welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

নদীয়া জেলা(Nadia District)

নদীয়া জেলা(Nadia District)


নদীয়া জেলার ভৌগোলিক অবস্থান- নদীয়া জেলা ২২°৫৩′ উত্তর থেকে ২৪°১১′ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮°৯′ পূর্ব থেকে ৮৮°৪৮′ পূর্ব দ্রাঘিমার মধ্যে বিস্তৃত। জেলার মোট ভৌগোলিক আয়তন ৩,৯২৭ বর্গ কিলোমিটার। এই জেলাটি ৪টি মহকুমায় বিভক্ত- তেহট্ট মহকুমা, কৃষ্ণনগর মহকুমা, রানাঘাট মহকুমা এবং কল্যাণী মহকুমা। নদীয়া জেলায় ১৮৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত, ১৭টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ২,১৪২টি গ্রাম। সংসদ রয়েছে। কৃষ্ণনগর জেলা সদর।

ভূ-প্রকৃতিঃ ভাগীরথীর পূর্বদিকে বাগ্নি মূলত নবীন পলি দ্বারা গঠিত, হালকা গঠন এবং মৃত্তিকা সামান্য অম্ল ধর্মী থেকে নিরপেক্ষ হওয়ায় চাষ আবাদ ভাল হয়। ভাগীরথী-জলঙ্গীর প্রবাহ বরাবর স্বাভাবিক বাঁধ গঠিত হয়েছে। অসংখ্য খাল, বিল ও জলাভূমি এই স্বাভাবিক বাঁধ সংলগ্ন রয়েছে। ভূমিভাগের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বাধিক ১৫ মিটার এবং স্বাভাবিক বাঁধ ও নদী তীরবর্তী উচ্চভূমির উচ্চতা ২০ মিটারের বেশি নয়। নদীর আঁকাবাঁকা গতিপথ অনেক অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের সৃষ্টি করেছে, বিশেষত, নাকাশিপাড়া, কালিগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলে। চাপরাবিল, কুটিরবিল, বাঘেরবিল, গুরগুরিয়া খ াল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ বর্ষাকালে প্লাবিত হলে বিশাল জলাভূমি সৃষ্টি হয়।

মুর্শিদাবাদের বেলডাঙা থেকে নদীয়ার কালিয়াগঞ্জ ও তেহট্ট ব্লকের মধ্যবর্তী অত্যন্ত নিম্নভূমি যা কতকটা সরার ন্যায় দেখতে, তাই কালান্তর নামে পরিচিত। এটি ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীর মধ্যে অবস্থিত। অসংখ্য বড় বড় জলাভূমি এবং মৃতপ্রায় নদী নিয়ে গঠিত কালান্তর অঞ্চল। এটি মূলতঃ জলাভূমি। বর্ষার সময় সমগ্র অঞ্চল বিশাল জলাভূমির আকার ধারণ করে। জলনিঃসরণের কোন প্রাকৃতিক উপায়ে বিশেষ না থাকায় এ অঞ্চলে জল জমে থাকে, প্রায় সারা বছর। বর্ষাকালে তা বিশাল জলাভূমির আকার নেয়। কেন্দ্রীয় অংশে সারা বছর জল থাকে, প্রান্তবর্তী এলাকাগুলি বর্ষাকাল ভিন্ন অন্যান্য সময় জলপৃষ্ঠের উপরে জেগে থাকে। বেশিরভাগ অঞ্চলই নদীর মধ্যবর্তী সমভূমির অন্তর্গত। পূর্বদিকে জলঙ্গী স্বাভাবিক বাঁধ এবং পশ্চিম দিকে ভাগীরথী স্বাভাবিক বাঁধ। মধ্যবর্তী স্থানে অবনমিত সমভূমি অঞ্চল।

