welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ভারতের অরণ্য সম্পদ(Forest Resource of India)

ভারতের অরণ্য সম্পদ(Forest Resource of India)


ভূমিকা: প্রকৃতিতে আপনা থেকেই যে উদ্ভিদ জন্মে তাকে স্বাভাবিক উদ্ভিদ বলে। স্বাভাবিক উদ্ভিদের বণ্টন ঘন ও ব্যাপক হলে তাকে অরণ্য বলে।

ভারতের আয়তনের ১/৫ ভাগ অঞ্চল অরণ্যে আবৃত। ঘন বনভূমি টিকে আছে কেবল দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে। কৃষি ও বসতি বিস্তারের ফলে সমভূমি প্রায় বনশূন্য হয়ে পড়েছে। ভারতের অধিকাংশ বনভূমি মৌসুমি পর্ণমোচী শ্রেণির হলেও, ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যের চিরসবুজতা (বৃষ্টিবহুল উত্তর-পূর্ব পাহাড়ী অঞ্চল, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ) যেমন রয়েছে, তেমনি নাতিশীতোয় অঞ্চলের সরলবর্গীয় বৃক্ষের সমাবেশও (হিমালয়ে) দেখা যায়। জলবায়ুর সঙ্গে উদ্ভিদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এতেই প্রমাণিত হয়। অবশ্য অরণ্য বন্টনে মৃত্তিকা (অম্ল বা ক্ষার প্রধান) এবং ভূ-প্রকৃতিরও (নিম্নভূমি বা পার্বত্য অঞ্চল) কিছু প্রভাব রয়েছে।

ভারতের অরণ্যের বন্টনের নিয়ন্ত্রকসমূহ:

১. জলবায়ুঃ জলবায়ুর সঙ্গে উদ্ভিরাজির বন্টনে ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। এই কারণে ভারতের স্বাভাবিক হিসাবে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতা-র ভূমিকা ভারতের উদ্ভিদ বন্টনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। অতাধিক বৃষ্টিযুক্ত (২০০ সেমির অধিক) অঞ্চলে যেমন কেরালা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং উত্তর-পূর্বের পাহাড়ী অঞ্চলে সুগভীর ক্রান্তীয় বৃষ্টি অরণ্যের সৃষ্টি হয়েছে। আবার শুষ্ক জলবায়ুর জন্য দেশের উত্তর-পশ্চিমের মরু বা মরুপ্রায় অঞ্চলে কাটাযুক্ত ঝোপঝাড় ও তৃণগুল্ম স্বাভাবিক উদ্ভিদ।

উদ্বুতার তারতম্য ও উদ্ভিদ বন্টনে কার্যকরী হয় তবে ভারতের তা হয়েছে সাধারণতঃ পার্বত্য অঞ্চলে যেখানে পাদদেশ অঞ্চল থেকে ঊর্ধ্বে সুউচ্চ পর্বতগাত্রে ক্রম পরিবর্তনশীল (ক্রান্তীয় থেকে নাতিশীতোয়

প্রকৃতির) উদ্ভিদ বিন্যাস দেখা যায়। সুউচ্চ হিমালয় পর্বতগাত্রে এই বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ বিন্যাস ঘটেছে।

২. মৃত্তিকা: মৃত্তিকা বণ্টন উদ্ভিদ বন্টনে ততখানি প্রভাব ফেলেনি। তবে ক্রান্তীয় উপদ্বীপীয় মালভূমির বনাঞ্চলে ল্যাটেরাইট মৃত্তিকার বিস্তার দেখা যায়। হিমালয়ের উচু অংশে তেমনি পডজল মৃত্তিকা গড়ে উঠতে দেখা যায়। এরূপ উদ্ভিদ ও মৃত্তিকার বন্টন বলা যায় উভয়ই উভয়ের জন্য দায়ী।

৩. ভূ-প্রকৃতিঃ ভূ-প্রকৃতির প্রভাব অরণ্যের স্থানিকতা বন্টনে তেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু উচ্চতার তারতম্যে উদ্ভিদ বন্টনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। তবে তা মূলতঃ জলবায়ু তথা উদ্বুতারই প্রভাব। উচ্চ পর্বতগাত্র খাড়া অবস্থানে থেকে শৈলোৎক্ষেপ বৃষ্টি ঘটিয়েও বৃষ্টির আধিক্য ঘটিয়ে বনভূমি সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে।

