ভারতের ভাষাভিত্তিক জনসংখ্যার বন্টন(Language based distribution of Indian Population)
ভূমিকা: ভারত বহুভাষাভাষি জনসংখ্যা সমন্বিত অঞ্চল। এক এক অঞ্চলে এক এক ভাষার অবিসংবাদিত প্রাধান্য এবং এই প্রাধান্য বজায় আছে একটানা এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। এ জন্যই স্বাধীনতার পর ভারতে রাজ্য গুলির বণ্টন ও পুর্নবন্টন হয়েছে ভাষাভিত্তিক। একটি ভাষা অঞ্চল থেকে অপর ভাষা অঞ্চলটি যেখানে শুরু হয়, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই থাকে দ্বিভাষাভাষী অঞ্চল, যেখানে একটি বিশেষ ভাষাভাষি অঞ্চলের জনসংখ ্যার কেন্দ্রীভবন হ্রাস পায় এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভাষাভাষী জনসংখ্যার কেন্দ্রীভবন শুরু হয়ে যায়। তবে কোনো অঞ্চল কেবল একক ভাষাভাষি হয় না, একক ভাষাভাষির প্রাধান্যযুক্ত হয়।
• ভাষা সর্বেক্ষণ (Lingustic Survey): স্যার জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন (Sir George Abraham Grierson) এর নেতৃত্বাধীন ভারতের ভাষা সর্বেক্ষণ কার্যক্রম (Lingustic Survey of India) উনবিংশ শতকের শেষদিকে ভারতে ১৭৯টি লেখ্য ও কথ্য ভাষা (Language) এবং ৫৪৪টি স্থানীয় কথ্য ভাষা (Dia-lects) রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তবে অ-চিহ্নিত কথ্য ভাষার সংখ্যা এর থেকে অনেক বেশি বলেই মনে হয়। ১৯৬১ সালের সেনসাস্ রিপোর্ট অনুসারে দেশে ১৮৭টি ভাষা প্রচলিত উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এগুলির অধিকাংশ ভাষাই স্থানীয়ভাবে অল্পসংখ্যক মানুষ কথাবার্তা বলেন। ভাষাভিত্তিক বিভিন্ন সমীক্ষালব্ধ ফলাফলে প্রমাণিত যে ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ৪/৫ ভাগ কেবলমাত্র প্রধান ২৩টি ভাষায় লেখা ও বাক্যালাপ করেন। অন্যান্য ভাষার প্রতিটি অতি স্বল্পসংখ্যক জনগণ (কয়েক লক্ষ থেকে কয়েক শত মাত্র) ব্যবহার করেন।
• ভাষা ও লিপি (Language and Script): ভাষা দু প্রকার (১) লেখ্যভাষা, যার লিপি থাকে এবং(২) কথ্যভাষা, যার লিপি নেই, কেবল মুখে মুখে প্রচলন। ভারত বহুভাষাভাষি। ভাষালিপিও বহুপ্রকার। প্রধান ভাষাগুলির অধিকাংশেরই লিপি পৃথক। এর ফলে এক ভাষাভাষি জনগণের অপর ভাষা পাঠ বিশেষ সহজ হয় না। এমনকি শ্রুতিগতভাবে অনুরূপ হলেও লিপিগতভাবে বিরাট পার্থক্য দেখা যায় কোনো কোনো ভাষায়। হিন্দি ও উর্দু ভাষা দুটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে এ ব্যাপারে। বাক্যালাপে এত ঐক্য অথচ লেখনীতে এত পার্থক্য বিস্ময়-এর উদ্রেক করে। অনুরূপভাবে প্রায় একই লিপি হওয়া সত্ত্বেও অহমিয়া ও বাঙলা ভাষার বাক্যালাপে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম ভাষায় শ্রবণগত পার্থক্যের চেয়েও লিপিগত পার্থক্য কম নয়। হিন্দি ও মারাঠি শব্দ বিন্যাসে অনেক ঐক্য লক্ষ্য করা যায়। পাঞ্জাবী কিছুটা পৃথক। বাঙলা ও ওড়িয়া ভাষায় লিপিগত পার্থক্য এত, কিন্তু বাক্যালাপে মিল অনেক। আদিবাসী জনগণের ভাষা যেমন অলচিকি, কুরুখ, মুন্ডারী, ভিলী প্রভৃতির লিপি থাকলেও প্রধান ভাষাভাষী জনগণের সংগে ঘনিষ্ঠ সংযোগের ফলে কথ্য ভাষার ব্যবহারিক গুরুত্ব কেন্দ্রীয় অঞ্চল ছাড়া অন্যত্র পূর্বাপেক্ষা হ্রাস পেয়েছে। অথচ বর্হিজগতের সংগে যখন আদিবাসী বসবাসকারী অঞ্চলগুলির যোগাযোগ ক্ষীণ ছিল বা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ প্রায় ছিলই না, তখন স্থানীয় ভাষাগুলিই বাক্যালাপে ছিল একমাত্র অবলম্বন। তবে শিক্ষার অভাব থাকায় এই সকল অঞ্চলে লিপির ব্যবহার নগণ্য ছিল তখনও।
• ভাষাভিত্তিক বৈচিত্র (Linguistic Diversity): ভারতের ভাষাভিত্তিক বৈচিত্রকে ৪টি বৃহৎ অনুশাসনের অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এগুলি হল চীনা-তিব্বতীয় (Sino Indian), অস্ট্রিক বা নিষাদ গোষ্ঠী (Austric), দ্রাবিড় (Dravidian) এবং ইন্দো-ইউরোপীয়ান (Indo European)। এরূপ ভাষাভাষী অঞ্চলের ভারতে বন্টন থেকে ধারণা করা যায় এই ভাষাসমূহ ভারতীয় অথবা ভারতে এসে পৌছেছে কোনো না কোনো পথ ধরে বা দিক থেকে। যেমন চীনা-তিব্বতীয় ভাষার আগমন ঘটেছে হিমালয় পর্বতের অপর দিক থেকে এবং প্রসার ঘটেছে চীন-তিব্বত সংলগ্ন উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতে হিমালয় এবং উত্তরপূর্বে পাহাড়ী অঞ্চলের সীমান্ত সন্নিহিত বিভিন্ন রাজ্যে বা অঞ্চলে। উত্তর ভারতের সমভূমি অঞ্চল ইন্দো-ইউরোপীয় প্রভাবান্বীত ভাষাভাষী অঞ্চল। দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় ভাষার প্রাধান্য, অস্ট্রিক ভাষা বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে কয়েকটি উপজাতি গোষ্ঠীর মধ্যে।