ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃদ্ধি(Population Growth in Historical Perspectives):
মানুষ সামাজিক জীব। সুপ্রাচীনকাল থেকে বর্তমানের নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা পর্যন্ত মানুষ দলবদ্ধভা সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলেছে। প্রাচীনকালে জনসংখ্যা যেমন কম ছিল, তেমনি সম্পদের জোগান ফ্রি অফুরন্ত। কিন্তু বর্তমানে সম্পদের জোগান অপেক্ষা জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতীতে মানুষ কোথ বসবাস করত, কী খেত, কীভাবে তারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত করত প্রভৃতি বিষয়গুলি জন্য হলে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট জানা দরকার। এই প্রেক্ষাপট থেকে জনসংখ্যার গতিপ্রকৃতি ইতিহাস আমরা বিশ্লেষণ করতে পারবো।
■ অতীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population Growth in the Past): আজ থেকে প্রায় 10 লক্ষ্য থেকে 15 লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীগণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইতিহাসকে নিম্নলিখিত পর্যায়ে ভাগ করেছেন।
(i) প্রাগৈতিহাসিক যুগ (সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আদি অধ্যায়) (Pre-Historic Age): প্রায় 10 লক্ষ বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম মানুষের (হোমো স্যাপিয়েন্স) আবির্ভাব ঘটেছিল। এই আদিম মানুষের অস্থির সন্ধান পাওয়া গেছে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায়।
অধিকাংশ নৃবিজ্ঞানীদের মতে, আদিম মানুষের প্রথম আবির্ভাব ঘটে পূর্ব গোলার্ধের বিভিন্ন স্থানে। প্রায় 15,000 বছর আগে ইউরোপে হোমো স্যাপিয়েন্সদের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমেরিকাতে প্রায় 25,000 বছর আগে হোমো স্যাপিয়েন্সদের দেখা গেছে।
আগুনের ব্যবহার, পাথর ও ধাতু থেকে অস্ত্র নির্মাণ প্রভৃতির মাধ্যমে সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু হয়। এই সময় মানুষ শিকার ও খাদ্য সংগ্রহকে (Hunting and food gathering) কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। জন্মহার ও মৃত্যুহার দুটোই খুব বেশি থাকায় জনসংখ্যার খুব একটা বৃদ্ধি ঘটেনি। এই সময় পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় 35 লক্ষ। খ্রিস্টের জন্মের ৪০০০ বছর আগে (8000 BC) প্রায় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বিক্ষিপ্তভাবে মানুষের বসবাস ছিল। এই সময় জনসংখ্যা ছিল প্রায় 10 মিলিয়ন। কৃষিকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায়।
খ্রিস্টীয় যুগের সূচনাপূর্বে পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় 280 মিলিয়ন। এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল 0.06%। কিন্তু যদি আমরা পরবর্তী 1650 খ্রিঃ-1750 খ্রি: পর্যন্ত সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার হবে 1.9%। প্রস্তর যুগে (Stone Age) মানুষের পরিবারের সদস্য-সংখ্যা কম ছিল। 6 থেকে 12 জন নিয়ে এক-একটি পরিবার গড়ে উঠত। যেসব জায়গায় মানুষের খাদ্যের জোগান বেশি ছিল সেইসব স্থানে মানুষ বেশি বসবাস করত। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে ছিল, কিন্তু এশিয়া মহাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(ii) প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে প্রাচীন যুগ (Prehistoric to Ancient Times): এশিয়ার রিমল্যান্ড অঞ্চলে এবং আমেরিকার বিভিন্ন এলাকাতে কৃষিকাজ শুরু হয়েছিল। এই কৃষিকাজে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ প্রতি বর্গকিমিতে 2 থেকে 3 জন বসবাস করত। কিন্তু জমির উর্বরতা কমতে থাকায় কৃষিজীবী মানুষ বিভিন্ন স্থানে চলে যেতে বাধ্য হন। কৃষিতে বিপ্লব সাংস্কৃতিক বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায়ের সূচনা করে।
খ্রিস্টপূর্বাব্দ 4000 বছরের পর (4000 B.C.) নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার পত্তন ঘটে। কৃষিকাজে দ্রুত উন্নতি ঘটে এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে এশিয়া, মধ্য এশিয়া ও চিন দেশে দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
এই সময় থেকে কয়েকটি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল বেশ উল্লেখযোগ্য। পারস্য সাম্রাজ্যের অস্তিত্বের সময় (550-425 B.C), এথেন্সে Percilean Age (5th Century, B.C), ভারতে অশোকের রাজত্বকাল (3rd Century B.C), রোমান সাম্রাজ্যে Augustan-এর সময় (1st century A.D) এবং চিনে হান সভ্যতার যুগে (202 BC-A.D. 220) পৃথিবীর জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার খুব বেশি ছিল।
পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে খুব স্বল্প জনসংখ্যার বসবাস ছিল। পশুপালক যাযাবর (Pastoral Nomads) এশিয়ার স্টেপ অঞ্চলে এবং উত্তর আমেরিকার প্রেইরী অঞ্চল জুড়ে বসবাস করত। ইউরোপের আল্পস পার্বত্য অঞ্চলে কিছু উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এই সময় রোমান আদমশুমারি যথাযথ ছিল না। এমনকি চিন এবং আমেরিকার সাম্রাজ্যেও জনসংখ্যার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। রোমান সাম্রাজ্যে (A.D. 14) মোট জনসংখ্যা ছিল 70 মিলিয়ন।
(iii) প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত (The Ancient to Medieval Period, A.D. 0 to 1650): খ্রিস্টাব্দের শুরুতেই সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল 133 মিলিয়ন থেকে 300 মিলিয়ন। এই সময়কাল ছিল গ্রিক-রোমান যুগ (Greek-Roman Period)। সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল এই যুগের সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
