পশ্চিমবঙ্গে মানবোন্নয়ন (Human Development)
মানবোন্নয়ন ঘটে অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রসরতার নিরিখে এবং সমাদর সুষ্ট বন্টনের উপর। পশ্চিমবঙ্গে মানবোন্নয়ন বণ্টন ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজ্য-এর মতোই সুবন্টিত নয়। উত্তরে ৬টি জেলা জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর ও মালদা জেলা; পশ্চিমের ৩ টি জেলা পুরুলিয়া, বাঁকুড়া,বীরভূম, মধ্য বঙ্গে মুশিদাবাদ জেলাটি মানবোন্নয়নে রাজ্যের অন্যান্য অংশের থেকে পিছিয়ে আছে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা ২টি গড় চিত্রে এগিয়ে থাকলেও সুন্দরবন অঞ্চলে মানবোন্নয়নের বাস্তব চিত্র হতাশাব্যাঞ্জক।
মানোবন্নোয়নে পশ্চাদপদতার কারণ: এই অঞ্চলগুলিতে অনেকাংশেই কৃষির উন্নয়ন ঘটলেও শিল্পে অনগ্রসরতা কম শ্রমদিবস সংখ্যা নিম্ন মজুরি উচ্চ বেকারত্ব ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষিজীবির সংখ্যাধিক্য ইত্যাদি মানবোন্নয়নের নিম্নহারের কারণ। এই অঞ্চলগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের (২%-এর কাছাকাছি) সংঙ্গে সংগতি রেখে শ্রমনিযুক্তির হারে (১%-এর আশেপাশে) বৃদ্ধি ঘটছে না। জেলাগুলিতে উন্নয়নের গতি তুলনাম্ লকভাবে ভাল হলেও আশানুরূপ নয়। কৃষির উপর রাজ্যের অত্যাধিক নির্ভরতা অথচ ফসলের বিক্রয় মূল্য
বেশী না হওয়ায় কৃষি নির্ভর জনসাধারণের অর্থনৈতিক তথা মানবোন্নয়নে ঘাটতি থেকেই যায়। শিল্পোন্নয়নের নিম্নহারও মানবোন্নয়নে রাজ্যের অবস্থানে উন্নতি ঘটাতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ঘনত্ব খুব বেশী, ভারতবর্ষের গড় ঘনত্বের প্রায় ৩ গুন। দেশভাগের সময় থেকে শরণার্থী আগমণের ঢেউ এবং পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলি থেকে একসময় শিল্পে এগিয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সংখ্যায় শ্রমজীবী মজুরের আগমণ, জনসংখ্যা ঘনত্ব বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। এছাড়াও পরিবার পরিকল্পনায় ধীর অগ্রগতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ।
অধিক জনঘনত্বের জন্য জনপ্রতি সম্পদের বন্টনের পরিমাণ কম। আঞ্চলিকভাবে সম্পদের উন্নয়নে বৈষম্য ঘটে। জেলাভিত্তিক মানবোন্নয়ন সূচক-এর পরিমাণ দেখলেও এবিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
চার্টটিতে প্রদত্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় স্বাস্থ্যসূচক (Health Index)- এ মালদা সর্বনিম্ন (০.৪৯) এবং কোচবিহার (০.৫০), বীরভূম (০.৫৩), মুর্শিদাবাদ (০.৫৭) সূচক-এর নিম্ন অবস্থায় আছে। স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা এই অঞ্চলে জনসাধারণের কাছ ভালভাবে পৌঁছায়নি বোঝা যায়। পৌরায়নের প্রসার বেশি ঘটেছে এমন জেলাগুলিতে দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যসূচক রাজ্যের গড় মান থেকে বেশি।
