতা সঞ্জয় গান্ধীর ৪ দফা কর্মসূচী রূপায়ণে স্থানীয় নেতৃত্ব ও প্রশাসন-এর অত্যুৎসাহ বিভিন্ন অঞ্চলে চাপা জনরোষের উদ্রেক করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বলপূর্বক বন্ধ্যাকরণের বিষয়টিকে আন্দোলনের হাতিয়ার করে এবং একসময় তা গণবিদ্রোহের রূপ নেয়। ফলে সমগ্র কর্মসূচিই বস্তুত ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হয়। ১৯৭৭সালে কেন্দ্রীয় সরকারের পতনের অন্যতম কারণ ছিল এটি। ১৯৭৭ নতুন সরকার ক্ষমতায় এলে বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাত্বকরণের কর্মসূচি অবিলম্বে ত্যাগ করা হয়। বিকল্পে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে 'স্বেচ্ছামূলক" রেখে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি (Programme of National Importance) হিসেবে রাখা হয়। বিভিন্ন সময়ে সরকার জন্ম নিয়ন্ত্রণসহ পরিবার পরিকল্পনা সফল করার লক্ষে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এগুলি হল-
• রাজ্য সরকারগুলিকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি রূপায়নে নিজস্ব নিয়ম নীতি নির্ধারণে স্বাধীনতা দেওয়া।
• পরিকল্পনাখাতে কেন্দ্রীয় সহায়তায় ৮ শতাংশ পরিবার পরিকল্পনা রূপায়নে খরচ করতে নির্দেশ দেওয়া।
• বিবাহের বয়স ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে ১৮৮ ন্যূনতম করা হয়।
• দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প হিসেবে নারী শিক্ষাসহ সমগ্র শিক্ষার প্রসার ঘটানো।
• জন্মমৃত্যু হার নিয়ন্ত্রণে সার্বিক শিক্ষার বিস্তারের পাশাপাশি মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষার প্রকল্প গ্রহণ।
• 'ছোট পরিবার, সুখী পরিবার' এরূপ প্রচারাভিযান জোরদার করা এবং গণযোগাযোগ ব্যবস্থার সাহায্য নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া।
• জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহারে উৎসাহমূলক প্রচার চালানো।
• বন্ধত্বাকরণ কর্মসূচির সাহায্য নেবেন এমন দম্পত্তির জন্য 'আর্থিক উৎসাহদান'-এর ব্যবস্থা করা। তবে এর পরিমাণ বর্তমানে অতি সামান্যই।
• 'পরিবার কল্যাণ কর্মসূচি' (Family Welfare Programme) গ্রহণ করে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহ দানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
উপরিউক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণের ফলে বিভিন্ন আদমসুমারীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে দেখা যায়। ১৯৮১ সালে বৃদ্ধির হার যেখানে ছিল ২-৩৫ শতাংশ, ১৯৯১ সালে তা নেমে হয় ২ শতাংশ এবং ২০১১ এই হার ২ শতাংশের নিচে নেমে বর্তমানে ১-৭৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে ১০০ কোটির অধিক জনসংখ্যার দেশে ১-৭৬ হারে জনসংখ্যার বৃদ্ধির অর্থ বছরে প্রায় ২ কোটি লোকসংখ্যা যোগ।
চিন তার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নীচে নামিয়ে এনেছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ দিষি প্রচিত্তে চালু করে এবং সর্বদা জনসংখ্যা নীতি রূপায়ণ করায় বিশেষ অতন্দ্র প্রহরায় থেকে এই সাফল্য এনেছে। ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে জন্মহার এখনই এতটা কমানো সম্ভব না হলেও সার্বিক শিক্ষার প্রসার ঘটিয়ে, জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহ দানের জন্য দেখেও অয়ারসহ অন্যান্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ও রূপায়নে সচেষ্ট থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসে আরও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া সম্ভব