বি. এস. গৃহ কৃত ভারতের জাতিগত শ্রেণীবিভাগ (Classification of Indian Races after B. S. Guha)
ড. বি. এস. গৃহ ছিলেন ভারতের নৃতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণ বিভাগের অধিকর্তা। তিনি ১৯৩১ সালে সেন্সাস অপারেশন-এর উপর নির্ভর করে ভারতের জাতিগত শ্রেণীবিভাগ করেন। এটি একটি নির্ভরযোগ্য শ্রেনীবিভাগ হিসেবে গন্য হয়েছে। তিনি ভারতবর্ষের ৬টি জাতিগত শ্রেনীবিভাগ করেন।
১. নেগ্রিটো (Negritoes): সম্ভবত ভারতবর্ষের প্রাচীনতম অভিবাসী নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী হলেন নেগ্রিটোগণ। ক্ষুদ্রাকৃতি গড়ন, কোঁকড়ানো চুল, কৃয় গাত্রবর্ণ, উচু চোয়াল নেগ্রিটোদের দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট। ভারতে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে জারোয়া, ওলো, সেন্টিনেলিস প্রভৃতি জনজাতি, দাক্ষিনাত্যের কাদার, কানিক্কার, পানিয়ান, পুলিয়ান প্রভৃতি উপজাতি গোষ্ঠী এই শ্রেণীভুক্ত। এদের দেহসৌষ্ঠবের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সেমাং ও সাকাইদের সঙ্গে মিল থাকায় মনে করা হয় মালয় উপদ্বীপ থেকে অতীতে এদের আগমন ঘটেছে।
২. প্রোটো-অস্ট্রেলয়েড (Proto-Australoid): নেগ্রিটোদের পরে ভারতবর্ষে সম্ভবত অস্ট্রেলিয়া থেকে এরা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেন। মধ্য ভারতের উচ্চভূমি ও ছোটোনাগপুর মালভূমির বিভিন্ন উপজাতি যেমন ভিল, হো, চেঞ্চু, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি জনজাতি। গাঢ় বাদামী থেকে কুরু-বাদামী গাত্রবর্ণ, চওড়া নাক, পুরু ঠোঁট, কোঁকড়ানো চুল ও ক্ষুদ্রাকৃতি গড়ন এদের দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট।
৩. মোঙ্গলয়েড (Mongoloid): মোঙ্গলয়েডগণ মনে করা হয় মোঙ্গলিয়া, চান, তীব্বত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও তৎকালীন ব্রহ্মদেশ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে ভারতে এসে বসতি গড়েন। জম্মু কাশ্মীরের লাদাখে, হিমাচল প্রদেশে, উত্তরাখন্ডে, সিকিমে ও উত্তর পূর্ব ভারতের পাহাড়ী অঞ্চলে বসতি বিস্তার করেন।
ড. গৃহ মোঙ্গলয়েডদের দুটি উপশাখায় বিভক্ত করেন। ক. পুরা মোঙ্গলয়েড (Palaco-Mongoloid) ও খ. তিব্বতী-মোঙ্গলয়েড (Tibeto-Mongoloid)। প্রাচীনতম অভিবাসী পুরামোঙ্গলয়েডগণ লম্বামুন্ড, হালকা বাদামী গাত্রবর্ণ, মাঝারি উচু নাক এবং মাঝারী আকৃতি দেহগড়ন। আসাম, অরুনাচল প্রদেশ ও বর্তমান মায়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে এরা বসবাস করেন। গাড়ো, খাসি, কুকি-নাগা, মেচি প্রভৃতি জনজাতি এদের উদাহরণ। তিব্বতী মোঙ্গলয়েডদের দেখা যায় লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, ভুটান ও কিছু সংখ্যায় উত্তরাখন্ডে। লম্বা গড়ন, ফর্সা, উন্নত নাসিকা ও চ্যাপ্টা মুখবয়ব এদের দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট্য। লাদাখী, কিন্নরী, গোর্খা, ভূটিয়া প্রভৃতি জনজাতি এই গোষ্ঠীর।
৪. ভূমধ্যসাগরীয় (The Mediterraneans): ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে বিভিন্ন পর্বে এরা এসেছেন। তিনটি উপশ্রেনী চিহ্নিত করেছেন ড. গৃহ- ক. পুরা ভূমধ্যসাগরীয় (Palaco-Mediterranean) খ. ভূমধ্যসাগরীয় (Mediterranean) ও গ. প্রাচ্য (Oriental)।