পৃথিবীর তিনটি অঞ্চলে সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল- (1) হান বংশের নেতৃত্বে চিন সাম্রাজ্যের বিছ (11) ভারতে অশোকের নেতৃত্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং (iii) ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অবল। রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে।খ্রিস্টীয় 2 সালে চিনের জনসংখ্যা ছিল 57.7 মিলিয়ন। সম্রাট অগাস্টাসের রোমান সাম্রাজ্যের জল * মিলিয়ন। এই সময় মধ্য এশিয়াতে প্রায় ৪ মিলিয়ন লোক বসবাস করত। মধ্যপ্রাচ্য এবং মেসোপারে ছিল 54 অঞ্চলে যথাক্রমে 18-19 মিলিয়ন এবং 9.1 মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল।
■ মধ্যযুগে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population growth during Medieval Period): প্রায় 600 শেষভাগ থেকে আধুনিক যুগের সূচনা পূর্বে (1650 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল।
মিয়ি দুর্ভিক্ষ প্রশ্ন পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় আগের তুলনায় দ্বিগুণ বেড়েছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সময় যুদ্ধবিগ্রহ, কারণে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেনি। কিন্তু চিন। ও ভারতের জনসংখ্যা এইসময় যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। 1600 খ্রিষ্ণু চিনে প্রায় 150 মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল।
মধ্যযুগে আল্পস পার্বত্য অঞ্চল এবং কার্পেথিয়ান অঞ্চলে কৃষিকাজের উন্নতির জন্য জনসংখ্যার পেয়েছিল।
■ আধুনিক যুগ (After 1650 to Present Time): 1650 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে বর্তমান ও সময় আধুনিক যুগের অন্তর্গত। এই সময়ের মধ্যেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব ঘটে। নগরায়ণ দ্রুতগতিতে ২ বিশ্বে চলতে থাকে। এর ফলে সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যাও দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
(1) 1650 খ্রিঃ-1900 খ্রি: অষ্টাদশ শতকে ইংলন্ডে ঘটে শিল্পবিপ্লব। নগরায়ণ প্রক্রিয়া সমগ্র। জুড়ে চলতে থাকে। এর ফলে এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল খুব দ্রুত। 1650 খ্রিস্টাব্দে সমগ্র বিং জনসংখ্যা ছিল 96 মিলিয়ন। কিন্তু 1900 খ্রিস্টাব্দে এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় 410 মিলিয়নে বেশি। মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি এবং মৃত্যুহার কমে যাওয়ার ফলেই জনসংখ্যার বৃদ্ধি যা থাকে।
এই সময় আফ্রিকা মহাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল। অধিক। ও মৃত্যুহার, কৃষিকাজে অনুন্নতি প্রভৃতি আফ্রিকা মহাদেশের স্বল্প জনসংখ্যার কারণ, এই সময় এশিয়া মহাদে জনসংখ্যা ছিল 985 মিলিয়ন। উত্তর আমেরিকা মহাদেশে এই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বে ছিল। 1700 খ্রি:-1800 খ্রি: পর্যন্ত সমগ্র বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল 2.5%। ইউরোপ মহাদে মোট জনসংখ্যা এই সময়ে ছিল 411 মিলিয়ন। 1850 খ্রি:-1950 খ্রি: এই সময়ের পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃধি হার ছিল 0.75%।
(ii) 1900 খ্রি:-1950 খ্রি:: 1900 খ্রিস্টাব্দ-1950 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীর জনসংখ্যা 1.6 বিলি জনসংখয় থেকে বৃদ্ধি পেয়ে 2.5 বিলিয়ন অতিক্রম করেছিল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় 9%। এই সম্য মধ্যেই প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদধ সংঘটিত হয়। ফলে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারি প্রভৃতির জন্য অসংখ্য মানুষ মৃত্যু ঘটে। তা ছাড়া এই সময় ইউরোপ তথা সমগ্র বিশ্ব অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মন্দার কবলে পড়ে। এসবের মিলিত প্রভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি খুব দ্রুতগতিতে ঘটেনি।
ইউরোপ মহাদেশের জনসংখ্যা এই সময় ছিল 594 মিলিয়ন। এশিয়ার জনসংখ্যা 1350 মিলিয়নে বেশি দেখা যায়। আফ্রিকা মহাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ৩৭%।
(iii) 1950 খ্রিস্টাব্দের পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি: 1950 খ্রিস্টাব্দের পর থেকে তৃতীয় বিদে দেশগুলিতে তীব্র জনসংখ্যা বিস্ফোরণ (Highly Population Explosion) ঘটতে থাকে। কিন্তু উন্নত দেশগুলি যেমন- ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের জনসংখ্যা অনেকটা স্থিতিশী ছিল। 1950 খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিল 2.4 বিলিয়ন। (1999 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি গে হয়েছিল 5.98 বিলিয়ন। এই সময়ের মধ্যে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা প্রায় দুই গুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল)।
1950 খ্রিস্টাব্দের পর সমগ্র বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশেই এই সময় জনসংখ্যা বৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হয়েছিল। 1999 খ্রিস্টাব্দে এশিয়া মহাদেশে জনসংখ্যা 3.62 বিলিয়ন এবং আফ্রিকা মহাদেশে জনসংখ্যা 3.62 বিলিয়ন এবং আফ্রিকা মহাদেশে জনসংখ্যা ছিল 7.75 মিলিয়ন। এশিয়া মহাদেশে এবং আফ্রিকাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল যথাক্রমে 2.5% এবং 3%।