অপেক্ষাকৃত খাড়া ভূ-প্রকৃতি কৃষিকাজের অনুপযুক্ত হওয়ায় অরণ্যময় থেকে গেছে।

1. চিরহরিৎ বৃক্ষের (বৃষ্টি) অরণ্য : (২০০ সেমি.-এর বেশি বৃষ্টিযুক্ত অঞ্চল) হিমালয়ের পূর্বদিকে অবস্থিত আর্দ্র, নিম্ন তরাই অঞ্চল, উত্তর-পূর্বের পাহাড়ী অঞ্চলের মিজো, খাসিয়া, জয়ন্তিয়া পাহাড়, উর্ধ্ব-ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, পশ্চিমঘাট পর্বতের প্রতিবাত ঢালে মহারাষ্ট্র, কর্ণটিক ও কেরালায় এবং আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এই অরণ্য দেখা যায়। আবলুস, শিশু, গর্জন, রোজউড, প্যাডক, চাপলাস, বিশপ উড, পুন, তুণ প্রভৃতি গাছের নিবিড় সমারোহ এই অরণ্যে দেখা যায়। এদের পাতা কখনও একসলো ঝরে যায় না বলে অরণ্য কখনো সবুজতা হারায় না। এজন্য এদের চিরহরিৎ বৃক্ষের অরণ্য বলা হয়। এই বনভূমির কাঠ খুব শক্ত এবং গৃহনির্মাণ ও আসবাবপত্রের জন্য ব্যবহৃত হয়।

বৈশিষ্ট্য:

(১) বৃক্ষগুলি দীর্ঘ, সুগঠিত ও দীর্ঘায়।

(২) কাঠ শক্ত। এগুলি আসবাবপত্র ও গৃহাদি নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত হয়।

(৩) প্রয়োজনীয় জ্বালানি কাঠও পাওয়া যায়।

(৪) বনভূমির বিভিন্ন পত্র, লতাগুল্ম ও শিকড় ঔষধ শিল্পে কাঁচামালের যোগান দেয়।

(৫) স্যাঁতস্যাঁতে বনভূমির জন্য অরণ্যসম্পদ সংগ্রহে অসুবিধা সত্ত্বেও কাষ্ঠ ও অন্যান্য অরণ্যসম্পদ সংগ্রহে গুরুত্ব বাড়ছে।

2. আর্দ্র পর্ণমোচী বৃক্ষের (মৌসুমি) অরণ্য (১০১-২০০ সেমি): হিমালয়ের পাদদেশীয় অঞ্চলে বিশেষতঃ অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও দাক্ষিণাত্য মালভূমির উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিম ভাগে এই জাতীয় বনভূমি দেখা যায়। এই বনভূমির বিশিষ্ট উদ্ভিদ হল শাল, সেগুন, আবলুস, গর্জন, অর্জুন, শিমুল, পলাশ, গামার, বট, অশ্বত্থ, আম, জাম প্রভৃতি। শুদ্ধ ঋতুতে এই সকল গাছের পাতা ঝরে যায়। এজন্য একে পর্ণমোচী গাছের বনভূমি বলে।

এই বনভূমির কাঠ গৃহ নির্মাণ, আসবাবপত্র, রেলের স্লিপার প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং বনভূমির সুমিষ্ট ফলাদিরও প্রচুর চাহিদা রয়েছে। সেগুন ও আবলুস কাঠ খুব মূল্যবান। শাল, গামার প্রভৃতি কাঠেরও প্রচুর চাহিদা রয়েছে বিশেষতঃ গৃহনির্মাণে।

বৈশিষ্ট্য:

(১) অরণ্য সহজ প্রবেশযোগ্য ও উন্নত পরিবহন ব্যবস্থার নৈকট্য রয়েছে।

(২) বহু মূল্যবান কাঠ যেমন সেগুন, আবলুস, শাল, শিরিষ প্রভৃতি বৃক্ষে সমৃদ্ধ বনভূমি। ।

