জনসংখ্যার বিবর্তন তত্ত্ব (Demographic Transition Theory)
জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেশ ও কালগতভাবে বিভিন্ন প্রকৃতির হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্পর্ক আছে। তাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের একাধিক স্তর থাকে। এসব স্তর জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে প্রভাবিত করে। জনসংখ্যার স্তর পরিবর্তন সম্পর্কিত মতবাদের (Demographic Transition Theory) মাধ্যমে জনসংখ্যাসংখ্যার বৃদ্ধির হারের পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা হয়।
Warren Thompson 1929 সালে সর্বপ্রথম জন বিবর্তন তত্ত্বটি প্রকাশ করেন। Thompson (1929), Notestein (1945), Blacker (1947) প্রমুখ অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীগণ লক্ষ করেন যে, জন্মহার ও মৃত্যুহারের সঙ্গে মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার গভীর সম্পর্ক আছে এবং এই ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে Demographic Transition Theory' গড়ে উঠেছে।
এই তত্ত্বের মূল কথা হল এই যে, কোনো দেশের সমাজ ও অর্থনীতির সঙ্গে ওই দেশের জন্মহার ও মৃত্যুহারের পারস্পরিক সম্পর্ক লক্ষ করা যায়।
■ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত পর্যায় লক্ষণীয়-
• প্রথম পর্যায়: উচ্চজন্মহার ও উচ্চমৃত্যুহার সমাজ ও অর্থনীতির দুর্বল অবস্থা। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি স্থির জনসংখ্যাবিশিষ্ট
• দ্বিতীয় পর্যায়: উচ্চজন্মহার ও নিম্নমৃত্যুহার দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি শিল্পোন্নয়ন উন্নয়ন শুরু।
• তৃতীয় পর্যায়: নিম্নজন্মহার ও নিম্নমৃত্যুহার ধীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি শিল্প ও বাণিজ্যিক অর্থনীতি এবং আধুনিক কৃষি প্রবর্তন সমাজ ও অর্থনীতির সবল অবস্থা।
• চতুর্থ পর্যায়: নিম্নজন্মহার ও অতিনিম্নমুখী মৃত্যুহার (জন্ম ও মৃত্যুহার প্রায় সমান) স্থিতিশীল জনসংখ্যা সবল অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
আবার, বিজু গার্নিয়ার মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার মূলত তিন প্রকার-
(i) ক্রমবর্ধমান প্রাচীর প্রকৃতির হার,
(ii) নবী পাশ্চাত্য পর্যায় এবং
(iii) পরিণত হার বা আধুনিক পাশ্চাত্য পর্যায়।
• প্রথম পর্যায় (First Stage): প্রধানত কৃষিনির্ভর অর্থনৈতিক অবস্থাতে শিল্পবিপ্লবের আগে.
এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(i) জন্মহার ও মৃত্যুহার দুটোই খুব বেশি হয়।
(ii) জন্মহার মৃত্যুহারের তুলনায় বেশি হয় (প্রতি হাজারে 30 জনের বেশি পরিলক্ষিত হয়)।
(iii) দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় তবে তা স্থির জনসংখ্যা (Stationary Population)
(iv) প্রাচীন অনুশাসন মেনে চলার রীতি দেখা যায়।
(৮)অপুষ্টি, মহামারি ও দারিদ্রের তাড়না দেখা যায়।
(খ) কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামো এবং মানব উন্নয়নের হার কম দেখা যায়।
(vii) স্বল্প জনসংখ্যা।
(vii) নিম্নবিত্ত উন্নয়নশীলদেশের আর্থসামাজিক পরিকাঠামো নির্দেশ করে।
■ দেশসমূহ: আফ্রিকা মহাদেশের গ্যাবন, জাম্বিয়া, সোয়াজিল্যান্ড ইত্যাদি প্রাচীন প্রকৃতির দেশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর গ্রেট ব্রিটেনে এই ধরনের অবস্থা ছিল। 1921 সাল পর্যন্ত ভারতও এই পর্যায়ে ছিল।
দ্বিতীয় পর্যায় (Second Stage): শিল্পবিপ্লবের সমসাময়িক হল এই দ্বিতীয় পর্যায়। শিল্পায়ার সবেমাত্র শুরু ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটে। আর্থসামাজিক অবস্থারও উন্নতি হয়।
এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(i) উচ্চজন্মহার ও নিম্নমুখী মৃত্যুহার।
(ii) মৃত্যুহার নিয়ন্ত্রিত এবং জন্মহার অনিয়ন্ত্রিত।
(iii) পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতি।
(iv) আর্থসামাজিক অবস্থা ক্রমশ মজবুত হয়।
(1) কখনও কখনও জনবিস্ফোরণ দেখা যায়।
(vi) সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
