সোফার-কৃত সাংস্কৃতিক আঞ্চলিকীকরণ(Cultural Regionalisation after Sopher)
ভূমিকাঃ ডেভিড ই. সোফার (David E. Sopher) তার "The Geographic Patterning of Culture * India" শীর্ষক প্রবন্ধে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য বণ্টনের ধরণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। ভারতের ভাষাগত, ধর্ম সংক্রান্ত, রীতিনীতি এবং জনসাধারনের বৈচিত্র-এর মুখোমুখি হয়ে তাদের দৈশিক বণ্টনের এংশ তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। ভারতীয় সভ্যতার বাস্তবতা এর ভূ-দৃশ্যে (Landscape) প্রকাশিত হয়। গ্রাম গুলির সামাজিক-দৈশিক শৃঙ্খলাক্রম তাদের বহু জাতপাত, ঘনবাসগৃহের সমন্বয় এবং মানুষ, ভূমি ও গবাদি পশুর মধ্যে এক অপূর্ব বাস্তুতান্ত্রিক সংহতি ও প্রকৃতির সংগে অভিযোজন লক্ষ্য করা যায়, এর পাহাড়, সমতলে, মরুভু মিও জঙ্গলে, বৃষ্টি অরণ্যে। ভারতীয় সভ্যতার স্বতন্ত্রতার কারণ এটি চারপাশে পর্বত ও সমুদ্রদ্বারা প্রায় বেষ্টিত যা এর সভ্যতা ও রীতিনীতিকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য রেখে অগ্রসর হতে সাহায্য করছে।
আঞ্চলিকীকরনের ভিত্তি: ভারতীয় সাংস্কৃতিক অঞ্চল সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অঞ্চলগুলির একতার নিরিখে সংগঠিত আনুষ্ঠানিক অঞ্চল (Formal Sector) হিসেবে গড়ে ওঠে নি। বরং এক একটি কর্মভিত্তিক অঞ্চল হিসেবে সময় ও দৈশিকতার আন্তঃক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। তাই অঞ্চলভেদে পরস্পরের স্বাতন্ত্র গড়ে উঠেছে। সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক উপকরণগুলি গতিশীলতার নিয়মেই মিশ্রণ ঘটিয়েছে একে অপরের সঙ্গে, যেমনভাবে ধর্মীয় আচরণ তৈরি করে ধর্মীয় ভাবাদর্শ, কথা থেকে আসে লেখা, একস্থান থেকে অন্যস্থানে নতুন ফসলের আগমনের ফলেও তৈরি হয় নতুন খাদ্যাভ্যাস।
আঞ্চলিকীকরণ: উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত
সোফার ভারতের অঞ্চলিকীকরণে নির্দিষ্ট কতকগুলি ভৌগোলিক সীমারেখা তুলে না ধরে ভারতকে প্রাথমিকভাবে দুটি বৃহৎ অঞ্চলে বিভাজিত করেছেন- (এক) উত্তর এবং (দুই) দক্ষিণ ("North" and "South")। অর্থাৎ ভারতের দৈশিক বিস্তারকে সোফার উত্তর ও দক্ষিণ এই দু'ভাগে ভাগ করেছেন। উত্তরে রয়েছে উত্তরের সমভূমি ও পার্বত্য বা মালভূমিভাগ। বাংলা ও বিহার উত্তর ভাগ সংলগ্ন এবং এটি একটি সাংস্কৃতিক বিভাজন রেখা হিসেবে রয়েছে। এই বিভাজনরেখা খ্রীস্টপূর্ব ১ম সহস্রাব্দের আর্য্য ও ম্লেচ্ছ দেশ-এর মধ্যে বিভাজনরেখা হিসেবে সংগতিপূর্ণ।
'দোয়াব' অঞ্চল ও দক্ষিণে 'তামিলনাড়ু'। উত্তর ও দক্ষিণের এই দুটি কেন্দ্রীয় স্থান (Core)-এর সাংস্কৃতিক
"উত্তর" ও "দক্ষিণ" -এর যে দুটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সবচেয়ে বেশি যোগাযোগ সম্পন্ন সে দুটি হ'ল উত্তরে বিভাজন (Cultural dichotomy) সুস্পষ্ট প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক, নৃতত্ত্ববিদ এবং পরিকল্পনাকারদের দ্বারা প্রদত্ত তথ্য পরিসংখ্যান ভৌগোলিকভাবে সংগঠিত করলে (The best connected nodes in the northern ad southern systems of circulation are, respectively, the Doab and Tamil Nadu, the two cores of the north-south cultural dichotomy that appears prominently in the Geographical organisation of Indian data by historians, anthropologists, and planners - David G. Mandelbaum, Society in India (Berkeley and Los Angeles University of California Press, 1970, PP. 11, 390-91)1 উত্তর-দক্ষিণ এর মধ্যে বৈষম্য-এর ক্ষেত্রে সমসাময়িক আঞ্চলিক অর্থনীতির প্রথাগত দিকটি হল-
