বনভূমি ও বনজ সম্পদ (Forest and Forest Resources)
কৃষিকার্যের জন্য বনভূমি পরিস্কার করায়, স্থানান্তর কৃষির দরুণ অনিয়ন্ত্রিত পশুচারণ ও বন সংরক্ষণে পরিচালনগত ত্রুটি ইত্যাদি কারণে বনভূমির পরিমাণ যথেষ্ট হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে জঙ্গলমহলে আয়তনের মাত্র ১/৫ ভাগ বনভূমি। এই বনভূমি ক্রান্তীয় পর্ণমোচী শ্রেণীর অন্তর্গত। দুর্গম অঞ্চলে যথা, পাঞ্চেৎ, অযোধ্যা, বাঘমুন্ডি ও দ্যা পাহাড়ে এবং শিলাই, আর্কুশা, দ্বারকেশ্বর ও কাসাই নদীর ধারণ-অববাহিকায় উচ্চ অংশে এখনও অরণ্য যথেষ্ট নিবিড়। যথেচ্ছ অরণাচ্ছেদনের ফলে জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মৃত্তিকা ক্ষয়ের সমস্যা প্রকট হয়েছে। অরণ্যের প্রধান বৃক্ষ শাল হলেও আরও নানাপ্রকার পর্ণমোচী বৃক্ষের সমারোহ দেখা যায়। বাঁশও একটি অর্থকরী উদ্ভিদ। শাল বৃক্ষের কাঠ খুব শক্ত, ভারী এবং মজবুত। এরও বিক্রয়মূল্যও যথেষ্ট। শাল গাছ থেকে রজন সংগ্রহ করা হয় এবং এর ত্বক চামড়া ট্যান করবার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি আদিবাসীদের নিকট পবিত্র বৃক্ষ এবং এই বৃক্ষের ছায়ায় তাদের উপাস্য দেবতা পুজিত হন। মুচকুন্দা এই বনভূমির একটি চিরসবুজ বৃক্ষ, যদিও এটি বেশী দেখা যায় না। কিছু সেগুন গাছও জন্মায়। অন্যান্য বৃক্ষের মধ্যে শিমূল, পলাশ, মহুয়া ও তুন যথেষ্ট গুরত্বপূর্ণ। তুন গাছের কাঠ সৌখিন বাক্স ও দ্রব্যাদি প্রস্তুতে ব্যবহারযোগ্য। বেল, কুল, কুসুম, আম, কাঁঠাল, অশ্বত্থ, ডুমুর, নিম, বট, শিরিষ, বাবলা, আমন, সিধ্য, কদম, করম প্রভৃতি বক্ষও এই জেলার স্বাভাবিক উদ্ভিদ। বর্তমানে বনভূমিতে কেন্দুপাতা সংগ্রহ সর্বাধিক অর্থকরী উৎপাদন হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। মহুয়া আদিবাসীদের নিকট একটি মূল্যবান বৃক্ষ। এর শক্ত কাঠ বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। মহুয়া ফুল খাওয়া হয় এবং এথেকে তৈয়ারী মদ্য আদিবাসীদের প্রিয় পাণীয়। বনভূমি থেকে আয়ের প্রধান উৎস কেন্দুপাতা।
কৃষিকার্য (Agriculture)
কৃষিই জঙ্গলমহলের অধিবাসীদের প্রধান উপজীবিকা। কৃষক ও কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা জঙ্গলমহলের মোট কর্মজীবী সংখ্যার শতকরা ২/৩ ভাগ। যদিও কৃষিকার্যে শ্রমনিযুক্তির সংখ্যা অধিক, কিন্তু কৃষিজীবীদের মাথাপিছু আয়ের স্বল্পতা কৃষির অনগ্রসরতাকেই প্রতীয়মান করে।
