ভারতে শিল্পায়ন ও শিল্পসমূহ(Industrialisation in India and Industries)
ভারতের শিল্পায়নের গতি-প্রকৃতি: ভারত উন্নয়নশীল এবং মূলত কৃষি অর্থনীতি নির্ভর দেশ।আধুনিক অর্থ ব্যবস্থায় উন্নতির অন্যতম শর্ত শিল্পোন্নতি। ভারতে বিভিন্ন সময়ে শিল্পায়নের লক্ষে কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৪৮ সালে প্রথম সুস্পষ্ট শিল্পোন্নয়ন নীতি গৃহীত হয়। এই নীতি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি রাজ্য সরকারগুলিকেও শিল্পায়নে উদ্যোগী হতে বলা হয়। ১৯৫৬ সালে গৃহীত শিল্পনীতি সরকারী ক্ষেত্রভুক্ত শিল্পগুলিতে রাজ্যগুলির বিশেষ ভূমিকা এবং পাশাপাশি বেসরকারী শিল্পক্ষেত্রে উন্নয়নের গুরুত্ব আরোপিত হয়।
শিল্পায়নে প্রতিবন্ধকতা: ১৯৬০ ও ৭০-এর দশক পর্যন্ত ভারতের শিল্পে উন্নতিতে বিশেষ কোনো উল্লেখ যোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। লাইসেন্স প্রদানে অতিরিক্ত কড়াকড়ি, সরকার নিয়ন্ত্রিত কতিপয় বৃহৎশিল্প ছাড়া অধিকাংশই ছিল ক্ষুদ্রশিল্প যেগুলির তেমন কোনো প্রযুক্তিগত সহায়তা ছিল না, অভাব ছিল প্রশিক্ষিত শ্রমশক্তির। আমদানী-রপ্তানীতে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ, অতি উচ্চ আমদানী শুল্ক শিল্পে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অন্তরায় ছিল। ১৯৮০-র দশক থেকে অতিমাত্রায় কৃষি নির্ভরতা যে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনসাধারনের এক বৃহৎ অংশের (প্রায় অর্ধেক) দারিদ্র মোচন করতে পারবে না, এটি পরিকল্পনাকার এবং সরকারী পরামর্শদাতাদের উপলব্ধি হয়।
শিল্পায়নে গুরুত্বদানের কারণ: ভারতে জনসাধারনের শিক্ষার মান, স্বাস্থ্যের মান, কর্মসংস্থানের সুযোগ অতি সীমিত থাকায় বিশাল জনসংখ্যা যে বৃহৎ বাজারের সম্ভাবনা রাখে তা সরকার এবং শিল্পপতিগণ সম্মক উপলব্ধি করেন। শিক্ষার মানোন্নয়নে কর্মসূচী, স্বাস্থ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। ক্ষুদ্রশিল্পগুলির প্রযুক্তিগত সহায়তা, বৃহৎশিল্প স্থাপন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরী করতে থাকে। শিল্পায়নে অগ্রগতি ঘটানোর জন্য লাইসেন্স প্রদান নীতিতে কঠোরতা হ্রাস করা হয়, আমদানীর ব্যাপারে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়। এর ফলে বৃহৎ শিল্পক্ষেত্রগুলি কেবল সরকার সংরক্ষিত থাকল না, বেসরকারী ক্ষেত্রেও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। এর পর আসে বিশ্বায়ন বা গ্লোবালাইজেশন (Globalisation)-এর অধ্যায়।
বিশ্বায়নের প্রভাবঃ ১৯৯১ সালে বিশ্বায়নের পর থেকে ভারতের শিল্পকে বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় পারদর্শী করার কথা বলা হয়। এই নীতি অনুযায়ী শিল্পগুলির মধ্যে দেশীয় প্রতিযোগীতার পাশাপাশি বৈদেশিক প্রতিযোগীতার সম্মুখীন হওয়ার সামর্থ বৃদ্ধির কথা বলা হয়। নতুন শিল্পনীতি (Industrial Policy), ১৯৯১ শিল্পে লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে সাতটি ক্ষেত্র যেমন প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা ও পরিবেশ ক্ষতিকর শিল্প ব্যাতিত অন্যান্য শিল্প স্থাপনে বাধা দূর করা হয়েছে। একচেটিয়া ও সীমিত বানিজ্য কার্যকলাপ আইন (The Monopolies and Re-strictive Trade Practices Act or MRTP) সংশোধিত করা হয়েছে যাতে বর্তমান শিল্পক্ষেত্রের সম্প্রসারণ এবং বৃহৎ শিল্পসংগঠনগুলি কর্তৃক নতুন শিল্প স্থাপনে সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বায়নের ব্যবসায়িক ও শিল্পায়নের সুযোগ গ্রহনের জন্য শুল্ক হ্রাস, ক্ষেত্রবিশেষে ৪০০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশে বা তারও নিচে নামিয়ে আনা হয়। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত শিল্প ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুক্তি কমানো বা বিলোপ করা হয়। বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয়ের ভান্ডার বাড়ার দিকে লক্ষ দেওয়া হয়। শিল্পক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের কথাও বলা হয়েছে।
বৈদেশিক বিনিয়োগ- বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগে উৎসাহমূলক কর্মসূচী গ্রহণ করার ফলে ১৯৯১-৯২ সালে যা ছিল মাত্র ১৭ কোটি ডলার, ২০১৬-১৭ সালে তা দাঁড়ায় ৬ হাজার কোটি ডলারে, যা বিশ্বায়নের পূর্বের তুলনায় বহুগুন বেশি।
বেসরকারী উদ্যোগে গুরুত্ব প্রদান: সরকারী উদ্যোগগুলির প্রতি কেবল পৃষ্ঠপোষকতা সীমিত না রেখে বেসরকারী উদ্যোগেও যাতে উন্নতি ঘটে সরকার সে বিষয়ে সচেষ্ট হন। ১৯৯১-এর শিল্পনীতির ফলে সরকারী শিল্পক্ষেত্রের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। বহু সরকারী ক্ষেত্রে বছরের পর বছর লোকসানে চলা শিল্পগুলি বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেওয়া হয় অথবা যৌথ উদ্যোগে লাভজনক করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। বিশ্বায়নের পর বেসরকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলি ভারতে আসতে শুরু করায় প্রতিযোগীতা তীব্রতর হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলি মিশে গিয়ে শিল্পোন্নয়নের অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূ মিকা নিয়েছে। এর ফলে ভারতের জাতীয় আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমদানী রপ্তানীর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ অনেক শিথিল হওয়ায় ব্যবসা বানিজ্যে উন্নতির সহায়ক পরিবেশ তৈরী হয়েছে।
ভারতের কৃষি ও খনিজ কাঁচামালের সমৃদ্ধি, সুলভ শ্রমশক্তির প্রাচুর্য, ক্রমবর্ধমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত উন্নত এবং বৈদেশিক সহযোগীতায় উন্নততর প্রযুক্তি আমদানী, শিল্প পন্যের জন্য বৈদেশিক আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে ও বিদেশে বাজারের সুযোগ গ্রহনে সরকারী শুল্কনীতির পরিবর্তন ভারতে শিল্পক্ষেত্রে অগ্রগতির সম্ভাবনা সুচিত করেছে।
২১ শতকের শুরু থেকেই শিল্পক্ষেত্রে বৈচিত্র্যমূলক অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেছে। প্রথাগত শিল্পগুলি যেমন, লৌহ ও ইস্পাত শিল্প, বস্ত্র শিল্প, কাগজ শিল্প ইত্যাদিতে উন্নততর প্রযুক্তি ও কৃৎকৌশলের সাহায্যে উৎপাদনের পরিমান ও গুনগতমান উন্নতিবিধানে যত্ন নেওয়া হচ্ছে। আধুনিকতর শিল্পক্ষেত্র যেমন তথ্য প্রযুক্তি শিল্প, মোটরগাড়ি নির্মান শিল্প ইত্যাদি পূর্বাপেক্ষা অধিকতর গুরুত্ব পেয়েছে। উপগ্রহ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও বিশ্বায়নের হাত ধরে উন্নতি এসেছে তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে এবং জনসাধারনের আর্থিক উন্নতির ফলে চাহিদা বেড়েছে মোটর যানের।