"উত্তর"-এ রয়েছে মূলধন বিনিয়োগ ও শিল্প সমাবেশের কেন্দ্রীভবন। কিন্তু "দক্ষিণ" এ দিক থেকে অনগ্রসর। উত্তরে জনসংখ্যার বৃহত্তম আয়তন সত্ত্বেও দক্ষিণ পৌরায়ন ও স্বাক্ষরতার দিক দিয়ে উন্নততর। নৃতত্ত্ববিদ্ বার্নার্ড কন (Bernard Cohn)-এর বক্তব্য- 'উত্তর ও দক্ষিণের এর বৈপরীত্য প্রদর্শনে জোর দেওয়াটা সম্ভবত
ভুল, বরং পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন বেশি যুক্তিগ্রাহ্য হ'ত।' (Bernard S. Cohn, "Regions Subjective and Objective: Their Relation to the Study of Modern Indian History and Society", in Regions and Regionisation, ed. Crane, PP 5-371
উত্তর দক্ষিণ / পূর্ব-পশ্চিম (North-South / East-West): ভারতের নৃ-তাত্ত্বিক সর্বেক্ষন বিভাগ (Anthoprological Survey of India) মানুষের ব্যবহূত দ্রব্যসামগ্রীর মানচিত্র প্রস্তুত করেছেন। এটি পূর্ব -পশ্চিম সাংস্কৃতিক বিভাজন-এর সমর্থনে কন (Cohn) বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে কতিপয় সামগ্রি বর্তমান গ্রামীণ জীবনযাত্রার (বাসগৃহ, শকটযান, পোষাক) এবং কৃষি প্রযুক্তি (লাঙল, তেলের ঘানি, ধান ভাঙার কল ইত্যাদি যন্ত্রপাতি), যেগুলি আর্দ্র শুদ্ধ পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভবতঃ সম্পর্কিত। পশ্চিম উপকূল ছাড়া অন্যত্র এটি পূর্ব-পশ্চিম বিভাজন প্রবণতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ-এর পরে কন (Cohn) সিদ্ধান্তে আসেন যে আঞ্চলিকীকরণে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম উভয় ক্ষেত্রই সমান বৈপরীত্যমূলক এই ধারণাটি গ্রহণযোগ্য।
উত্তরভারতের দক্ষিণতম সীমা মান্ডেলবাউম-এর মতে বাংলা থেকে রাজস্থান পর্যন্ত। তিনি পূর্ব-পশ্চিম -এ বৈশিষ্টগত স্বাতন্ত্র লক্ষ করেছেন এবং গুজরাট ও মহারাষ্ট্রকে দক্ষিণ ভারতের অন্তর্ভুক্ত না করে 'পশ্চিম ভারত' বলেছেন এবং পূর্ব ভারত এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন অসম, ওড়িশা এবং সম্ভবত বাংলাকে।
কন ও মান্ডেলবাউম কৃত শ্রেণিবিভাগ থেকে বোঝা যায় তারা ভারতকে দুটি পৃথকভাবে ভাগ করেছেন। কন ভারতকে পর্যায়ক্রমিক, উপর্যুপরি দ্বি-বিভাজন (Dichotomy) করেছেন, যেখানে মান্ডেলবাউম (Man-delbaum) ভারতকে চর্তুবিভাজন (Fourfold division) করেছেন। কন উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন (North-South Dichotomy) এবং মান্ডেলবাউম উত্তর-দক্ষিণ ছাড়াও পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের কথা বলেছেন।
বণ্টনগত সীমানা পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ধরা যাক, মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে দক্ষিণ থেকে উত্তর-এর দিকে সম্বন্ধীকরন যেমন, তেমন আসাম ও বাংলার ক্ষেত্রে উত্তর থেকে দক্ষিণের দিকে সম্বন্ধীকরনের কথা বলা হয়েছে।
