welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

দার্জিলিং-এ পর্যটন

5 min read

 দার্জিলিং-এ পর্যটন


ভূমিকা: "পাহাড়ের রানী" (Queen of the hills) আখ্যায় ভূষিত দার্জিলিং হিমালয়-এর অনন্য প্রাকৃতিক শোভা তার তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গে, পর্বতগাত্রে ঘন সবুজ অরন্য ও গ্রীষ্মে রাডোডেনড্রনের রক্তিম শোভা, গভীর নদী উপত্যকা, অসংখ্য জলপ্রপাত ও প্রাকৃতিক ঝোড়া, সবুজ চা বাগিচার চাদর বিছানো নাতিটাল পর্বতগাত্র, খাড়াই ভৃগুতট, সুদৃশ্য অভিক্ষিপ্তাংশের যোগাযোগ (Interlocking Spur), গভীর মেঘে ঢাকা উপত্যকা, শৈলশীর্ষে মেঘের আনাগোনা, বরফে মোড়া শৈলশিরায় রোদের সোনালী রূপোলি প্রতিফলন, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তে তুষারশৃঙ্গগুলির রঙবদল ইত্যাদির অনবদ্য সৌন্দর্য্য দেশী বিদেশী পর্যটকদের বারে বারে দার্জিলিং-এ নিয়ে আসে। এছাড়াও শহরাঞ্চলে ও উপকন্ঠে রয়েছে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। দার্জিলিং চিড়িয়া খ ানা, মিউজিয়াম, রক গার্ডেন, ওয়ার মেমোরিয়াল, টয়ট্রেন, রোপওয়ে ইত্যাদি মনুষ্যসৃষ্ট নিদর্শনগুলিও অন্যতম আকর্ষণ।।

পর্যটনের প্রকারভেদ ও কর্মকান্ড (Tourism Types andActivities): বিভিন্ন পর্যটন আকর্ষণ কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে;

(১) এ্যাডভেঞ্চার টুরিজম যেমন, ট্রেকিং, ক্লাইম্বিং, রিভার র‍্যাষ্টিং, টেন্টে রাত্রিযাপন ও বিপদসংকুল পথে গমন ইত্যাদি।

(২) ইকো টুরিজম আরণ্যক বাস্তুতন্ত্র ও নদী উপত্যকার পলি বিশেষতঃ তিস্তা, রঙ্গিত প্রভৃতি নদীগুলির তীরে ভ্রমণ ও বৃক্ষ, ফুল ও পশুপাখির সান্নিধ্যে দিবস ও রাত্রিযাপন।

(৩) টি-টুরিজম- চা বাগিচাগুলি ভূমিরূপের ওঠানামার সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে তার বিস্তার ঘটায় এক অনুপম সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। শ্রমিকদের নিপুন হাতে চা পাতা তোলাও একটি দর্শনীয় ব্যাপার। অনেক চা বাগিচাই এখন পর্যটনের ব্যবস্থা করেছে; চা বাগানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে।

৪) হোম-স্টে টুরিজম পার্বত্য পরিবেশে, নদী উপত্যকায়, অরণ্য অথবা চা-বাগিচার ধারে স্থানীয় অধিবাসীদের গৃহে আতিথ্য আপ্যায়নের সঙ্গে দিন-রাত্রি যাপনের যে আরাম ও আয়াস এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি, তা ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দার্জিলিং-এ এ ধরণের প্রচুর হোম-স্টে এই পরিষেবা প্রদানে এগিয়ে এসেছে, এটি সুলভও বটে।

(৫) হেল্থ টুরিজম দার্জিলিং স্বাস্থ্যকর স্থান হওয়ায় শৈলাবাসগুলিতে বিশ্রাম নিতে ও স্বাস্থোদ্ধারে বহু মানুষের আগমন ঘটে। এখানকার নাতিশীতোষ্ণ জলবাযুতে কিছুদিন থেকে সমতল-এর কর্মব্যস্ত জীবনের ক্লান্তি হ্রাসের ইচ্ছায় বহু মানুষ এখানে বেড়াতে আসেন।

(৬) কালচারাল টুরিজম- দার্জিলিং বিভিন্ন জাতি ও উপজাতির আবাসস্থল। লেপচা উপজাতি যারা দার্জিলিং-এর প্রাচীনতম বাসিন্দা তারা তাদের জীবনযাত্রায় প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অনেকাংশেই ধরে রেখে ছেন। ভুটিয়া জনবসতি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করে চলেছেন। গোর্খা জনবসতিও পার্বত্য পরিবেশে কীভাবে তাদের আর্থ-সামাজিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করে চলেছেন এবং নিজস্ব সংস্কৃতি ও অর্থনীতি অনুসরণ করেন তাও লক্ষণীয়। এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র অনুসন্ধান, অধ্যয়ন ও উপভাগে করতেও বহু মানুষ আকৃষ্টহন।