কৃষিজমির পরিমাণ এই অঞ্চলের মোট আয়তনের প্রায় অর্ধেক। পতিত জমির পরিমান কর্ষণযোগ্য জমির প্রায় ১/৩ ভাগ যা তরঙ্গায়িত ভূ-প্রকৃতির উচ্চ অংশে প্রধানতঃ দেখা যায়। নিম্নের ঢালু অংশ ও নদী-অববাহিকা অধিকাংশ কৃষিজমি অধিকার করে রয়েছে। পতিত জমি পুনরুদ্ধার করা যে ব্যয়সাধা কেবল তাই নয়, জেলার সামগ্রিক জলাভাব ও সেচকার্যের সুবিধার অনুপস্থিতিতে এই সকল পতিত জমি পুনরুদ্ধারও বিশেষ সম্ভব হচ্ছে না। জলের অভাবে বহু জমিতেই একফসলী কৃষি-ব্যবস্থা এখনও প্রবর্তিত রয়েছে। সেচকার্যের প্রসার, খ রা প্রতিরোধ ও বহু-ফসলী-ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে জেলার কৃষি উৎপাদন যেরূপ বৃদ্ধি পাবে, কৃষকদের দারিদ্র মোচনেও তা সহায়ক হবে।
কৃষিজ উৎপাদন: ধানই হল প্রধান শস্য। অন্যান্য উৎপন্ন ফসলের মধ্যে গম, ভুট্টা, ডাল, সরিষা ও তিল, ইকু, আলু এবং মেস্তা উল্লেখযোগ্য।
আমন, আউস ও বোরো এই তিন প্রকার ধান উৎপন্ন হলেও অধিকাংশ জমিতেই আমন ধানের চাষ হয়। আউশ ও বোরো ধানের চাষ খুব সামান্যই হয়ে থাকে। কেবলমাত্র আমন ধানই মোট বপিত জমির শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ অধিকার করে থাকে। বর্তমানে উন্নত ধরণের বীজ ব্যবহার করে এবং সাধ্যমত সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করে কৃষি উৎপাদন বাড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর ফলে হেক্টরপ্রতি চাল উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অধিকাংশ ধান চাষ হয় নদী-উপত্যকায় অপেক্ষাকৃত উর্বর পলিগঠিত সমভূমিতে, তরঙ্গায়িত ভূমির উপরের অংশে ধাপের সাহায্যে এবং দুই তরঙ্গের মধ্যবর্তী নিম্নভূমিতে।
ধানের পরেই খাদ্যশস্য হিসেবে গম ও ভুট্টার চাষ করা হয়। যদিও মোট কৃষিজমির সামান্য অংশে কৃষিকার্য হয়।অন্যান্য দানাশস্য যেমন গম, ভুট্টা, যব, মিলেট প্রভৃতি।
দানাশস্য ছাড়াও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আলু, ইক্ষু, সরিষা, তিল, চীনাবাদাম এবং মেস্তার চাষ হয়। জেলায় পাট চাষের পরিমাণ যৎসামান্য।
কৃষিকাজে সমস্যাঃ জেলার কৃষিকার্য খুবই সমস্যা সংকুল। জমির উর্বরা শক্তি মাঝারি থেকে কম হলেও উপযুক্ত সার প্রয়োগের অভাব দেখা যায়। সীমিত সেচের সুযোগ বিশেষতঃ এই খরাপ্রবণ জেলায় কৃষিকার্যে বিশেষ অসুবিধা ঘটায়। কৃষিজীবিদের এক বিরাট অংশের এখনও নিজস্ব কোন জমি নেই। তারা পরের জমিতে দিন-মজুর খাটেন। জমি থাকলেও দরিদ্র কৃষকের সংখ্যাই অধিক। পুরাতন যন্ত্রপাতির প্রচলন এখনও অব্যাহত।
নিজেদের জমি চাষের ট্রাক্টর বা বলদ অনেকেরই নেই। কিন্তু কৃষকদের ফসল বিক্রয়ের, মজুতের, কৃষি ইনপুট (সার, উচ্চফলনশীল বীজ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদির মাধ্যমে)-এর সুব্যবস্থা দরিদ্র কৃষিজীবী যারা কৃষক সংখ এর সিংহভাগ তাদের মধ্যে এই সকল সুবিধা সম্প্রসারিত করতে না পারলে কৃষির উল্লেখযোগ্য উন্নতি সম্ভব নয়।