এরকম পরিবর্তন যাই হোক কন্-এর দ্বি-বিভাজন উত্তর-দক্ষিণ থেকে পূর্ব-পশ্চিম-এর দিকে পরিবর্তনের সমার্থক। মান্ডেলবাউম-এর ক্ষেত্রে উভয় বণ্টনই কমবেশি "উত্তর পশ্চিম" বা "পূর্ব দক্ষিণ" নিয়ে। এরূপ বণ্টনের ক্ষেত্রে মুখ্য অভ্যন্তরীন সীমানা মিলে যায় প্রাচীনকালের বিন্ধ-নর্মদা অক্ষ ও এর পূর্বে প্রসারিত রেখা যা ছোটোনাগপুর মালভূমির উত্তরপ্রান্ত বরাবর চলে গেছে। এখানেই ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক উত্তর-এর সঙ্গেঙ্গ যুক্ত করেছে এমন একটি অঞ্চল যা কেবল উত্তর-নয় অংশতঃ দক্ষিণও।
Anthropological Survey of India প্রকাশিত Peasant life in India তে বর্ণনা অনুসারে উত্ত র-দক্ষিণে বিভাজন একটি বাস্তবতা, এটি উত্তরে উত্তরপ্রদেশ এবং দক্ষিণে তামিলনাড়ুর মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতিগত পার্থক্য লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়।
নারী-পুরুষ অনুপাত এবং উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন: উত্তর ও দক্ষিণ-এর মধ্যে নারী-পুরুষ অনুপাতে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষিত হয়। উত্তরে পুরুষ প্রাধান্য বেশি এবং সর্বাধিক প্রাধান্য লক্ষ করা যায় উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে। কিন্তু পুরুষ প্রাধান্য কমতে থাকে ক্রমশ দক্ষিণ ও পূর্বদিকে। লিঙ্গভিত্তিক প্রব্রজন এবং বয়ঃসন্ধি ও প্রাপ্তবয়সে তারতম্যমূলক মরণশীলতা, ইত্যাদিও উত্তর অঞ্চলে পুরুষ প্রাধান্যের কারণ। নর্মদা নদীরেখা এবং এর প্রসারণ উত্তর-পূর্বদিকে ছোটোনাগপুর মালভূমির দক্ষিণপ্রান্ত দিয়ে গেছে। এটি উত্তরে যেখানে সর্বাধিক পুরুষ প্রাধান্য এরু প অঞ্চল থেকে দক্ষিণে ও পূর্বে যেখানে ১০ বছরের নীচ শিশুকন্যা পুত্রসন্তানের চেয়ে বেশি সংখ্যক দেখা যায় সেদিকে গিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশে পুরুষ প্রাধান্য রয়েছে।
কৃষি নির্ভর সংস্কৃতি: উত্তর-পশ্চিমের শুষ্কতর জলবায়ুর জন্য শ্রমনির্ভর কৃষিকার্য্যের প্রভাব দেখা যায় জনসংখ্যার লিল্য অনুপাতে, এই জন্যই সম্ভবতঃ পুরুষ প্রাধান্য। পূর্ব ভারতে ও উপকূলীয় ভারতে আর্দ্র জলবায়ুতে ধান চাষ এর জন্য নারী শ্রমিকের চাহিদা বেশি। এই কারণটি দুটি অঞ্চলের মধ্যে লিঙ্গ বৈষম্যের কারণ বলে কেউ কেউ মনে করেন।
• পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল থেকে আগত সংস্কৃতির মিশ্রণ
উত্তর-দক্ষিণ বিভাজনের ভৌগোলিক রূপরেখা সম্ভবতঃ দুটি প্রক্রিয়ায় ভারত ভূ-খন্ডে অবিরাম ক্রিয় করেছে। একটি হল- কেন্দ্রমুখী। বী প্রবাহ (Centripetal flow) পশ্চিমের সীমান্তের স্থলভাগ থেকে, যার প্রভাব দূরত্বের সঙ্গে ক্রমশঃ গতি হারিয়েছে। অপরটি হল কেন্দ্রবিমুখ প্রবাহ (Centrifugal flow) যাকে A. L Basham-এর ভাষায় সর্বকালে "ভারতের হৃৎস্বল" (Heart of India) যা অবস্থিত গাঙ্গেয় সমভূমির পশ্চিম অর্ধাংশে। এরূপ অঞ্চলে সংস্কৃতির মিশ্রণ লক্ষ করা যায় ইন্দো-ইউরোপীয় বাচনে (Speech)-র অনুপ্রবেশে।
