পশ্চিমবঙ্গের কৃষিজাত পণ্য বা কৃষি সম্পদ
পশ্চিমবঙ্গে কৃষি উন্নয়নে অনুকূল অবস্থা
• ভূমিরূপ:বিস্তীর্ণ প্রশস্ত সমতলভূমি,মৃত্তিকা:নদীবাহিত পলল মৃত্তিকা,অনুকূল উদ্বুতা ও বৃষ্টিপাত,বিশাল জনসংখ্যার চাহিদা ও শ্রমের যোগান,জলসেচের প্রসার এবং সরকারি প্রচেষ্টায় সুসংহত গ্রামোন্নয়ন প্রকল্প, কৃষি ঋণদানের ব্যবস্থা, উচ্চফলনশীল বীজ প্রদান প্রভৃতি কৃষি উন্নয়নে অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করেছে।
কৃষিকাজের বৈশিষ্ট্য - সমস্যা ও সম্ভাবনা
কৃষিকাজের বৈশিষ্ট্য: পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ব্যবস্থা এখনও প্রথাগত পদ্ধতিতে পরিচালিত হলেও বর্তমানে স্থানে স্থানে আধুনিক কৃষি-ব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে। ট্রাক্টরের ব্যবহার এখনও খুব কম হলেও হ্যান্ডটিলার-এর ব্যবহার অনেক স্থানেই জনপ্রিয়। এতে ব্যয়ও বেশী হয় না। পশ্চিমবঙ্গের কৃষির বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরুপঃ
শ্রমনির্ভর কৃষিব্যবস্থা খাদ্য ফসলের প্রাধান্য বহুফসলী কৃষির প্রচলন গ্রামীন বৈদুতীকরন প্রসারে জলসেচের প্রসার ইত্যাদি (v) খাদ্য ফসলের প্রাধান্য। ধানই প্রধান খাদ্য ফসল। ধান উৎপাদনেপশ্চিমবঙ্গ ভারতে শ্রেষ্ঠ। পাট ও চা উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ভারতে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয়।
সমস্যা- জনপ্রতি উৎপাদন কম হেক্টরপ্রতি উৎপাদন কম কারন কৃষকের আর্থিক অসুবিধায় উচ্চফলনশীল বীজ, উপযুক্ত সার ও কীটনাশকের অভাবে ফসল কম হয়।সেচ খালে জল আসা অনিয়মিত হওয়ায় ব্যায়সাপেক্ষ ডিপ টিউবওয়েলের উপর নির্ভর করতে হয় বলে ট্রাক্টর ইত্যাদি উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ কম মূলধনী ঋনের অভাব। ব্যাঙ্ক, সমবায় ইত্যাদি থেকে কৃষি ঋণের কিন্তু মহাজনী ঋণের বন্ধন থেকে তাদের এখনও সম্পূর্ণ মুক্ত করা যায়নি। ব্যবস্থায় বহু চাষী উপকৃত হয়েছেন, শিক্ষার সুযোগ গ্রামাঞ্চলে প্রসারিত হলেও দরিদ্র কৃষক পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রায়শঃই স্কুলে যেতে পারে না। ফলে শিক্ষিত শ্রমশক্তি গড়ে ওঠেনি।
সম্ভাবনা- অনাবাদী জমিগুলিকে প্রযুক্তিগত সহায়তায় আবাদী করে তোলা অর্থকরী ফসল উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান উদ্বৃত্ত ফসল গুদামজাত করনের সুযোগ বৃদ্ধি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির ঋনদানে এগিয়ে আসা, ভূমি সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কৃষি সমবায় গঠন করে কৃষককে ফসল উৎপাদন থেকে বিকি তে সর্বতোভাবে সহায়তা প্রদান করলে পশ্চিমবঙ্গে উর্বর কৃষিজমি কৃষিকাজে আরো এগিয়ে যাবে।
• ধান: পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য কৃষিপণ্য হল ধান। মোট কৃষিজমির ৭০% এলাকায় ধান চাষ হয়। আউস, আমন, বোরো তিন প্রকার ধান চাষ হলেও আমন ধানের উৎপাদন বেশি। এই ধানের উন্নত মানের জন্য এর চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।
আমন ধান উৎপাদনে শ্রেষ্ঠ জেলা হল মেদিনীপুর, এরপর বর্ধমানের স্থান। পাহাড়ী অঞ্চলে ধাপ কেটেও আমন ধানের চাষ হয়। পশ্চিমবলো ২০১৪-১৫ সালে প্রায় ১ কোটি ৯ লক্ষ ৮৪ হাজার মেট্রিক টন আমন ধান উৎপন্ন হয়। আউশ ধান উৎপাদনে মুরশিদাবাদ জেলা এবং নদিয়া জেলা যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গে ৫-৯১ লক্ষ মেট্রিক টন আউশ ধান উৎপন্ন হয়।