(৩) কাঠ শক্ত ও চেরাই সহজসাধ্য

(৪) আসবাব, গৃহাদি নির্মাণ, পরিবহনযান নির্মাণের উপযুক্ত কাঠ পাওয়া যায়।

৩. শুদ্ধ পর্ণমোচী বৃক্ষের বন ও তৃণভূমি (৫১-১০০ সেমি): 

অপেক্ষাকৃত শুষ্কতর জলবায়ুযুক্ত দাক্ষিণাত্যের মধ্যভাগে, রাজস্থানের দক্ষিণ পূর্বাংশে, হিমালয়ের মাঝে মাঝে, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের অল্প বৃষ্টিযুক্ত স্থানে তৃণভূমি এবং তাদের মাঝে ছোটো ছোটো গাছ দেখা যায়। সমভূমির অধিকাংশে কৃষির বিস্তারের ফলে বনভূমি আর নেই। তবে উঁচু পাহাড়ী অংশে বিক্ষিপ্তভাবে ঝোপ জাতীয় জঙ্গল এবং রাজস্থানে ছোটো ছোটো কাঁটাগাছের বন দেখা যায়।

বৈশিষ্ট্য:

(১) বৃক্ষাদি শীর্ণকায় ও কন্টকপূর্ণ।

(২) জ্বালানি কাঠের উপযুক্ত।

(৩) বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগিতা স্বল্প।

(৪) পরিবেশ সংরক্ষণেই এগুলির গুরুত্ব বেশি।


৪. শুষ্ক মরু অঞ্চলের কাঁটাঝোপ ও গুল্ম (৫০ সেমি পর্যন্ত): ভারত গ্রীষ্মপ্রধান দেশ। এজন্য ৫০ সেমি বা তার কম বৃষ্টিযুক্ত স্থানে উদ্ভিদের বদলে কাঁটাজাতীয় গাছ যেমন- বাবলা, ফনিমনসা, তেশিরা মনসা প্রভৃতি জন্মায়। ছোটো ছোটো কাঁটাঝোপের আকারে এগুলি অবস্থান করে। থর মরুভূমিতে এধরনের কাঁটাঝোপ দেখা যায়। যেখানে ভৌম জলস্তর কাছে সেখানে খেজুর গাছ জন্মায়।

বৈশিষ্ট্য:

অরণ্যসম্পদ হিসেবে এগুলির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনুল্লেখযোগ্য। তবে পরিবেশ সংরক্ষণে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে।

৫. পার্বত্য অরণ্য: হিমালয়ের উচ্চতার পার্থক্যে অরণ্যের প্রকৃতি পাল্টায়। হিমালয়ের পাদদেশে মৌসুমি পাতা ঝরা গাছের বনভূমি এবং ১৫০০ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত পূর্ব হিমালয়ে চিরহরিৎ বনভূমি দেখা যায়। এই অঞ্চলে বাঁশ, বেত ও পর্ণমোচী গাছের সঙ্গে অন্যান্য গাছ প্রচুর জন্মায়। ১,০০০-৩,৬০০ মিটার পর্যন্ত উচ্চতার নীচে নাতিশীতোর মন্ডলের প্রশস্ত পত্রযুক্ত ওক জাতীয় বৃক্ষ এবং ওপরে পাইন, ফার জাতীয় সরলবর্গীয় বৃক্ষ জন্মায়। দক্ষিণ ভারতে নীলগিরি ও পাল্টি পর্বতে ২,৬০০ মিটার উচ্চতায় নাতিশীতোয় বনভূমি রয়েছে। এই বনভূমিতে পাইন, ফার, ম্যাগনেলিয়া, লরেল, এল প্রভৃতি গাছ এবং বিভিন্ন শ্রেণির ফার্ণ জন্মে। হিমালয়ে ৩,৬০০ মিটারের ওপরে পর পর তৃণ, গুল্ম ও শৈবাল জন্মায় যার ওপরে থাকে চিরতুষার। সেখানে কোনো উদ্ভিদ জন্মাতে পারে না।

