পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প(Petro-chemical Industry)
পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প কী
এটি একটি দ্রুত বিকাশশীল শিল্প। হাইড্রো-কার্বনের রাসায়নিক সংশ্লেষের দ্বারা বিভিন্ন দ্রব্য প্রস্তুত হয়। উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল পেট্রো-রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ন্যাপথলিন, কৃত্রিম রবার, রেয়ন, প্লাস্টিকের কাঁচামাল প্রভৃতি। তৈল-শোধনাগারগুলির অবস্থান ও বাজারের সুবিধা এই শিল্প স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
পৃথিবীর খনিজ তৈলক্ষেত্রগুলির কেন্দ্রীভবন ও পেট্রো-রসায়ন শিল্পের কেন্দ্রীভবনের মধ্যে এক আকর্ষণীয় বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। শিল্পোন্নত কয়েকটি দেশ ছাড়া এই শিল্পে তেমন উল্লেখযোগ্য উন্নতি চোখে পড়ে না। খনিজ তেল সমৃদ্ধ আরবে এই শিল্প খুব সামান্যই গড়ে উঠেছে, যেখানে এই অঞ্চলের খনিজ তেল কিনে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স এই শিল্পে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে। ভারতেও সামগ্রিকভাবে এই শিল্পে উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পেট্রো-রসায়ন দ্রব্য উৎপাদক দেশ। জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন এই শিল্পে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দেশ।
ভারতে পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পের অবস্থানে কাঁচামালের ভূমিকাঃ
পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পে দু'ধরনের কাঁচামাল প্রয়োজন হয়- (i) ব্রুড তেল এবং (ii) ক্রুড তেলের উপজাত দ্রব্যসমূহ।
(i) ক্রুড তেল: এটি পরিশোষিত করে ব্যবহৃত হয়। পরিশোধন প্রক্রিয়ায় বহু উপজাত দ্রব্য প্রস্তুত হয়। পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন ও গ্যাস উৎপাদিত হয়। এজন্য ভারতের খনিজ তেল পরিশোধনাগার সন্নিহিত অঞ্চলে অধিকাংশ পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প অবস্থিত। উদাহরণ-ট্রম্বে, কয়েলি, চেন্নাই, বনগাইগাঁও ও হলদিয়া পেট্রোলিয়াম শোধনাগারগুলির কাছে গড়ে ওঠা পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পসমূহ।
(ii) ক্রুড তেলের উপজাত দ্রব্যভিত্তিক কাঁচামাল: কুড তেলের উৎপন্ন দ্রব্যগুলির মধ্যে পেট্রোল, ডিজেল, গ্যাস প্রভৃতি ছাড়াও পীচ বা অ্যাসফাল্ট, মোম, প্যারাফিন, ন্যাপথা, ভেসলিন, কোক, স্যাকারিন,কৃত্রিম তন্তু, কৃত্রিম রবার, গক প্রভৃতি। এগুলির ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে পেট্রো-রাসায়নিক সার (যেমন-ন্যাপথাভিত্তিক সার), কীটনাশক, ঔষধ, প্রসাধনী, কৃত্রিম রবার, কৃত্রিম রেয়ন, প্লাসটিক, পিভিসি পাইপ, সীট প্রভৃতি উৎপাদন শিল্প। মহারাষ্ট্রের খানে, নবাগাথন। গুজরাটের ভাদোদরা, হাজিরা, জামনগর ও দাহেজ। উত্তরপ্রদেশের পাটায় পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প গড়ে উঠেছে। তৈল শোধনাগারগুলি থেকে কিছু দূরে অবস্থিত হলেও কাঁচামাল হিসেবে কুড তেলের উপজাত দ্রব্য প্রাপ্তির সুবিধায় এই সকল অঞ্চলে পেট্রো-রাসায়নিক শিল্প গড়ে উঠেছে।