(vii) অর্থনীতি মিশ্র প্রকৃতির হলেও অর্থনীতির মূলভিত্তি হল কৃষি।
(viii) শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়। উন্নয়নশীল দেশের বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে।
■ দেশসমূহ: এশিয়া মহাদেশের চিন, ভারত, বাংলাদেশ, আফ্রিকার মিশর ও নাইজেরিয়া, দক্ষি আমেরিকার ব্রাজিল, ইউরোপের ইটালি, গ্রিস, রোমানিয়া এই পর্যায়ের অর্ন্তগত।
ভারত প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় পর্যায়ের বিলম্বিত অবস্থায় (Late second stage of Demographic Transitio Theory) আছে।
• দ্বিতীয় পর্বের দেশগুলির জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়-
(ক) গুয়াটেমালা ধরন (Guatemala type), (খ) থাইল্যান্ড ধরন (Thailand type) ও (গ) চিহ্নি ধরন (Chile type) |
(ক) গুয়াটেমালা হার বা ধরন: জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার প্রতি হাজারে 20-30 জন। ভবিষ্যরে জনসংখ্যা খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ার আশা আছে। জন্মহার অনিয়ন্ত্রিত, চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা কম লক্ষ করা যায়।
পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ এই পর্যায়ের অন্তর্গত।
(খ) থাইল্যান্ড ধরন: জনসংখ্যার স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার প্রতি হাজারে 25-35 জন। জন্মহার বেশি হয়। চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা বেশি বলে মৃত্যুহার কম হয়।
শ্রীলঙ্কা, পুয়ের্তোরিকো এই অবস্থায় আছে। এটি গুয়াটেমালা ধরনের বিপরীত অবস্থা।
(গ) চিলি ধরন: জন্মহার হাজারে 27. মৃত্যুহার 8.4. জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্বাভাবিক হার হাজারে।। জন। জন্মহার ক্রমশ হ্রাস পায়। মৃত্যুহারও কম হয়। অধিবাসীরা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে সামাজিক দিক দিয়ে সচেতন। চিলি এর অন্তর্গত।
তৃতীয় পর্যায় (Third Stage): জনসংখ্যা বিবর্তনের এই পর্যায় হল উন্নতির স্তর। শিল্পকেন্দ্রিক নগর ও শহরের সংখ্যা বাড়তে থাকে, জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হয়। মৃত্যুহার দ্রুত কমতে থাকে এবং জন্মহারও নীচের দিকে নামতে থাকে।
এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(i) চিকিৎসার সুযোগ বৃদ্ধি পায় বলে মৃত্যুহার অনেক কমে যায়।
(ii) জন্মন্মহার (Birth rate) অনেকাংশ নিয়ন্ত্রিত।
(iii) Per capita income এবং per capita production বৃদ্ধি পায়।
(iv) নাগরিক সভ্যতা প্রাধান্য পায়।
(v) জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়।
(vi) অতিরিক্ত জনসংখ্যার আয়তন কমতে থাকে।
(vii) উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা গড়ে ওঠে।
(viii) অর্থনীতির ওপর জনসংখ্যার চাপ কমতে থাকে।
■ দেশসমূহ: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য এই দেশগুলি এই পর্যায়ে পড়ে।
• চতুর্থ পর্যায় (Fouth stage): এই পর্যায়ে অভূতপূর্ব শিল্পোন্নয়ন ও নগরায়ণ দেখা যায়। মৃত্যুহার জন্মহারের চেয়ে বেশি হয়। জনসংখ্যা ক্রমহ্রাসমান।
এই পর্যায়ের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(i) জন্মহার নিয়ন্ত্রিত থাকে।
(ii) জন্মহার ও মৃত্যুহার প্রায় সমান হয়।
(iii) কখনো কখনো মৃত্যুহারের থেকে জন্মহার কম হয়।
(iv) দেশের জনসংখ্যার মধ্যে স্থিতাবস্থা বিরাজ করে।
(v) অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটে।
(vi) জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।
(vii) জন্মনিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দরকার হয়।
(Viii) এই অবস্থা বেশিদিন থাকে না। এটি ক্ষণস্থায়ী পর্যায়।
■ দেশসমূহ: নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন এই পর্যায়ভুক্ত। এদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্য।জনসংখ্যা বিবর্তনের সঙ্গে প্রতিটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার নিবিড় সম্পর্ক বর্তমান। জনসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থারও পরিবর্তন শুরু হয় অর্থাৎ কোনো দেশ পরবর্তী পর্যায়ে উন্নীত হবে বলে মনে করা হয়।