পরিকল্পনাকালে পশ্চিমবঙ্গে খনিজ সম্পদ উন্নয়নঃ
স্বাধীনতা লাভের বিভিন্ন পরিকল্পনাকালে খনিজ সম্পদ উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই উপলক্ষে খনিজ সম্পদ অনুসান, বর্তমানের খনিগুলি থেকে খনিজ উত্তোলনের সুব্যবস্থা ইত্যাদির দিকে লক্ষ্য দেওয়া হয়। যে সকল নতুন খনিজ ভান্ডার আবিষ্কৃত হয় সেগুলির মধ্যে আছে-
• চুনাপাথরের বিরাট সপ্তয় পুরুলিয়ার ঝালদায় এবং বিক্ষিপ্তভাবে মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বর্ধমান ও জলপাইগুড়ি জেলায় এই খনিজের অবস্থান।
• দার্জিলিংয়ে তামার আবিষ্কার।
• মেদিনীপুর জেলার বেলপাহাড়ী অঞ্চলে ম্যাঙ্গানিজ-এর সঞ্চয়ের সান।
• জলপাইগুড়ি জেলার বক্সাদুয়ার এলাকায় ডলোমাইটের সান।
• বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরে চীনামাটির সন্বয় আবিষ্কার।
• বাঁকুড়ার ঝিলিমিলিতে উলফ্রাম-এর আবিষ্কার।
খনিজ তেল অনুসানের জন্য ONGC-র উদ্যোগে নিম্ন-গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের কয়েক স্থানে বেশ কয়েকটি তেলের কূপ খনন করা হয়েছে এবং রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ অংশে আরো কিছু কূপ খনন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে প্রাপ্ত খনিজ সম্পদের বণ্টনঃ
পশ্চিমবঙ্গো খনিজ সম্পদ কয়েকটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পাওয়া যায়। তবে কয়লা ছাড়া কোনো মূল্যবান খনিজ সম্পদে এই রাজ্য সমৃদ্ধ নয়। বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের মধ্যে কয়লা, ফায়ার ক্লে, চুনাপাথর, ডলোমাইট, বেলেপাথর, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, উলফ্রাম, চীনামাটি, লৌহ-আকরিক কিছু কিছু পরিমাণে সঞ্চিত থাকলেও বাণিজ্যিক উত্তোলন-যোগ্য খনিজের তালিকায় কয়লা, ফায়ার ক্রে, চুনাপাথর, ডলোমাইট ও চীনামাটি ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পড়ে না। রাজ্যের দক্ষিণে সুন্দরবন অঞ্চলে এবং উত্তরবঙ্গের সমভূমিতে পলল স্তরের নীচে খনিজ তেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ভূতাত্ত্বিকদের ধারণা। খনিজ অনুসানের জন্য খননকার্যের পরিকল্পনা রয়েছে।
কয়লাঃ পশ্চিমবঙ্গের উত্তোলিত খনিজদ্রব্যের মধ্যে অর্থমূল্যের বিচারে কয়লার স্থান কেবল প্রথমই নয়; এটি মোট উত্তোলিত খনিজদ্রব্যের মূল্যের হিসাবে শতকরা ৯৯ ভাগ। দামোদর অববাহিকা অঞ্চল কয়লা সঞ্চয়ে সমৃদ্ধ। তবে ওই নদী উপত্যকার বিহার অংশেই কয়লা সঞ্চয়ের পরিমাণ বেশি। পশ্চিমবঙ্কো রাণীগঞ্জ ভারতের অন্যতম প্রাচীন কয়লাখনি। আসানসোল ও রাণীগঞ্জে অধিকাংশ কয়লাখনি রয়েছে। মেজিয়াতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কয়লা পাওয়া যায় যা শিল্পে বিশেষতঃ লৌহ ও ইস্পাতশিল্পের খুব উপযোগী।
পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের এই কয়লাখনিগুলির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে আসানসোল, দুর্গাপুর শিল্পাশ্বল এবং হুগলি নদীর দুই তীরে অবস্থিত কলকাতা শিল্পাঞ্চল বা হুগলি শিল্পাম্বুল। দুর্গাপুরের লৌহ ও ইস্পাত কারখানা এই কয়লাখনিগুলির সুবিধায় গড়ে উঠেছে। রাজ্যের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিও এই কয়লার ওপর নির্ভরশীল।
দাজিলিং-এর পার্বত্য অঞ্চলে কিছু লিগনাইট জাতীয় কয়লার সঞ্চয় রয়েছে। বর্তমানে কয়লা উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ভারতে ষষ্ঠ। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গে ২.২৮ টন কয়লা উত্তোলিত হয়। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খনন কার্যের ফলে রাণীগঞ্জ কয়লা-স্তরের পূর্বদিকে বিস্তারের সম্ভাবনা পাওয়া গেছে দামোদরের দক্ষিণে নওয়াদার গোপালপুর, বরাচক, বরাধেমো ও দিশেরগড়ে। দিশেরগড়ের কয়লান্তর ফায়ার ক্রে বা আগুনে মাটি রাণীগঞ্জ কয়লাখনি অঞ্চলে এবং পুরুলিয়ায় পাওয়া যায়। এ থেকে প্রস্তুত ইট তাপ নিরোধক এবং এই ইট চুল্লিতে ব্যবহৃত হয়। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ৫৫.৮ হাজার মেঃ টন ফায়ার ক্রে উত্তোলিত হয়।
চিনামাটি (China Clay): এই রাজ্যের অপর একটি উল্লেখযোগ্য খনিজ। চিনামাটির ব্যববহারও সেরামিক শিল্পে উন্নত এই রাজ্যে যথেষ্ট বেশি। পশ্চিম অঞ্চলের বীরভূম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বর্ধমান জেলায় চিনামাটি পাওয়া যায়। চায়না ক্রে দুইভাবে এই জেলায় পাওয়া যায়। একভাবে প্রাণাইটের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় ও অপরভাবে ফিলাইয়ের সঙ্গে। প্রথমোক্তটির উল্লেখযোগ্য সঞ্চয় রয়েছে রামকেনালি স্টেশনের নিকট খাদ্রায়, আদ্রা থেকে ১৯ কি. মি. দূরে কালাঝোর ও কালাবনিতে, ঝালদার অদূরে মাহাতামারা এবং রাঙামাটিতে। ফিলাইটের সহিত কেওলিন সঞ্চিত আছে মানবাজার থেকে ৮ কি.মি. দূরে খড়িদুয়ারা, শিয়ালভাঙা, দানদুলি এবং তামাখানে। তবে এখানকার শিলা থেকে কেওলিন ২৫% এর বেশী পাওয়া সম্ভব নয়। উত্তোলনযোগ্য চায়না ক্লে-র সঞ্চয় আছে রঘুনাথপুর থানার আমতোরে, পুরুলিয়া, ঝালদা এব বাঘমুন্ডি থানার কালাবনি, মাহাতামারা এবং শ্রাবন্দিতে। ধাতারার চায়না ক্লে কাগজ, রবার ও বয়ন শিল্পে ব্যবহারোপযোগী। এখানকার সঞ্চয়ের পরিমাণ ৮.২ লক্ষ টন। কালাবনির চায়না ক্রে উৎকৃষ্ট ও মৃৎশিল্পে ব্যবহারোপযোগী। বীরভূম জেলার মহম্মদবাজার, পুরুলিয়ার রঘুনাথপুর, ঝালদা ও বাঘমুণ্ডিতে চিনামাটি সংগ্রহ উল্লেখযোগ্য। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ৭৯ হাজার মে. টন চিনামাটি উত্তোলিত হয়।
তাম্র (Copper): মানবাজার থানার তামাথুন-এ ৬ মিটার গভীর একটি প্রাচীন তামখনি উন্মোচিত হয়েছে, যার সঞ্চয়ের পরিমাণ ৮,০০০ টন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাতিরামগোরা ও কান্তাগোরায় তাম্র উত্তোলিত হত। এই এলাকায় সরকারীভাবে পুনরায় অনুসন্ধান চালানো হয় এবং এটি একটি সম্ভবনাময় অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। এখানকার প্রধান আকরিক হল চালকোপাইরাইট।
