পরিব্রাজনের শ্রেণিবিভাগ (Classification of Migration)
সমাজবিজ্ঞানীগণ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে পরিব্রাজনের শ্রেণিবিভাগ করেছেন
(1) স্বায়িত্বের বিচারে
(1) দীর্ঘকালীন পরিব্রাজন (Long term migration)
(ii) স্বল্পকালীন পরিব্রাজন (Short term msigratin)
(iii) দৈনিক পরিব্রাজন (Daily migration)
(2)দূরত্বের বিচারে
(i) স্বল্প দূরত্বে পরিব্রাজন (Short distance migration)
(ii) মাঝারি দূরত্বে পরিব্রাজন (Medium distance magratios distance migration)
iii) অধিক দূরত্বে পরিব্রাজন (Long distance migration)
(3) রাষ্ট্র সীমানার বিচারে
(1) অভ্যন্তরীণ পরিব্রাজন (Internal migration)
(ii) আন্তর্জাতিক পরিব্রাজন (International migration)
(4) পরিব্রাজনের বাধ্যবাধকতা বিচারে
(i) স্বেচ্ছায় পরিব্রাজন (Voluntary migration)
(ii) বাধ্যতামূলক পরিব্রাজন (Force migration)
(5) জনবসতির বৈশিষ্ট্য অনুসারে
(1)গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন (Rural to Urban migrat
(ii) শহর থেকে শহরে পরিব্রাজন (Urban to Urban migration
(iii) গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন (Rural to Rural migration
(iv) শহর থেকে গ্রামে পরিব্রাজন (Urban to Rural migration
(6) সংস্কৃতিক বিচারে
(i) সামাজিক পরিব্রাজন (Social migration)
(ii) রাজনৈতিক পরিব্রাজন (Political migration)
গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন (Rural-Urban migration):
বিভিন্ন কারণে গ্রামের মানুষ শহরে এসে বসবাস করেন। একে Rural-Urban migrationহয়। এটি প্রধানত অভ্যন্তরীণ ধরনের হয়। স্বল্পকালীন, দীর্ঘকালীন, ঋতুভিত্তিক পরিব্রাজন গ্রাম থেকে প্রায়ঘটে। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলিতে গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজনের প্রবণতা দেখা যায়।
• গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজনের কারণ (Causes of Rural-Urban migration):
অর্থনৈতিক কারণ:
(a) তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে গ্রাম ও শহরের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তীব্র বৈষম্য লক্ষ কং যায়। এজন্য গ্রামের মানুষ শহরের উন্নততর জীবনযাত্রায় আকৃষ্ট হয়ে শহরে এসে বসবাস করেন।
(b) শহরে শিল্প-কলকারখানা এবং অন্যান্য জায়গায় কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। এঐ জন্য গ্রামের মানুষ শহরে বেশি করে শহরমুখী হয়।
(c) গ্রামাঞ্চলের চাষিরা যে সময় কর্মহীন হয় সেই সময় শহরে কাজের সন্ধানে চলে আসেন। বিশেষ করে ফসল কাটার পর যে দু-তিন মাস সময় তাদের কোনো কাজ থাকে না, সেই সময়ে শহরে বিভিন্ন কাজের সন্ধানে চলে আসে।
(d) শহর অঞ্চলগুলির সঙ্গে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলে গ্রামের মানুষ শহরে চলে আসে।
সামাজিক কারণ:
(a) গ্রামের মেয়ের শহরে বিবাহ হলে সে শহরে বসবাস করতে থাকে। এই পরিব্রাজন স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি দুই ধরনেরই হতে পারে।
(b) শহরে শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতির সুযোগ-সুবিধা বেশি। তাই গ্রামের মানুষ শহরে বেশি করে চলে আসেন।
প্রভাব (Consequences):
(i) শহরের আয়তন ও পরিকাঠামোর উন্নতি না ঘটলে যদি গ্রাম থেকে শহরে বেশি লোকের আগমন ঘটে তাহলে শহরে নিম্নবর্ণের লোকের সমাগম বৃদ্ধি পায়। ফলে শহরে বসতি অবন (Slum arca) বৃদ্ধি পায়। মুম্বাই, কলকাতা প্রভৃতি শহরে এই সমস্যা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করেছে।
শহরে একদিকে যেমন জনঘনত্ব বৃদ্ধি পায় তেমনি পানীয় জল, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট প্রভৃতির ওপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পায়।