নদনদী: গঙ্গা প্রধান নদী। গঙ্গার উপনদী গুলির মধ্যে রয়েছে ভাগীরথী, জলঙ্গী ও ভৈরব। ভাগীরথী নদী ও ভাগীরথীর উপনদী জলঙ্গি, মাথাভাঙা, চুণী, ইচ্ছামতী প্রভৃতি প্রধাননদী। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মৃতপ্রায় অংশ নদীয়া জেলা। অত্যন্ত আঁকাবাঁকা নদী পথ। কোথাও কোথাও এটি প্রায় গোলাকৃতিতে বেঁকে প্রবাহিত হয়েছে।

ফলে বহু জায়গায় নদী প্রবাহ বিচ্ছিন্ন হয়ে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ ও অন্যান্য জলাভূমি সৃষ্টি করেছে। ময়ূরাক্ষী নদী মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমায় কিছু অংশে প্রবাহিত হয়েছে।

জলঙ্গি পদ্মা থেকে বেরিয়ে এসে নদীয়া ও মুর্শিদাবাদের সীমানা নির্দেশ করে কৃষ্ণনগরের দিকে প্রবাহিত হয়েছে এবং পরে পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে এটি ভাগীরথী নদীতে এসে মিশেছে, নবদ্বীপ এই জেলায় অবস্থিত ভাগীরথীর অপর তীরে। এখানে ভাগীরথী নদীর পাড় ভাঙনের সমস্যা খুব প্রকট।

বনসম্পদ (Forest Resource)- নদীয়া জেলায় সে অর্থে বনভূমি অনুপস্থিত। তবে ১৮২৪ সালের একটি নর্থী থেকে জানা যায় সুন্দরবন একসময় নদীয়া জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে জনবসতির প্রসারে এবং কৃষি কার্যের বিস্তারে বনভূমি ধ্বংস হয়। স্থানে স্থানে ঝোপ-ঝাড়, কিছু জঙ্গল যেগুলি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। উদ্ভিদ কিছু স্বাভাবিক এবং বেশ কিছু সৃজিত। দামী উদ্ভিদগুলি বা মূল্যবান উদ্ভিদগুলি প্রধানত সৃজিত। জেলায় বেশ পরিমাণে দেখা যায় বটগাছ, পিপুলগাছ। এছাড়াও মেহগনি, আকাশমনি, বাবুল, আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু তো দেখা যায়ই। চাষের জমি সংলগ্ন বেশ কিছু বৃক্ষ রোপিত হতে দেখা যায় যা জ্বালানি এবং অর্থকরী কাঠের প্রয়োজন মেটায়। যেমন শিশু, মেহগনি, নারকেল গাছ, খেজুর গাছ, তাল গাছ, সেগুন গাছ ইত্যাদি। এছাড়া রাস্তার ধার বরাবর বেশকিছু গাছ সৃজিত হয়েছে এবং সামাজিক বনসৃজন ও বনমহোৎসব বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে, খেলার মাঠের ধারে বেশ কিছু বৃক্ষ সৃজিত হয়েছে। জলাভু মি অঞ্চলে মূলতঃ জলজ উদ্ভিদ, শুশনি, হেলেঞ্চা, কলমি শাক ইত্যাদি সংগ্রহ করে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করেন। সরকারি জমিতে কিছু বনসৃজন হয়েছে। মজঃফপুর বন বাগিচায় সেগুন, শিশু গাছের সৃজন, দেবগ্রাম বনবাগিচায় সেগুন, বাবুল ইত্যাদি গাছ, মাদপুর বনবাগিচায় সেগুন, শিশু, আকাশমণি, রানাঘাটের হিজুলীতে সেগুন, শিশু, বাবুল, আকাশমনি প্রভৃতি বৃক্ষ সৃজিত হচ্ছে, মাহদপুর বাগিচায় সেগুন, শিশু, আকাশমণি ইত্যাদি এবং আরো বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বনবাগিচা সরকারি বনদপ্তর এর সৌজন্যে সৃজিত হচ্ছে। বেথুয়াডহরি রিজার্ভফরেস্ট হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং এখানে অরণ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। প্রায় ২৪৪ হেক্টর জায়গা জুড়ে বেথুয়াডহরি সংরক্ষিত অরণ্য হিসেবে রয়েছে।