ভাষাগত পার্থক্য: উত্তরের এই প্রভাব থেকে দক্ষিণ ভারত অনেকটাই মুক্ত। নর্মদা-ছোটোনাগপুর রেখা থেকে সুদূর দক্ষিণে দ্রাবিড় ভাষার প্রাধান্য। তবে প্রতিবেশী ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাভাষী অঞ্চল থেকে দক্ষিণদিকে প্রব্রজন ঘটায় মধ্যবর্তী অঞ্চলে কম-বেশি জনগোষ্ঠী প্রভাবিত হয়েছে। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মিশ্রণ হয়েছে আসামে ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা উপত্যকায়। ছত্তিশগড় অববাহিকায় এবং দক্ষিণ ভারতে পূর্ব ও পশ্চিম সমুদ্রপ্রান্তিক এলাকা ধরে। এছাড়া মুসলিম প্রভাবে উর্দু ভাষার প্রচলনও ঘটেছে অনেক মুসলিম ধর্মাবলম্বী জনগনের মধ্যে বাংলা, বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং দক্ষিণ ভারতে গোয়ার উপকূলে, উত্তর তামিলনাড়ু প্রভৃতি অঞ্চলে।
ধর্মাচরণ: উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব ভারতে বিভিন্ন কাজে প্রবজন ঘটে মুসলিম ধর্মাবলম্বীগণ জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ। মুসলমান শাসনকালে এই ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটে। হিন্দু জাতপ্রথা বলাদেশে বিরাজ করলেও এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতি যেমন মুসলিম ধর্ম এর প্রসার, বৌদ্ধধর্মের ক্ষীয়মান উপস্থিতি এবং অন্যান্য বৈদেশিক প্রভাবে ব্রাহ্মণবাদ সুরক্ষিত থাকে নি।
উপক্রান্তীয় ভারতে মিশনারী প্রভাবে বিশেষত সমুদ্র প্রান্তিক অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্ম বিস্তার ঘটেছে। ফলে উত্ত সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে কেরালা ও অন্যান্য কিছু অঞ্চলে। কেরালায় মুসলমান ধর্মীয় প্রভাব, খ্রীষ্ট ধর্মীয় প্রভাব, হিন্দু ধর্মের প্রভাব সমন্বিত তিনটি ধর্মাবলম্বী জনসংখ্যাই রয়েছে। একইভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে, অসম পার্বত্য অঞ্চলে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে।
ব্রাহ্মন জনসংখ্যাগত পার্থক্য: উত্তর ভারতে হিন্দু জনসংখ্যায় ব্রাহ্মণদের সংখ্যা দক্ষিন ভারতের তুলনায় বেশ বেশি এবং গাঙ্গেয় সমভূমিতে ব্রাহ্মণ জনসংখ্যা প্রচুর। গ্রামাঞ্চলে তারা অনেক বেশি সংখ্যায় বসবাস করেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে ব্রাহ্মণদের সংখ্যা বেশ কম। উদাহরণ স্বরূপ, তেলেঙ্গানায় সহস্রাধিক জনসংখ্যা সম্বলিত ত্রামের সংগৃহীত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১,২৩৭ গৃহের মধ্যে কেবল ৫টি গৃহে ব্রাহ্মান বসতি। কর্নাটকের একটি ক্ষুদ্র গ্রামে ১১৩ টি গৃহের মধ্যে মাত্র একটি গৃহে ব্রাহ্মণ পরিবার পাওয়া গেছে। সুতরাং গ্রামীণ জনসংখ্যা বণ্টনে ব্রাহ্মাণদের সংখ্যা বিচারে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে বৈষম্য প্রকট।
ব্রাহ্মন জনসংখ্যা কম হলেও তামিলনাড়ুর স্মার্ত ব্রাহ্মনগোষ্ঠী অত্যন্ত সম্মানজনক সামাজিক অবস্থানে রয়েছেন।
হিন্দুত্বঃ হিন্দুত্ব শব্দের অর্থ করা হত ভারতের জনসাধারণের ধর্ম (The Religion of The People of India) প্রাচীনকালে হিন্দু ধর্ম বলতে কেবল হিন্দুদেরই বোঝাতো না, ছিল বিভিন্ন ধর্ম ও সমন্বয়ের ভারতবর্ষ। সম্ভবত ভারতের জনগণের বিভিন্ন ধর্ম আচরণ লক্ষ্য করে ভারতের বাহিরে বসবাসকারী লোকেদের প্রদত্ত এই নাম। তৃতীয় থেকে একাদশ শতকে গড়ে ওঠা ভারতের তীর্থস্থান গুলির অবস্থান দেখে প্রাচীন মানচিত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল যা ভরদ্বাজ চিহ্নিত করেছেন। এতে উত্তর ভারতের মন্দির গুলির অবস্থান প্রাধান্য পেয়েছে, দক্ষিণ ভারতের অনেক