(৭) এডুকেশনাল টুরিজম- দার্জিলিং ব্রিটিশ আমল থেকেই সম্পন্ন শিক্ষানুরাগীদের সন্তান-সন্ততি কনভেন্টে পাঠদানের জন্য প্রেরণে উৎসাহ যুগিয়েছিল। দার্জিলিং, কার্শিয়াং ও কালিম্পং-এ অনেকগুলি ইংরেজি মাধ্যম রেসিডেন্সিয়াল স্কুল রয়েছে, রয়েছে বিশিষ্ট কয়েকটি কলেজ। এই উদ্দেশ্যে অভিভাবকদের আনাগানো, ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভ্রমণ, শিক্ষাকেন্দ্রগুলিতে চাকরীতে যোগদানের জন্য শিক্ষকদের দার্জিলিং-এ আগমন ও বসবাস দার্জিলিংকে একটি শিক্ষাকেন্দ্রের মর্যাদা দেয়। এটি এডুকেশনাল টুরিজমকে উৎসাহ দেয়।

এছাড়া বর্ষার ৩ মাস (জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর) ব্যতীত সারা বছরই পর্যটক-এর ভীড় লেগে থাকে দার্জিলিং-এ। দুর্গাপুজোর ছুটি উপভোগ করতে, শীতে তুষারপাত ও বরফে ঢাকা শৈলশিরা দেখতে, গ্রীষ্মে ফুলের বিশেষতঃ রোডোডেনড্রনের সমারোহ দেখতে বিশেষভাবে পর্যটকদের ঢল নামে পাহাড়ে। সারা বছর প্রায় ৫ লক্ষ দেশি বিদেশী পর্যটক-এর আগমন ঘটে। এর মধ্যে প্রায় ৫% বিদেশী এবং প্রায় ৯৫% দেশীয় পর্যটক। অর্থাৎ দার্জিলিং-এ প্রতি ১০০ জন পর্যটক-এর মধ্যে ৫ জনের মত বিদেশী পর্যটক।

পর্যটন অর্থনীতি: দার্জিলিং-এ পর্যটন ব্যবসা চা-শিল্পের পরেই। বছরে প্রায় ৫ লক্ষ পর্যটক (Dept of Tourism-GTA)-এর আগমন ঘটে। প্রতি ১০০ জন পর্যটক এ প্রায় ৫ জন বিদেশী পর্যটক। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। চা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উৎস্য। পর্যটন থেকেও কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। পর্যটন শিল্পে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বহু মানুষ জড়িত। হোটেল-রেস্তোরায়, পরিবহন ক্ষেত্রে, বাজার ও হোটেলে কৃষি পণ্য সরবরাহে, স্থানীয় হস্তশিল্প বিশেষতঃ উলের পোষাক বিক্রয়-এ, টুরিস্ট গাইড হিসেবে বহুলোক পর্যটক ব্যবসা থেকে জীবিকা অর্জন করেন। স্থানীয় অর্থনীতি পর্যটন ব্যবসার ওঠানামা দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত। হয়, যেহেতু পর্যটকের আগমনের সাথে হোটেলগুলির আয় এবং হোটেলের সঙ্গে কর্মচারী, খাদ্যের কাঁচামাল সরবরাহকারীগণ যুক্ত।

পর্যটক আগমনের ওঠানামার সঙ্গে গাড়ী ব্যবসা এবং এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ড্রাইভার, ক্লিনার, গাড়ি সারাই বা মেরামত ব্যবসা, যাত্রী ওঠানামার স্থানগুলিতে দোকান-পাট ইত্যাদির সঙ্গে বহু মানুষ-এর শ্রমনিযুক্তি জড়িত থাকে। পর্যটনে বৎসরে কয়েকশত কোটি টাকার ব্যবসা হয় দার্জিলিং-এ।

পর্যটনে সমস্যা ও সমাধান প্রকল্প:

(১) স্থানাভাবঃ ভরা পর্যটন মরসুমে যেমন পূজোর ছুটিতে, স্কুল-কলেজে গ্রীষ্মাবকাশে, বিশেষত পাহাড়ে ফুল ফোটার মরশুমে এত বেশি সংখ্যক পর্যটক একসলো চলে আসেন যে হোটেলগুলিতে স্থানাভাব ঘটে। পর্যটকরা চড়ামূল্যে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের হোটেলে থাকতে বাধ্য হন। দার্জিলিং ম্যাল-এ এই সময় অতিরিক্ত ভীড় জমে যায়। এছাড়া সান্দাকফু, ফালুট ইত্যাদি স্থানে পর্যটক আবাস-এর অভাব রয়েছে এবং অনুরূপ দুর্গম। পার্বত্য পর্যটন স্থলে চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। এতে পর্যটকদের ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে থাকে। ভরা মরসুমের কথা মাথায় রেখে পর্যটন আবাস-এর সমস্যা নিরসন এবং দুর্গম অঞ্চলে পর্যটনকালে ভ্রাম্যমান চিকিৎসা পরিসেবা চালু রাখা প্রয়োজন।