বৈশিষ্ট্য:

(১) নরম কাঠের বৃক্ষ।

(২) কাঠ চেরাই সহজসাধ্য এবং হাল্কা হওয়ায় পার্বত্য অঞ্চলেও পরিবহনের উপযুক্ত।

(৩) বিভিন্ন শিল্পের বিশেষত কাগজশিল্পে, প্লাইউড নির্মাণ শিল্পে এই কাঠের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।

(৪) আসবাব নির্মাণে বাঁশ, বেত ও পাইন কাঠের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য।


৬. উপকূলীয় অরণ্য বা ম্যানগ্রোভ (১৫০ সে.মি.-এর বেশি বৃষ্টিপাত): লবণাক্ত জলাভূমি বা সমুদ্রতীরের অবনমিত অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ জাতীয় বৃক্ষ যেমন- সুন্দরী, গরাণ, গেওয়া, কেওড়া প্রভৃতি জন্মে। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিখ্যাত। মহানদী, গোদাবরী ও কৃষ্ণা নদীর ব-দ্বীপেও এই অরণ্য দেখা যায়। নরম কর্দমময় মাটির জন্য এদের শিকড় খুব লম্বা হয় ও মাটির নীচে ঢুকিয়ে দেয়। এদের ঠেসমূল অনেক গাছকেই নরম মাটিতে দাঁড়াতে সাহায্য করে।

উদ্ভিদ (Flora)- ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদ প্রজাতি সংখ্যা একশতর কিছু বেশি হলেও প্রায় ৫৪ ধরনের প্রজাতি আদর্শ কারণ এগুলি ম্যানগ্রোভ অরণ্য ছাড়া অন্যত্র সাধারণত জন্মায় না।

লবণতার তারতম্য, জোয়ারে প্লাবিত হওয়া, অবাত মৃত্তিকা পরিবেশে, ক্রান্তীয় অঞ্চলের চড়া রোদ সহ্য করতে হয় ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদকে। উল্লেখ্য উদ্ভিদ বৈচিত্র কিন্তু কম ম্যানগ্রোভ অরণ্যে উপরোক্ত কারণে।

7. লবনাম্বু উদ্ভিদের অভিযোজনগত বৈশিষ্ট্য (Plant Characteristics):

(i) শ্বাসমূল (Pneumatophore)- অনেক উদ্ভিদ যেগুলি কর্দমাক্ত এবং জলমগ্ন জমিতে বেড়ে ওঠে, যেমন কেওড়া, বাইন প্রভৃতি বৃক্ষের শ্বাসমূল থাকে। একে নিউম্যটোফোর (Pneumatophore) বলে। এই শ্বাসমূল জলের ওপরে উঠে থাকে বলে উদ্ভিদ অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে।

(ii) ঠেসমূল (Stilt root)- কর্দমাক্ত নরম মৃত্তিকায় জন্মানো উদ্ভিদ যাতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে সেজন্য গাছের ঠেসমূল থাকে। ঠেসমূল উদ্ভিদের মূলকান্ড থেকে বেরিয়ে মাটিতে নেমে আসে।

(iii) জরায়ুজ অঙ্কুরোদগম (Viviporous Germination)- কতলি উদ্ভিদ যেমন গরান, গর্জন প্রভৃতির বীজ-এর অঙ্কুরোদ্গম হয় ফল-এর মধ্যেই। ফল ফেটে জলসিক্ত মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এইজন্য একে জরায়ুজ অঙ্কুরোদ্গম বলে। ফলে এই উদ্ভিদগুলো মাটিতে তাড়াতাড়ি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। বীজ জলে ডুবে নষ্ট হওয়া বা ভেসে যাওয়া আটকাতে বৃক্ষের এরূপ অভিযোজন ঘটে।

(iv) জলের কোনো অভাব ঘটে না বলে ম্যানগ্রোভ চিরসবুজ অরণ্য।

বৈশিষ্ট্য:

(১) সুন্দরী সহ বেশ কয়েকটি বৃক্ষের কাঠ খুব মূল্যবান।

(২)পরিবেশ বিশেষত উপকূল সংরক্ষণে এই অরণ্যের গুরুত্বের জন্য কাঠ সংগ্রহ এখানে সীমিত।

