জনসংখ্যা বিষয়ক তথ্য (Population Information):
ভারতে পৃথিবীর মোট স্থলভাগের মাত্র ২.৪ শতাংশ এলাকা রয়েছে, কিন্তু পৃথিবীর সমগ্র জনসংখ্যার ১৬.৭ শতাংশ লোক বাস করেন ভারতে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশ ভারতবর্ষ যার সমগ্র লোকসংখ্যা ২০০১-এর আদমসুমারী অনুযায়ী ১০২.৭ কোটি। এর মধ্যে পুরুষ ৫৩.১ কোটি ও নারী সংখ্যা ৪৯.৬ কোটি। এটি অনুমিত যে ভারতের জনসংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যেই চিনের জনসংখ্যাকে (বর্তমান যা প্রায় ১২৭ কোটি) অতিক্রম করবে। কেননা চিনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার এখনই প্রায় ১ শতাংশ। কিন্তু ভারতে প্রায় ২ শতাংশ বৃদ্ধির হার।
দেশের ৩৫টি শহরের জনসংখ্যা ১০ লক্ষ অতিক্রম করেছে যাদের মোট জনসংখ্যা ১৭.৭৯ কোটি। পৌরজনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশে বাস করে বস্তি অঞ্চলে যা মোট পৌরজনসংখ্যার ২২.৫৮ শতাংশ। এই বস্তি অঞ্চলে জীবনযাত্রার মান খুব নিম্ন এবং নাগরিক সুখ-সুবিধাও এখানে সাধারণত নিম্নমানের।
উল্লেখ্য, ১৯৮১-১৯৯১ এই দশ বছরে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে ০.০৮ শতাংশ এবং ১৯৯১-২০০১ সালে তা আরো ০.২১ শতাংশ হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ২ শতাংশ-এর নীচে এসেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরো হ্রাস পাবে। এর ফলে দেশে জনপ্রতি আয়, সামগ্রিক শিক্ষাসহ নারী ও শিশু শিক্ষা, নারীদের অর্থনৈতিক কাজকর্মে অধিকতর যোগদান, পৌরায়ণের ফলে নাগরিক সুখ সুবিধা বৃদ্ধি পাবে। দেশে জনপ্রতি কৃষি ও শিল্পোৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটবে। দরিদ্র জনসংখ্যা কমবে। শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারিত হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে উল্লেখণীয় অগ্রগতি ঘটবে। এর অনুকূল প্রভাব ঘটবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে।
জনসংখ্যার সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য শিক্ষা, স্বস্থ ও অন্যান্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ ছাড়াও গৃহ নির্মাণ ও পুনর্বাসনের দিকে লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে।
নারী জনসংখ্যার অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে উন্নয়ন এবং পুরুষের সঙ্গে সমমর্যাদা দানের কথা বলা হয়েছে। প্রশিক্ষণের ও আর্থিক সহযোগিতা দানের কর্মসূচী গ্রহণ করে অধিক সংখ্যায় নারীদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজ হচ্ছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা ও সমান সুযোগ করে দেওয়া এবং বিভিন্ন উন্নয়মূলক কর্মসূচিতে এদের অংশগ্রহণ এরূপ ব্যক্তিদের আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেছে। চাকুরি ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করে এরূপ জনসংখ্যাকে মানব সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে অগ্রগতি ঘটছে।
তফশিলিজাতি ও জনজাতি জনসংখ্যার জন্য শিক্ষা ও চাকুরিতে সংরক্ষণের সুযোগ চালু রেখে তাদের উন্নয়ন ঘটানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। আদিবাসী কল্যাণে বিবিধ প্রকল্প গ্রহণ করে, আদিবাসী এলাকা উন্নয়নের বিষেষ কর্মসূচী নেওয়ায় ভারতের এরূপ মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটছে।
মানবোন্নয়নের সঙ্গে শিক্ষা কীভাবে সম্পর্কিত?