ফেলস্পার এর সঞ্চয় বহু স্থানে রয়েছে। এটি রেলপথে কলিকাতায় পাঠান হয়, যেখানে এটি ব্যবহারের পূর্বে মিহি পাউডারে পরিণত করা হয়।
ফ্লুয়োরাইট ইস্পাত, এনামেল ও রাসায়নিক-শিল্পের একটি প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একটি বিরল খনিজ। পুরুলিয়ায় এটি ঝাল্দা থানার অর্ন্তগত বেলামু পাহাড়ে পাওয়া যায়। পূর্বাঞ্চলের ইস্পাত কেন্দ্রগুলিতে এর চাহিদা রয়েছে।
চুনাপাথর জেলার কতিপয় এলাকায়ই রয়েছে। ঝাল্দা থানা এলাকায় প্রায় ২ কোটি টন চুনাপাথর মজুত রয়েছে এবং এটি কাঁচামাল হিসাবে সিমেন্ট শিল্পের বিশেষ উপযোগী। হংসপাথরে পূর্বেও চুনাপাথর উত্তোলিত হত। বর্তমানে এখানে প্রায় ১৩ লক্ষ টন চুনাপাথর সঞ্চিত আছে। এ ছাড়াও তামাথুন, গোবিন্দপুর, মিরগীচান্দায় ও কান্তাগোরায় অদূরে চুনাপাথর সঞ্চিত রয়েছে। জেলায় বার্ষিক চুনাপাথর উত্তোলনের পরিমাণ প্রায় ৩০,০০০ টন। উৎকৃষ্ট মানের জন্য এটি প্রধানতঃ চুন প্রস্তুতে ব্যবহৃত হয়।
লৌহ-আকরিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় রয়েছে পাঞ্চেত পাহাড়, ঝালদা, গৌরাঙ্গাদিহ, সুপুর ও মানবাজার এলাকায়। এদের অধিকাংশই রহিয়াছে পেগমাটাইট ও কোয়ার্টজের শিরায় এবং এতে রয়েছে ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট প্রভৃতি। বাউচ-এ উচ্চশ্রেণীর হেমাটাইট এবং ঝালদায় কৃষ্ণ বর্ণের ম্যাগনেটাইট সঞ্চিত রয়েছে।
ম্যাঙ্গানীজ-এর বণ্টন অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক নয়, তবে সিংভূম-সীমান্তে পাহাড়পুরের সঞ্চয়টি বাণিজ্যিক সম্ভবনাময়।
পুরুলিয়ার বড়বাজারের উত্তরভাগে কাশীপুর, বলরামপুর ও জয়পুর থানা এলাকায় ক্ষুদ্রাকৃতি অন্নের পাত রয়েছে। পূর্বে কয়েক স্থানে অভ্র উত্তোলিত হত। কৃষ্ণবর্ণের গ্রাফাইট সিস্ট আণবিক রি-এ্যাক্টরে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু পুরুলিয়ায় এটি এত মালিনাযুক্ত যে, বর্তমান কারিগরীজ্ঞানে কার্যোপযোগী করা বিশেষ সম্ভব হচ্ছে না। এই খনিজ রয়েছে কালাকোর, কাশীপুর ও গৌরাঙ্গাদিহ, আদ্রার অদূরে বঙ্গোরা, দিমাডিহা ও পাঞ্চেত পাহাড় অঞ্চলে। শালবনিতে কায়ানাইট উত্তোলিত হয়। বলরামপুরে উৎকৃষ্ট কায়ানাইট ও সিলিমেনাইট অন্যান্য খনিজের সহিত মিশ্রিত অবস্থায় রয়েছে।
লবণঃ কাঁথির সমুদ্র উপকূলে লবণ সংগৃহীত হয়। উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ১৫৬ হাজার কুইন্টাল। ২০০৭)।
এছাড়া কোয়ার্টজ বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে ও পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে পাওয়া যায়। পশ্চিম দিকের জেলাগুলিতে যেমন, পুরুলিয়া, বীরভূম, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম জেলায় রাস্তা ও গৃহ নির্মাণের কাজে সহজলভ্য ল্যাটেরাইটের ব্যবহার বহু দিন থেকে চলে আসছে।