(৩) ঔষধ শিল্পে ভেষজ কাঁচামাল-এর গুরুত্ব রয়েছে।

(৪) অরণ্যের মধু, মোম ও বিভিন্ন পত্র সংগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ।

8. ভারতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য (Mongrove Forests in India):

ভারতে পৃথিবীর কয়েকটি শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ অরণ্য রয়েছে। এগুলির সব কটিই উপকূল বরাবর অবস্থিত। সুরক্ষিত নদী মোহনায়, জোয়ারের জলপ্লাবিত খাঁড়ি এলাকায়, ব্যাক-ওয়াটার অঞ্চলে এবং লবণাক্ত জলাভূমিতে ম্যানগ্রোভ অরণ্য দেখা যায়। সুন্দরবন ভারতের শ্রেষ্ঠ ম্যানগ্রোভ অরণ্য। ভারতে মানগ্রোভ অরণ্যের মোট আয়তন ৪,৮২৭ বর্গকিলোমিটার। ম্যানগ্রোভ অরণ্য সংরক্ষণ ও পরিচালনার জন্য ১৫টি ম্যানগ্রোভ অঞ্চল চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলি হল (১) উত্তর আন্দামান, (২) নিকোবর, (৩) শ্চিমবলোর সুন্দরবন; অপ্রপ্রদেশের (৪) কোরিঙ্গা, (৫) গোদাবরী ব-দ্বীপ, (৬) কৃষ্ণা নদীর মোহনা; ওড়িশার (৭) ভিতরকণিকা ও (৮) মহানদী ব-দ্বীপ; তামিলনাড়ুর (৯) পিচাভরম ও (১০) পয়েন্ট কালিমার: (১১) গোয়া: (১২) গুজরাটের কচ্ছ উপসাগর: (১৩) কর্ণাটকের কুন্ডাপুর: (১৪) মহারাষ্ট্রের রত্নগিরি এবং (১৯) কেরালার ভেম্বনাদ। বনজ সম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্ব:

ভারতের বনজ সম্পদকে দু'ভাগে ভাগ করা হয়- (১) প্রধান বা মুখ্য বনজ সম্পদ এবং (২) অপ্রধান বা গৌণ বনজ সম্পদ।

১. প্রধান বা মুখ্য বনজ সম্পদ: এরূপ বনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে চেরাই কাঠ বা শিল্পে ব্যবহার্য কাঠ ও জ্বালানি কাঠ।

চেরাই কাঠ (Timber)- বহু প্রকার দ্রব্য নির্মাণ, আসবাব, ব্যাকিং বাক্স তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শাল, সেগুন, আবলুস, তৃণ, শিরীষ, চাপলাম, জারুল, প্যাডক, বহেড়া, কাঁঠাল, দেবদারু, সুন্দরী প্রভৃতি শক্ত কাঠের গাছ থেকে চেরাই কাঠ পাওয়া যায়। চেরাই শক্ত কাঠের ব্যবহারই ভারতে খুব বেশি (৯০ শতাংশ)। যেসকল গাছ থেকে নরম কাঠ চেরাই হয় ভারতে সেগুলির মধ্যে রয়েছে চিরপাইন, নীলপাইন, প্রুস, ফার প্রভৃতি। ভারতে নরম কাঠের উৎপাদন কম। কেন না নরম কাঠের বনভূমি হিমালয়ের দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত বলে কাঠ কেটে আনা ব্যায়সাধ্য। কাগজের মন্ড প্রস্তুত করতে এজন্য নরম কাঠের ব্যবহার কম। পরিবর্তে বাঁশ, সাবাই ঘাস প্রভৃতি বেশি পরিমাণে ব্যবহার করা হয়।

২. অপ্রধান বা গৌণ বনজ সম্পদ : এখানে অপ্রধান বনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে লাক্ষা, বেত, বাঁশ,কেন্দু বা বিড়িপাতা, সাবাই ও অন্যান্য ঘাস, রেজিন, মধু, মোম, ধুনো, বিভিন্ন ভেষজ ঔষধ। তালগাছ, খেজুর গাছের রস ও মহুয়া দিয়ে দেশি মদ তৈরি হয়। এই দেশি মদ পরিশোধন করে স্পিরিটও তৈরি করা যায়।