(iii) গ্রামের বেকার, ছদ্মবেকার প্রভৃতি শহরে এসে ভিড় করলে শহরে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(iv) শহরে শ্রমের জোগান বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকের মজুরি হ্রাস পায়।
গ্রাম থেকে শহরে পরিব্রাজন (Rural-Urban migration):
শহরের মানুষ যখন গ্রামে চলে আসেন তখন শহর-গ্রাম পরিব্রাজন (Urban to Rural migration) শহুরে জীবনের জটিলতা, দূষণ প্রভৃতি কারণে এই ধরনের পরিব্রাজন ঘটে থাকে।
শহর থেকে গ্রামে পরিব্রাজনের কারণ:
অর্থনৈতিক কারণ:
(a) শহরে জমির দাম অত্যন্ত বেশি। তাই শহরের অনেক মানুষ গ্রামে এসে সস্তায় জমি কিনে বসতবাড়ি নির্মাণ করেন।
(b) গ্রামাঞ্চলে সেবামূলক কাজকর্মের সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি আছে।
(০) অনেকে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন এবং পৈতৃক জমি-জায়গা ব্যবহার করে আয় করার চেষ্টা করেন।
সামাজিক কারণ:
(a) বিবাহ সূত্রে শহরের স্ত্রীলোকগণ গ্রামে এসে বসবাস করেন।
(b) অনেকে উচ্চশিক্ষা অর্জনের শেষে শহর থেকে গ্রামে ফিরে যান।
(c) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য যেমন বাবা-মায়ের পারলৌকিক কাজ, পূজা প্রভৃতি কাজে শহরের লোকের গ্রামে আগমন ঘটে।
(d) অনেক ব্যক্তি গ্রামাঞ্চলে বেশি প্রতিপত্তি লাভের আশায় শহর ছেড়ে গ্রামে আসেন।
রাজনৈতিক কারণ:
(a) রাজনৈতিক অস্থিরতা, যেমন যুদ্ধ, রাজনৈতিক দাঙ্গা প্রভৃতি কারণে অনেকে শহর ছেড়ে গ্রামের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে এসে বসবাস করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং 1971 খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু লোক শহর ছেড়ে গ্রামে চলে এসেছেন।
(b) প্রশাসনিক কাজে, যেমন জনপ্রতিনিধি হিসেবে, বিধায়ক, সাংসদ প্রমুখ রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ অনেকেই গ্রামে বসবাস করেন। এঁরা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন।
অন্যান্য কারণ:
(a) শহরের অত্যধিক দূষণের থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে এসে বসবাস করেন।
(b) শহরের সামাজিক জীবনের জটিলতা অনেকের ভালো লাগে না, তাই তারা গ্রামে চলে আসেন।
প্রভাব (Consequences):
(i) গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রায় শহরের মতো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে, বাড়িঘর, পোশাক-পরিচ্ছদ, কথাবার্তায় শহরে ভাব লক্ষ করা যায়।
(ii) শহরের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে শহরের লোকের বেশি পরিব্রাজন ঘটে। এর ফলে ওই সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির জনঘনত্ব বেশ বৃদ্ধি পায়। এমনকি এইসব গ্রামীণ অঞ্চলে শহরের প্রভাবে পৌরায়ন ঘটতে থাকে। কলকাতার সীমান্তবর্তী রাজারহাট, সোনারপুর, বাবুইপুর প্রভৃতি এলাকা বর্তমানে নগরায়ণের কবলে পড়েছে.
(ii) শহরের লোকেরা বেশি সংখ্যায় গ্রামে এসে বসবাস করে। তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব গ্রামেদ মানুষের জীবনেও দেখা যায়।
গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন (Rural-Urban migration):
এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে গিয়ে বসবাস করলে গ্রাম থেকে গ্রামে পরিরাজন (Rural to Raza Migration) ঘটে। প্রধানত কৃষি অধ্যুষিত অঞ্চলে এই ধরনের পরিব্রাজন ঘটে।
গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজনের কারণ:
সামাজিক কারণ:
(a) এক গ্রামের মেয়ের অন্য গ্রামে বিবাহ হলে সে ওই গ্রামে স্বামীর সঙ্গে বসবাস করে।
(b) উত্তর-পূর্ব ভারতের কয়েকটি উপজাতি সম্প্রদায়, যেমন- গারো, খাসি, নাগা প্রভৃতি উপজাতির ছেলেরা বিবাহের পর বিভিন্ন গ্রামে মেয়েদের বাড়ি গিয়ে বসবাস করে।
অর্থনৈতিক কারণ:
(a) পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার প্রভৃতি রাজ্যে দেখা যায় যে, যেসব গ্রামে কৃষিকাজের সুযোগ-সুবিধা বেশি সেই সব গ্রামে গিয়ে মানুষ বসবাস করছে.
