ভারতে মানব উন্নয়ন(Human Development in India)
মানবোন্নয়ন সূচক (Human Development Index): UNDP (United Nations Development Programme) রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি সুসংবদ্ধ মানব উন্নয়ন কর্মসূচী। মানব উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমীক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে। মানব উন্নয়নের বিষয়ে কতকগুলি মূল নির্দেশিকার কথা বলা হয়েছে তাদের কর্মসূচীতে। বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচিতে শিক্ষা, আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু ইত্যাদি বিষয়গুলিকে সূচক হিসেবে ধরে সহায়তা প্রকল্প নির্ধারণ করেন। এই বিষয়গুলিই বেসিক হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস (Basic Human Development Indicators) নামে পরিচিত এবং এর ভিত্তিতেই রচিত হয় যে সূচক তাকে HDI বা মানবোন্নয়ন সূচক বলে। এটি দ্বারা কোনো দেশ বা অঞ্চলের মানবোন্নয়ন সম্পর্কে ধারণা করা যায়। এর অন্তর্গত বিষয়গুলির মধ্যে রয়েছে-
• জন্মকালীন প্রত্যাশিত গড় আয় (Life Expectancy at Birth):
• বয়স্ক সাক্ষরতা (Adult Literacy)
• বিদ্যালয়ে নথীভুক্ত করণের অনুপাত (School Enrolment Ratio)
শিক্ষার সূচক (Education Index)
মোট জাতীয় উৎপাদন-এর সূচক (GDP Index)
নিরাপদ জলের সুবিধা পেয়ে থাকে এমন জনসংখ্যার হার (P. C. of Population with Access to Safe Drinking Water Sources)
কম ওজনের শিশু সংখ্যা (Number of Under Weight Children):
• দৈনিক আয় (Per capita Income)
• দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী জনসংখ্যা (People Living Below Poverty-line)
• জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (Population Growth Rate)
• পৌরজনসংখ্যার হার (Urban Population Percentage)
• প্রজনন হার (Fertility Rate)
• পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা (Facilities of Sanitation)
• ওষুধপত্রের সুবিধা পেয়ে থাকেন তার হার (Access to Medicinal Benefit Rate)
• প্রতিরোধক টাকাকরণের সুবিধা (Facilities of Immunisation)
• চিকিৎসকের সংখ্যা প্রতি লাখে (No. of Physicians Per 1,00,000 Population)
• স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় (Percentage of GDP Expenses)
প্রযুক্তিগত সহায়তা (Technological Support)
• অর্থনৈতিক বৈষম্য (Economic Disparity)
বেকারত্ব (Unemployment) প্রভৃতি
এই সকল নির্দেশিকাগুলির বিবেচনায় হিউম্যান ডেভেলপম্যান্ট ইনডেক্স (Human Development Index)
করা হয়েছে যার ভেতরে নির্দিষ্ট করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের HDI Rank। নরওয়ের স্থান ১ নম্বরে এবং ভারত ১২৭নম্বরে। ১৭৫ নম্বরে রয়েছে আফ্রিকার দরিদ্র দেশ সিয়েরা লিওন। ২০১১ সালের -এর তালিকাটি দেওয়া হ'ল।
মূলবৈশিষ্ট্য (Salient Features)
[১] HDI Rank: HDI Rank-এ সর্বশীর্ষে রয়েছে নরওয়ে দেশ। এই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নিরিখে HDI ০.৯৪৪। ভারতের HDI Rank বিশ্বের মোট ১৭৫টি দেশের মধ্যে ১২৭ (২০১১)। HDI মানের দিকে থেকে এই দেশ মধ্যম শ্রেণিভুক্ত। ভারতের HDI মান ০.৫৯০। সবচেয়ে কম সিয়েরালিওন ০.২৭৫।
[২] প্রত্যাশিত গড় আয়ু (Life Expectancy at Birth) : শীর্ষে আছে জাপান। এই দেশের জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু ধরা হয় ৮১.৩ বছর। ভারতে এই প্রত্যাশা ৬৩.৩ বছর।
[৩] বয়স্ক শিক্ষার হার (Adult Literacy Rate): বয়স্ক শিক্ষার হার যেখানে ৯৯ শতাংশ-এর ওপর নরওয়ে, সুইডেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, জাপান বা ব্রিটেনের মতো দেশগুলিতে হয়েছে সেখানে ভারতে এই হার ৫৮ শতাংশ। দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দের স্বল্পতা, প্রাথমিক ও সার্বিক শিক্ষা প্রকল্প রূপায়ণে ত্রুটি, গ্রামীণ দারিদ্র বয়স্ক শিক্ষার হার কম হওয়ার কারণ।
[৪] জনপ্রতি জাতীয় উৎপাদন (GDP Per Capita): GDP জনপ্রতি সবচেয়ে বেশি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে।এদেশে জনপ্রতি GDP Per Capita ৩৪,৩২০ ডলার। উন্নয়নশীল দেশ ভারতে জনপ্রতি GDP Per Capita হল মাত্র ২,৮৪০ ডলার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কি ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে এ থেকে পরিস্ফুট হয়। উচ্চ আয়ের সুযোগ এবং উচ্চ জীবনযাত্রার মান নরওয়ে, সুইডেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলিতে, নিম্ন ও মাঝারি আয়ের সুযোগ ও জীবনযাত্রার মান ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে দেখা যায়।
[৫] জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (Population Growth Rate): জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নরওয়ে, জার্মানি, ফ্রান্সও ব্রিটেনে ০-০.৫ শতাংশের মধ্যে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে, চিনে ১ শতাংশের কাছাকাছি। ভারতে এই হার প্রায় ২ শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উন্নতদেশগুলিতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় এবং আর্থিক উন্নতি অতি দ্রুততর হওয়ায় জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান উচু। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশে বৃদ্ধির হার বেশি হওয়ায় বিপুল জনসংখ যার রোজগারের সুযোগ সংকুচিত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির মান নিম্ন হওয়ায় অধিকাংশ জনসংখ্যার জীবযাত্রার মানও নিম্ন।