বাঁশ-এর ব্যবহার অতি প্রাচীন। কুটির ও গৃহাদি নির্মাণে, বেড়া দিতে এর ব্যবহার খুব বেশি। সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হয় কাগজশিল্পে। এ থেকে উৎকৃষ্ট শ্রেণির কাগজ তৈরি হয় যা প্রধানত ছাপার ও লেখার কাজে লাগে। ভারতের প্রায় সব রকম বাঁশ জন্মালেও অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, কেরালা, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এবং মধ্যভারতের উচ্চভূমিতে ও হিমালয়ের পাদদেশে বাঁশ বেশি জন্মে।

লাক্ষা এক প্রকার পোকার মুখ নিসৃত লালা থেকে তৈরি হয়। পলাশ, কুল, কুসুম, বাবলা প্রভৃতি গাছের পাতা খেয়ে এই পোকা জীবনধারণ করে থাকে। বিহার, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের অরণ্যে লাক্ষা বেশি পাওয়া যায়। ছোটনাগপুরে মালভূমি অঞ্চলেই ভারতের সবচেয়ে বেশি লাক্ষা উৎপন্ন হয়।

লাক্ষা থেকে গালা প্রস্তুত হয়। বার্ণিশ, শীলমোহর, মুদ্রণ শিল্প, গ্রামাফোন রেকর্ড, বিদ্যুৎ রোধক পদার্থ তৈরিতে গালা ব্যবহৃত হয়।

ভারতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি লাক্ষা উৎপন্ন হয়। কলকাতা বন্দর দিয়ে দেশের উৎপাদনের অধিকাংশ লাক্ষা পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।

কেন্দুপাতা বা বিড়ি পাতা সংগ্রহ যেখানে কেন্দুপাতা ভাল জন্মে সেখানকার একটি উল্লেখযোগ্য বনজ সম্পদ। দেশের কয়েক লক্ষ লোক এই বিড়ি বাঁধার কাজে নিযুক্ত আছে।

ভারতের বনজ শিল্পে অনুন্নতির কারণ:

(১) অধিকাংশ বনভূমি দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত এবং বিপদশঙ্কুল।

(২) উপযুক্ত পরিবহন ব্যবস্থার অভাব থাকায় কাঠ সংগ্রহ করে নিয়ে আসার খরচ বেশি পড়ে।

(৩) এক জায়গায় এক জাতীয় বৃক্ষের অভাব দেখা যায়, বেশির ভাগই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।

(৪) শিল্পে ব্যবহার্য কাঠের চেয়ে জ্বালানি কাঠেরই প্রাচুর্য বেশি।

(৫) কাষ্ঠ-ভিত্তিক বিভিন্ন শিল্প (যেমন-নিউজপ্রিন্ট, রেয়ন, খেলাধুলার সরঞ্জাম) গড়ে তোলার পরিকাঠামোগত উন্নতির অভাব।

(৬) কৃষি ও বসতি বিস্তারের ফলে ইতিমধ্যেই বহু বনভূমি বিনষ্ট হওয়ায় বনের পরিমাণ খুব হ্রাস পেয়েছে।

দেশে বনজ সম্পদের ব্যবহার সুষ্ঠু কর্মসূচী ও পরিকল্পনা নিয়ে বনজ সম্পদের উন্নতি সাধন প্রয়োজন। দেরাদুনে বন গবেষণাগার এ বিষয়ে গবেষণায় ব্যাপৃত রয়েছে।