(২) পরিবেশ দূষণজনিত সমস্যাঃ পর্যটকদের যথেষ্ট সচেতনতার অভাবে অতি সুন্দর পাহাড়ী পরিবেশে এখন যত্রতত্র প্লাস্টিক, ফেলে দেওয়া খাবার ও অন্যান্য আবর্জনা নিক্ষেপে দূষিত হচ্ছে এবং দৃষ্টি দুষণও ঘটছে। শহরাঞ্চলে ত্রুটিপূর্ণ তরল দূষিত জল নির্গমনের ব্যবস্থার জন্য স্থানে স্থানে, রাস্তার ধারে পরিবেশ দূষিত হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে নাগরিক সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। প্রয়োজনে আইন সংশোধন ও রূপায়ণ প্রয়োজন।

(৩) রাস্তাঘাটের সমস্যা: সড়কপথে অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে, বর্ষায় জলস্রোতে রাস্তা ভেঙ্গে যাওয়া, ধসে রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, রাস্তায় ঘন ঘন গর্ত বা পট হোল (Pot holes) সৃষ্টি সুষ্ঠু পরিবহনে সমস্যা সৃষ্টি করে। জাতীয় সড়কপথগুলিতে প্রায় সারা বছরই নির্মাণ কর্মীরা লেগে থাকলেও অপ্রধান রাস্তাঘাটগুলিতে সারাই ও মেরামতে আরও নজরদারী এবং নির্মাণকারী নিয়োগ প্রয়োজন। এছাড়া বিপদজনক পথে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।

(৪) রাজনৈতিক সমস্যা: দীর্ঘসময় দার্জিলিং-এর পর্যটন শিল্প রাজনৈতিক আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘন ঘন বন্ধু, মিছিলে যোগদানের জন্য চাপ, সংকীর্ণ দলীয় রাজনীতির শিকার হয়েছেন দার্জিলিং-এর সাধারণ মানুষ। ৮০-র দশকে হিংস্র আন্দোলনে পর্যটন ব্যবসার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ২০১০-এর দশকে কয়েকটি বছর রাজনৈতিক আন্দোলন যদিও মূলতঃ অহিংস ছিল, কিন্তু ঘন ঘন বন্ধু ডাকায় ও পুনঃ পুনঃ রাজনৈতিক মিছিলের কারণে পর্যটকদের মধ্যে দার্জিলিং ভ্রমণে উৎসাহে ভাটা পড়ে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্তরে আলাপ-আলাচেনা চালাতে হবে।

(৫) পর্যাপ্ত উন্নয়ন পরিকাঠামোর অভাব: পর্যটনে পরিকাঠামোগত উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক তৎপরতা দার্জিলিং-এ পর্যটন ব্যবসার উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটাবার সম্ভাবনা রাখে। উন্নতমানের পরিবেশ বান্ধব হোটেল, পাহাড়ের সঙ্গে সমতলের দ্রুত যোগাযোগ, প্রয়োজনে বিমানবন্দরের সঙ্গে যুক্ত হেলিকপ্টার পরিসেবা দেশী বিদেশী পর্যটকদের আরো আকৃষ্ট করবে। সুশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা ও ন্যায্য গাড়ি ভাড়ায় যাত্রী পরিসেবা, পাহাড়ে ধস্ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত ব্যবস্থা, পর্যটন বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনে বৈচিত্র আনা, শিক্ষামূলক ভ্রমণে থাকা-খাওয়া ও ভ্রমণে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দান, দূর্গম পর্যটন কেন্দ্রগুলিতেও নিরাপদ পানীয় জলের ব্যবস্থা করা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সুযোগ সুবিধা ইত্যাদি পরিকাঠামোগত অসুবিধাগুলি দূর করার লক্ষে প্রশাসনকে আরো উদ্যোগী হতে হবে।

এই পোস্টগুলি আপনার ভাল লাগতে পারে

  •  দার্জিলিং-এ পর্যটনভূমিকা: "পাহাড়ের রানী" (Queen of the hills) আখ্যায় ভূষিত দার্জিলিং হিমালয়-এর অনন্য প্রাকৃতিক শোভা তার তুষারাবৃত পর্বতশৃঙ্গে, পর্বতগাত্রে ঘন সবুজ অরন্য ও গ্র…
  • দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি শিল্পাঞ্চল(Darjeeling-Jalpaiguri Industrial Region)উত্তরবঙ্গের এই একটিমাত্র শিল্পাঞ্চলে চা শিল্পের ব্যাপক কেন্দ্রীভবন ঘটেছে। এর কারণ স্থানীয় (1) উষ্ম ও আর্দ্র জ…

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01