[৬] স্বাস্থের অবস্থা (Status of Health): উন্নত দেশগুলিতে যেখানে কম ওজনের শিশু (Underweight children) সংখ্যা নগন্য (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র ১ শতাংশ) সেখানে ভারতে এই হার প্রায় অর্ধেক, ৪৭ শতাংশ। ভারতে অর্ধেকের কাছাকাছি শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়।
অপুষ্টিতে (Lack of nutrition) ভোগেন এরূপ জনসংখ্যা ভারতে ২১ শতাংশ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এই সংখ্যা প্রায় অনুপস্থিত।
প্রতি লাখ জনসংখ্যার (Physician per lakh population) জন্য আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে যেখানে ২৭৬ জন ডাক্তার রয়েছেন, ভারতে রয়েছেন মাত্র ৪৮ জন ডাক্তার।
স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় (Health expenditure) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে মোট জাতীয় উৎপাদনের ৬ শতাংশ, সেখানে ভারতে তা মাত্র ৩ শতাংশের মতো। অত্যাবশ্যক ওষুধ (Essential drugs) আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৯৫-১০০ জন লোক অত্যাবশ্যক ওষুধ ক্রয়ে সমর্থ হলেও ভারতে অঞ্চলবিশেষে এই হার ০-৪৯ শতাংশ।
বয়স্ক জনসংখ্যা (Elderly population) অর্থাৎ ৬৫ বৎসরের ওপর জনসংখ্যা পৃথিবীতে মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। জাপানে এই হার ১৭.৭ শতাংশ। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১২.৩ শতাংশ ও ভারতে প্রায় ৭ শতাংশ। উন্নত দেশগুলিতে পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের সু-অবস্থা লোকের দীর্ঘায়ুর কারণ। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এর অভাবে বয়স্ক জনসংখ্যার হার কম।
উন্নত পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা (Sanitation facilities) উন্নয়শীল দেশগুলিতে অপ্রতুল। বিশ্বে গড়ে যেখানে ৬১ শতাংশ লোক এই সুবিধা ভোগ করেন, ভারতে মাত্র ২৪ শতাংশ লোক উন্নত পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা পান। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ১০০ শতাংশ লোকের এই সুবিধা রয়েছে।
[৭] পৌরায়ণ (Urbanisation): পৌরায়ণের মান জনসাধারণের আর্থিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিকে সৃচিত করে। বিশ্বের ৪৭.৭ শতাংশ লোক (২০০১) পৌর এলাকায় বাস করে। উন্নয়শীল দেশগুলির মাত্র এক-তৃতীয়াংশ লোক পৌর এলাকায় থাকেন। জাপান (৭৯ শতাংশ), ব্রিটেনে (৮৯.৫ শতাংশ), আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে (৭৭৪ শতাংশ) অধিকাংশ লোক পৌর অধিবাসী। ভারতে মাত্র ২৭.৯ শতাংশ লোক পৌর এলাকায় থাকেন। উন্নয়নশীল দেশগুলির গ্রামাঞ্চলে অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, শিক্ষায়তনের অপ্রতুলতা, বিরল সংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীন বৈদ্যুতিকরণের অভাব জনজীবনকে চরম অসুবিধার সম্মুখীন করে।
[৮]আধুনিক স্বাচ্ছন্দ ও ভোগ (Modern Amenities and Consumption): আধুনিক স্বাচ্ছন্দ ও ভোগের পরিমাণে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ব্যাপক বৈষম্য দেখা যায়। উন্নত দেশগুলিতে যেখানে শিক্ষা, স্বাদ, বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ রয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলির এক বিরাট সংখ্যক মানুষ শিক্ষা, উন্নততর স্বাস্য পরিষেবা, ন্যূনতম পুষ্টির সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
[৯] টেলিযোগাযোগ (Telecommunication): পরস্পর যোগাযোগ ও বার্তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলি প্রভূত এগিয়ে রয়েছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে টেলিফোন গ্রাহকের সংখ্যা প্রতি হাজার জনসংখ্যা পিছু ৬৬৭, ভারতে এই সংখ্যা ৩৮। সেলফোন গ্রাহক ও ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যেখানে প্রতি হাজার জনসংখ্যায় যথাক্রমে ৪৫১ জন ও ৫০১ জন, ভারতে এই সংখ্যা যথাক্রমে ৬ জন ও ৬.৮ জন মাত্র। তবে সাম্প্রতিককালে ভারতে সেলফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
[১০] অন্যান্য (Others): প্রযুক্তিগত উন্নয়নের হার, আর্থিক কার্যকলাপ, বাণিজ্যের গঠন (উদ্বৃত্ত ও ঘাটতি বাণিজ্য ও তার পরিমাণ), বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ, মূলধনী ঋণের পরিমাণ, সরকারী ব্যায়ে প্রাধান্য দান (শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রতিরক্ষা), লিঙ্গ-বিষয়ক বৈষম্য, নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, শক্তি ও পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ও HDI মান নির্ণয়ে সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়।