মন্দিরই এই মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত হয়নি। রচনাকাররা উত্তর ভারতীয়, সেই জন্যেই এই পক্ষপাতিত্ব বলে মনে করা হয় (Hindu Places of Pilgrimage, Bharadwaj, P. 64, 68, 70)। হিন্দু ভারতের আকৃতির রূপরেখা তৈরি হয়েছে চারটি প্রাচীন তীর্থ ধাম দিয়ে, বদ্রিনাথ ও কেদারনাথ, হিমালয়ে (উত্তর), জগন্নাথ ধাম- পুরীতে (পূর্ব) ওড়িশা উপকূলে, রামেশ্বরম দক্ষিণ ভারতে শ্রীলঙ্কার পথে এবং দ্বারকা (Dwarka) পশ্চিম ভারতে সৌরাষ্ট্র উপকূলে। এছাড়া সীমানা চিহ্নিতকারী বিশেষ পবিত্র ভূমি হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে উত্তর ভারতে আবু (Mt. Abu), উপদ্বীপীয় ভারতে অমরকন্টক, কন্যাকুমারী (উপদ্বীপের দক্ষিণতম বিন্দু কেপ কোমোরিন) এবং পূর্ব ভারতে গঙ্গাসাগর (প্রাচীন গঙ্গা-ভাগীরথী নদী মুখে)।
বৈষ্ণব সংস্কৃতি: সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে থাকা এই সংস্কৃতি দক্ষিণে উদ্ভূত হয়ে উত্তরদিকে বিস্তার লাভকরেছে বাংলায়, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে, গুজরাটে এবং মহারাষ্ট্রে। কৃষ্ণ আরাধনায় সাহিত্য, শিল্প ও সংগীতের উপর গুরুত্ব আরোপিত হতে শুরু করেছে ষোড়শ শতকে এক তেলেগু ব্রাহ্মণ বল্লভাচার্যের উদ্যোগে। বৈষ্ণব সংস্কৃতি তখন ব্যাপকভাবে মিশ্রিত হয়েছে ভারতীয় সংস্কৃতিতে, এমনকি দূরবর্তী জনবসতি এলাকায়ও। ছোটনাগপুর মালভূমিতে ভগত আন্দোলন (Bhagat Movement) এর অন্যতম, যা জাতিভেদে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশুবলি, মাংস ভক্ষণ এবং মদ্যপান নিষিদ্ধ করতে সমর্থ হয়। বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবে শিব ও শক্তির উপাসনা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ক্ষীয়মান হয়। কেবল উত্তর ও মধ্য ভারতে নয়, পশ্চিম সমুদ্র প্রান্তিক এলাকা ধরে সুরাট থেকে দক্ষিনে কেরালা পর্যন্ত এর প্রভাব পড়ে। উত্তর কর্ণাটক-এ লিঙ্গায়ত-দের (Lingayats) শক্ত ঘাঁটি। তামিলনাড়ুর ভক্তি মার্গও বৈষ্ণব সংস্কৃতির শক্ত ঘাঁটি, তবে ধর্মীয় ব্যাপারে দক্ষিণ ভারতে শিব-এর উপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মনদেরই প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহারঃ আধুনিক ভারতে দৈশিক কাঠামোর প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে ভাষাভিত্তিক সাংস্কৃতিক অঞ্চলের উন্মেষে যা স্বাধীনোত্তর ভারতে পৃথক রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে। দীর্ঘকালের আধা জাতীয় অনুভূতির বাস্তব দিকটির উদাহরণ হিসেবে বলা চলে হিন্দুত্বের সঙ্গে বা ভারতীয়ত্বের সঙ্গেই থাকে গুজরাটী, মারাঠি, তামিল, তেলেগু, মালয়ালী, শিখ, বাঙালী বা অহমীয়া প্রভৃতি। বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার তারতম্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তিত হয় পৌর সমাজও। মান্ডেলবাউম (Mandelbaum) সঠিক যখন তিনি বলেন ভারতীয় সমাজ সমীক্ষা করতে হয় গ্রাম সমীক্ষার মাধ্যমে। উপসংহারে বলা যায়, উত্তর ভারত ও দক্ষিণ ভারত তাদের ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক কারণে ঘটনা পরম্পরায় সাংস্কৃতিক অঞ্চল হিসেবে ভিন্নতার মধ্য দিয়ে জাতীয় ঐক্য বা সংহতির মিশ্রণ বা মেলবন্ধন ঘটিয়েছে।