(b) গ্রামীণ এলাকায় ইটভাটা থাকলে অন্যান্য গ্রাম থেকে সেখানে এসে লোকেরা বসবাস করে এবং ইটভাটায় কাজ করে।
(C) গ্রামের মধ্য দিয়ে সড়কপথ, রেলপথ প্রভৃতি নির্মাণকল্পে একাধিক গ্রামের লোকেরা এসে কাজ করে এবং কয়েকমাস থেকে দু-এক বছর পর্যন্ত বসবাস করেন।
রাজনৈতিক কারণ: রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় অশান্তি, শান্তি, নিরাপত্তা প্রভৃতি কারণে এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে বসবাস করে। পশ্চিমবঙ্গের সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, গড়বেতা, ভাঙড় প্রভৃতি অঞ্চলে রাজনৈতিক হানাহানির কারণে এক গ্রামের মানুষ অন্য গ্রামে গিয়ে বসবাস করছে।
অন্যান্য কারণ:
(a) গ্রামে বন্যা, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি কারণে মানুষ অন্য গ্রামে চলে যায়।
(b) অনেকসময় বড়ো বড়ো সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন দুর্গোৎসব, বার্ষিক ধর্মীয় মেলা প্রভৃতি উপলক্ষে স্বল্প মেয়াদি গ্রাম থেকে গ্রামে পরিব্রাজন ঘটে।
প্রভাব:
(i) অনুন্নত গ্রামের লোকজন উন্নত গ্রামে বেশি সংখ্যায় গিয়ে বসবাস করলে উন্নত গ্রামের অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে।
(ii) দুটি গ্রামের মধ্যে সংস্কৃতির আদানপ্রদান ঘটে।
(iii) উৎস গ্রাম থেকে অধিক সংখ্যক লোক গন্তব্য গ্রামে গিয়ে বসবাস করলে গন্তব্যগ্রামে শ্রমশক্তির জোগান বৃদ্ধি পায়।
শহর থেকে শহরে পরিব্রাজন (Urban to Urban Migration):
যে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক শহরের মানুষ অন্য শহরে গিয়ে বসবাস করেন কিংবা অন্য শহর থেকে ওই নির্দিষ্ট শহরে এসে লোকজন থাকেন তাকে শহর থেকে শহর পরিব্রাজন বলে (Urban to Urban Migration)। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাকুরি এবং ব্যাবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত কারণেই এক শহর থেকে অন্য শহরে পরিব্রাজন ঘটে।
শহর থেকে শহরে পরিব্রাজনের কারণ:
অর্থনৈতিক কারণ:
(ক) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই দেখা যায় যে অধিক আয়ের ও কর্মসংস্থানের সুযোগ-সুবিধাকে কেন্দ্র Uhl এতে এক শহরের লোক অনা শহরে যান। তাঁরা প্রধানত চাকুরি, ডাস্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি পেশার সঙ্গে। নয়ে বসবাস ও চাকরি করার ক্ষেত্রে বেশি আগ্রহী হন। শহরবাসী।
(ক) এক শহর থেকে অন্য শহরে শিল্পে বিনিয়োগের অধিক সুযোগ, নতুন নতুন আবাসন প্রকল্প, গাড়ি কেনার সুবিধা প্রভৃতির ওপর নির্ভর করে মানুষ অন্য শহরে পাড়ি দেন।
সামাজিক কারণ:
(২) প্রভাব-প্রতিপত্তি, নাম-যশ প্রভৃতি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে মানুষ অন্য শহরে চলে যান। ডাক্তার, অধ্যাপক, হরলিয়ার এমনকি বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
(চ) বৈবাহিক সূত্রে বিশেষত এক শহরে মেয়ের যখন অন্য শহরে বিবাহ হয় তখন ওই কন্যাকে শ্বশুর এড়িতে গিয়ে বসবাস করতে হয়। জির
(৫) উচ্চশিক্ষালাভের জন্য এক শহর থেকে অন্য শহরে মানুষ পাড়ি দেয়।করে ।
রাজনৈতিক কারণ:
(a) রাজনৈতিক দাঙ্গা, যুদ্ধবিগ্রহ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এক শহরের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ চনা শহরে গিয়ে বসবাস করেন।
অন্যান্য কারণ:
(a) সরকারি চাকুরিজীবীদের এক শহর থেকে অন্য শহরে বদলি করে দিলে তারা নতুন শহরে গিয়ে বসবাস করেন।
(b) কোনো নগর কিংবা শহরে জনসংখ্যার চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পেলে সেই সব শহরের লোকজন নানা শহরে চলে যান। কলকাতা নগরীর জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য বিধাননগর, সল্টলেক, পাটুলী প্রভৃতি উপনগরীগুলিতে লোক বসবাস শুরু করেছেন।
প্রভাব (Consequences):
(i) শহরের জনসংখ্যার চাপ হ্রাস পায়।
(ii) শহরের পরিকাঠামোর উন্নয়ন ঘটে।
(iii)অর্থনৈতিক কার্যাবলি ও পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে।
(iv) পরিকল্পিত পরিব্রাজনের মাধ্যমে শহরের মূল কেন্দ্রস্থানের পরিবর্তন ঘটানো হয়।