গ্রামীণ বসতির কর্মধারা (Functions of Rural Settlement):
পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গ্রামীণ বসতিতে মানুষের মধ্যে নানান প্রাথমিক অর্থনৈতিক কার্যকলাপ দেখা যায়। পরবর্তীকালে গ্রামগুলি যত উন্নত হতে থাকে কার্যকলাপও কিছুটা উন্নত ধরনের হতে থাকে।
গ্রামীণ বসতির প্রধান কর্মধারাগুলি হল-
(i) কৃষিকাজ (Agriculture): গ্রামীণ বসতির প্রধান কর্মধারা হল কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করে মানুষের বসতি স্থাপন করা। এজন্য খামার বসতি এর অন্যতম অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। ভারতের অধিকাংশ গ্রামেও অধিবাসীরা কৃষিকাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে সংকীর্ণ উপত্যকায় বিভিন্ন ধরনের কৃষিজ ফসল উৎপাদন করা হয়। এসব অঞ্চলেও কৃষিভিত্তিক গ্রামের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে সমতল কৃষিজমির আশেপাশে গ্রামের অবস্থান দেখা যায়। উনবিংশ শতকে জার্মানির কৃষি খামারগুলির আশেপাশে গ্রামগুলি গড়ে উঠেছিল এবং সেখানকার অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ।
(ii) পশুপালন (Grazing of Animals): পশুপালন আগেও করা হত। এখনও এই কাজ প্রচলিত আছে। তবে বর্তমানে পৃথিবীর তৃণভূমি অঞ্চল এবং অন্যান্য অরণ্য অঞ্চল কিংবা পার্বত্য অঞ্চলের কাছে গড়ে ওঠা গ্রামগুলিতে উপজাতিরা পশুপালনে নিযুক্ত আছে। পশ্চিম হিমালয়ে গাড্ডি (Gaddi) উপজাতিরা গ্রীষ্মকালে পার্বত্য অঞ্চলের উঁচু অংশে সাময়িকভাবে বসতি স্থাপন করে। কিছুকাল এখানে প্রোপাগান করার পর শীতের শুরুতে পর্বতের নীচু অংশে নেমে আসে। উত্তর আমেরিকার প্রেইরী, তিন আমেরিকার পম্পাস এবং মধ্য-এশিয়ার স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলে পশুপালন নির্ভর গ্রামীণ বসতি রাড় উঠেছে।
(iii) মৎস্য শিকার (Fishing): সব গ্রামই যে কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে তা নয়। কৃষি এরা অন্য পেশা বা কাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গ্রামগুলির মধ্যে মৎস্য গ্রামগুলিই (Fishing Village) এরম। এই গ্রামগুলি নদী, সমুদ্রের উপকূল কিংবা হ্রদের তীরে গড়ে ওঠে। প্রধান জীবিকা মৎস্য শিকার এসেও অধিবাসীরা কৃষিকাজও করে। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর জেলার জুনপুট মৎস্য শিকার গ্রামের জাহরণ। ওডিশার চিলকার উত্তর অংশে এরকম গ্রাম দেখা যায়। কেরালার উপকূলবর্তী অঞ্চলেও মৎস্য একার অধিকাংশ অধিবাসীদের প্রধান জীবিকা।
(iv) খনিজ সম্পদ আহরণ (Mining Activity): পৃথিবীর কিছু কিছু জায়গায় খনিজ উত্তোলন গ্রামে(Mining Village) খনিজ সম্পদ সংগ্রহ করা অধিবাসীদের প্রধান কাজ। তবে এই ধরনের গ্রাম প্রাচীন এলেই বেশি, গড়ে উঠেছিল। যেমন- উত্তর ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ বেলজিয়ামে কয়লাকে কেন্দ্র করে এই গানের গ্রাম গড়ে ওঠে। যেহেতু খনিজ সম্পদ সংগ্রহ এখন আর প্রাথমিক অর্থনৈতিক কাজের অন্তর্গত না. তাই বর্তমানে এ ধরনের গ্রামের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। ওডিশার বোলানি গ্রামের অধিবাসীদের ঐবিকা হল খনিজ সম্পদ উত্তোলন।
(v) কাষ্ঠ সংগ্রহ (Lumbering): অরণ্যের কাষ্ঠ সম্পদকে কেন্দ্র করেও গ্রামীণ বসতি গড়ে ওঠে।কিন্তু বর্তমানে অরণ্য সম্পদ সংরক্ষণ নিয়ে এত কঠোর নিয়মকানুন আছে যে, কাষ্ঠসংগ্রহ প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তা ছাড়া কাষ্ঠকে কেন্দ্র করে কাষ্ঠশিল্প গড়ে ওঠে বলে তা গ্রামীণ বসতির অন্তর্গত হয় না। বনাঞ্চলের সীমান্তের অধিবাসীদের মধ্যে এই ধরনের জীবিকার প্রচলন দেখা যায়। এধরনের এলাকায় অনেকক্ষেত্রে সবুজ শ্রম গড়ে ওঠে। একদা নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ডের সরলবর্গীয় অরণ্য অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে ভাইসম্পদ আহরণ প্রধান জীবিকা ছিল।
(vi) ক্ষুদ্র শিল্প ও কুটির শিল্প (Small Industry and Cottage Industry): যেহেতু কৃষিকাজই গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান মাধ্যম তাই কৃষিজ সম্পদকে কেন্দ্র করে অনেকসময় গ্রামে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গড়ে ওঠে। যেমন- তাঁত শিল্প, মাটির মূর্তি তৈরি, ছুতোর মিস্ত্রি কর্তৃক কাঠের কাজ প্রভৃতি এবং মুরশিদাবাদের চক ইসলামপুরে তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে কৃষ্ণনগরের মৃৎশিল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গ্যে গ্রামের আকৃতি, গঠন ও কর্মের পরিবর্তন ঘটে। শিক্ষার প্রসার, কৃষির উন্নতি, যোগাযোগ এবস্থার উন্নতি, বাজারের আয়তন বৃদ্ধি প্রভৃতি কারণে গ্রামগুলিও ধীরে ধীরে পৌর বসতিতে পরিণত হচ্ছে।
(vii) প্রশাসনিক কাজকর্ম (Administrative Function): যেসব গ্রামগুলিতে B.D.O অফিস, পঞ্চায়েত অফিস অবস্থিত সেইসব গ্রামের একটি অন্যতম কাজ হল বিভিন্ন ধরনের প্রশাসনিক কার্য পরিচালনা করা। এই গ্রামগুলির আয়তনও অনেক বড়ো হয়।