মানবোন্নয়নে শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণঃ
ক. জনপ্রতি আয় ও জীবনযাত্রার মানের ওপর প্রভাবঃ অশিক্ষিত, নিম্নসাক্ষর জনসাধারণ উন্নততর জীবিকা অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। শ্রমিক শ্রেণির এই জনগণ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকেন। জনপ্রতি আয় কম হওয়ায় তাদের জীবনযাত্রার মান নিম্ন হয়। শিক্ষার উন্নততর পর্যায়ে মানুষ অধিকতর অর্থকরী কাজের সুযোগ পান। ফলে জনপ্রতি আয় বাড়ে এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ঘটে।
খ. পুষ্টি ও স্বাস্থের ওপর প্রভাবঃ শিক্ষা সচেতনতা আনে। সুষম খাদ্য, সুচিকিৎসা সম্পর্কে অবহিত করে। শিক্ষার অভাব যে সকল দেশে আছে, সেখানে পুষ্টির অভাবে জনসাধারণের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষীণ স্বাস্থের অধিকারী। শিশু মৃত্যু হারও এই সকল দেশে বেশি। গড় পরমায়ুও এদের কম। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শিক্ষার অভাবে এই প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। উন্নত দেশগুলিতে উন্নত শিক্ষান্তরের জন্য এর বিপরীত চিত্র দেখা যায় অর্থাৎ মানবোন্নয়নের মান উন্নততর হয়।
গ. মরণশীলতা ও গড় প্রত্যাশিত আয়ুর ওপর প্রভাবঃ শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ পুষ্টি ও স্বাস্থ সম্পর্কে সচেতন। উপযুক্ত সময়ে নির্দিস্ট টীকাকরণের দ্বারা রোগ প্রতিরোধে সচেষ্ট হন। ফলে মরণশীলতার হার শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে কম। এটি গড় প্রত্যাশিত আয়ু বৃদ্ধি করে।
▲ ভারতে মানবোন্নয়নের মূলবৈশিষ্ট্য (Salient Features of Human Development of India)
(১)HDI Rank: HDI Rank এ সর্বশীর্ষে রয়েছে নরওয়ে দেশ। এই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিরিখে HIDI ০.৯৪৪। ভারতের HDI Rank বিশ্বের মোট ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১২৯ (২০১৯)। HDI মানের দিকে থেকে এই দেশ মধ্যম শ্রেণিভুক্ত। ভারতের HDI মান ০.৫৯০। সবচেয়ে কম সিয়েরালিওন ০.২৭৫।
(২) প্রত্যাশিত গড় আয়ু (Life Expectancy at Birth): এটি জন্ম সময়ে মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে নির্দেশ করে। জীবনসারণী থেকে এটি তৈরি হয়। প্রত্যাশিত গড় আয়ু বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন। উচ্চ শিশু মৃত্যু বা কম বয়সে মৃত্যু প্রত্যাশিত গড় আয়ু হ্রাস করে। আবার শিশু মৃত্যু বা কম বয়সে মৃত্যু হার কম হলে প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধি করে। এছাড়াও উপযুক্ত স্বাস্থ ও পুষ্টি সব বয়সে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে যার অনুকূল প্রভাব পড়ে প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে। প্রত্যাশিত গড় আয়ুতে শীর্ষে আছে জাপান।
(3) বয়স্ক শিক্ষার হার (Adult Literacy Rate): বয়স্ক শিক্ষার হার যেখানে ৯৯ শতাংশ-এর ওপর নরওয়ে, সুইডেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা ব্রিটেনের মতো দেশগুলিতে হয়েছে সেখানে ভারতে এই হার ৫৮ শতাংশ
(৪)জনপ্রতি জাতীয় উৎপাদন (GDP Per Capita): GDP (Gross Demestic Product) বা জনপ্রতি মোট জাতীয় উৎপাদন সবচেয়ে বেশি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। এদেশে জনপ্রতি GDP Per Capita ৫৭,৪০০ ডলার (২০১৬)। উন্নয়নশীল দেশ ভারতে জনপ্রতি GDP Per Capita হল মাত্র ৬,৬০০ ডলার (২০১৬)।
• দারিদ্রসীমা (Poverty line): ভারতে দারিদ্রসীমা ধরা হয় গ্রামাঞ্চলে জনপ্রতি দৈনিক ২৬ টাকা এবং শহরাঞ্চলে জনপ্রতি দৈনিক ৩২ টাকা। অর্থাৎ এর নীচে উপার্জনকারী ব্যক্তিরা গ্রাম ও শহরে দরিদ্র বলে সরকারীভাবে বিবেচিত হয়।
রাষ্ট্রপুঞ্জ (United Nations) কিন্তু ১.২৫ ডলার অর্থাৎ জনপ্রতি দৈনিক প্রায় ৯০ টাকার নীচে উপার্জনকারী ব্যক্তিদের দরিদ্র বলে বিবেচনা করে থাকে।
• BPL ও APL: উক্ত আয় সীমার উপরে (জনপ্রতি দৈনিক ২৬ টাকা ও ৩২ টাকা) যারা থাকেন তারা ভারতে APL (Above Poverty line) এবং নীচে যারা থাকেন তার BPL (Below Poverty line) তালিকাভুক্ত। গ্রামে জনপ্রতি দৈনিক ২৪০০ ক্যালরি ও শহরে দৈনিক ২১০০ ক্যালরি খাদ্য ক্রয়ক্ষমতার নিম্নে যারা রয়েছেন তারা দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন।
GDP-Gross Demestic Product (মোট জাতীয় উৎপাদন)
• BPL- Below Poverty Line (দারিদ্র সীমার নীচে)
APL- Above Poverty Line (দারিদ্র সীমার উপরে)
•MPI-Multi Dimensional Proverty Index: দারিদ্রের মাত্রা নির্ধারণের জন্য এই সূচকটি ব্যবহৃত হয়। এর পরিমাপকগুলি হ'ল স্বাস্থ্য (শিশু মরণশীলতা, পুষ্টি), শিক্ষা (বিদ্যালয় শিক্ষার সময়কাল ও নাম নথিভুক্তকরণ), জীবনযাত্রার মানসমূহ (পানীয় জল, প্রয়ঃ প্রণালী, বিদ্যুৎ সংযোগ, রান্নার জ্বালানী, গৃহের মেঝে এবং গৃহস্থালীর অন্যান্য সম্পদসমূহ ইত্যাদি)।
•HPI- Human Proverty Index বা মনুষ্য দারিদ্র সূচক তিনটি পরিমাপকের উপর নির্ভর করে: আয়ুষ্কাল (Longevity) জ্ঞান (Knowledge) এবং জীবনযাত্রার মান (Standard of Living)। পূর্বে HPI দারিদ্র পরিমাপের সূচক হিসেবে প্রচলিত ছিল। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে MPI দারিদ্র পরিমাপক সূচক হিসেবে অধিকতর গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। উভয় সূচকেই ভারত সহ উন্নয়নশীল দেশগুলির মান বিশ্ব তালিকায় অনেক নীচের দিকে রয়েছে।