অর্থনীতি- নদীয়া জেলায় মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। জেলার দুই-তৃতীয়াংশের অধিক লোক কৃষি কাজ থেকে জীবিকা সংগ্রহ করেন। প্রধান ফসল ধান। কিছু ডাল, তৈলবীজ এবং প্রচুর সবজি চাষ হয় নদীয়া জেলায়। ফুলকপি, বাঁধাকপি, কাঁচা লঙ্কা ইত্যাদি উৎপাদনের জন্য নদিয়া খ্যাত। কিছু জমিতে আখের চাষ হয়, পাটের চাষ হয় এবং গম চাষ হয়। উর্বর পলি গঠিত সমভূমি হওয়ায় সারা বছরই প্রায় সেচসেবিত এলাকাগুলিতে কোন না কোন ধানের চাষ হয়। শীতকালে প্রচুর সবজির চাষ হয় এবং কিছু জমিতে গম চাষ হয়। জলাভূমি সংলগ্ন এলাকায় ধান এবং পাট চাষ উল্লেখযোগ্য। স্বাভাবিক বাঁধ সংলগ্ন এলাকা সামান্য উঁচু হওয়ায় এখানে সবজির চাষ ভালো হয়, আমন ধানের চাষ ভালো হয়। নদীগুলির মধ্যবর্তী সমতলভূমি ও নিম্নভূমিতে প্রচুর ধান চাষ হয়।

ভূমির ব্যবহার- জেলার মোট আয়তন ৩,৯২৭ বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে স্বাভাবিক উদ্ভিদের বিস্তার প্রায় ৪০২ বর্গ কিলোমিটার এলাকায়। কৃষিকাজে ব্যবহৃত জমির পরিমান প্রায় ২,৩৬২ বর্গ কিলোমিটার। বসতি বিস্তার ঘটেছে প্রায় ১,০৫৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকায়। জলাভূমির বিস্তার রয়েছে ১০৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকায়।

পশুপালন- জেলায় গবাদি পশুর সংখ্যা ১ লক্ষ ১১ হাজার ৪০৩টি। মহিষের সংখ্যা ১ লক্ষ ১২ হাজার ৪১৬ টি। ছাগলের সংখ্যা ১০ লক্ষ ৬৩ হাজার ৭৩৩টি। গবাদি পশু পালন করে বহুলোকই জীবিকা সংগ্রহ করেন। এবং এই জেলা দুগ্ধ সরবরাহে পশ্চিমবঙ্গের একটি উল্লেখযাগ্যে স্থান দখল করে। এই জেলা থেকে প্রচুর ছানা তৈরি হয়ে কলকাতা শহরে বিক্রয়ের জন্য প্রতিদিন প্রেরণ করা হয়।

পরিবহন- নদীয়া জেলার মধ্য দিয়ে বিস্তৃত রেল লাইনের দৈর্ঘ্য ২২২ কিলোমিটার। সড়কপথের মধ্যে রয়েছে জাতীয় রাজপথ ১১৬ কিলোমিটার, রাজ্য সড়কপথ ১৫৯ কিলোমিটার। প্রধান জেলা সড়ক পথ ২৬৬ কিলোমিটার, অন্যান্য রাস্তা ৪৭৮ কিলোমিটার। এছাড়া কাঁচা রাস্তা গ্রামের নানা দিকে যোগাযোগ সাধন করছে।