আয়সূচক (Income Index) এ পুরুলিয়ার মান অত্যন্ত খারাপ। মাত্র ০.১৮ যা রাজ্যের গড় মান (০.৪৩) থেকে অর্ধেকেরও কম। রাজ্যের সর্বাপেক্ষা পশ্চাদপদ জেলা হিসাবে চিহ্নিত এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক অনগ্রসতার প্রাপ্তিফল ঘটেছে এর আয়সূচকে। বাঁকুড়া (০.২৬), বীরভূম (০.২৭), মুর্শিদাবাদ (০.২৯)-এর অবস্থাও তথৈবচ, রাজ্যের গড় আয়সূচক-এর থেকে অনেক কম। এই জেলাগুলি কৃষিকাজে পিছিয়ে আছে, কারণ বহুজমি সেচের অভাবে এখনও একফসলী, ফসল উৎপাদন কম, শ্রম দিবসের সংখ্যা কম হওয়ায় কৃষিতে শ্রম নিযুক্তিও কম। রাজ্য শিল্পে অনগ্রসর, পরিবহণ ব্যবস্থা বিস্তারেরও অভাব রয়েছে। ফলে আয়ের সুযোগ কম এই সকল অঞ্চলের মানুষদের।
শিক্ষাসূচক (Education Index)-এ জেলাগুলির মান তত খারাপ নয়। মালদা (০.৪৮), মুর্শিদাবাদ (০.৫২), দিনাজপুর (০.৫৩), পুরুলিয়া (০.৫৫)-র অবস্থান যদিও রাজ্যের গড় মান (০.৬৯) থেকে অনেকটাই কম। এই জেলাগুলিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে শিক্ষার সুযোগ সীমিত এবং জনগনের আর্থিক অনগ্রসরতাও শিক্ষার নিম্নহারের কারণ।
HDI র্যাঙ্ক থেকে এটি স্পষ্ট যে কৃষিতে অগ্রসরতা 9বেশ কিছু জেলায় বেশি এবং শিল্পোন্নয়নেও অপেক্ষাকৃত অগ্রসর অঞ্চলগুলিতে পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়াতে সম্পদের বন্টনে অসাম্য এই জেলাগুলিতে কম। এই জেলাগুলিতে জনগণের আর্থিক ও অন্যান্য সামাজিক সুযোগ সুবিধা গ্রহণের সুযোগ বেশী হওয়ায় স্বাস্থ্য, আয়, শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে এই জেলাগুলির জনগন বেশী উপকৃত হয়েছেন। HDI র্যাঙ্ক এই কারণে এই জেলাগুলিতে বেশী। এই জেলাগুলির মধ্যে HDI র্যাঙ্কে ১ম স্থানে কলকাতা (০.৭৮) মূলতঃ পৌর ও শিল্পাঞ্চল; ২য় স্থানে হাওড়া (০.৬৮), এটিও পৌরায়ন ও শিল্পায়নে এগিয়ে; ৩য় স্থানে উত্তর ২৪ পরগণা০.৬৬), পৌরায়ন ও শিল্পসংক্রান্ত কাজকর্মে এগিয়ে: ৪র্থ স্বস্থানে দার্জিলিং (০.৬৫) পাহাড় চা ও পর্যটন শিল্পে অগ্রসর, সমভূমিতে শিল্প ও ব্যবসায় উন্নতি; ৫ম স্থানে বর্ধমান (০.৬৪) কৃষি ও শিল্পে অগ্রগতি, হুগলী (০.৬৩), কৃষি ও শিল্পে অগ্রগতি; মেদিনীপুর (০.৬২), কৃষিকাজে অগ্রসর।
HDI র্যাঙ্কে খুব নিম্ন অবস্থানে রয়েছে মালদা (০.৮৮), কৃষি ও শিল্পে অনগ্রসরতা; পুরুলিয়া জেলা (০.৪৫) কৃষি, শিল্প, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় অনুন্নত; মুর্শিদাবাদ (০.৪৬) কৃষি ও শিল্পে অনগ্রসর; বীরভূম (০.৪৭) কৃষি ও শিল্পে অনগ্রসর। উক্ত অনগ্রসরতার কারণে HDI র্যাঙ্কে রাজ্যের গড় মান (০.৬১)-এর থেকে অনেক নিম্ন অবস্থানে থাকা এই জেলাগুলির অধিকাংশ জনসাধারণ স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উপযুক্ত আয়ের উপযুক্ত সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
এখানে সমাজে নারীর অবস্থান দেখা যাক। লিঙ্গ উন্নয়নসূচক থেকে এই চিত্রটি ধরা পড়ে। সাধারণভাবে। GDI বা লিঙ্গ উন্নয়ন সূচক (Gender Development Index) কিন্তু HDI এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে GDI ও HDI বা মানবোন্নয়ন সূচক (Human Development Index) র্যাঙ্কে খুব পার্থক্য হয় না। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ে নারী-পুরুষে বৈষম্য আর্থিকভাবে অনগ্রসর অঞ্চলগুলিরই বৈশিষ্ট্য। HDI র্যাঙ্ক যত বেশী নারী পুরুষের বৈষমা তত কম হওয়ার সম্ভবনা থাকে। উন্নত দেশগুলির সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনা করলেই দেখা যায় পাশ্চাতা দেশগুলি ইউরোপ ও আমেরিকায় লিঙ্গ বৈষম্য খুব কম বা প্রায় নেই। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলিতে যেমন ধনী দরিদ্রে বৈষম্য, তেমনি দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে নারী-পুরুষে বৈষম্য নারীরা প্রায়শ:ই স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও আয়ের সুযোগ থেকে কম বেশী বঞ্চিত দেখা যায়।
