মনুষ্যসৃষ্ট কারণ (Man-made Causes)
(১) বন ধ্বংসকরণ: কাঠের প্রয়োজনে, কৃষিকার্যের বিস্তারে বর্ধিত জনসংখ্যার বাসস্থান সংকুলানের জন্য অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণে, দাবানল সহ বনে অগ্নিসংযাগে ঘটনায়, স্থানান্তর কৃষি ইত্যাদি কারণে বনভূমি সঙ্কুচিত হচ্ছে। বৃক্ষহীন বা বিরলবৃক্ষ পর্বতগাত্র ভূমিক্ষয়ের অন্তর্গত হচ্ছে। ভূমিক্ষয় যত বাড়বে পর্বত গাত্রে ধসের সম্ভাবনাও তত বেড়ে যায়। বিভিন্ন পার্বত্য নদী উপত্যকায় এরূপ কারণে ভূমিধস ঘটতে দেখা গেছে।
(২) ভূমিঢালে কর্ষণ: পাহাড়ের গায়ে ঢালবিশিষ্ট অঞ্চলে ধাপ কেটে চাষ করা হয়। এই ধাপগুলিতে সেচের বা বৃষ্টির জল জমে ধীরে শিলামধ্যে প্রবেশ করে এবং নিম্ন শিলাকে ক্রমশঃ অস্থিতিশীল করে তােেল। এ ছাড়া খাড়া ঢালের নীচে রিলক্ষয় বৃদ্ধি পেয়ে উপরের ঢালটিকে অস্থিতিশীল করে। এর প্রভাবে উক্ত ঢালে ভু মিধসের সম্ভাবনা তৈরি হয়। কালিম্পং-এ এই জাতীয় ধসের প্রবণতা রয়েছে। কয়েকটি অঞ্চলে জনবসতিকে এই কারণে স্থানান্তরিত করতে হয়েছে।
(৩) অপরিকল্পিতভাবে বাসগৃহ ও রাস্তাঘাট নির্মাণ: এটিও ভূমিধসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিম্নস্থ শিলাস্তরের ভঙ্গুরতা পরীক্ষা না করেই বহুতল অট্টালিকা নির্মাণের ফলে দার্জিলিং-এ ধসের সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
(৪) নির্মাণ কার্যে বিস্ফোরকের ব্যবহার: রাস্তাঘাট বা ইমারত নির্মাণে বিস্ফোরকের ব্যবহার সুনিয়ন্ত্রিত হলে শিলাস্তর ভঙ্গুর হয়ে পড়ে ও ধস ঘটে। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা জলনির্গমনের উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকলে সড়কের নীচে বা উপরে জল জমে মাঝে মাঝে ধস্ ঘটায়। যানবাহনের চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। দার্জিলিং ও সিকিম সড়ক পথে এ ধরনের ভূমিধসের সমস্যা রয়েছে।
৫) জলধার নির্মাণ: পার্বত্য অঞ্চলে নদী পরিকল্পনার অন্তর্গত কৃত্রিম জলাধার নির্মাণের ফলে বিশাল জলরাশির চাপ সহ্য করতে না পারলে বড়ো রকমের শিলাচ্যুতি ঘটতে পারে, যা একই সঙ্গে ধস ও বন্যার সৃষ্টি করতে পারে। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা জলাধার প্রকল্পে এজন্য সতর্কতা প্রয়োজন।
(৬) ত্রুটিপূর্ণভাবে খনিজ ও প্রস্তর সংগ্রহ ব্যবস্থা: যথেচ্ছভাবে বিস্ফোরক ব্যবহার করে বা অনিয়ন্ত্রিভাবে পাথর কাটলে পর্বতগাত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়ে ধস্ ঘটে ভূ-পৃষ্ঠের নীচে খনিজ সংগ্রহের ফলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিলে খনির ছাদ ধসে পড়ে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভূমিভাগ বসে যেতে পারে।
সমস্যা মোকাবিলা:
ভূমিধস্ মূলত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও ধস ঠেকানো কল্পে বনসৃজন বা বন সংরক্ষণ, মৃত্তিকা সংরক্ষণ, নিয়ন্ত্রিত ধাপচাষ, ঢালে জলধারা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি উপায়ে ধস্ প্রবণতা কমানো যায়।।
ধসজনিত বিপর্যয় রোধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গৃহীত হতে পারে। এগুলি নিম্নরূপ-
• বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদনের পূর্বে সুচিন্তিত ও বিজ্ঞানসম্মত স্থান নির্বাচন, কার্য পদ্ধতি নির্ণয় এবং বিপর্যয় প্রবণ এলাকার মানচিত্রায়ণ প্রয়োজন, যাতে এটি ধজনিত বিপদ বা ঝুঁকির মাত্রা নির্ণয়ে করে প্রতিকারকল্পে বা প্রতিরোধকল্পে ব্যবস্থা নির্দেশ করতে পারে।
• দূরসংবেদন ব্যবস্থা তথা ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা, ধ্বস সংক্রান্ত তথ্যসমূহ সংগৃহীত করে অঞ্চলবিশেষে তথ্য পরিসংখ্যান সরবরাহ করে ধস্ প্রতিরোধে কার্যকরি হতে পারে।
• পাহাড়ের ঢালের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে ও ক্ষয় প্রতিরোধে জৈব প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। তৃণাচ্ছাদন তৈরি করে, অরণ্য সৃজন করে মৃত্তিকা ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশে ধস্ প্রবণতাকে কমিয়ে ফেলে।
• অন্যান্য পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে কংক্রিটের দেয়াল, তারের জাল ইত্যাদির সাহায্যে ধযোগ্য শিলাগাত্রকে আটকে রাখা।
• আইন প্রণয়ন করে যত্রতত্র বসতি ও অন্যান্য অবৈধ নির্মাণ বন্ধ করা প্রয়োজন। বিশেষতঃ অস্থিতিশীল পর্বতগাত্রে এজন্য নজরদারি প্রয়োজন।
• বর্ষা ঋতুতে শিলাস্তরের শিথিলতা আছে বলে এবং পুঞ্জপদার্থ পিচ্ছিল হয়ে পড়ে বলে পার্বত্য পথে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
• রাস্তাঘাট যাতে ধসের কবলে না পড়ে এইজন্য জলধারা নিষ্ক্রমণ পথ তৈরি করা প্রয়োজন, রাস্তার পাশে শিথিল শিলাগাত্র চট ও কংক্রিটের বাঁধনে বেধে দেওয়া।
• সড়ক নির্মাণে, বসতি নির্মাণে মৃত্তিকা পরীক্ষা ও ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষা করেই কেবল বিস্ফোরকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করা উচিত।
• খনি প্রকল্পে খনি খনন কেবল যথেষ্ট ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষার পরেই করতে হবে যাতে শিলাস্তরের সহন ক্ষমতা অতিক্রান্ত না হয়।
• জলাধার নির্মাণের মতো ভারী প্রকল্প গ্রহণ ও রূপায়ণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের শিলাস্তরের বহন ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ও তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তালো জরুরি, যাতে মহারাষ্ট্রের কয়না জলাধার বসে গিয়ে যে বিপর্যয় ঘটেছিল তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
তথ্যসূত্র: Saha A.K., et el: An approach for GIS based statistical landslide susceptibility zonation,