বনভূমি হ্রাস ভারতের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার স্থান সংকুলানের জন্য অরণ্য পরিষ্কার করে বসতি ও কৃষি জমিতে পরিণত করায় এবং ক্রমবর্ধমান খনিজ উত্তোলনের স্থান করে দিতে অরণ্য পরিষ্কার করায় এবং শিল্পায়ন ও নগরায়নের জন্য অরণ্যের পরিমাণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। ভারতে বর্তমানে মোট ভৌগোলিক আয়তন ৩২.৮৭কোটি হেক্টরের মধ্যে ৬:৭১ কোটি হেক্টর বনভূমি দ্বারা আবৃত রয়েছে। এই জমির পরিমাণ মোট আয়তনের মাত্র ১/৫ ভাগ। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় অরণ্য সংরক্ষণ নীতি গৃহীত হয়। এই নীতি অনুসারে স্থির হয়ে থাকে ভারতে অন্তত এক তৃতীয়াংশ জমিতে বনভূমি থাকবে। এই লক্ষ্যে ভারতে প্রতি বছর রাজ্যগুলিতে বনোমহোৎসব মাধ্যমে বৃক্ষরোপণ করার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়ে থাকে। কিন্তু বনভূমি হ্রাস ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া সত্ত্বেও এই লক্ষ্য এখনো বহু দূরে। যৌথ বন ব্যবস্থাপনা যা বর্তমানে জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট বা পার্টিসিপেটরি ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ গ্রামবাসীদের বন সংরক্ষণে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অরণ্য সংরক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে এবং তাতে আকাঙ্ক্ষিত ফলও পাওয়া যাচ্ছে।

ভারতে বন সংরক্ষণ (Forest Conservation in India):

বিভিন্ন পরিকল্পনাকালে বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির জন্য গৃহীত ব্যবস্থাগুলির মধ্যে রয়েছে-

(ক) সামাজিক অরণ্য সৃজন (Social Foresty): সামাজিক অরণ্য সৃজন হ'ল অরণ্য সৃজন ও সংরক্ষণ প্রকল্প যা সমাজ ও পরিবেশের উন্নতিকল্পে গৃহীত হয়। এর অন্তর্গত-

• বসতি এলাকায় বনসৃজনঃ শহর ও গ্রামে রাস্তা, রেল, জলপথের দুধারে, শিক্ষায়তন প্রাঙ্গণে, গৃহসমীপে বৃক্ষচারা রোপন ও রক্ষণাবেক্ষণের দ্বারা সামাজিক অরণ্য সৃজন করা হয়।

• বনমহোৎসব: প্রতি বছর বর্ষাঋতুতে এই বনমহোৎসব পালন করা হয়। অরণ্য সপ্তাহ পালনের মাধ্যমে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করা হয় ও অরণ্য সৃজনে উৎসাহ দেওয়া হয়।

• কৃষি বন সৃজন: কৃষিক্ষেতের মাঝে মাঝে অথবা কৃষির অনুপযুক্ত জমিতে চারা রোপন করে ফসলের ন্যায় বুকষ সৃজন করা হয়। জ্বালানি, আসবাবের কাঠ, শিল্পের বিশেষতঃ কাগজশিল্পের প্রয়োজনীয় কাঠের গাছ এবং রেশমকীট পালনের জন্য তুঁত গাছ প্রভৃতির চারা রোপনের মাধ্যমে কৃষি বন সৃজন করা হয়।

(খ) যৌথ বন-ব্যবস্থাপণা বা গ্রামবাসীদের অংশগ্রহনে বন-ব্যবস্থাপনা (Joint Forest Management বা Participatory Forest Management): অরণ্য রক্ষায় বনবাসী বা বনসংলগ্ন গ্রামবাসীদের নিযুক্ত করায় তারা বনরক্ষীদের পাশাপাশি বনরক্ষায় সতন্দ্র ও সজাগ থাকে। ফলে চোরাকারবারী ও চোরা শিকারীর উপদ্রব কমেছে। পশ্চিমবঙ্গে আড়াবাড়িতে প্রথম যৌথ ব্যবস্থাপনা কার্যকরী হয়। এছাড়া

(গ) বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বৃক্ষচ্ছেদন।

(ঘ) বনভূমি অঞ্চলে পশুচারণ নিষিদ্ধকরণ।

(ঙ) কুমচাষের জন্য অরণ্য ধ্বংসে নিরুৎসাহকরণ।

(চ) চারাগাছ সংরক্ষণে যত্ন নেওয়া

(ছ) খরাপ্রবণ অঞ্চলে জ্বালানি কাঠ উৎপাদন প্রভৃতি।

দেরাদুন 'ভারতীয় বন গবেষণাগার' (Forest Research Insititute) বনজ শিল্প ও অরণ্য উন্নয়নের স্বার্থে গবেষণা করে চলেছে।