প্রদত্ত জেলাভিত্তিক GDI র্যাঙ্ক এবং স্বাস্থ্য, আয় ও শিক্ষাসূচক থেকে প্রতিভাত হয় যে নারীদের ক্ষেত্রে উক্ত সুযোগ সুবিধাগুলি ততখানি উপলব্ধ নয় ।
পূর্বোক্ত তালিকা থেকে বোঝা যায় ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের মত এই রাজ্যেও লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট এবং জেলাভিত্তিক এর তারতম্য বেশি। নারী শিক্ষার হার কম, বিদ্যালয়ে নাম নথীভূক্ত করণের সংখ্যা পুরুষের তুলনায় কম। স্বাস্থ্য ও পুষ্টির ক্ষেত্রেও নারী অবহেলার শিকার।
পশ্চিমবঙ্গে ভূমি সংস্কার আইন (Land Reform Act) রূপায়িত হবার সময় বর্গায় নাম নথিভূক্তকরণে পুরুষের একক প্রাধান্য ছিল। জমির উত্তরাধিকার স্বত্বও বর্তমানে পুরুষানুক্রমে আসার প্রাধান্য। কৃষি শ্রমের মজুরীর ক্ষেত্রেও দেখা যায় বহু ক্ষেত্রে গ্রামাঞ্চলে নারী শ্রমিকের মজুরী পুরুষের চেয়ে অনেকটাই কম। এই সকল কারণে সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন (Women empowerment) বিলম্বিত হয়েছে। অথচ একটি পরিবারে শিশুপালনের মূল দায়িত্ব নারীর। নারীর ক্ষমতায়ন যেখানে বেশি, যেমন পৌরাঞ্চলে, পরিবারের শিক্ষায়, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির দিকে যত্নও বেশী। ফলে মানবোন্নয়নে গতি আসে।
পূর্বোক্ত তালিকা থেকে দেখা যায় নিম্ন মানবোন্নয়ন বিশিষ্ট জেলাগুলি যেমন- দ.২৪ পরগণা, নদীয়া, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, কোচবিহার, দিনাজপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া, মালদা এদের মানবোন্নয়ন সূচক রাষ্ট্রের গড় মানবোন্নয়ন সূচক থেকে কম। আবার GDI-এর ক্ষেত্রে এই জেলাগুলিরই গড় মান রাজ্যের গড় GDI মান থেকে কম।
উপসংহার: নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজন প্রথমতঃ নারী শিক্ষার প্রসারে উৎসাহ দান। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কন্যাশ্রী প্রকল্প চালু করায় নারী শিক্ষায় উল্লেখনীয় অগ্রগতি ঘটছে। স্বাস্থ্য কর্মসূচীতে নারীদের অধিকতর সংখ্যায় যোগদান সম্ভব হলে এবং স্বনির্ভর গোষ্ঠী (Self-help group)-এর মাধ্যমে অধিকতর সংখ্যায় নারীদের যুক্ত করা গেলে নারীদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভরতা লক্ষে অনেকখানি এগোনো যাবে। এছাড়া গ্রামে নারী-পুরুষের মজুরীগত বৈষম্য হ্রাসও নারীদের আয় বৃদ্ধির সহায়ক হবে। পশ্চিমবঙ্গে আরেকটি সদর্থক পদক্ষেপ হল পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় অধিকতর সংখ্যায় নারীদের যোগদান যে পরিসংখ্যানে পশ্চিমবঙ্গ দেশের প্রথম সারিতে। গ্রামাঞ্চলে নারীর ক্ষমতায়নে ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে এটি সহায়ক হবে বলেই ধারণা।