ভারতের ভৌগোলিক অঞ্চল(Geographical Regions)
অঞ্চল সম্পর্কে ধারণা (Concept of Region)
অঞ্চল ও আঞ্চলিকীকরণ: ভৌগোলিক এবং প্রাকৃতিক উভয় প্রকার হইতে পারে। প্রাকৃতিক অঞ্চল নির্ণয়ে কেবল প্রাকৃতিক বিষয়সমূহেরই সমতা লক্ষ্য করা হয়, ভৌগোলিক আঞ্চলিকীকরণে নির্ণয়ে প্রাকৃতিক ও আর্থ-সামাজিক উভয় নিয়ন্ত্রকগুলি বিবেচিত হয়। অধ্যাপক হার্বার্টসন প্রাকৃতিক অঞ্চল নির্ণয়ে ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু ও স্বাভাবিক উদ্ভিদের সমতার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ে প্রাকৃতিক বিষয়সমূহের সমতা যেমন লক্ষণীয়, তেমনি সমপ্রাকৃতিক পরিবেশে আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যসমূহের সমতা আছে এরূপ অঞ্চলসমূহকে একই ভৌগোলিক অঞ্চলভুক্ত করা হয়। অর্থাৎ ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের সম্পর্ক নির্ধারণ করা হয় এবং সমবৈশিষ্ট্যপূর্ণ অঞ্চলগুলিকে একই ভৌগোলিক অঞ্চলভুক্ত করা হয়।
সংজ্ঞা (Definition): ভৌগোলিক অঞ্চলের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায়, যে সকল অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, মৃত্তিকা, উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল এবং মানুষের জীবনযাপন প্রণালী প্রায় অনুরূপ সেই সকল অঞ্চল নিয়েই গড়ে ওঠে একটি ভৌগোলিক অঞ্চল।
প্রয়োজনীয়তা (Necessity): ভূগোলশাস্ত্রে ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ধারণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কারণ কোন দেশ বা অঞ্চলের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক সীমানা মনুষ্যকৃত এবং তা পরিবর্তনশীল। কিন্তু ভৌগোলিক অঞ্চল কতকগুলি প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠায় মানুষের হঠকারী সিদ্ধান্তে বা প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে সহজেই তা পরিবর্তনযোগ্য নয়। সুতরাং আঞ্চলিক ভূগোল পাঠের আলোচনায় ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ধারণের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনেক বেশি।
বিস্তার (Extent): ভৌগোলিক অঞ্চলের বিস্তার ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অঞ্চলে হতে পারে। সাধারণতঃ একটি বৃহৎ বা মুখ্য ভৌগোলিক অঞ্চল (Macro Regions) কতকগুলি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র বা গৌণ ভৌগোলিক অঞ্চল (Micro Region)-এ বিভক্ত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সমগ্র গঙ্গা সমভূমির ভৌগোলিক পরিবেশ মোটামুটি একই ধরণের বলে গঙ্গা সমভূমিকে একটি বৃহৎ ভৌগোলিক অঞ্চলরূপে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন বা ব-দ্বীপীয় অংশে গাঙ্গেয় সমভূমির প্রাকৃতিক এবং অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রায় কিছু পার্থক্য রয়েছে বলে উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন অববাহিকাকে আবার মাঝারি বা গৌণ অঞ্চলে ভাগ করা হয়। কিন্তু নিম্ন গাঙ্গেয় বা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অন্তর্গত বিভিন্ন অংশের আবার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা রয়েছে। যেমন, ব-দ্বীপের সুন্দরবন অংশটিতে ক্রান্তীয় ব-দ্বীপের বাস্তুসংস্থানের একটি উল্লেখযোগ্য স্বকীয়তা রয়েছে। এদিক থেকে ক্ষুদ্রতর ভৌগোলিক অঞ্চল চিহ্নিত করবার সুযোগ রয়েছে। এভাবেই ক্ষুদ্রতর ভৌগোলিক অঞ্চল (Micro Regions)-এর সৃষ্টি হয়।
সীমানা (Boundary): একটি ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে অন্য ভৌগোলিক অঞ্চলের সীমানা হঠাৎই শুরু হয়ে যায় না। এদের মধ্যে থাকে একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চল (Transitional Zone)। এই পরিবর্তনশীল অঞ্চলে উভয় অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ মৃদু লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এটিকে যেকোন একটি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে সুগম। সকল অঞ্চলকেই বিভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলভুক্ত করা হয়েছে। এদিক থেকে অনুরুপ সকল স্থানই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলভুক্ত।
ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ের ভিত্তি বা পদ্ধতি (Basis of Regionalisation)
ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ের পদ্ধতি কিন্তু ত্রুটিমুক্ত নয়। ভৌগোলিক অঞ্চল চিহ্নিতকরণের জন্য যে বিষয়গুলির ওপর বিভিন্ন সময়ে ভূ-বিজ্ঞানীগণ গুরুত্ব দিয়েছেন তাহা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। কেউ কেউ ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ে ভূ-প্রকৃতি, আবার কেউ জলবায়ুর উপর অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু এরূপ শ্রেণীবিভাগের কোনটিই ত্রুটিমুক্ত নয়। কারণ ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ুর দ্বারা কোন অঞ্চলের বৈশিষ্ট। অনেকখানি প্রভাবিত হয় একথা ঠিকই, কিন্তু অঞ্চলটির অক্ষাংশীয় অবস্থান, মৃত্তিকার প্রকৃতি, উদ্ভিদশ্রেণী, অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবনযাত্রার উপকরণ প্রভৃতিও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কোন কোন ভূগোলবিদ ভৌগোলিক অঞ্চল নির্ণয়ে আর্থসামাজিক বৈশিষ্টের উপর অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এরূপ অঞ্চল বিভাগেও যথেষ্ট ত্রুটি থেকে যায়।
একই প্রকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত অঞ্চলে আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রারও ব্যাপক ভিন্নতা গড়ে উঠতে পারে। এই কারণে কেবল প্রাকৃতিক বা সাংস্কৃতিক উপকরণ নয়, প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক উভয় প্রকার উপকরণের মিলনে আঞ্চলিক ঐক্য গড়ে ওঠে যে সকল অঞ্চলে, সেগুলি ভৌগোলিক অঞ্চলরূপে চিহ্নিতকরণের খুবই সুবিধাজনক উপকরণ। তবে এরূপ সঠিক সীমানা চিহ্নিতকরণ বাস্তবিক দুরুহ ব্যাপার।