ভারতে মানব উন্নয়ন (Human Development in India)
ভারত পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলির অন্যতম। স্বাধীনতা লাভের আগে আমাদের দেশের মানব উন্নয়নের ধারা যেরকম ছিল, স্বাধীনতা লাভের পরে তার দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে। 2005 খ্রিস্টাব্দের Human Development Report অনুসারে পৃথিবীর 177টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল 127, 2009 খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্থান হয় 134 পৃথিবীর 182টি দেশের মধ্যে। 2011 খ্রিস্টাব্দের Human Development Report অনুসারে পৃথিবীর দেশের মধ্যে ভারতের স্থান। 2005 খ্রিস্টাব্দে মানব উন্নয়ন সূচকের পরিপ্রেক্ষিতে নরওয়ের স্থান ছিল পৃথিবীতে প্রথম। এই দেশের HDI মান ছিল 956। এই সময় ভারতের HDI মান ছিল 545। অর্থাৎ, পৃথিবীর ১ম স্থানাধিকারী দেশের সঙ্গে এর পার্থক্য হল 411। ভারতে মানব সম্পদের উন্নয়ন ঘটলেও তা এখনও অনেক উন্নয়নশীল দেশের নিরিখে বেশ পিছিয়ে আছে। 2009 খ্রিস্টাব্দের পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতের GDI মান ছিল 594 (স্থান 114)। 2002 খ্রিস্টাব্দে ভারতের স্থান ছিল 103।
ভারতে প্রত্যাশিত জীবনের আয়ু ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। 1951 খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছিল ছেলেদের ক্ষেত্রে 37.2 বছর এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে 36.2 বছর। কিন্তু 2001 খ্রিস্টাব্দে প্রত্যাশিত গড় আয়ু ছেলেদের এবং মেয়েদের ক্ষেত্রে বৃদ্ধি পেয়ে হয় 63.9 বছর ও 66.9 বছর।
∎ আফ্রিকা মহাদেশে মানব উন্নয়নের স্বল্প হার:
আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের দেশগুলিতে মানব উন্নয়ন সূচকের মান খুব কম পরিলক্ষিত হয়। কিছু কিছু আফ্রিকান দেশে বর্তমানে মানব উন্নয়ন সূচকের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইথিওপিয়ার স্থান 11, বৎসোয়ানা, বেনিন এবং Burkina Faso প্রথম 25টি দেশের মধ্যে আছে যারা দ্রুত মানব উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, এমনকি পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রত্যাশিত জীবনের আয়ু হ্রাস পেয়েছে। চিনে Gross Enrollment Ratio কমে গেছে। আর্মেনিয়া এবং ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে প্রত্যাশিত আয়ু উন্নত দেশগুলির মতো। বর্তমানে 61% মরোক্কোর শিশু স্কুলে পড়াশুনা করে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, যুদ্ধ, অশিক্ষা, শিল্পে পিছিয়ে পড়া প্রভৃতি কারণে আফ্রিকার দেশগুলিতে মানব উন্নয়নের হার নিম্ন। পৃথিবীর যেসব দেশে HIV আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশি সেইসব দেশে প্রত্যাশিত গড় আয়ু পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। আফ্রিকার অধিকাংশ দেশে 15%-এর বেশি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ HIV +ve-এ আক্রান্ত। এসব দেশে মানুষের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ১। বছরের কম। ড্রাগে আসক্তি, অত্যধিক মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, জীবনের অনিশ্চয়তা এগুলিও আয়ুহ্রাসের কারণ।
দীর্ঘকালীন যুদ্ধবিগ্রহ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিককালে আফগানিস্তানে (1979-1989. 2001 থেকে এখনও পর্যন্ত), কাম্বোডিয়া (1967-1999) এবং মোজাম্বিক (1975-1992)-এ বিভিন্ন দাঙ্গা, যুদ্ধবিগ্রহের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটেছে।
পুষ্টি (nutrition) স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। পুষ্টির জোগান নির্ভর করে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের আয়ের ওপর। দীর্ঘকালীন ক্ষুধার্ত এবং অপুষ্টির কারণে মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি মৃত্যুর হারও এর জন্য বৃদ্ধি পায়। তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলিতে অশিক্ষার সঙ্গে অপুষ্টিও মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই মানব উন্নয়নের জন্য এসব দেশে খাদ্য নিরাপত্তা (food security) আগে দরকার।