নিম্নে ভারতের অঞ্চলভিত্তিক পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পের অবস্থান আলোচিত হল-
পশ্চিম ভারত: ভারতে পেট্রো-রাসায়নিক শিল্পের সর্বপ্রথম বিকাশ ঘটে পশ্চিম ভারতে। এখানকার পেট্রো-রসায়নকেন্দ্রগুলি হল:-
(১) ট্রম্বে(Union Carbide India Limited): ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে মহারাষ্ট্রের ট্রম্বেতে (মুম্বাই-এর কাছে) বহুজাতিক সংস্থার পরিচালনাধীনে পেট্রো-রসায়ন দ্রব্য উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এখানে শিল্পকেন্দ্র স্থাপনের সুবিধা নিকটস্থ ট্রম্বে ও মুম্বাই শোধনাগার থেকে কাঁচামাল পাওয়ার সুবিধা। পাইপ লাইন, সড়ক ও রেলপথে দ্রুত পণ্য প্রেরণের ব্যবস্থা: বহুজাতিক সংস্থাটির বিরাট আর্থিক বিনিয়োগের সামর্থ থাকায় আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ। নিকটবর্তী মুম্বাই-পুনে শিল্পাঞ্চলে পেট্রো-রাসায়নিক দ্রব্যের চাহিদা।
পশ্চিমঘাট অঞ্চলের সুলভ জলবিদ্যুৎ শক্তির সাহায্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা। এখানকার উৎপন্ন প্রবাসমূহ হ'ল- পি ভি সি, পলি-প্রপিলিন, পলিয়েস্টার প্রভৃতি।
(২) খানে (National Organic Chemicals Limited): ১৯৬৮ সালে মহারাষ্ট্রের মুম্বাই-এর কাছে খানেতে এই শিল্প কারখানা বেসরকারী উদ্যোগে স্থাপিত হয়। এটি মুম্বাই-এর নিকটবর্তী অবস্থানে থাকায় উম্বের অনুরূপ সুবিধা ভোগ করে। এখানে উৎপন্ন দ্রব্যাদির মধ্যে আছে ন্যাপথা জাত এখিলিন, প্রপিলিন, কুইডিন, বেনজিন, পলি এথিলিন, স্লাইসল, পি ভি সি প্রভৃতি।
(৩) ভাদোদরা (Indian Petro-Chemical Corporation Limited): সরকারী উদ্যোগে ১৯৬৯ সালে গুজরাটের ভাদোদরায় জওহরনগরে কয়ালি শোষনাগারের পেট্রো-রসায়ন দ্রব্য নির্ভর একটি কারখানা স্থাপিত হয়। এখানকার প্রধান উৎপন্ন দ্রব্যগুলি হল-পলিমার, এথিলিন, বেনজিন, পিভিসি প্রভৃতি।
(৪) কয়ালি: প্রাকৃতিক গ্যাস ও প্রেট্রোলিয়াম উপজাত দ্রব্যের সাহায্যে পেট্রো-রসায়ন দ্রব্য প্রস্তুতের জন্য বেসরকারী উদ্যোগে গড়ে ওঠা কারখানা। এখানকার কারখানায় বেনজিন, টালিন সহ অন্যান্য পেট্রো দ্রব্যাদি উৎপন্ন হয়।
পশ্চিম-ভারতের অন্যান্য পেট্রো-রসায়ন শিল্পকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে মহারাষ্ট্রের নবাগাথান, টেম্বর, গুজরাটের হাজিরা, জামনগর ও দাহেজ।
দক্ষিণ ভারত: দক্ষিণ ভারতে মাদ্রাজ বা বর্তমানে চেন্নাই-এ পেট্রো-রসায়ন শিল্প পশ্চিম ভারতের পরে পরেই গড়ে ওঠে।
চেন্নাই (Madras Petro-chemicals):
ব্রিটেন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত সহায়তায় চেন্নাই-এর কাছে শোধনাগারের নৈকট্যে পেট্রো-রসায়ন উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে ফেনল, ইথাইল, অ্যাসিটোন, সুর্গা দ্রব্য প্রভৃতি।
পূর্ব ভারত: পূর্ব ভারতেও এই শিল্প গড়ে উঠেছে। এখানে অবস্থিত দুটি কেন্দ্র হল-
বঙ্গাইগাঁও (Bangaigaon Petro-chemicals Ltd): সরকারী পরিচালনাধীন এই কারখানা অসমের নওগাঁ জেলার বঙ্গাইগাঁও-এ স্থাপিত হয়েছে। বঙ্গাইগাঁও ছাড়াও নুনমাটি শোধনাগার থেকে এই কেন্দ্র কাঁচামাল পায়।