বোরো ধান বর্ধমান জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হয়। জলসেচের সুবিধা হওয়ায় শীতকালীন এই ধান মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, নদিয়া, বীরভূম প্রভৃতি জেলায়ও চাষ করা হয়। জলা নিম্নভূমিতে বোরো ধান চাষ ভালো হয়। ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবলো ৪৩-৫২ লক্ষ টন বোরো ধান উৎপন্ন হয়।
উৎপাদন: ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিমবলো প্রায় ৫৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে মোট ১ কোটি ৫৯ লক্ষ টন ধান উৎপন্ন হয়েছিল। রাজ্যে হেক্টর-প্রতি ধান উৎপাদন ২,৭৮০ কেজি।
গম: গম শীতকালীন ফসল। মুর্শিদাবাদ জেলায় সর্বাধিক গম উৎপাদন (৩ লক্ষ টন) হয়। নদীয়া (১.৪৮ লক্ষ টন), মালদা (১.২৬ লক্ষ টন), বীরভূম (৯৬ হাজার টন) প্রভৃতি জেলায় গম চাষ হয়। ২০১৪-১৫ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে ৩.৩৪ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে মোট প্রায় ১.৪ লক্ষ টন গম উৎপন্ন হয়।
পাট: 'সোনালি তত্ত্ব' পাট পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থকরী ফসল। দেশের প্রায় ২/৩ ভাগ পাট পশ্চিমবঙ্গ্যে উৎপন্ন হয়। রাজ্যে পাটকলগুলির চাহিদা মেটাতে এই পাট চাষের প্রয়োজন হয়।পাট চাষে মালদহ, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, নদিয়া, মুরশিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বর্ধমান, মেদিনীপুর, হাওড়া ও হুগলি উল্লেখযোগ্য। ২০১৪-১৫ সালে রাজ্যে ৫-৬২ লক্ষ হেক্টর জমিতে ৮৮০ লক্ষ টন পাট উৎপন্ন হয় যা দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় ২/৩ ভাগ।
চা: পশ্চিমবঙ্গোর অপর শ্রেষ্ঠ অর্থকরী ফসল হ'ল চা। দার্জিলিং জেলায় উৎপন্ন চা পৃথিবীতে স্বাদে ও গন্ধে শ্রেষ্ঠ। পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে ১০০ মিটার থেকে প্রায় ২০০০ মিটার উচ্চতার মধ্যে সাধারণত চা বাগানগুলি দেখা যায়। এর বেশি উচ্চতায় উন্নতা কমে যাওয়ার কারণে চা বাগান বিশেষ গড়ে ওঠে না। জলপাইগুড়ির ডুয়ার্স অঞ্চলে প্রচুর চা বাগান রয়েছে। কুচবিহার জেলায়ও চা-এর চাষ হয়। উত্তরবঙ্গের পার্বত্য অঞ্চলে চা উৎপাদনের অনুকূল অবস্থা প্রচুর বৃষ্টিপাত, লৌহমিশ্রিত মাটি ও উঁচু ও ঢালু ভূমিভাগ, সুলভ শ্রমিক, সু-পরিবহন ব্যবস্থা এবং দার্জিলিং-ডুয়ার্সের চা-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদা।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১০-১১ সালে প্রায় ১ লক্ষ হেক্টর জমি থেকে প্রায় ২৩ কোটি কেজি চা উৎপন্ন হয়। পশ্চিমবঙ্গে ভারতের মোট উৎপাদনের প্রায় ১/৪ ভাগ চা উৎপন্ন হয়।
পশ্চিমবঙ্গে চা উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা:
বৈদেশিক বাণিজ্যে তাঁর প্রতিযোগিতা,চা চাষে উন্নত পদ্ধতির অভাব,চা প্যাকিং ও সংরক্ষণের উন্নত পদ্ধতির অভাব, উপযুক্ত মজুরি ও অন্যান্য সুবিধার দাবিতে শ্রমিক অসন্তোষ প্রভৃতি।এই সমস্যার সমাধানে উৎকৃষ্ট ও সুলভে চা উৎপাদন মাধ্যমে বাণিজ্যিক সুবিধা অর্জন, চা চাষে এবং প্যাকিং ও সংরক্ষণে উন্নত প্রযুক্তির প্রসার ও শ্রমিকদের দাবিদাওয়ার প্রতি মনোযোগ চা চাষের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করবে।