জনসংখ্যার গতিশীলতা প্রাকৃতিক কারণসমূহ (Physical Factors)
জনঘনত্বের তারতম্যের প্রাকৃতিক কারণগুলি হল-
(i) জলবায়ু (Climate):
জলবায়ু জনবসতিকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। মনোরম এবং স্বাস্থ্যকর জলবায়ুযুক্ত এলাকায় স্বাভাবিকভাবে বেশি ঘনবসতি লক্ষ করা যায়। চরমভাবাপন্ন মরু জলবায়ু অঞ্চলে অথবা শীতল মেরু অঞ্চলে বিরল বসতি লক্ষ করা যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে অধিক উয়তা ও বৃষ্টিপাত কৃষিকাজের বিশেষ উপযোগী। ফলে এসব অঞ্চলে অত্যন্ত ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির অধিক উন্নতা এবং অত্যল্প বৃষ্টিপাত কৃষিকাজে প্রতিকুলতা সৃষ্টি করেছে। ফলে ওইসব অঞ্চল অত্যন্ত বিরল বসতিপূর্ণ। অবশ্য মিশরের নীলনদ অববাহিকায় জলবায়ু বুক্ষ প্রকৃতির হলেও কৃষিকাজে উন্নতির জন্য এখানে ঘনবসতি লক্ষ করা যায়। ভারতের হিমালয় সংলগ্ন পার্বত্য অঞ্চলে অত্যধিক শীতলতার জন্য বিরল বসতি গড়ে উঠেছে। আবার সমুদ্রের উপকূলবর্তী কিংবা সমভূমি এলাকায় সমভাবাপন্ন জলবায়ু বিরাজ করে বলে খুব ঘনবসতি গড়ে ওঠেছে।
(ii) মৃত্তিকা (Soil):
মৃত্তিকার উর্বরতার ওপর কোনো অঞ্চলের কৃষির উন্নতি নির্ভর করে। আবার কৃষি জনবসতির ঘনত্বকে প্রভাবিত করে। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নদীর অববাহিকা অঞ্চলে বসবাস করে। সমগ্র এশিয়ায় পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার 60 ভাগ মানুষ বাস করে। কারণ ওই অঞ্চলের উর্বর পলিমৃত্তিকা ধান উৎপাদনের সহায়ক। অন্যদিকে ভারতে থর মরুভুমি, মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমি এবং আফ্রিকার সাহারা মরুভূমির মৃত্তিকা বালুকাময় ও অনুর্বর। সেই কারণে এসব অঞ্চলে জনবসতি ঘনত্ব কম হয়। তবে মনে রাখা দরকার শিল্প এবং ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নয়নের আগে মৃত্তিকা জনবসতিকে প্রভাবিত করার যে ক্ষমতা ছিল, বর্তমানে তা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। যে অঞ্চলে মৃত্তিকার উৎপাদন ক্ষমতা কম, সেই সব অঞ্চলেও বর্তমানে ঘনবসতি দেখা যায়। এর মূল কারণ হল খনিজ সম্পদের প্রাচুর্য কিংবা শিল্প ও ব্যবসাবাণিজ্যের বিস্তৃতি। এ প্রসঙ্গ্যে মধ্যপ্রাচ্যের খনিজ তেল উত্তোলক অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য।
(iii) ভূপ্রকৃতি (Physiography):
যে-কোনো অঞ্চলের জনবসতির বিন্যাস, ঘনত্ব প্রভৃতি ভূপ্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়। বন্ধুর পার্বত্য অঞ্চল কিংবা মালভূমি অঞ্চলে জনবসতির ঘনত্ব সাধারণত কম হয়। অন্যদিকে নদী অববাহিকা, বদ্বীপ অঞ্চল, উপকুলীয় সমভূমি এবং পার্বত্য এলাকার উপত্যকায় কিংবা কিছুটা সমতল ক্ষেত্রে ঘন জনবসতি লক্ষ করা যায়। সমতল ক্ষেত্রে কৃষির উপযোগী জমি তৈরি সহজ হয়। সমতলক্ষেত্রে মৃত্তিকার গভীরতা বেশি হয়। তা ছাড়া যানবাহন ব্যবস্থা সহজে গড়ে তুলে ব্যাবসাবাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের পরিধি বিস্তৃত করা যায়। অর্থাৎ, মানুষ সমতলভূমিতে সহজে জীবনযাপনের উপযুক্ত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চালাতে পারে।
অন্যদিকে বন্ধুর পার্বত্য বা মালভূমি অঞ্চলে সহজে সড়কপথ বা রেলপথ তৈরি করা যায় না। আবার এসব অঞ্চলে নদনদী খরস্রোত হয় বলে নদীপথে পরিবহণ ব্যবস্থাও গড়ে তোলা সহজসাধ্য নয়। কৃষিজমির অভাব, ভূমিক্ষয় ধ্বংস প্রভৃতি কারণে মানুষের জীবনযাত্রা ঝুঁকিবহুল হয়। এ সবকারণে বন্ধুর পার্বত্য অঞ্চলে ঘনজনবসতি গড়ে ওঠে না। পৃথিবীর বিরলবসতি পূর্ণ অঞ্চলগুলির মধ্যে দুর্গম ও বন্ধুর পার্বত্য এলাকা পড়ে। এ প্রসঙ্গে হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, রকি ও আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চল প্রভৃতির উল্লেখ করা যায়।
(iv) নদনদী (River):নদনদী এবং হ্রদকে কেন্দ্র করে জনবসতির বিস্তার লক্ষ করা যায়। নদনদী এবং হ্রদ থেকে পানীয় জল এবং শিল্পে ব্যবহৃত জল মানুষ সংগ্রহ করে। কোনো অঞ্চলের শিল্পায়ন এবং পরিবহণ ব্যবস্থায়ও নদনদী ও হ্রদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন কালে তাই নদনদী কিংবা হ্রদকে কেন্দ্র করেই জনপদগুলি গড়ে উঠেছিল। তাই আমরা দেখি নদী বা হ্রদের মিষ্টি জল ব্যবহার করে নীলনদের উভয়তীরে ঘনবসতি গড়ে উঠেছে।
এই অঞ্চলে প্রায় প্রতি বর্গকিমিতে ৪4 জন মানুষ বসবাস করে। তবে এর মানুষ-জমির অনুপাত 2426 জন। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের হ্রদ অঞ্চলের মানুষ বৃহৎ পঞ্চহ্রদে সুলভ জলপরিবহণ এবং জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলেছে।
(v) স্বাভাবিক উদ্ভিদ (Natural Vegetation):স্বাভাবিক উদ্ভিদ থেকে মানুষ সম্পদ সংগ্রহ করে। কিন্তু পৃথিবীর ঘন নিরক্ষীয় অরণ্য অঞ্চলে প্রতিকূল জলবায়ুর জন্য ঘনবসতি গড়ে ওঠেনি। আবার উত্তর গোলার্ধের শীতল নাতিশীতোয় অঞ্চলের সরলবর্গীয় অরণ্যের নরম কাঠকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠশিল্প, কাগজ শিল্প প্রভৃতি নানা শিল্প ওইসব অঞ্চলে ঘনবসতি গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।