ক. পুরা ভূমধ্যসাগরীয় (Palaco-Mediterranean): প্রাচীনতম এই ভূমধ্যসাগরীয় গোষ্ঠীর দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট্য হ'ল সরু মাথা, লম্বা মুখাবয়ব, ক্ষুদ্র বা মাঝারি নাক, বাদামী বর্ণ ও মাঝারি গড়ন। মনে করা হয় নিওলিথিক উপযুগে তারা ভারতে এসেছিলেন এবং বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিনদিকে বিচ্ছিন্নভাবে বসতি গড়ে তোলে।
খ. ভূমধ্যসাগরীয় (Mediterranean): এদের দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট্য মাঝারি গড়ন, কতকটা বাদামী বর্ণ, লম্বা মুন্ড ও বড় চোখ। এদের দেখা যায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ এবং কিছু সংখ্যায় কেরালায়।
গ. প্রাচ্য (Oriental): প্রাচ্য ভূমধ্যসাগরীয়রা অনেক দেরিতে ভারতে এসেছিলেন। প্রায় অনুরূপ দেহসৌষ্ঠব হলেও তাদের পৃথক করা যায় লম্বা, উত্তল নাসিকা এবং ফর্সা গাত্রবর্ণ থেকে। রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে ও উত্তরাখন্ডের দক্ষিণ দিকে তাদের বসতি দেখা যায়।
৫. পাশ্চাত্য গোলমুন্ড (The Western Brachycephals): ড. গৃহ-র শ্রেনীবিভাগ অনুযায়ী এরা তিনটি উপবিভাগে বিভক্ত- ক. আলপিনয়েড খ. দিনারিক গ. আর্মেনয়েড।
ক. অ্যালপিনয়েড (Alpinoid): প্রাক-বৈদিক যুগে সিন্ধু উপত্যকায় এদের আগমন এবং পরবর্তীকালে গুজরাট, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, অস্ত্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কেরালায় ছড়িয়ে পড়েন। আরো পরে এঁরা গন্ধ্যা অববাহিকায় প্রবেশ করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ওড়িষা পর্যন্ত বসতি বিস্তার করেন। এরা মাঝারি গড়ন, গোলাকৃতি মুখাবয়ব, উন্নত নাসিকা ও ফর্সা গাত্রবর্ণবিশিষ্ট।
খ. দিনারিক (Dinarics): আলপিনয়েডদের পরে এরা এসেছিলেন এবং মহারাষ্ট্র, গুজরাট, কর্ণাটক, কেরালা, তামিলনাড়ু ও অল্পপ্রদেশে বসতি বিস্তার করেন। এদের লম্বা গড়ন, লম্বা মুখ, তীক্ষ নাসিকা এবং বাদামী গাত্রবর্ণ বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে আলপিনয়েডদের সঙ্গে এরা মিশে যান। গুজরাটের কাথিয়াবার ও কর্ণাটকের কুর্গে এদের দেখা মেলে।
গ. আর্মেনয়েড (Armenoids): আর্মেনিয়া থেকে এরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন। মাঝাড়ি গড়ন, চওড়া মুন্ড, লম্বা নাসিকা, ফর্সা গাত্রবর্ণ এদের দেহসৌষ্ঠবের বৈশিষ্ট্য। মুম্বাই ও গুজরাটের পার্শিগন এই শ্রেনীর।
৬. নর্ডিক (The Nordics): বৈদিক আর্য বলে পরিচিত নর্ডিকগণ সবশেষে ভারতে এসেছিলেন।খ্রীষ্টপূর্ব দুই সহস্রাব্দে সম্ভবত এরা এই দেশে এসেছিলেন এবং দ্রাবিড়দের পরাভূত করে উত্তরভারতের সমত্ব মিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা গড়ে তোলেন। পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতের দিকে তারা রাজ্যবিস্তার করেন। তাদের দেহসৌষ্ঠবের বৈষিষ্ট্য লম্বা মুন্ড, লম্বা মুখবয়ব ও ফর্সা গাত্রবর্ণ। রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাংশে এবং উত্তরাখন্ডের দক্ষিণ দিকে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মন জনসংখ্যা মধ্যে তাদের দেখা যায়। মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন জনজাতির মিশ্রনে সৃষ্ট তাদের পরবর্তী প্রজন্ম।