হলদিয়া (Haldia):স্থানীয় শোধনাগার থেকে কাঁচামাল,কলকাতা শিল্পাঞ্চলের বাজার, উন্নত পরিবহন। সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগ এই কারখানা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কলকাতাসহ দুর্গাপুর, আসানসোল এবং এমনকি হলদিয়া শিল্পাঞ্চলেও পেট্রো-রসায়ন দ্রব্যের চাহিদা রয়েছে। এখানে (ক) হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কর্পোরেশন-এর সার কারখানাটিতে খনিজ তেলের উপজাত দ্রব্য ন্যাপথা-ভিত্তিক সার উৎপন্ন হয় এবং (খ) 'শ ওয়ালেশ'-এর কীটনাশক উৎপাদন কারখানা এখানে রয়েছে।
সরকার টাটা, গোয়েঙ্কা প্রভৃতি শিল্পগোষ্ঠীর সাহায্যে এই পরিকল্পনা রূপায়ণের পরিকল্পনা নিয়েছেন। এখানে পিভিসি, কৃত্রিম তত্ত্ব, কৃত্রিম রবার, পেট্রোলিয়াম উপজাত ভিত্তিক সার কারখানা ইত্যাদি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
উত্তর ভারত: উত্তর প্রদেশের পাটা-য় একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমমেকস (জুন, ১৯৯৯) স্থাপিত হয়েছে। এখানে উৎপন্ন ইথিলিন, পলিইথিলিন, বিভিন্ন প্লাস্টিকের কাঁচামাল উত্তর ভারতে পেঠেপণ্যের চাহিদার পরিপূরক হবে।
পেট্রোপণ্য উৎপাদন: পেট্রোপনা উৎপাদন: ভারতে বর্তমাপে প্রায় ২.৩ হাজার টন কৃত্রিম তন্তু, ৫:৫ হাজার টন পলিমার এবং প্রায় ১.৪ লক্ষ টন প্লাস্টিক উৎপন্ন হয়।
(1) প্লান্টিকের কাঁচামাল উৎপাদন: এর মধ্যে আছে অন্যান্য শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে পলিইথিলিন, পি ভি সি, ফেনল, রেজিন, মোল্ডিং পাউডার, ন্যাপথা প্রভৃতি। টুম্বে, খানে, ভাদোদরা, বঙ্গাইগাঁও-এ প্রচুর প্লাস্টিকের কাঁন্ডামাল উৎপন্ন হয়।
(2) রূপান্তর শিল্প (Conversion Industry): এই ধরনের শিল্পে পলিখিঘন শিট, পিভিসি শিট, পলিথিন ফিল্ম, পলিথিন পাইপ প্রভৃতি মোল্ডিং ও ফেব্রিকেশন করা হয়। উৎপন্ন দ্রব্যের তালিকায় আরো রয়েছে টায়ার ও টিউব, রেনকোট, জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি। এই রূপান্তর শিল্পকেন্দ্রগুলি তৈলশোধনকেন্দ্র থেকে যথেষ্ট দূরেও স্থাপিত হতে পারে। সেজন্য বাজারের সুবিধা বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মুম্বাই, চেন্নাই ছাড়াও দিল্লি, বার্ণপুর, অমৃতসর ও কলকাতায় এ ধরনের কারখানা স্থাপিত হয়েছে।
সমস্যা ও সম্ভাবনা:
ভারতে পেট্রো-রসায়ন শিল্পে (1) উচ্চ প্রযুক্তির অভাব, (ii) মূলধনের সমস্যা। (iii) উপজাত দ্রব্য নিয়মিত এবং উপযুক্ত পরিমাণে সরবরাহে বিঘ্ন ইত্যাদি সমস্যা থাকলেও দেশে পেট্রো-রসায়ন শিল্পের এক বিরাট সম্ভাবনাময় বাজার রয়েছে। এই বাজার দখলের লক্ষে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে দেশীয় সংস্থা ও সরকার-এর সমঝোতা চুক্তি (Memorendum of Understanding বা MOU) স্বাক্ষরিত হচ্ছে। তৈল শোধনাগারগুলির অবস্থান বিকেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং পরিবহন ব্যবস্থায় সম্প্রসারণ ঘটার ফলে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ খুবই সম্ভাবনাময়।