ভারতে গ্রামীণ বসতির বিচ্ছিন্নকরণে শ্রেণি এবং জাতিভেদ প্রথার প্রভাব:(Influence of Clans and Caste for the Segregation of Rural Settlement in Indul:
ভারতীয় সমাজব্যবস্থা গঠনে বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা সংগঠনে শ্রেণি (Class) এবং জাতিয়েন (Caste System) গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। গ্রামীণ বসতির আকার ও আয়তন দুটোই শ্রেণি ও জাতিভেদ প্রথার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
• শ্রেণিব্যবস্থার ভূমিকা: সামাজিক স্তরবিন্যাসের একটি বিশেষ দিক হল শ্রেণি প্রথা। ম্যাকআইভার ও পেজ-এর মতে, শ্রেণি হল সমাজের এমন একটি অংশ বিশেষ যা সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে স্বতন্ত্র। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট সামাজিক শ্রেণির অন্যতম ভিত্তি। সমাজের উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত প্রভৃতি শ্রেণির দ্বারা সমাজ ও জনবসতি গঠিত হয়। এই শ্রেণিব্যবস্থা অত্যন্ত গতিশীল প্রকৃতির হয়। ফলে এদের গতিশীল প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে গ্রামীণ বসতির স্বরূপ নির্ধারণ করা হয়। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণিও সমাজে দেখা যায়।
ভারতীয় গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় গ্রামের মধ্যে বসবাস করে। কিন্তু তাদের বাসগৃহ অন্যান্যদের থেকে আলাদা ধরনের হয়। তাদের ঘরবাড়ি যেমন অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে অনেক উন্নতমানের হয় তেমনি তাদের আশেপাশে তাদের মতো উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় ছাড়া বসবাস করে না।
মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত সম্প্রদায় গ্রামের সীমানায় বসবাস করে। এরা যেহেতু নিম্নসম্প্রদায় এজন্য এই শ্রেণির সঙ্গে উচ্চবিত্ত শ্রেণির সামাজিক সম্পর্ক খুব কম গড়ে ওঠে। উচ্চবিত্ত গোষ্ঠীর সঙ্গে নিম্নবিত্ত গোষ্ঠীর সামাজিক দূরত্ব তাদের বসতির মধ্যেও লক্ষ করা যায়।
সামাজিক শ্রেণি হল একটি গোষ্ঠী যা কোনো আইন বা ধর্মের দ্বারা স্বীকৃত বা নির্দিষ্ট নয়। সমাজে শ্রেণির একটি বিশেষ স্থান আছে এবং যার দ্বারা অন্যান্য গোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নির্ণয় করা যায়। শ্রেণিগত বিন্যাসের ওপর নির্ভর করে গ্রামে উচ্চশ্রেণির বসতি, নিম্নশ্রেণির, শ্রমিকশ্রেণির, কৃষকশ্রেণির বসতি লক্ষণীয়।
• জাতিভেদ প্রথা (Caste System): ভারতীয় গ্রামীণ কিংবা শহরের সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল জাতিভেদ প্রথা।
ভারতীয় গ্রামীণ বসতির আকারে ও আকৃতি জাতিভেদ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। ঘরবাড়ির আকৃতি, একটি বসতির সঙ্গে অন্য বসতির দূরত্ব ও অন্যান্য বৈশিষ্ট জাতিভেদ প্রথার ওপর নির্ভরশীল।
ভারতের গঙ্গা ও দক্ষিণ ভারতের নদী-উপত্যকা অঞ্চলের গ্রামগুলিতে বসতির আকার ও বিন্যাস ও জাতিভেদ প্রথার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।
চাষের জমিতে কৃষিক ফসল চাষের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জাতি একসঙ্গে এসে বসবাস করেন। জঙ্গল পরিষ্কার করে যেসব গ্রাম গঠন করা হয়েছে সেখানে দণ্ডাকৃতির বসতি গড়ে উঠেছে।
হিন্দু প্রধান গ্রামে ব্রাহ্মণ বা উচ্চবর্ণের মানুষ বা জমিদার গ্রামের কেন্দ্রস্থলে বাস করতেন। আজও সেই ধারা কিছুটা অব্যাহত রয়েছে। আজকে জমিদার বা সামন্ত প্রভুর স্থান নিয়েছে বিত্তবানরা, সমাজের নীচু বর্ণের ব্যক্তিরা গ্রামের প্রান্তভাগে বা মূলগ্রাম থেকে একটু দূরে বসবাস করেন। গ্রামের এসব অংশে টোলা বা টুলি থাকলে বুঝতে হবে আশপাশে প্রধান গ্রামটি অবস্থান করছে।
বিহারে জাতপাতের ব্যাপারটি খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায়। যদিও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে জাতপাতের বিষয়টি গ্রামীণ সমাজকে প্রভাবিত করে না। তবে পূর্বতন "পাড়া” (ঘোষ পাড়া, বামুনপাড়া, মণ্ডলপাড়া,সমার পাড়া ইত্যাদি) নামগুলি রয়ে গেছে, তবে ব্রাহ্মণপাড়াতেও অন্যজাতের সন্ধান মেলে। হিন্দু প্রধান গ্রামে বিন্দু-মুসলিমরা পরস্পর থেকে একটু দূরত্ব রেখে বসবাস করেন।
গ্রামীণ সমাজে দেখা যায় যে, গ্রামের একেবারে সীমানায় সম্প্রদায় বসবাস করে। অনেকক্ষেত্রে তারা জঙ্গলের সীমানায় নদীর পাড়ের সীমায় কিংবা উপকূলীয় সীমানায় বসবাস করেন। ফলে সীমান্ত গ্রামের উদ্ভব হয়।
প্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ হল বহু জাতি সম্প্রদায়ের বাসভূমি। অনেক জাতি আবার বাইরে থেকে এখানে এসে বসবাস করছে। আবার স্থানীয় জাতিরাও বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করে চলেছে।
উপকূলবর্তী অঞ্চলে জেলে সম্প্রদায় উপকূল ধরে বসবাস করে দন্ডাকৃতি গ্রাম গঠন করে। আবার অনেক সময় জঙ্গলের মধ্যে সাঁওতাল বা অন্যান্য উপজাতি বিক্ষিপ্ত বসতি তৈরি করেছে।