Jean Dreze এবং Amartya Sen-এর মতে, Hunger is a many-headed monster. highlighting the many ways a lack of food that can affect people's freedom
1970 খ্রিস্টাব্দ-2010 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশে শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে পৃথিবীর অধিবাসীদের মধ্যে শিক্ষাগত দিক দিয়ে যোগ্যতামান বৃদ্ধি পেয়েছে। 1960 খ্রিস্টাব্দের 4-15 বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা 2010 খ্রিস্টাব্দে এসে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই হারের প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি ঘটেছে। Average Education Index বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি ঘটেছে। বর্তমানের যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাক্ষরতার হার 95%-99%। বেশির ভাগ দেশে শিশুদের স্কুলে যাওয়ার প্রবণতাও খুব দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিগত কয়েক দশকে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে Enrollment Ratio-র পার্থক্য অনেক কমে গেছে। এমনকি মেয়েদের মধ্যে Enrollment Ratio ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়। 1991 খ্রিস্টাব্দ থেকে 2007 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মেয়েদের মধ্যে Completion Rate 87% এবং ছেলেদের মধ্যে ৭০%। উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বর্তমানে মেয়েরা পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে ছেলেদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় পড়তে আসছেন। দক্ষিণ এশিয়া এবং সাব-সাহারা আফ্রিকাতে ছেলেরা মেয়েদের তুলনায় শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে আছে।আফগানিস্তান, বেনিন, মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিক, হাইতি, লাইবেরিয়া, মোজাম্বিক, নাইজার, টোগোর মেয়েরা ছেলেদের শিক্ষাকেন্দ্রে কাটানো বছরের চেয়ে অর্ধেক অতিবাহিত করে।
∎ বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি: সমগ্র বিশ্ব জুড়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেসরকারি স্কুলে প্রাথমিক স্তরে 92% মাধ্যমিক স্তরে ৪5% এবং ছাত্রছাত্রী বিশ্বজুড়ে পড়ছে। 1970 খ্রিস্টাব্দে মোট GDP-র 3.9% শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় করা হয়েছিল। কিন্তু 2006 খ্রিস্টাব্দে শিক্ষাক্ষেত্রে GD.P-র 5.1% ব্যয় করা হয়েছে। ছাত্রপিছু সম্পদ বিনিয়োগের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত হ্রাস পেয়েছে। তবে সর্বক্ষেত্রে শিক্ষার গুণগত মানের উন্নতি হয়নি, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে। উন্নয়নশীল দেশের ছেলেমেয়েরা। এখনও উন্নত দেশের শিক্ষার্থীদের চেয়ে 20% নম্বর কম পাচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট অভিক্ষাপত্রের পরীক্ষায়। এমনকি কিছু কিছু দেশে বিদ্যালয়ের বেতন এবং ইউনিফর্ম এবং অন্যান্য ব্যয়ের জন্য শিক্ষার্থীদের মধ্যে drop out-এর সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে এই ঘটনা বেশি লক্ষণীয়।
■ জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন: বিগত 20 বছরে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু আয়ের বণ্টন সুষম নয়। 1970 খ্রিস্টাব্দ থেকে এখন পর্যন্ত 155টি দেশের মধ্যে 95% দেশের per capita income বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে মাথাপিছু আয় $10,760 যা বিগত 20 বছরে প্রায় 15 গুণ। বিশ্বজুড়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যগত বিষয়ে উন্নয়নের মধ্যে বেশ কিছুটা সাম্য থাকলেও আয়ের ক্ষেত্রে একেবারে বিপরীত চিত্র পরিলক্ষিত হয়। 2010 খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলির 2.3% বার্ষিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। চিন, মালয়েশিয়া, এই পেজে থাইল্যান্ড এইসমস্ত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের হার খুব দ্রুত। ইরান, সেনেগাল দেশদুটির অর্থনৈতিক উন্নয়ন স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। আইভরি কোস্ট, মাদাগাস্কার, জিম্বাবোয়ে এই দেশগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে ভেঙে পড়েছে।
প্রকৃত এবং আপেক্ষিক দিক থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশ ভালো। 1970 খ্রিস্টাব্দে জিম্বাবোয়ে দেশটি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় যতটা দরিদ্র ছিল 2010 খ্রিস্টাব্দে তার চেয়ে আরও 25% দারিদ্রদ্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে চিন বর্তমানে অর্থনৈতিক দিক থেকে খুবই সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। 1970 খ্রিস্টাব্দ থেকে 2010 খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চিনের per capita income 20 গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একসময় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনার per capita income বেশ দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই দুটি দেশেরই অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ খারাপ অবস্থায় আছে। কোনো ব্যক্তি যদি নাইজার দেশে জন্মগ্রহণ করে তবে ওই ব্যক্তির প্রত্যাশিত আয়ু ডেনমার্কের জন্মানো ব্যক্তি অপেক্ষা 26 বছর কম হবে, 9 বছর কম শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাবে এবং ডেনমার্কে জন্মানো ব্যক্তি অপেক্ষা 53 গুণ কম সম্পদ ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পাবে।
সাধারণত per capita income-এর সঙ্গে প্রত্যাশিত জীবনের আয়ুর একটা সম্পর্ক থাকে। per capita income বাড়লে Life Expectancy বাড়বে। কিন্তু বিগত 40 বছরে সমগ্র বিশ্বে এই নিয়ম সর্বত্র দেখা যাচ্ছে না। কোনো ওষুধের মূল্য হ্রাস পেলে দরিদ্র দেশগুলিই সবচেয়ে বেশি ওই ওষুষগুলি ব্যবহারের সুযোগ-সুবিধা পায়। কাম্বোডিয়ার মতো দেশে সর্বদা রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও এই দেশটিতে মানব উন্নয়নের মধ্যে ধারাবাহিকতা বজায় আছে। অনেক ক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে, তাদের মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেশ বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, ভারত, বাংলাদেশ, কেনিয়া, ফিলিপাইনস-এই দেশগুলিতে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারগুলিতেও মোবাইল ফোনের ব্যবহার খুব দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।এর কারণ মোবাইল ব্যবহারের মাধ্যমে তারা স্বল্প খরচে যোগাযোগ এবং অন্যান্য কাজ পরিচালনা করছে। সর্বক্ষেত্রেই যে মানব উন্নয়ন সূচকের উচ্চমান গণতন্ত্র, সাম্যতা কিংবা সুস্থায়ী উন্নয়নের নির্দেশক তা বলা যায় না।
■ নারী সক্ষমতার পরিমাপ: নারী সক্ষমতা বলতে মেয়েদের কোনো বিষয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে বোঝানো হয়। স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগ্রহণ, দেশ কিংবা সমাজে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে নারীদের অংশগ্রহণ প্রভৃতির মাধ্যমে নারীর সক্ষমতা প্রকাশ পায়। নারী সক্ষমতার প্রথম ধাপ হল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। এজন্য দেখা যাচ্ছে, যে সব দেশের HDI- মান খুব বেশি তাদের দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক সরকার কম লক্ষণীয়। এজন্য এখানে মানব উন্নয়নের হার যেমন এম, তেমনি নারী স্বাধীনতাও খুব কম।