শিল্প- কল্যাণী ব্যতীত অন্যত্র শিল্পের বিশেষ বিকাশ ঘটেনি। কল্যাণী মহকুমায় বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগ গড়ে উঠেছে। রেজিস্ট্রিভুক্ত শিল্প সংখ্যা ২০১১-১২ হিসেব অনুযায়ী ২১৪টি। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পোদ্যোগে ১৫ হাজারের কিছু বেশি শ্রমিক নিয়োজিত। জেলায় ৪টি বড় শিল্প উদ্যোগ রয়েছে। কাগজ ও কাগজ দ্রব্য উৎপাদনে, চর্মশিল্পে, রাসায়নিক দ্রব্য প্রস্তুত কারখানায়, রাবার, প্লাস্টিক ও পেট্রোপণ্য উৎপাদনে, খনিজ নির্ভর শিল্পোদ্যোগে, ধাতব শিল্পোদ্যোগে ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি, পরিবহন যন্ত্রপাতি উৎপাদনে বেশ কিছু শিল্পোদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। বিশিষ্ট শিল্প কোম্পানিগুলোর মধ্যে এন্ড্র ইউলে, কল্যাণী স্পিনিং মিল, কল্যাণী ব্রিওয়ারিজ লিমিটেড, মেসার্স ওয়েস্ট বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল এন্ড ফাইটোকেমিক্যালস্ ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড কল্যাণী, মেসার্স অ্যালেন বারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন গ্যাস, কল্যাণী বিশেষ উল্লেখযোগ্য। জেলায় শিল্প বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি। কল্যাণী মহকুমায় অধিকাংশ শিল্প কেন্দ্রীভূত। জেলার জনসম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার, উন্নত পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা, কলকাতা হুগলি শিল্পাঞ্চলের নৈকট্য, কলকাতা বন্দরের নৈকট্য এবং সহযোগী শিল্প গুলির উপস্থিতিতে শিল্প উদ্যোগ এর উপযোগী পরিবেশ রয়েছে এই জেলায়, ফলে শিল্পোন্নতির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই জেলার রানাঘাট, চাকদহ, গয়েশপুর, তেহট্ট, নবদ্বীপ শিল্পায়নে সম্ভাবনা রাখে এবং কিছু কিছু ক্ষুদ্র শিল্প এই অঞ্চলগুলিতেও রয়েছে। চাকদাতে সুপ্রিম পেপার মিল, গয়েশপুরে আইফেল লিমিটেড, কল্যাণীতে সিকা ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড,ওয়েবসি ইলেকট্রিক্যাল সেরামিক, ডাবর, নিক্কো করপোরেশন লিমিটেড, সিং অ্যালয় এন্ড টুলস্ লিমিটেড, ফারমেন্টেশন ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড ইত্যাদি। হরিণঘাটায় হরিণঘাটা ডেয়ারি, কৃষ্ণনগরে কৃষ্ণনগর চিলিং প্ল্যান্ট বা শীতলীকরণ কারখানা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

নদীয়া জেলায় ধর্মীয় পর্যটন শিল্প সম্ভাবনাময়। শ্রীচৈতন্যের জন্মভূমি নবদ্বীপ ধর্মপিপাসু জনগনের কাছে পবিত্র স্থান। নবদ্বীপে পোড়ামাতলা মন্দির, মায়াপুরে ইসকন মন্দির দর্শনে বহু পর্যটকের আগমন ঘটে।

জেলার জনসম্পদ, কৃষিজ, বনজ সম্পদ কাজে লাগাতে পারলে এই জেলা সম্পদ সম্ভাবনাময়। ফুলের সুগন্ধি প্রস্তুত, পাট এর সঙ্গে অন্য তত্ত্ব মিশিয়ে উৎকৃষ্ট বস্ত্র প্রস্তুত, সিল্ক ও তাঁত বস্ত্র প্রস্তুত, চালকল, প্রক্রিয়াজাত সবজি, ফল প্রক্রিয়াকরণ, মশলাপাতির প্রক্রিয়াকরণ ও প্যাকেজিং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গ্রামীণ এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে এবং এগুলির বাণিজ্যিক সাফল্য যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। এছাড়া রয়েছে পিতল ও কাঁসার দ্রব্য প্রস্তুত, সোনা ও রুপোর গহনা প্রস্তুতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিট।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01