বন সংরক্ষণ সংক্রান্ত আন্দোলন:

► চিপকো আন্দোলন (Chipko movement):

১৯৬৮, ১৯৭২, ১৯৭৪, ১৯৭৭, ১৯৭৮ প্রভৃতি বিভিন্ন সময়ে গাড়োয়াল হিমালয়ে অরণ্যরক্ষায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চিপকো আন্দোলনের সলো যুক্ত নারী-পুরুষেরা। সরলা বেন, মীরা বেন, সুন্দরলাল বহুগুনা, গোপেশ্বর, চন্দ্রিকা প্রসাদ, গৌরীদেবী প্রমুখ পরিবেশপ্রেমীরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

গাড়োয়াল হিমালয়ে অরণ্যরক্ষায় এ গিয়ে এসেছিলেন পুরুষের সঙ্গে বহু আদিবাসী নারী। এরা এক একটি গাছকে সন্তানের মতো জড়িয়ে ছিলেন এবং দিন-রাত্রি সবাই মিলে অরণ্য পাহারা দিয়েছিলেন। ফলে সরকারীকর্মী ও ঠিকাদারদের গাছকাটার প্রচেষ্টা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়। সার্থক হয় চিপকো আন্দোলন (চিপকো কথার অর্থ জড়িয়ে ধরা)।

একসময় সরকারকে এই অরণ্যকাটার পরিকল্পনা পরিত্যাগের কথা ঘোষণাকরতে হয়। চিপকো আন্দোলনের সাফল্য ভারতের অন্যত্র পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনে উৎসাহ জোগায়।

▶ 'সাইলেন্ট ভ্যালি' আন্দোলন (Silent Valley movement):

কেরালার পালঘাট জেলায় একটি পাহাড়ে ঘেরা উপত্যকা। মাঝখান দিয়ে, কুস্তি নদী (কুস্তিপুঝা, পুঝা মানে নদী) বয়ে চলেছে। এটি ভারতের কয়েকটি মাত্র বৃষ্টিঅরণ্যের একটিতে অবস্থিত। গভীর ক্রান্তীয় বৃষ্টিঅরণ্যের নির্জনতা, নিস্তব্ধতা একে নিস্তব্ধ অরণ্য বা সাইলেন্ট ভ্যালি আখ্যা দিয়েছে। এই অরণ্যে, কুন্তি নদী যেখানে হঠাৎ উপত্যকা দিয়ে খুব খাড়াভাবে নেমে গেছে সেখান বাঁধ দিয়ে জলাধার তৈরি করে উচ্চজলবিদ্যুৎ সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছিল রাজ্য সরকার।

এই প্রকল্পে বৃষ্টিঅরণ্যের পরিবেশ ধ্বংস হয়ে যাবার আশঙ্কা প্রকাশ করেন কয়েকজন পরিবেশবিদ। কেরালা শাস্ত্র সাহিত্য পরিষদ (KSSP) রাজ্যজুড়ে আন্দোলনে নামে এবং এই প্রকল্পের মূল্যায়ন করে পুস্তিকা প্রকাশ করে ও এর বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান করে। কেন্দ্র ও রাজ্য এই প্রকল্পের দ্রুত রূপায়নে প্রথমে তৎপর হয়ে উঠলেও দেশের ও রাজ্যের পরিবেশপ্রেমী মানুষ, পরিবেশ আন্দোলনকারী এবং যে আন্তর্জাতিক সাড়া এই আন্দোলন ফেলেছিল তার প্রভাবে সাইলেন্ট ভ্যালি প্রজেক্ট ১৯৮৩ সালেই পরিত্যন্ত বলে ঘোষণা করা হয়। সাইলেন্ট ভ্যালিকে জাতীয় উদ্যানের মর্যাদা দেওয়া হয়।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01